
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও সংবিধান সংস্কারের বিষয়টি অন্যতম দাবীতে পরিণত হয়েছে। কেউ যাতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে আর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে, এজন্য এ সংস্কারের দাবী তোলা হয়। দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস গত বছরের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এসব কমিশন গঠন করার কথা বলেন।
কমিশনগুলোকে ৯০ দিনের মধ্যে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। গত ১৫ই জানুয়ারী’২৪ অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিটি তার সুফারিশ- সংবলিত প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন। সুপারিশের সারসংক্ষেপ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। সারসংক্ষেপে সংবিধান সংস্কারে যেসব সুফারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাখা, পাঁচ মূলনীতি হিসাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, দুই কক্ষের সংসদে মোট আসন ৫০৫টি, সংসদের মেয়াদ ৪ বছর, দুই মেয়াদের বেশী প্রধানমন্ত্রী নয়, নিম্নকক্ষে ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী করা, ২১ বছর হ’লে প্রার্থী হওয়া, অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখা এবং নারী আসনে সরাসরি ভোট, সব মিলিয়ে ১৬টি ক্ষেত্রে ১৫০টির মতো সুফারিশ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, সংস্কার কমিটির সুফারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে বলা হয়েছে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এগুলোর মধ্যে শুধু গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসাবে রাখার প্রস্তাব করেছে। এর সঙ্গে তারা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার ও বহুত্ববাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণের সুফারিশ করেছে। মূলত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটিকে রাখা বিভ্রান্তিকর। মুসলিম জাতীয়তা ও ইসলামী মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে এদেশে কোন সংস্কার গ্রহণযোগ্য হবে না। সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস, ‘জনগণের অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব এবং শোষণ-যুলুম ও বৈষম্যমুক্ত আদর্শ’ থাকতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ‘ইসলাম’ অক্ষুণ্ণ রাখা এবং কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত কোন আইন প্রণয়ন করা যাবে না, তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। ‘গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভেদ নয় ঐক্য, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ এই প্রতিপাদ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার কর্তৃক দেশ ও দেশের মানুষকে বিভক্ত করার মিথ্যা বয়ানগুলো পরিহার করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থান ঘটালো একত্ববাদীরা অথচ সংবিধানের মূলনীতি হবে বহুত্ববাদ! বহুত্ববাদের একটা সহজ উদাহরণ হ’তে পারে সম্রাট আকবরের সময় চালু হওয়া ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ নামক একটি ধর্ম। সব ধর্মের সংমিশ্রণে দ্বীন-ই-ইলাহীর মত নতুন ধর্ম হচ্ছে বহুত্ববাদ। সেই বহুত্ববাদের আদলেই রচিত হবে নতুন সংবিধান। বাংলা বহু ঈশ্বরবাদ বা ‘বহুত্ববাদ’ অর্থাৎ ইংরেজি Polytheism কথাটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ poly (যার অর্থ হল ’বহু’) এবং theoi (যার অর্থ হল ‘ঈশ্বর’) থেকে। সেই অর্থে বহুত্ববাদ বলতে বহু ঈশ্বর বা বহু দেবতার উপাসনাকে বোঝায়। আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদী লেখক ফিলো ‘বহুত্ববাদ’ কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। আধুনিককালে ফরাসী লেখক জাঁ বোঁদা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এবং ইংরেজ লেখক স্যামুয়েল পার্কাস ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘বহুত্ববাদ’ কথাটি ব্যবহার করেন। বহুত্ববাদের মূলকথা- সত্তা এক নয়, দুইও নয়, বহু। বহুত্ববাদ’ pluralism কথাটি নতুন নয়, গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতায় কথাটি পুরনো। রাষ্ট্রচিন্তায়, সভ্যতা বিচারে, সংস্কৃতির বিবেচনায় পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁসের সূচনা পর্বের পর থেকেই নানা বিষয়ের সঙ্গে totalitarism ও pluralism ইত্যাদি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা লক্ষ্য করা যায়। বহুত্ববাদের কথা বলে বাংলাদেশের সব কিছুকে শুধু বিভক্ত করতে করতে দুর্বল করে চললে বাংলাদেশের ওপর বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্তৃত্ব ও শোষণ বজায় রাখতে সুবিধা হয়।
বহুত্ববাদ হ’ল একত্ববাদের কেন্দ্রীভূত সর্বাত্মক ও অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার ফল। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল একত্ববাদের সমালোচনা হিসাবে নয়, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ হিসাবে বহুত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। জেন্ডার বিষয়ে সচেতন বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘বহুত্ববাদের’ মানে হ’ল, এলজিবিটিকিউ ও ট্রান্সজেন্ডারদেরকেও জায়গা করে দেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া।
বহুত্ববাদ শব্দটি আরও নানা কারণে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। ইসলাম ধর্মের প্রাণ; তাওহীদ-এর বাংলা তরজমা করা হয় ‘একত্ববাদ’। অবচেতনভাবেই বহুত্ববাদকে একত্ববাদের বিপরীত ভাববাচক শব্দ মনে হয়। এটা আরও বড় সমস্যা।
