ভূমিকা : ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলাম মানুষের সুখ-শান্তির জন্য শরী‘আতের বিধানগুলো সহজ করে দিয়েছে। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর জন্য আবশ্যকীয় প্রয়োজন হচ্ছে পবিত্রতা। আর পবিত্রতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ওযূ বা তায়াম্মুম। আর ওযূর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান হচ্ছে মোযার উপর মাসাহ করা। শীতকালে ওযূর সময় মোযা খোলা বা পরিবর্তনের জটিলতার কারণে শরী‘আত মোযার উপর মাসাহ করার অনুমতি দিয়েছে। আবহমানকাল থেকে সমাজে দুই প্রকারের মোযার প্রচলন রয়েছে। চামড়া ও সুতার মোযা। চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণের মাঝে কোন মতপার্থক্য নেই। তবে সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কেউ কেউ দ্বিমত করেছেন। যদিও এই বিরোধিতার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। শীতকাল আসলেই একশ্রেণীর মানুষ সর্বাধিক ব্যবহার্য সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয বা নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেজন্য বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে।
হাদীছ থেকে দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ যেমন চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করেছেন তেমনি সুতার মোযার উপরেও মাসাহ করেছেন। তবে তৎকালীন আরবের বুকে চামড়ার মোযার ব্যাপক প্রচলন থাকায় এ সম্পর্কিত বর্ণনা বেশী এসেছে। এর অর্থ এটা নয় যে তারা কাপড়ের বা সুতার মোযা ব্যবহার করেননি এবং ওযূ শেষে এই মোযার উপর মাসাহ করেননি। ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বিভিন্ন সময় উভয় প্রকারের মোযা ব্যবহার করতে দেখেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُغِيرَةَ بْنَ شُعْبَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ وَالنَّعْلَيْنِ-
মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওযূর সময় জাওরাবাইন তথা সুতার মোযার উপর এবং উভয় জুতার উপর মাসাহ করেছেন।[1] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে।[2]
عَنْ ثَوْبَانَ، قَالَ: بَعَثَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَرِيَّةً، فَأَصَابَهُمُ الْبَرْدُ فَلَمَّا قَدِمُوا عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَهُمْ أَنْ يَمْسَحُوا عَلَى الْعَصَائِبِ وَالتَّسَاخِينِ-
ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি ছোট সেনাদল প্রেরণ করলেন। তারা (যাত্রা পথে) ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়। অতঃপর তারা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ফিরে আসলেন তখন তিনি তাদেরকে পাগড়ী ও মোযার উপর মাসাহ করার নির্দেশ দিলেন।[3] আল্লামা ইবনুল আছীর (রহঃ) বলেন,(التساخين) كل ما يسخن به القدم من خف وجورب ونحوهما- ‘তাসাখীন হচ্ছে যার মাধ্যমে পা গরম করা হয় সেটা চামড়ার মোযা, সুতার মোযা এবং অনুরূপ কিছু দ্বারা হ’তে পারে।[4]
ছাহাবায়ে কেরামের বাণী ও আমল থেকে দলীল :
জুলাস বিন আমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَنَّ عُمَرَ، تَوَضَّأَ يَوْمَ جُمْعَةٍ، وَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ- ‘ওমর (রাঃ) জুম‘আর দিনে ওযূ করলেন এবং তার দুই (সুতার) মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন’।[5]
