সাড়ে পনের বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর একটি নতুন স্বপ্নময় রাষ্ট্রের প্রত্যাশায় বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ। সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার তরতাযা জীবন এবং শত শত ছাত্রের চোখ হারানো, অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ে অর্জিত ৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক বিজয় দেশের আপামর জনগণের মানসপটে এঁকে দিয়েছে এক নতুন বাংলাদেশের বুনিয়াদ। যে বাংলাদেশ হবে শোষণ-পীড়নমুক্ত এক প্রশান্তিময় বাংলাদেশ। যেখানে কায়েম হবে শতভাগ ইনছাফ ও ন্যায়-নীতি। বন্ধ হবে বিচারের নামে অবিচার। অবসান ঘটবে দীর্ঘসূত্রী বিচার ব্যবস্থার। যেখানে থাকবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। থাকবে অধিকার বঞ্চিতের পূর্ণ অধিকার। মযলূম মানবতার আর্তচিৎকারে যে দেশের আকাশ-বাতাস ভারি হবে না। বুভুক্ষু মানবতা ক্ষুধার জ্বালায় পথে-প্রান্তরে নিভৃতে ডুকরে কাঁদবে না। গুম, খুন ও অপহরণের লোমহর্ষক ইতিহাস পুনরায় রচিত হবে না। শান্তির সুবাতাস বইবে অট্রালিকা থেকে পর্ণকুটির পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বত্র।
প্রশ্ন হচ্ছে- এমন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব? মানব রচিত কোন বিধান, কোন মতবাদ, কোন তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে কি এর সফল বাস্তবায়ন সম্ভব? একবাক্যে উত্তর হচ্ছে- না। কেননা মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত আছে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের মধ্যে। তিনিই একমাত্র অবগত আছেন মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। তাঁর প্রেরিত কল্যাণবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার মাধ্যমেই এর সফল বাস্তবায়ন সম্ভব। যে বিধানের বাস্তব রূপকার হচ্ছেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর এ বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘ইসলামী খেলাফত’।
ইসলামী খেলাফতের চেতনা হচ্ছে আখেরাতে মুক্তির চেতনা। এর সংবিধান হচ্ছে আসমানী সংবিধান তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। যা অপ্রতিদ্বন্দ্বী (Unchallengeable) ও অপরিবর্তনীয় (Unchangeable)। যে সংবিধানের কোন সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ বা প্রয়োজন নেই। এটি এমন এক ইনছাফপূর্ণ সংবিধান, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনার ফলে যুলম-নির্যাতন, শোষণ-নিপীড়ন ও পাপসাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত জাহেলী আরবের মানুষগুলো অল্পদিনের ব্যবধানে বিশ্বসেরা উন্নত সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়। যে আরবে কন্যা সন্তান জন্মদানকে চরম লজ্জাকর মনে করে তাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে দিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হ’ত, সে আরবের লোকেরা কন্যা সন্তান জন্মদানকে বরং গর্ব ও নেকীর কাজ মনে করতে লাগল। এ কল্যাণ বিধানের ছোহবতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ-বিগ্রহের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়েছিল। এটি এমন এক সংবিধান যেখানে আশরাফ-আত্বরাফের মধ্যে কোন পার্থক্য করার সুযোগ নেই। একজন সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে যেমন বিচার ও সুযোগ-সুবিধা, তেমনি নেতার সন্তান বা উচ্চবংশীয় কেউ অপরাধ করলেও একই বিচার। একবার মক্কার ‘বনু মাখযূম’ গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরি করলে কুরায়শ বংশের লোকেরা তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। বংশীয় মর্যাদার দিক বিবেচনায় হাত না কেটে হালকা শাস্তি দেওয়া যায় কি-না এমন প্রস্তাব তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পেশ করতে চাইল। কিন্তু সাহস করতে পারল না। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয়পাত্র উসামা বিন যায়েদের মাধ্যমে প্রস্তাব পেশ করলে রাসূল (ছাঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিলেন, ‘হে উসামা! তুমি কি আল্লাহর একটি দন্ডবিধির বিরুদ্ধে সুফারিশ করছ? অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ، وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا- ‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিগুলি ধ্বংস হয়েছে একারণে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করত, তখন তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত, তখন তার উপরে দন্ডবিধি জারী করত। আললাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তাহ’লে আমি তার হাত কেটে দিতাম’।