ইসলাম মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যা মেনে চলা সমগ্র মানব ও জিন জাতির উপর ফরয। আল্লাহ যেমন এর বিধান নাযিল করেছেন, তেমনি তা বাস্তবে রূপদানের জন্য নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জে আরাফার ময়দানে ছাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে যখন বিদায় হজ্জ পালন করেছিলেন তখন আল্ল­াহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করলেন,اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا، ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)। রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) বলেন,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، لاَ يَزِيْغُ عَنْهَا بَعْدِيْ إِلاَّ هَالِكٌ، ‘আমি তোমাদেরকে একটি উজ্জ্বল স্বচ্ছ দ্বীনের উপর ছেড়ে গেলাম। যার রাতটাও দিনের মত (উজ্জ্বল)। ধ্বংসশীল ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই তা থেকে সরে আসতে পারে না’।[1]

সম্মানিত পাঠক! বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া পূর্ণাঙ্গ, পরিচ্ছন্ন দ্বীনের মধ্যে হরেক রকম মত, পথ ও পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এর মধ্যে সস্তায় জান্নাত লাভের মিথ্যা আশায় অসীলা কিংবা মাধ্যম হিসাবে পীর ধরাকে ফরয গণ্য করতঃ এর সমর্থনে কুরআন ও হাদীছ থেকে দলীল উপস্থাপন করে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলেছে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিম্নে তাদের উত্থাপিত কিছু দলীল পর্যালোচনা করা হ’ল।-

প্রথম দলীল : আল্লাহ তা‘আলার বাণী-مَنْ يَهْدِ اللهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُرْشِدًا، ‘আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করেন, সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত হয়। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য কোন সুপথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না’ (কাহফ ১৮/১৭)। অত্র আয়াতে বর্ণিত مُرْشِدًا বলতে পীরকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং পীর কোন নতুন শব্দ নয়; বরং এর বর্ণনা কুরআনে এসেছে।

জবাব : প্রথমতঃ ‘পীর’ ও ‘মুরশিদ’ শব্দ দু’টির শাব্দিক বিশ্লেষণ করা যাক। ‘পীর’ শব্দটি ফার্সী, যার আভিধানিক অর্থ বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কিংবা সম্মানিত ব্যক্তি। প্রাচীনকালে পারস্যের অগ্নিপূজকরা ‘পীর’ শব্দের ব্যবহার করত। তাদের পুরোহিতদেরকে ‘পীরে মগা’ বলা হ’ত। পক্ষান্তরে ‘মুরশিদ’ শব্দটি আরবী। যার আভিধানিক অর্থ পথপ্রদর্শনকারী। উল্লিখিত দু’টি শব্দের বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, ‘পীর’ শব্দের আরবী সমার্থক শব্দ কখনো ‘মুরশিদ’ হ’তে পারে না। বরং তা হতে পারে ‘শায়খ’ (الشيخ) যার অর্থ পীর শব্দের অনুরূপ।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত আয়াতে ‘মুরশিদ’ বলতে সরাসরি আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় জগদ্বিখ্যাত মুফাসসির ইবনু কাছীর (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেন, هُوَ الَّذِي أَرْشَدَ هَؤُلَاءِ الْفِتْيَةَ إِلَى الْهِدَايَةِ مِنْ بَيْنِ قَوْمِهِمْ، فَإِنَّهُ مَنْ هَدَاهُ اللهُ اهْتَدَى، وَمَنْ أَضَلَّهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ. ‘তিনিই (আল্লাহ) ঐ সমস্ত যুবকদেরকে (আছহাবে কাহফ) তাদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে সুপথ প্রদর্শন করেছিলেন। আর তিনি (আল্লাহ) যাকে হেদায়াত করেন সেই হেদায়াত প্রাপ্ত হন এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোন হেদায়াতকারী নেই’।[2] তিনি সূরা ফাতিহার তাফসীর করতে গিয়ে উল্লিখিত আয়াতটি পেশ করে বলেন,