কা‘ব ইবনু আব্দিল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, رَأَيْتُ عَلِيًّا بَالَ فَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ، ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي- ‘আলী (রাঃ)-কে দেখলাম তিনি পেশাব করার পর (ওযূ শেষে) তার দুই মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন অতঃপর ছালাতের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন’।[6]
ইবরাহীম নাখঈ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ ابْنَ مَسْعُودٍ كَانَ يَمْسَحُ عَلَى خُفَّيْهِ وَيَمْسَحُ عَلَى جَوْرَبَيْهِ- ‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ) চামড়ার মোযা এবং সুতার মোযা উভয়ের উপর মাসাহ করতেন’।[7]
কাতাদা হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّهُ كَانَ يَمْسَحُ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ قَالَ: نَعَمْ، يَمْسَحُ عَلَيْهِمَا مِثْلَ الْخُفَّيْنِ- তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) সুতার মোযার উপর মাসাহ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ তিনি চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করার ন্যায় সুতার মোযার উপর মাসাহ করেছেন।[8]
ইয়াসীর ইবনু আমর হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,رَأَيْتُ أَبَا مَسْعُودٍ، بَالَ، ثُمَّ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ ‘আমি আবু মাসঊদ আনছারীকে দেখেছি যে, তিনি পেশাব করলেন অতঃপর ওযূ করে মোযার উপর মাসাহ করলেন’।[9]
খালিদ ইবনু সা‘দ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ أَبُو مَسْعُودٍ الْأَنْصَارِيُّ يَمْسَحُ عَلَى جَوْرَبَيْنِ لَهُ مِنْ شَعْرٍ وَنَعْلَيْهِ ‘আবু মাসঊদ আনছারী সুতার তৈরি মোযার উপর এবং জুতার উপর মাসাহ করতেন’।[10]
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘তিনি সুতার মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করতেন’।[11]
ইয়াহইয়া আল বাক্কা হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি ইবনু ওমর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, সুতার মোযার উপর মাসাহ করা চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করার ন্যায়’।[12]
ইসমাঈল বিন রাজা তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করে বলেন, رَأَيْتُ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ يَمْسَحُ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ-‘আমি বারা ইবনু আযেবকে দেখেছি, তিনি সুতার মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করেছেন’।[13] ইসমাঈল ইবনে উমাইয়া বলেন,أَنَّ الْبَرَاءَ بْنَ عَازِبٍ، كَانَ لَا يَرَى بَأْسًا بِالْمَسْحِ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ ‘বারা ইবনু আযেব (রাঃ) সুতার মোযার উপর মাসাহ করাকে দোষণীয় মনে করতেন না’।[14]
এতদ্ব্যতীত ওকবা বিন আমের, সাহল বিন সা‘দ, সাঈদ ইবনু যুবায়ের ও আবু উমামাহ (রাঃ) সুতার মোযার উপরে মাসাহ করতেন।[15]
সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) ও তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব হ’তে বর্ণিত,أَنَّهُمَا كَانَا لَا يَرَيَانِ بَأْسًا بِالْمَسْحِ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ- ‘তারা সুতার দুই মোযার উপর মাসাহ করাকে দোষণীয় মনে করতেন না’।[16]
