হিব্রু ভাষায় ইস্রাঈল অর্থ আল্লাহর দাস। এটি হ’ল ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম। বিশ্বের দু’জন নবীর নাম দু’টি করে ছিল। ইয়াকূব বিন ইসহাক বিন ইব্রাহীম (আঃ)। ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈলের শেষনবী। আরেকজন হলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যার অপর নাম আহমাদ। যিনি ছিলেন ইব্রাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল বংশীয়। এই বৈমাত্রেয় হিংসার কারণে ইহূদী-নাছারারা চিরকাল মুসলমানদের শত্রু। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের রীতির অনুসরণ কর’ (বাক্বারাহ ১২০)।
ইহূদী-নাছারা পরাশক্তি প্রভাবিত জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৪৮ সালে যবরদস্তীভাবে ফিলিস্তীনের শতকরা ৯৭ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অধিকাংশকে হতাহত ও বিতাড়িত করে কথিত ‘ইস্রায়েল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুতে বলা হয়েছিল ইস্রাঈল ও ফিলিস্তীন দু’টিই পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। কিন্তু ইস্রাঈল রাষ্ট্র হিসাবে সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তীন আজও পায়নি। ফলে শুরু থেকেই চলছে বিতাড়ন ও রক্তক্ষরণের ইতিহাস। বর্তমানে যা ক্রান্তিকাল চলছে। ইহূদী ও নাছারা উভয় জাতি আল্লাহর অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট (তিরমিযী হা/২৯৫৪)। এবিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহে অবিশ্বাস করত এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। আর এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা সীমালংঘন করত’ (বাক্বারাহ ৬১)। এরপরেও তারা দুনিয়ায় কিভাবে বেঁচে থাকবে, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের উপর লাঞ্ছনা অবধারিত করা হয়েছে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, কেবলমাত্র আল্লাহর অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। আর তারা নিজেদের উপর আল্লাহর ক্রোধকে ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা অবধারিত হয়েছে। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কেননা ওরা অবাধ্য হয়েছিল এবং সীমালংঘন করত’ (আলে ইমরান ১১২)।
এখানে ইহূদীদের স্থায়ী লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা বাঁচবে কেবল দু’ভাবে। এক- আল্লাহর অঙ্গীকার। আর সেটি হ’ল তাদের নারী-শিশু এবং সাধক ও উপাসকরা। যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। দুই- মানুষের অঙ্গীকার। আর সেটি হ’ল মুসলমান বা অন্যদের সাথে সন্ধিচুক্তি দ্বারা। যেমন তারা এখন টিকে আছে কতিপয় পরাশক্তির উপর ভর করে। সম্প্রতি তারা কয়েকটি মুসলিম দেশের সাথেও সন্ধিচুক্তি করেছে। এভাবেই তাদের পরমুখাপেক্ষিতা প্রলম্বিত হবে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা লাঞ্ছিত হয়েই থাকবে। একইভাবে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান জগত সূদী অর্থনীতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠলেও এবং মারণাস্ত্রের জোরে পরাশক্তির দাবীদার হ’লেও তারা সারা পৃথিবীর মানুষের ঘৃণার পাত্র। কারণ ওরা পথভ্রষ্ট। ওরা শেষনবীকে পেয়েও তাঁকে মানেনি এবং ইসলাম কবুল করেনি। প্রতি রাক‘আত ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ প্রতিদিন ওদেরকে ‘অভিশপ্ত’ ও ‘পথভ্রষ্ট’ বলে এবং ওদের পথে না যাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকটে ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের হেদায়াত প্রার্থনা করে থাকে।
মিথ্যা ও প্রতারণা ইহূদী-নাছারাদের মজ্জাগত। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথে তাদের প্রতারণা ছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ। যার জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি তাদেরকে মদীনা থেকে উৎখাত করেন। কুরআনে এটাকে ‘আউয়ালুল হাশর’ বা প্রথম উৎখাত বলা হয়েছে। অতঃপর তাদের শেষ হাশর হবে ক্বিয়ামতের দিন। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইহূদীরা বিশ্বের কোথাও শান্তির সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবে না। আজও তারা খ্রিষ্টান নেতাদের সহায়তায় মুসলিম বিশ্বের সাথে প্রতারণা করেই চলেছে। কখনো মিত্রবাহিনী সেজে, কখনো জাতিসংঘের সাইনবোর্ড নিয়ে, কখনো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে নিজেদের জন্য ‘ভেটো’ ক্ষমতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে কুক্ষিগত করে তারা বিশ্বব্যাপী শোষণ-নিপীড়ন ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এযুগের হালাকু নেতানেহুর মাধ্যমে ফিলিস্তীনে তারা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে আধুনিক বিশ্বে তার তুলনা কেবল তারাই।
দুঃখ হয় মুসলিম দেশগুলির নেতাদের জন্য। এতকিছুর পরেও তারা ইহূদী-নাছারা পাশ্চাত্য পরাশক্তিকেই ফিলিস্তীনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য কাতর আহবান জানাচ্ছেন। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যদি একযোগে মাত্র একমাস আমেরিকা ও তার সহযোগী দেশগুলিতে তৈল রফতানী বন্ধ রাখে, তাহ’লে এক সপ্তাহের মধ্যে ইস্রাঈলের যুদ্ধের চাকা বন্ধ হ’তে বাধ্য।