هَذِهِ الْآيَةُ الدَّالَّةُ عَلَى أَنَّهُ سُبْحَانَهُ هُوَ الْمُنْفَرِدُ بِالْهِدَايَةِ وَالْإِضْلَالِ، لَا كَمَا تَقُولُهُ الْفِرْقَةُ الْقَدَرِيَّةُ وَمَنْ حَذَا حَذْوَهُمْ، مِنْ أَنَّ الْعِبَادَ هُمُ الَّذِينَ يَخْتَارُونَ ذَلِكَ وَيَفْعَلُونَهُ، وَيَحْتَجُّونَ عَلَى بِدْعَتِهِمْ بِمُتَشَابِهٍ مِنَ الْقُرْآنِ، وَيَتْرُكُونَ ما يكون فيه صريحا فِي الرَّدِّ عَلَيْهِمْ، وَهَذَا حَالُ أَهْلِ الضَّلَالِ وَالْغَيِّ.

‘এই আয়াত প্রমাণ করে যে, হেদায়াত করা এবং পথভ্রষ্ট করার ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা একক। ক্বাদারিয়াহ ফিরক্বা এবং তাদের অনুসারীরা যেমন দাবী করে বিষয়টি তেমন নয়। তাদের দাবী, বান্দারাই হেদায়াত ও ভ্রষ্টতার পথ বেছে নেয় এবং তদনুযায়ী কাজ করে। তারা তাদের নব আবিষ্কৃত মতের পক্ষে কুরআনের মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট আয়াত সমূহকে দলীল হিসাবে পেশ করে এবং তাদের মতের বিপরীতে মুহকাম বা স্পষ্ট আয়াত সমূহকে প্রত্যাখ্যান করে। আর পথভ্রষ্ট ফিরক্বার অনুসারীদের অবস্থা এমনই হয়ে থাকে।[3] আর এদেরকেই আল্লাহ বক্র অন্তরের অধিকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন,

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللهُ

‘তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব নাযিল করেছেন। যার মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে ‘মুহকাম’ বা সুস্পষ্ট অর্থবোধক। আর এগুলিই হ’ল কিতাবের মূল। আর কিছু রয়েছে ‘মুতাশাবিহ’ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক। অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, তারা অস্পষ্ট আয়াতগুলির পিছে পড়ে ফিৎনা সৃষ্টির জন্য এবং তাদের মনমত ব্যাখ্যা দেবার জন্য। অথচ এগুলির সঠিক ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না’ (আলে-ইমরান ৩/৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন ভ্রান্তদের থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন,فَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ، فَأُولَئِكَ الَّذِيْنَ سَمَّى اللهُ، فَاحْذَرُوهُمْ، ‘যারা (মুতাশাবিহ) অস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াতের পেছনে ছুটে তাদের যখন তুমি দেখবে তখন মনে করবে যে, তাদের কথাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে’।[4]

তৃতীয়তঃ মানুষও মুরশিদ বা পথপ্রদর্শনকারী হ’তে পারে। এক্ষেত্রে হেদায়াতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।[5] (১) هِدَايَةُ الدَّلَالَةِ وَالْإِرْشَادِ إِلَى سَبِيلِ الْهُدَى، বা হেদায়াতের রাস্তার দিকে পথনির্দেশ করা। এই অর্থে প্রত্যেক নবী-রাসূলগণ মুরশিদ ছিলেন। কারণ তাঁরা তাঁদের উম্মতকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন। এমনকি যূগে যূগে যত ওলামায়ে কেরাম এসেছেন এবং ক্বিয়ামত অবধি আসবেন, যারা মানুষকে যাবতীয় শিরক-বিদ‘আত থেকে সতর্ক করেন এবং হেদায়াতের পথে আহবান করেন তারা সকলেই এই অর্থে ‘মুরশিদ’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ ‘তুমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র। আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে পথ প্রদর্শক’ (রা‘দ ১৩/৭)। সুতরাং কোন ব্যক্তি বিশেষকে মুরশিদ আখ্যা দিয়ে তার মাধ্যমে জান্নাত পাওয়ার আশা করা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়।