তাবেঈনে ইযামের আমল ও বাণী থেকে দলীল :
হিশাম ইবনে আয়েয হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, بَالَ وَنَحْنُ عِنْدَهُ، فَمَسَحَ عَلَى جَوْرَبَيْهِ وَنَعْلَيْهِ، ثُمَّ صَلَّى ‘ইবরাহীম নাখঈ (রহঃ) একদিন পেশাব করলেন যখন আমরা তার পাশেই ছিলাম। অতঃপর ওযূ করে সুতার দুই মোযা ও জুতার উপর মাসাহ করলেন এবং ছালাত আদায় করলেন’।[17]
আত্বা বিন রাবাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সুতার দুই মোযার উপর মাসাহ করা চামড়ার দুই মোযার উপর মাসাহ করার সমতুল্য’।[18] এছাড়াও তাবেই হাসান বাছরী, নাফে‘, যাহহাক, সুফিয়ান ছাওরীসহ বহু তাবেঈ ও তাবে‘ তাবেঈ সুতার মোযার উপর মাসাহ করাকে জায়েয বলেছেন।[19]
সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে চার ইমামের অবস্থান :
হানাফী মাযহাবের অবস্থান : ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) প্রাথমিক জীবনে সুতার মোযার উপর মাসাহ করাকে মাকরূহ মনে করতেন। পরবর্তীতে সফরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে আবারো গবেষণা করেন। পরিশেষে পূর্বের মত পরিবর্তন করে জায়েযের পক্ষে ফৎওয়া দেন এবং নিজে সুতার মোযার উপর মাসাহ করেন। অতঃপর বলেন, فَعَلْتُ مَا كُنْت أَمْنَعُ النَّاسَ عَنْهُ ‘আমি এমন কাজ করলাম যা থেকে আমি লোকদের নিষেধ করতাম’।[20] অন্যদিকে তার দুই শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শায়বানী প্রথম থেকেই মনে করেন সুতার মোযা মোটা হ’লে তার উপর মাসাহ করা জায়েয।[21] ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, سَمِعْتُ صَالِحَ بْنَ مُحَمَّدٍ التِّرْمِذِىَّ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا مُقَاتِلٍ السَّمَرْقَنْدِىَّ يَقُولُ دَخَلْتُ عَلَى أَبِى حَنِيفَةَ فِى مَرَضِهِ الَّذِى مَاتَ فِيهِ فَدَعَا بِمَاءٍ فَتَوَضَّأَ وَعَلَيْهِ جَوْرَبَانِ فَمَسَحَ عَلَيْهِمَا ثُمَّ قَالَ فَعَلْتُ الْيَوْمَ شَيْئًا لَمْ أَكُنْ أَفْعَلُهُ مَسَحْتُ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ وَهُمَا غَيْرُ مُنَعَّلَيْنِ. ‘ছালিহ ইবনু মুহাম্মাদ আত-তিরমিযীর নিকট শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আবু মুকাতিল সামারকান্দীকে বলতে শুনেছি, আমি ইমাম আবু হানীফার নিকট ঐ অসুখের সময় উপস্থিত হ’লাম যে অসুখে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। তিনি পানি আনতে বললেন, অতঃপর ওযু করলেন তার পায়ে জাওরাবা ছিল, তিনি তার উপর মাসাহ করলেন আর বললেন, আজ আমি এমন একটি কাজ করলাম, যা আমি পূর্বে করিনি। আমি জাওরাবার উপর মাসাহ করেছি অথচ তার সাথে জুতা ছিল না (সুনানু তিরমিযী হা/৯৯-এর আলোচনা)।
মালেকী মাযহাবের অবস্থান :
মালেকী মাযহাবের বিদ্বানগণ সুতার মোযার উপর মাসাহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তবে তাদের কেউ কেউ মোযার উপর নীচ চামড়ার হওয়াকে শর্ত করেছেন। কিন্তু এই শর্ত যৌক্তিক নয়। মালেকী ফিক্বহের কিতাবে বলা হয়েছে, أنه يباح للرجل والمرأة مسح الجورب في الوضوء، ‘নারী ও পুরুষের জন্য ওযূতে সুতার মোযার
উপর মাসাহ করা জায়েয’।[22]