[1] বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক নেতার কি এই হিম্মত আছে যে, নিজের ছেলে-মেয়ে তো দূরে থাক নিজ দলীয় কর্মীদের ব্যাপারেও এতটা কঠোর ও ন্যায়বিচারক হ’তে পারেন। দলীয় অপশাসনের হর্তাকর্তাদের দ্বারা এটা যে অসম্ভব হালযামানার শাসনামলে জনগণ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর খোলাফায়ে রাশেদীনের ৩০ বছরের শাসনামলও ছিল ইনছাফ ও ন্যায়নীতি দ্বারা পরিপূর্ণ। এলাহী সংবিধানের আলোকে তারা ইসলামী সালতানাতের সর্বত্র সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খলীফা হয়েও ওমর ফারূক (রাঃ) নিজের পিঠে বহন করে আটার বস্তা প্রজার বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে নিজের জামা লম্বা হওয়ার সদুত্তর দেওয়ার পর খুৎবা দিয়েও নযীর স্থাপন করেছেন। দিনভর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে আবার রাতের অন্ধকারে তিনি বেরিয়ে পড়তেন প্রজাসাধারণের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীযকে রাজসভায় তার পরিবার সম্পর্কে প্রশ্ন করা হ’লে তিনি জ্বলন্ত মোমবাতিটি নিভিয়ে দেন এবং ভিতর থেকে ছোট এক টুকরো মোমবাতি জ্বালিয়ে উক্ত প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রশ্নকারী বাতি পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতক্ষণ আমি রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলাম তাই রাজদরবারের মোমবাতি ব্যবহার করেছি। কিন্তু তুমি যখন আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করেছ তখন আমি আমার নিজস্ব মোমবাতি জ্বালিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। কেননা রাজদরবারের মোমবাতি দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সমীচীন মনে করছি না।
প্রিয় পাঠক! কতটা আমানতদার এবং আখেরাতে জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি থাকলে এত চুলচেরা হিসাব করা সম্ভব, চিন্তার গভীরতা ছাড়া তা উপলব্ধি করা দুঃসাধ্য। মূলত তাদের চেতনা ছিল আখেরাত, তাদের জবাবদিহিতা ছিল একমাত্র মহান আল্লাহর নিকটে। ফলে তারা সর্বাধিক সতর্কতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। অথচ ঘুণাক্ষরেও তারা নেতৃত্ব চেয়ে নেননি বা এর জন্য আকাঙ্খাও পোষণ করেননি। তাদের স্কন্ধে বরং দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তও হয়েছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাও ছিল তাই।- لاَ تَسْأَلِ الْإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أُوتِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوتِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا، ‘তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নিয়ো না। কেননা যদি তুমি চাওয়ার মাধ্যমে নেতৃত্ব পাও, তাহ’লে তোমাকে তার ওপরেই ন্যস্ত করা হবে। আর যদি বিনা চাওয়ায় তোমাকে নেতৃত্ব অর্পণ করা হয়, তাহ’লে সেজন্য তোমাকে সাহায্য করা হবে’।[2]
প্রখ্যাত ছাহাবী আবু যার গিফারী (রাঃ) একদিন রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোন এলাকার শাসক নিযুক্ত করবেন না? তখন তিনি তার কাঁধে আঘাত করে বললেন,يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْيٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِي عَلَيْهِ فِيهَا. وَفِي رِوَايَةٍ : قَالَ لَهُ : يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّي أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّي أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِي لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيمٍ- ‘হে আবু যার! তুমি দুর্বল। আর শাসনকার্য হ’ল একটি আমানত। নিশ্চয়ই তা হবে ক্বিয়ামতের দিন অপমান ও লজ্জার কারণ। তবে সে ব্যক্তি নয়, যে তা যথার্থভাবে গ্রহণ করে এবং নিষ্ঠার সাথে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, হে আবু যার! আমি দেখছি তুমি একজন দুর্বল ব্যক্তি। আর আমি তোমার জন্য সেটাই পসন্দ করি, যা আমি নিজের জন্য পসন্দ করি। তুমি কখনো দু’জন লোকেরও নেতা হয়ো না এবং ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না’।[3] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً، يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِّرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ- ‘আল্লাহ যখন তার কোন বান্দাকে কিছু লোকের দায়িত্বশীল নিয়োগ করেন, অতঃপর সে খেয়ানতকারী হিসাবে মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন’।[4]