(২) هِدَايَةُ التَّوْفِيقِ বা হেদায়াতের তাওফীক্ব পাওয়া। অর্থাৎ কারো অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করা। এটা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য খাছ। তিনি ব্যতীত কেউ কারো অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَشَاءُ ‘তাদেরকে হেদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাঁর আপন চাচা আবু ত্বালেবকে তার মৃত্যুর সময় ক্বালেমা পাঠ করে ঈমান আনার জন্য চেষ্টা করছিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করলেন,إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ، ‘নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পারো না যাকে তুমি ভালবাস। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করে থাকেন। আর তিনিই হেদায়াত প্রাপ্তদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত’ (ক্বছাছ ২৮/৫৬)

দ্বিতীয় দলীল : আল্লাহ তা‘আলার বাণী- أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ، ‘মনে রেখ (আখেরাতে) আল্লাহর অলী বা বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। অতএব আল্লাহর অলীদের যেমন কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই; তাদের ভক্তদেরও তেমন কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই। আর স্বয়ং আল্লাহই তাদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ، ‘আর যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে, তুমি তার রাস্তা অবলম্বন কর’ (লোক্বমান ৩১/১৫)। আর পীরেরাই যেহেতু আল্লাহর অভিমুখী হয়েছে এবং আল্লাহর বন্ধু হিসাবে পরিগণিত হয়েছে, তাই পীরের অনুসরণ-ই পরকালে মুক্তির একমাত্র উপায়।

জবাব : প্রথমতঃ أَوْلِيَاءَ اللهِ তথা আল্লাহর অলীগণ বলতে কোন পীর-দরবেশকে বুঝানো হয়নি। বরং আল্লাহর অলী কারা তা তিনি পরের আয়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ، لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ، (তারাই আল্লাহর অলী বা বন্ধু) যারা ঈমান আনে এবং সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে। তাদের জন্যই সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে (ইউনুস ১০/৬৩-৬৪)। সুতরাং আল্লাহর অলী হওয়ার জন্য দু’টি গুণের অধিকারী হ’তে হয়। (১) ঈমানদার হওয়া (২) আল্লাহকে ভয় করা। সুতরাং আল্লাহকে ভয়কারী সকল ঈমানদার ব্যক্তিই তাঁর অলী বা বন্ধু। আর তাঁর অলী না হ’তে পারলে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। তাই বিশেষ কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর অলীর সার্টিফিকেট না দিয়ে নিজেকে আল্লাহর অলী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অলী বা বন্ধুদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি কুরআন মাজীদের কোথাও এমন কথা বলেননি যে, আল্লাহর অলী বা বন্ধুর ভক্ত বা অনুসারীদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই। সুতরাং কোন পীরের মুরীদ হওয়ার মাধ্যমে পরকালে ভয় ও চিন্তা মুক্ত থাকার মিথ্যা আশা চরম মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। পীরের মুরীদ হয়ে নয়, বরং নিজেকেই আল্লাহর অলী বা বন্ধু হিসাবে প্রস্ত্তত করার মাধ্যমে পরকালে ভয় ও চিন্তা মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।

তৃতীয়তঃ সূরা লোক্বমানের ১৫নং আয়াতে আল্লাহর অভিমুখীদের রাস্তার অনুসরণের নির্দেশ দ্বারা কোন পীর-দরবেশের অনুসরণ বুঝানো হয়নি। বরং তা দ্বারা মুমিনদের রাস্তার অনুসরণ বুঝানো হয়েছে।[6] আর মুমিনদের রাস্তা বলতে পীরদের তৈরী করা ১২৬টি রাস্তা নয়; বরং মুমিনরা যে ঈমানের রাস্তায় পরিচালিত হয় সেই রাস্তার অনুসরণ করতে হবে।

