গত ১০ই মে ২৭শে রামাযান সোমবার দিবাগত রাত থেকে বিশ্বের বৃহত্তম কারাগার ফিলিস্তীনের গাযা সিটির উপর বর্বর ইস্রাঈলী বিমান হামলা শুরু হয়। যা মিসরের মধ্যস্থতায় ১১ দিনের মাথায় ২০শে মে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২-টায় ইস্রাঈলের যুদ্ধিবিরতি ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয়। ইস্রাঈল-ফিলিস্তীনের বর্তমান সংঘর্ষে ৬৬ জন শিশু ও ৩৯ জন নারী সহ মোট ২৪৩ জন ফিলিস্তীনী নিহত হয়েছেন। পক্ষান্তরে হামাসের রকেট হামলায় ইস্রাঈলে নিহত হয়েছে ২ জন শিশু সহ ১২ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে আহত ফিলিস্তীনীদের সংখ্যা ৮ হাযার ৫৩৮ জন।
এদিকে গাযায় ইস্রাঈলী বিমান হামলার বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফিলিস্তীনের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মাদ শতেয়াহ। তিনি বলেন, গাযায় ইস্রাঈলী বিমান হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল। সেখানে নারী ও শিশুদের গণহত্যা করার অপরাধে ইস্রাঈলকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এছাড়াও তাদেরকে আসামী করা হবে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এপি ও আল-জাজিরার ১২ তলা ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
হামলার আগে গত ৩০শে এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় ইস্রাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর প্রধান ইউসি কোহেন এক অনির্ধারিত সফরে ওয়াশিংটন এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে হোয়াইট হাউজে গোপন বৈঠক করেন। সেখান থেকে সবুজ সংকেত নিয়েই ফিলিস্তীনে বিমান হামলা শুরু হয়। আমেরিকার বিগত প্রেসিডেন্টদের ন্যায় বাইডেনেরও কৈফিয়ত হ’ল ‘ইস্রাঈলীদের বাঁচার অধিকার আছে’। কারণ হামাস নিজেদের বাঁচার জন্য ইস্রাঈল অভিমুখে রকেট ছুঁড়ছে। এরই মধ্যে বাইডেন প্রশাসন গত ৫ই মে ইস্রাঈলের নিকট ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তীনীদের সমর্থনে ব্যাপক বিক্ষোভ হ’লেও কথিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তাতে কোন সাড়া নেই। জার্মানী ও ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেওয়ায় ১৬ই মে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইস্রাঈলের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বৈঠকে চীন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই দীর্ঘ কয়েক দশক ফিলিস্তীন-ইস্রাঈল সংকট নিরসন হচ্ছে না। তারা বলেছে, যেরুযালেমকে ফিলিস্তীনের রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের ইস্রাঈল-সিরিয়া যুদ্ধের পূর্বের সীমানা মেনে নিয়ে জাতিসংঘ গৃহীত দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হৌক’। ইস্রাঈলের সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী লিবারম্যান এই হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেন, হামাসের হামলা মুকাবিলায় যদি ইস্রাঈলের এরূপ ছন্নছড়া অবস্থা হয়, তাহ’লে ইরান ও হিযবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে কি হবে? তিনি বলেন, এর ফলে হামাসের বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে’। বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তীনীদের প্রতি সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পিছন দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, (১) ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে জাতিসংঘ কর্তৃক ফিলিস্তীনে একটি স্বাধীন ইস্রাঈল রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান (১৯৪৫-১৯৫৩ খৃ.) ইস্রাঈলকে স্বীকৃতি দেন। (২) ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে হারানো সিরিয়ার গোলান মালভূমি ও মিসরের সিনাই উপত্যকা পুনর্দখলের জন্য ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে আরব দেশগুলির সামরিক অভিযানের মুখে ইস্রাঈল যখন কোনঠাসা, তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন (১৯৬৯-১৯৭৪) ইস্রাঈলকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র পাঠিয়ে সাহায্য করেন। (৩) ১৯৮৭-১৯৯১ ফিলিস্তীনীদের ‘ইনতেফাদা’ দমনে নৃশংস ইস্রাঈলী বাহিনীকে শক্তিশালী করতে রসদ জোগান দেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান (১৯৮১-১৯৮৯)। (৪) ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তীনীদের দ্বিতীয় ইনতিফাদা দমনের জন্য গাযা ও পশ্চিম তীরে ইস্রাঈলী বিমান হামলা ও স্থল হামলায় সহযোগিতা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০১-২০০৯)। (৫) ২০০৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর গাযায় ইস্রাঈলীদের চালানো অপারেশন ‘কাষ্ট লিড’ নামে সেনা অভিযানকে সমর্থন দেন জর্জ বুশ। (৬) ২০১৪ সালের জুলাইয়ে গাযায় ইস্রাঈলের বেপরোয়া বিমান হামলায় সমর্থন ব্যক্ত করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (২০০৯-২০১৭)। (৭) ২০১৮ সালের মে মাসে গাযার ফিলিস্তীনী বিক্ষোভকারীদের নির্মূল করার জন্য ইস্রাঈলের বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের সমালোচনা নাকচ করে দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (২০১৭-২০২১)। তিনিই প্রথম তার উপদেষ্টা ও ইহূদী জামাতা কুশনারের পরামর্শে ২০১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে যেরুযালেমে স্থানান্তরিত করার ঘোষণা দেন। অতঃপর ২০১৮ সালের ১৪ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি বাস্তবায়িত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ব দ্রুত ইস্রাঈলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আল্লাহর ইচ্ছা হ’লে উক্ত ঐক্যবদ্ধ শক্তি আমেরিকার কোলে আশ্রিত তথাকথিত ইস্রাঈল রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে। অতঃপর সেখানকার ভদ্র নাগরিকরা পূর্বের ন্যায় ইসলামী ফিলিস্তীনের অধীনে বসবাস করবে। যেমনভাবে তারা ইসলামী খেলাফত সমূহের অধীনে শান্তির সাথে বসবাস করে আসছিল।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, ‘ভূ-পৃষ্ঠে এমন কোন মাটির ঘর বা পশমের ঘর (অর্থাৎ তাঁবু) বাকী থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছাবেন না, সম্মানী ব্যক্তির ঘরে সম্মানের সাথে এবং অপমানিতের ঘরে অপমানের সাথে। এক্ষণে আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করবেন, তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলামের মিল্লাতভুক্ত করে দিবেন। পক্ষান্তরে যাদেরকে তিনি অপমানিত করবেন, তারা (জিযিয়া দানের মাধ্যমে) ইসলামের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে’। রাবী মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বলেন, (একথা শুনে) আমি বললাম, তখন তো পুরা দ্বীনই আল্লাহর হয়ে যাবে’ (অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপরে ইসলাম বিজয়ী হবে) (আহমাদ হা/২৩৮৬৫; মিশকাত হা/৪২)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।
[ইস্রাঈলী হামলার বিরুদ্ধে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবে ১৭ই মে ও ২৩শে মে ২০২১ তারিখে]