পাঠক! পুনরায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। Two-nation theory বা দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা হচ্ছে ইসলাম। তিনদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি ও একদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত ছোট্ট এই ভূখন্ডটির অধিবাসীরা যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ না হ’ত তাহ’লে এটি আদৌ পূর্ব-পাকিস্তান হ’ত না। আর পূর্ব পাকিস্তান না হ’লে আদৌ স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হ’ত না। অথচ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ইসলামের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা সময় ও প্রয়োজনের তুলনায় একবারে অপ্রতুল।
স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৫৩ বছরে এদেশে শুধুমাত্র নেতার পরিবর্তন হয়েছে। নীতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। যারাই মসনদে বসেছে তারাই নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ও আখের গোছানোতে ব্যতিব্যস্ত থেকেছে। ধরাকে করেছে সরা জ্ঞান। বাক স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করেছে। এমনকি ইসলামিক সম্মেলন, মাহফিল বা জালসার ক্ষেত্রেও অনুমতির দেয়াল তৈরি করে দ্বীনি দাওয়াতের ক্ষেত্রকে বাধাসংকুল ও সংকুচিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ কবি রবী ঠাকুরের এ বাণীই যেন বাস্তবরূপ লাভ করেছে। নিরপরাধ নির্দোষ ব্যক্তিদের দিয়ে কারাগারগুলো টইটম্বুর করা হয়েছে। যেখানে তিল ধারণের কোন ঠাঁই নেই। কারাগার নয় যেন মুরগীর খামার।
যে স্বপ্নময় রাষ্ট্রের প্রত্যাশা নিয়ে জুলাই-আগষ্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, হাযারো ছাত্র-জতার রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সে আশায় যেন ‘গুড়ে বালি’। নীতি-আদর্শ ও দক্ষতা বিবেচনা না করে উপদেষ্টাদের বহর বৃদ্ধি, অকার্যকর প্রশাসন, সেনাবাহিনীর নির্বিকার অবস্থান, চোর-ডাকাত ও চাঁদাবাজ-মাস্তানদের দৌরাত্য, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি নানাবিধ কারণ বর্তমান সরকারকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। যা আদৌ দেশবাসীর কাম্য নয়। তদুপরি অযোগ্য অদক্ষ নাস্তিক ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করায় মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
৫ই আগষ্ট পতিত স্বৈরাচার বিদায় নিলেও বন্ধ হয়নি দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি। শুধু খোলস বদলেছে। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। আগে যেমনটি চাঁদা দিতে হ’ত এখনও তদ্রূপ বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশীও দিতে হচ্ছে। শুধু ব্যক্তি ও দলের পরিবর্তন হয়েছে এই যা। এসবই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কুফল। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি পরিবর্তন হয়, কিন্তু নীতির তেমন পরিবর্তন হয় না।
বিগত শাসনামলে দীর্ঘ সাড়ে পনের বছর যারা মামলা-হামলা যুলুম-নির্যাতনে জর্জরিত ছিল, বিছানায় পিঠ লাগানোর যাদের ফুরছত ছিল না, শত শত মামলা দিয়ে যাদের জীবন বিপন্ন করে ফেলা হয়েছিল, রাজপথে ‘টু’ শব্দটি করার সুযোগ যাদের ছিল না, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর তারা এখন মরিয়া হয়ে ওঠেছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দিন যেন তাদের পারই হচ্ছে না। স্বৈরশাসনের অবসানের পর ভঙ্গুর একটি দেশে সংস্কারের জন্য যে সময় প্রয়োজন তারা এতটুকু দিতেও রাজি না। দ্রুত ক্ষমতার স্বাদ না পেলে যেন তাদের সুখনিদ্রাই হচ্ছে না। অথচ পতিত স্বৈরাচারের আগে তাদের আমলটিও যে কাছাকাছি একইরূপ ছিল তা দীর্ঘ বিরতির কারণে হয়তো দেশবাসী ভুলতে বসেছে। ‘হাওয়া ভবন’ কেন্দ্রিক দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কথা। কিন্তু আমরা বিস্মৃত হইনি। কেননা হাওয়া ভবনের অন্যায় সিদ্ধান্তে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করে ১০টি মিথ্যা মামলা দিয়ে ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন কারাবন্দী করে রাখা হয়েছিল। কারণ কিছুই ছিল না। ছিল আদর্শিক দ্বন্দ্ব। ইসলামের মূল আদর্শ তিনি তার লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরতেন। যা তারা বরদাশত করতে পারেনি।
প্রিয় পাঠক! এরশাদের স্বৈরশাসন, হাওয়া ভবনের দুঃশাসন, আয়না ঘরের নির্মম নির্যাতন সবই এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। দূর অতীতে দেখেছে বাকশালী ও রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন। প্রত্যেক আমলেই দলীয় শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে বিরোধী মত। বাকস্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মুখ খুললেই খুন, গুম, অপহরণ ও মামলা-হামলার শিকার হ’তে হয়েছে বহু গুণীজনকে। রাষ্ট্রের তাবত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে দলীয় বশংবদরা। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে- এসব অপশাসন থেকে বাঁচার উপায় কি?