শাফেঈ মাযহাবের অবস্থান : শাফেঈ মাযহাবের বিদ্বানগণ সুতার মোযার উপর মাসাহ করাকে জায়েয বলেছেন। তবে কোন কোন বিদ্বান দু’টি শর্তারোপ করেছেন। ১. মোযা মোটা কাপড় বা সুতার হ’তে হবে ২. কেবল মোযা পরে হাঁটাহাটি করে সম্ভব হ’তে হবে।[23] তবে অন্যান্য বিদ্বানগণ দ্বিতীয় শর্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,وَحَكَى أَصْحَابُنَا عَنْ عُمَرَ وَعَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا جَوَازَ الْمَسْحِ عَلَى الْجَوْرَبِ وَإِنْ كَانَ رَقِيقًا وحكوه عن أبي يوسف ومحمد واسحق وَدَاوُد، ‘আমাদের সাথীরা ওমর ও আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেন, সুতার মোযা পাতলা হ’লেও তার উপর মাসাহ করা জায়েয। অনুরূপ বর্ণনা এসেছে- আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ, ইসহাক ও দাঊদ থেকে’।[24]
হাম্বলী মাযহাবের অবস্থান : হাম্বলী মাযহাবের সকল বিদ্বান বিনা শর্তে সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয বলেন। বাহুতী (রহঃ) বলেন,يَصِحُّ الْمَسْحُ أَيْضًا عَلَى جَوْرَبٍ صَفِيقٍ مِنْ صُوفٍ أَوْ غَيْرِهِ، ‘সুতা, তুলা এবং অন্যান্য কাপড়ের তৈরি পাতলা মোযার উপর মাসাহ করা সিদ্ধ।[25] ইবনুল মুনযির বলেন,يُرْوَى إبَاحَةُ الْمَسْحِ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ عَنْ تِسْعَةٍ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلِيٍّ وَعَمَّارٍ وَابْنِ مَسْعُودٍ وَأَنَسٍ وَابْنِ عُمَرَ وَالْبَرَاءِ وَبِلَالٍ وَابْنِ أَبِي أَوْفَى وَسَهْلِ بْنِ سَعْدٍ نُعِلَا أَوْ لَمْ يُنْعَلَا كَمَا أَشَارَ إلَيْهِ ‘সুতার মোযার উপর মাসাহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে নয়জন ছাহাবী থেকে অভিমত এসেছে সে মোযার সাথে জুতা থাক বা না থাক। যেমন আলী, আম্মার, ইবনু মাসঊদ, আনাস, ইবনু ওমর, বারা, বিলাল, ইবনু আবী আওফা, সাহল বিন সা‘দ।[26]
সালাফী বিদ্বানগণের অভিমত :
সালাফী বিদ্বানগণের প্রায় সবাই উভয় প্রকার মোযার উপর মাসাহ করাকে জায়েয বলেছেন। যেমন ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন,وَهُوَ قَوْلُ غَيْرِ وَاحِدٍ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ وَبِهِ يَقُولُ سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ وَابْنُ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِيُّ وَأَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ قَالُوا يَمْسَحُ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ نَعْلَيْنِ إِذَا كَانَا ثَخِينَيْنِ، ‘একাধিক বিশেষজ্ঞ যেমন, সুফিয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারক, শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক বলেছেন, জাওরাবের (সুতার মোযার) উপর মাসাহ করা যাবে, তার সাথে জুতা না পরা হলেও। যখন মোযা মোটা বস্ত্রের হবে।[27] ইবনুল মুনযির ও ইবনু হাযম-এর সাথে অনেক তাবেঈর নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘তাবেঈগণের মধ্যে সাঊদ ইবনুল মুসাইয়িব, আত্বা, ইবরাহীম নাখঈ, খেলাস ইবনু আমর, সাঈদ ইবনু জুবায়ের, ইবনু ওমরের দাস নাফে‘ রয়েছেন এর পক্ষে। এর পক্ষে আরো রয়েছে, সুফিয়ান ছাওরী, হাসান বিন হুহাই, আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আবী ছাওর, আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইসহাক ইবনু রাওয়াহা, দাউদ ইবনু আলী প্রমুখ।[28]
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,يَجُوزُ الْمَسْحُ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ إذَا كَانَ يَمْشِي فِيهِمَا سَوَاءٌ كَانَتْ مُجَلَّدَةً أَوْ لَمْ تَكُنْ، ‘জাওরাব তথা সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয যদি তা পরিধান করে হাঁটা যায় তা চামড়ার হৌক বা সুতা-কাপড়ের হৌক’।[29]