চতুর্থতঃ যেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর বংশধর এমনকি তাঁর কলিজার টুকরা, নয়নের পুত্তলি কন্যা ফাতেমা (রাঃ)-কে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর নিশ্চয়তা দিতে পারেননি; সেখানে একজন পীরের ভক্তরা ক্বিয়ামতের দিন কিভাবে ভয় ও চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে? একদা রাসূল (ছাঃ) ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর বংশীয় নিকটজনদের সবাইকে ডেকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ كَعْبِ بْنِ لُؤَىٍّ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ هَاشِمٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا عَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا يَا فَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّىْ لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئاً غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِماً سَأَبُلُّهَا بِبَلاَلِهَا- ‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে আববাস বিন আব্দুল মুত্তবালিব! আমি তোমাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষায় কোনই কাজে আসব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! কেননা আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না। তবে তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আমি (দুনিয়াতে) সদ্ব্যবহার দ্বারা সিক্ত করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ وَلاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا، ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী চেয়ে নাও। কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না’।[7]

তৃতীয় দলীল : আল্লাহ তা‘আলার বাণী- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর ও তাঁর অসীলা সন্ধান কর। আর আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (মায়েদা ৫/৩৫)। অত্র আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই অসীলা অনুসন্ধান করতে বলেছেন। সুতরাং পীরকে অসীলা মানার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের চেষ্টা করতে হবে।

জবাব :প্রথমতঃ উক্ত আয়াতে বর্ণিত অসীলা বলতে কোন পীরের মুরীদ হওয়া উদ্দেশ্য নয়; বরং অসীলা হ’ল, التي يتوصل بها إلى تحصيل المقصود، ‘যা কিছুর মাধ্যমে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য (আল্লাহর নৈকট্য) হাছিল করতে পারে’।[8] ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন,وابتغوا إليه الوسيلة أي تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه، ‘অসীলা অনুসন্ধান করা বলতে আল্লাহর আনুগত্য ও তিনি যে সকল আমল ভালবাসেন তা পালনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাছিল করা বুঝায়’।[9] সুতরাং অসীলা অর্থ পীর ধরা নয়; বরং ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সহ আল্লাহর পসন্দনীয় কর্মসমূহ সম্পাদনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য হাছিল করাই অসীলা।

দ্বিতীয়তঃ অসীলার অর্থ পীর ধরা করলে তা পবিত্র কুরআনের অনেকগুলি আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। কেননা আল্লাহ কোন মাধ্যম ধরে তাঁকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ‘তোমরা আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব’ (মুমিন ৪০/৬০)। এখানে তিনি কোন মাধ্যম দিয়ে ডাকতে বলেননি; বরং সরাসরি ডাকতে বলেছেন। তিনি আরো বলেন, اتَّبِعُوْا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيْلًا مَا تَذَكَّرُوْنَ- ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হ’তে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য কোন অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো’ (আ‘রাফ ৭/৩)

চতুর্থ দলীল : আবু হামেদ গাযালী (রহঃ) বলেন, فمن لم يكن له شيخ يهديه قاده الشيطان إلى طرقه لا محالة، ‘পথ দেখানোর মত যার কোন শায়খ বা পীর নেই, শয়তান তাকে অবশ্যই বিপথে নিয়ে যাবে’।[10] আরো কথিত আছে, من لا شيخ له فشيخه الشيطان، ‘যার কোন পীর নেই, শয়তানই তার পীর’।[11] সুতরাং পীর ধরা ফরয। পীর না ধরলে শয়তান তাকে বিপথে নিয়ে যাবে।

জবাব : প্রথমতঃ উক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এমন কোন বক্তব্য বা ধারণার অস্তিত্ব নেই। বরং এটা মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত ধারণা মাত্র। এই যুক্তিতে কোন ব্যক্তিকে পবিত্র জ্ঞান করা ও তার প্রতি অন্ধ আনুগত্য সঁপে দেয়া নিঃসন্দেহে বিধর্মী গুরুবাদীদের অনুকরণ বৈ কিছুই নয়। ইসলামের মধ্যে পীরতন্ত্রের নামে ভক্তিবাদ বা গুরুবাদ ঢোকানোর এই অপচেষ্টা ইসলাম ও মুসলিমের সাথে প্রতারণা বৈ কিছুই নয়’।