জবাব একটাই, এই অপশাসন থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘ইসলামী খেলাফত’। যা পরিচালিত হয় এলাহী বিধানের আলোকে। যেখানে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক সকলের অধিকার সংরক্ষিত থাকে। যা ইনছাফ ও ন্যায়নীতিতে পরিপূর্ণ। যেখানে ক্ষমতা চেয়ে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এমনকি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা করলেও তাকে ক্ষমতা দিতে রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। যে খেলাফত আখেরাতের চেতনার উপর ভিত্তিশীল। যে খেলাফতের অধীনে চোরের হাত কাটা, যেনাকারকে ছঙ্গেছার করা, মদখোরকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করার মত শারঈ হুদূদগুলো
দুর্ভাগ্য, ইসলামী দলগুলোও আজ ক্ষমতার মোহে পড়ে ইসলামী খেলাফতের সমুজ্জ্বল ইতিহাস ভুলতে বসেছে। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়াই যেন তাদের নিকটে মূখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। ইক্বামতে দ্বীনের ভুল ব্যাখ্যার কারণে বুলেট বা ব্যালট যে কোন উপায়ে হুকুমত কায়েম করার মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের স্বপ্ন দেখছে। অথচ সকল নবী-রাসূলের নিকটে ‘ইক্বামতে দ্বীন’ অর্থ ছিল ‘ইক্বামতে তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া এবং তাঁর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। কেউবা আবার পশ্চিমাদের চালান করা এই তন্ত্রকে ইসলামী লেবাস পরাতে কোশেশ অব্যাহত রেখেছে। যা আরও ন্যক্কারজনক। সুতরাং ইসলামী দলগুলোকে বলব, যদি সত্যিকার অর্থে ইসলামী রাজনীতি করতে চান, তাহ’লে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করুন। মহান আল্লাহ চাইলে বিজয় পতাকা একদিন আপনাদের হাতেই উড্ডীন হবে ইনশাআল্লাহ। ঐ শুনুন মহান আল্লাহর ঘোষণা- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদনা করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা প্রদান করবেন, যেমন তিনি প্রদান করেছিলেন পূর্ববর্তীদরকে। আর তিনি সৃদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভীতির বদলে নিরাপত্তা দান করবেন’ (নূর ২৪/৫-৫৬)।
অতএব বাতিলের সাথে আপোষ করে হক প্রতিষ্ঠার কষ্টকল্পনা ছেড়ে আসুন আমরা সকলে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার আওয়ায তুলি। সকল ইসলামী দল ও সংগঠনের বজ্রকঠিন আওয়াযে যেদিন এ দেশের মুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গবে সেদিন আরেকটি বিপ্লব সূচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. বুখারী হা/৩৪৭৫; মুসলিম হা/১৬৮৮ (৮); মিশকাত হা/৩৬১০ ‘দন্ডবিধি সমূহ’ অধ্যায়।
[2]. বুখারী হা/৬৬১২; মিশকাত হা/৩৪১২ ‘শপথ ও মানত’ অধ্যায়।
[3]. মুসলিম হা/১৮২৫; মিশকাত হা/৩৬৮২ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায়।
[4]. মুসলিম হা/১৪২; মিশকাত হা/৩৬৮৭, রাবী মা‘ক্বিল বিন ইয়াসার (রাঃ)।