অতএব আমরা মনে করি যে, মুসলিম বিশ্বকে নিজেদের শিরদঁাড়া সোজা করে দঁাড়াতে হবে এবং তাদেরকে আল্লাহ পাক তৈল ও গ্যাস সহ যেসব অমূল্য সম্পদ দান করেছেন, সেগুলির পরিকল্পিত ব্যবহারে ঐক্যবদ্ধ হ’তে হবে। জনৈক মার্কিন বিশেষজ্ঞের মতে ‘আমেরিকার সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। বর্তমান শতাব্দীতেই তাদের চূড়ান্ত ধস প্রত্যক্ষ করা যাবে’। বরং এটাই বাস্তব যে, ফিলিস্তীন সহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার দ্বৈতনীতি তার নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন তার অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। আর সেটা খুব সহজেই সম্ভব যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলি তাদের অস্ত্র ব্যবসার ফঁাদে না পড়ে। বর্তমানে বিশ্বে যে পরিমাণ অস্ত্র রফতানী হয় তার ৩৯ শতাংশ ওয়াশিংটনের। ১৯২৯-১৯৩৯ সালের মার্কিন মহামন্দার দশকে কেবলমাত্র অস্ত্র ব্যবসাই তাদেরকে উদ্ধার করে। যাতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) কারণ ঘটে। যার ফলে ৫ থেকে ৮ কোটি মানুষ নিহত হয়। ‘ট্রুথ আউট’-এর তথ্য মতে, মার্কিন অস্ত্র রফতানীর প্রায় ৪৩ শতাংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে শীর্ষ গ্রাহক হ’ল সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। যাদের নেতৃত্বে বিগত ৮ বছরে মুসলিম রাষ্ট্র ইয়ামনকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে আনুমানিক ৩ লক্ষ ৭৭ হাযার মানুষ নিহত হয়েছে। ২০২২ সালের ৬ই জুনের হিসাব আনুযায়ী ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি এবং ১৫৯টি দেশে মোট ১ লক্ষ ৭৩ হাযার সেনা মোতায়েন আছে। এতে যে বিপুল পরিমাণ মানববিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার হয়, তার জোগানদাতা মারণাস্ত্র প্রস্ত্ততকারী শিল্পমালিকেরা। এরাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির প্রণেতা। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সরকারী ও বিরোধী দলকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে এরা সুবিধা লোটে। গত ৭ই অক্টোবরের পর থেকে গাযায় ব্যাপক ভাবে যে বোমা হামলা চলেছে ও অবাধে নারী-শিশু ও অসহায় মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তা বন্ধের জন্য ১৫ সদস্যের জাতিসংঘ ‘নিরাপত্তা পরিষদে’ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপক্ষে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ‘ভেটো’ দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই ইহূদী এবং অস্ত্র ব্যবসার সুবিধাভোগী। তাই ইচ্ছা করলেও তিনি অস্ত্র শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এসেছে ব্যাপকভাবে। অথচ তাদের উচিত ছিল আফ্রিকার মরু-অধ্যুষিত দেশ নামিবিয়ার উত্তরাঞ্চলে মাটির নীচে সুপেয় পানির যে বিশাল আধার আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দিয়ে আগামী অন্তত ৪০০ বছর এতদঞ্চলের লাখো মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে, সেটি উঠিয়ে ব্যবহার করা। কেবল নামিবিয়া নয়, বরং প্রত্যেক দেশেরই মাটির নীচে আল্লাহ বান্দার জন্য ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সকল রূযীর উৎস সঞ্চিত রেখেছেন (লোকমান ২০)। বান্দার উচিত ছিল পরস্পরে যুদ্ধ না করে সেগুলি উঠিয়ে সেগুলি জনকল্যাণে বিতরণ করা।
বর্তমান ইউরোপ সমগ্র পৃথিবীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ উত্তপ্ত হচ্ছে তাদের পাপের কারণে। ২০২৩ সালে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল, হিট স্ট্রোক, ভারী বৃষ্টিপাত এখানেই দেখা গিয়েছে। আমেরিকায় আত্মহত্যার হিড়িক পড়েছে। ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চীন-রাশিয়াসহ বাকী বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে আবহাওয়াকে তপ্ত করছে। ফলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফল ও ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য সংকট। পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ পানি হওয়া সত্ত্বেও পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে সর্বত্র। মানুষের স্বভাবে দেখা দিয়েছে নিষ্ঠুরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা। বস্ত্তবাদী আমেরিকার হিংস্র থাবায় প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে ফিলিস্তীন। মানবতা সেখানে ভূলুন্ঠিত।
গাযায় হামাসের হাতে এখনও বন্দী থাকা ১৩৩ ইস্রায়েলী বন্দীকে ফিরিয়ে আনতে নেতানিয়াহু সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ইস্রায়েল জুড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। আমেরিকায় ইস্রায়েলী দূতাবাসের সামনে সেখানকার ইহূদীরা ‘জেনোসাইড’ (গণহত্যা) সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, গাযার প্রায় ৮৫ শতাংশ অধিবাসী বাস্ত্তচ্যুত হয়েছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে সেখানকার সকলেই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইস্রায়েল গাযার ওপর ব্যাপকভাবে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। হাযার হাযার মানুষ খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছে। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ত্রাণবাহী ট্রাক ও লরী সেখানে প্রবেশ করছে। গাযার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, সেখানে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাযারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে আরও ৭৬ হাযারের বেশি মানুষ। ইস্রাঈল ও মিসরের নিরপেক্ষ রাফাহ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তীনী। তাদের বোবা কান্নায় ভারী হচ্ছে আকাশ-বাতাস। আল্লাহ সবই দেখছেন। তঁার প্রতিশোধ নেমে আসবেই। যেমন এসেছে ইতিপূর্বেকার বহু অপরাজেয় যালেম শক্তির উপর। আজকের ইস্রায়েলও তাই অপরাজেয় নয়। ইতিহাস থেকে তাদের নাম মুছে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।