ইমাম ইবনু কুদামাহ (রহঃ) বলেন, ‘আর মোটা জাওরাবের (সুতার মোযার) উপরেও মাসাহ করা জায়েয যে হাঁটার সময় পা থেকে খুলে পড়ে যাবে না’।[30]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। অতঃপর এর পক্ষে বর্ণনাকারী ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও সালাফী বিদ্বানগণের নাম উল্লেখ করেন এবং যারা বিপক্ষে কথা বলেছেন তাদের দলীল ভিত্তিক জওয়াব প্রদান করেছেন।[31]
শায়খ বিন বা‘য (রহঃ) বলেন, ‘পা আবৃতকারী পবিত্র সুতার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয যেমন চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয। কারণ এ ব্যাপারে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সুতার মোযা ও জুতাদ্বয়ের উপর মাসাহ করেছেন। এছাড়া এক জামা‘আত ছাহাবী থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তারা সুতার মোযার উপর মাসাহ করেছেন’।[32]
শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, الراجح من أقوال أهل العلم جواز المسح على الجوربين فإنه قد روي عن النبي صـ (أنه قد مسح عليهما) ولأن العلة التي من أجلها أبيح المسح على الخفين موجودة في الجوربين، ‘বিদ্বানগণের অগ্রগণ্য অভিমত হ’ল যে মোযার উপর মাসাহ করা জায়েয। কেননা এটি নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সেগুলোর উপর মাসাহ করেছিলেন এবং যে কারণে চামড়ার মোযার উপর মাসাহ করাকে জায়েয করা হয়েছে সে কারণ সুতার মোযার মধ্যে বিদ্যমান’।[33]
ফৎওয়া লাজনা দায়েমায় বলা হয়েছে,في المسح على الجوربين في الوضوء خلاف بين الفقهاء فمنهم من منعه ومنهم من أجازه، والصحيح أنه جائز إذا لبسهما على طهارة وكانا ساترين للقدمين والكعبين، ‘ওযুর সময় মোযার উপর মাসাহ করার ব্যাপারে ফিক্বহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে, কেউ কেউ তা নিষেধ করেছেন আবার তাদের কেউ কেউ জায়েয বলেছেন। তবে সঠিক মত হ’ল, যদি কেউ তা পবিত্র অবস্থায় পরে এবং পা ও গোড়ালি ঢেকে রাখে তাহ’লে তা জায়েয’।[34]
আলবানী (রহঃ)-এর অভিমত : আলবানী (রহঃ) সুতার মোযার উপর মাসাহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন । পাশাপাশি নিষেধকারীদের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘ছাহাবায়ে কেরামের কর্তৃত্বে মোযার উপর মাসাহ প্রমাণিত হওয়ার পর যে সুতার মোযার উপর মাসাহ করতে অনিহা প্রকাশ করে ও বলে, এটা চামড়ার মোযার জন্য প্রযোজ্য' তার ব্যাপারে আমাদের জন্য একথা বলা কি জায়েয হবে না যেমন ইবরাহীম নাখঈ বলেছেন, فمن ترك ذلك رغبة عنه فإنما هو من الشيطان ‘যে
ব্যক্তি ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে তা পরিত্যাগ করে, সে শয়তানের
পক্ষ থেকে করে’।[35]
উপসংহার : সমাজে প্রচলিত দুই প্রকারের মোযার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কেননা দুই প্রকারের মোযার মধ্যে মোযা বা খুফ-এর অর্থ পাওয়া যায়। তাই সুতা বা কাপড় কিংবা তুলার তৈরি মোযার উপরে মাসাহ করার শর্ত হ’ল এই যে, সুতা-কার্পাসের তৈরি, মোযা যেন পুরু বা মোটা হয়, ঘন সুতা দিয়ে তৈরি করা হয়, যাতে উপর থেকে পায়ের চামড়া প্রকাশ না পায় এবং পায়ের উপরে সঠিকভাবে স্থাপিত হয়, বেঁধে রাখার প্রয়োজন না হয়। তাই উক্ত পায়ের মোযা যদি পাতলা হয় পায়ের চামড়া আবৃত না করে, তাহ’লে তার উপরে মাসাহ করা বৈধ নয়। কেননা এই অবস্থায় পা যেন মোযামুক্ত রয়েছে, আর অনাবৃত পায়ের উপরে মাসাহ করা বৈধ নয়। সুতা বা কাপড় কিংবা কার্পাসের তৈরি মোযার উপরে মাসাহ করার অন্য একটি শর্ত হ’ল: পরিপূর্ণ পবিত্র অবস্থায় ওযূ অথবা গোসল করার পর মোযার উপর মাসাহ করা। আর এটাই হ’ল অধিকাংশ ইমাম ও বিদ্বানগণের অভিমত। মহান আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