দ্বিতীয়তঃ এগুলোকে দলীল হিসাবে পেশ করে পীরতন্ত্র সাব্যস্ত করা নিঃসন্দেহে দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ির শামিল, যা মুসলমানদের ধ্বংসের কারণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِى الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِى الدِّينِ، ‘হে লোক সকল! দ্বীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে তোমরা সাবধান থাকো। কেননা তোমাদের পূর্বেকার লোকেদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের বাড়াবাড়ি ধ্বংস করেছে’।[12]

তৃতীয়তঃ নিঃসন্দেহে সঠিক দ্বীন জানা ও বুঝার জন্য হকপন্থী ওলামায়ে কেরামকে শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করা যরূরী। শিক্ষক বিহীন ইলম মানুষকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষক গ্রহণ করতে হবে কেবল ইলম অর্জনের জন্য। কোন একজনকে আল্লাহর অলী আখ্যা দিয়ে তার প্রতি শর্তহীন আনুগত্য ও ভক্তি দেখিয়ে তার অসীলায় জান্নাত পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- ‘আর জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জেনে থাক’ (নাহল ১৬/৪৩)। এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে পারদর্শী আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাঁদের প্রতিও এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যথাযথ সংবাদ দেয়। তেমনি তাদের ভ্রষ্ট মতামত প্রদান ও মিথ্যা ধারণার ভিত্তিতে দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুকে বৈধ করার অনুমতি দেননি।

(চলবে)

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।

[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪৩, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৩৭।

[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, সূরা কাহফ-এর ১৭নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টাব্য।

[3]. ঐ, সূরা ফাতিহা-এর ৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টাব্য।

[4]. বুখারী হা/৪৫৪৭; মুসলিম হা/২৬৬৫; মিশকাত হা/১৫১।

[5]. হাফেয ইবনু আহমাদ ইবনে আলী আল-হাকামী, মাআরিজুল কুবূল পৃ. ২/৬৭৬।

[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা লোক্বমান ১৫নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টাব্য।

[7]. বুখারী হা/২৭৫৩; মুসলিম হা/২০৪, ২০৬; আহমাদ হা/৮৭১১; মিশকাত হা/৫৩৭৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-২৬।

[8]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা মায়েদা ৩৫নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টাব্য।

[9]. ঐ।

[10]. আবু হামেদ গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন পৃঃ ৩/১১২-১১৩।

[11]. সাইয়েদ আবুল হুদা আর-রিফাঈ, ক্বিলাদাতুল জাওয়াহের, পৃ. ১৭৭।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/৩০২৯; ছহীহাহ হা/১২৮৩।






জামা‘আত ও বায়‘আত সম্পর্কিত সংশয়সমূহ পর্যালোচনা - আত-তাহরীক ডেস্ক
পীরতন্ত্র : সংশয় নিরসন - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
প্রসঙ্গ : সারা বিশ্বে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ছহীহ হাদীছের পরিচয়
(৩য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচয় - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
মাযহাবের পরিচয় (৪র্থ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
জামা‘আত ও বায়‘আত সম্পর্কিত সংশয়সমূহ পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - গবেষণা বিভাগ, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
জামা‘আত ও বায়‘আত সম্পর্কিত সংশয়সমূহ পর্যালোচনা - গবেষণা বিভাগ, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
মুসলিম জাতির বয়সসীমা ও ইমাম মাহদী প্রসঙ্গ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
রাজনীতি করুন, ইসলামের অপব্যাখ্যা করবেন না - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মক্কা-মদীনার বাইরে আলেম নেই? - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
সঊদী আরবের সঙ্গে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষে-বিপক্ষে বাহাছ; বিপক্ষ দলের বিজয়
আরও
আরও
.