[1]. আবূদাউদ হা/১৫৯; তিরমিযী হা/৯৯; ইবওয়া হা/১০১; মিশকাত হা/৫২৩।
[2]. শরহু মুশকিলুল আছার হা/৬১৬;ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৯৮।
[3]. আবূদাউদ হা/১৪৬; আহমাদ হা/২২৪৩৭, সনদ ছহীহ)।
[4]. আউনুল মা‘বুদ ১/১৭১; তোহফাতুল আহওয়াযী ১/২৮৭।
[5]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৭৪;সনদ যঈফ, আবু জনাব ইয়াহইয়া ইবনু হায়াত নামে একজন যঈফ বর্ণনাকারী রয়েছে। তবে মতন ছহীহ ।
[6]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৩;এর সনদে কা‘ব বিন আব্দুল্লাহ নামে একজন সমালোচিত বর্ণনাকারী থাকায় এর সনদকে কতিপয় বিদ্বান যঈফ বলেছেন (আলবানী, ছহীহ আবূদাউদ ১/২৭৮)।
[7]. মুছান্নাফ আব্দির রাযযাক হা/৭৮১; সনদ ছহীহ, আলবানী, ছহীহ আবূদাউদ ১/২৭৯।
[8]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৯; তাবারানী কাবীর হা/৬৮৬; সনদ ছহীহ, তাহকীকুল মাসহি আলাজ জাওরাবাইন ৫৮ পৃ.; ছহীহ আবূদাউদ ১/২৭৯।
[9]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৮৮;সনদ ছহীহ, ছহীহ আবূদাউদ ১/২৭৯।
[10]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৪, সনদ ছহীহ, তাহকীকুল মাসহি আলাজ জাওরাবাইন ৫৭ পৃ.।
[11]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৬;সনদ হাসান, তাহকীকুল মাসহি আলাজ জাওরাবাইন ৫৮ পৃ.।
[12]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৯৪; মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৭৮২, সনদ ছহীহ, তাহকীকুল মাসহি.. ৫৮ পৃ.।
[13]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৮;সনদ ছহীহ, ছহীহ আবূদাউদ ১/২৭৯।
[14]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৮৩;।
[15]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৭৫-৯০।
[16]. মুছানণাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৮৩, সনদ সমালোচিত।
[17]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৫, সনদ ছহীহ।
[18]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৭৭৫, সনদ ছহীহ।
[19]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৭৫, ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৩।
[20]. কাসানী, বাদায়ে‘উছ ছানায়ে্‘ ১/১০।
[21]. কাসানী, বাদায়ে‘উছ ছানায়ে্‘ ১/১০।
[22]. খারশী, মুখতাছারে খলীল ১/১৭৮; শানক্বীতী, লাওয়ামিউদ দুরার ১/১৯৮।
[23]. নববী, আল-মাজমূ‘ ১/৪৯৯।
[24]. নববী, আল-মাজমূ‘ ১/৫০০।
[25]. কাশশাফুল কেনা‘ ১/১১১।
[26]. বাহতী, কাশশাফুল কেনা‘ ১/১১১; নববী, আল-মাজমূ‘ ১/৪৯৯।
[27]. তিরমিযী হা/৯৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[28]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা ১/৩২৪।
[29]. মাজমূউল ফাতাওয়া ২১/২১৪।
[30]. ইবনু কুদামাহ, মুগনী ১/২১৫।
[31]. তাহযীব সুনান আবীদাউদ ১/৮৭-৮৯।
[32]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/১১০।
[33]. ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৭/০২।
[34]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৪/১০১, ৫/২৬৩।
[35]. জামালুদ্দীন কাসেমী, তাহকীক আলবানী, তাহকীকুল মাসহি আলাল জাওরাবাইন ৫৮ পৃ.।