বহুত্ববাদ সংবিধানের ইসলাম বিরোধী নীতি। বহুত্ববাদ একটা ষড়যন্ত্র! এটি কেবল মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সেক্যুলারিজম ও বহুত্ববাদ একই জিনিস। বহুত্ববাদ শব্দটি ব্যবহার করা বাংলাদেশের মানুষদের বোকা বানানোর পাঁয়তারা মাত্র। কুরআন মাজীদে আল্লাহ ইসলামকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। এবং ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম। আর আহলে কিতাবগণ (শেষনবীর উপর ঈমান আনার ব্যাপারে) মতভেদ করেছে তাদের নিকট ইলম এসে যাবার পরেও কেবলমাত্র পরস্পরে বিদ্বেষবশত। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, সত্বর আল্লাহ তাদের হিসাব গ্রহণ করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। পেরেনিয়ালিস্টরা এই আয়াতগুলি এককভাবে ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, ‘ইসলাম’ শব্দটি আনুগত্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যে কোন বিশ্ব ধর্ম অবলম্বন করে আল্লাহর আনুগত্য অর্জনের চেষ্টা করা যায়। তার মানে তাদের মতে এখানে ‘ইসলাম’ কেবল মাত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি ইঙ্গিত করে না।
পেরেনিয়ালিস্টদের (Perennialist) কথিত আনুগত্যের ব্যাখ্যা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে পাওয়া যায়। যেমন ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১৩২)। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং (এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ) শোনার পর তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (আনফাল ৮/২০)। এবং ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের। আর তোমরা তোমাদের আমলগুলিকে বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। এখানে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহর আনুগত্য করতে হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা আবশ্যক। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করতে হ’লে কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনীত কুরআন ও সুন্নাতের পথ তথা একমাত্র ইসলাম অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। সারকথা, পেরেনিয়ালিস্টদের দাবী অনুযায়ী যে কোন বিশ্ব ধর্ম অবলম্বন করে আল্লাহর আনুগত্য অর্জন করা যাবে। অথচ এটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী।
পেরেনিয়ালিস্টরা দাবী করে যে, সব বিশ্বধর্মের ধর্মাবলম্বীরা একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে। যদিও প্রতিটি ধর্মের ইবাদতের ধরন এবং ঈশ্বরের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। তার মানে পেরেনিয়ালিস্টরা বলতে চায় যে খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর যাকে তারা ‘তিনের মধ্যে এক’ হিসাবে ধারণা করে অর্থাৎ পিতা গড, পবিত্র আত্মা গড, ছেলে গড- এই তিন মিলে এক গড, আর ইসলামের সম্পূর্ণ একক আল্লাহ, একই ঈশ্বর। খ্রিষ্টানরা তাদের যে ঈশ্বরের ইবাদত করে, মুসলমানরাও সে একই আল্লাহর ইবাদত করে। কিন্তু এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর আর মুসলমানদের আল্লাহর স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘তুমি বল! হে অবিশ্বাসীরা! আমি ইবাদত করি না তোমরা যাদের ইবাদত কর এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি, আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যাদের ইবাদত কর এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’ (কাফিরূন ১০৯/১-৫)। এই আয়াতগুলিতে আল্লাহর হুকুমে রাসূল (ছাঃ) অবিশ্বাসীদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, রাসূল (ছাঃ) যে আল্লাহর ইবাদত করেন, অবিশ্বাসীরা সে আল্লাহর ইবাদত করে না। বুঝা গেল, পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে সব বিশ্বধর্মের ধর্মাবলম্বীরা একই ঈশ্বরের ইবাদত করে বলে যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা সঠিক নয়।
পেরেনিয়ালিস্টরা আরও বলে থাকে যে, আল্লাহই বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে তারা সূরা হুজুরাতের ১৩নং আয়াতের উদ্ধৃতি পেশ করে- ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হ’তে পার’। তারা এও বলে যে, আজ বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই ইসলাম বহির্ভূত অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। যদি কেবল ইসলামকেই আল্লাহ কবুল করেন তাহ’লে তো ৮০ শতাংশ মানুষকে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে হবে এবং সেটা হবে আল্লাহর দয়া, ক্ষমা ও শানের পরিপন্থী। তাই অন্যান্য বিশ্বধর্মের অনুসারীদেরও আল্লাহ নাজাত দিবেন।
এর জবাবে আমরা বলব, (১) আল্লাহ তো পেরেনিয়ালিস্টদের মতো করে জাহান্নামের হিসাব করবেন না। এই ২০% ও ৮০% কেবল বাহ্যিক ধর্মীয় পরিচয়, এই সংখ্যাগুলি থেকে প্রকৃত বিশ্বাসীর সংখ্যা জানা যায় না। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কারা বিশ্বাসী হিসাবে মারা যেতে পারে সে সম্পর্কে উপরে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ কোন কোন মানুষকে বিশ্বাস অর্জনের বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, সে তার নিজের মঙ্গলের জন্যেই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, সে তার নিজের ধ্বংসের জন্যেই সেটা হয়। বস্ততঃ একের বোঝা অন্যে বহন করে না। আর আমরা রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না (বনু ইসরাঈল ১৭/১৫)।
এই আয়াতের শেষাংশে দেখা যাচ্ছে যাদের কাছে কোন রাসূল পৌঁছায়নি, কোন এলাহী ম্যাসেজ পৌঁছায়নি, তাদেরকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না। অর্থাৎ তারা নাজাত পেয়ে যাবে। এ বিষয়টি এটাও ইঙ্গিত করে যে, এই জাতীয় মানুষ পৃথিবীতে থাকবে। কারা সেই সকল মানুষ তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। যেমন- (ক) যারা অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা শিশু অবস্থায় মারা যায়। তারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করেনি। (খ) এমন কোন গোষ্ঠী বা গোত্র যারা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বা গহীন অরণ্যে বা দুর্গম স্থানে বা প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করে এবং যাদের কাছে নবী-রাসূল ও কুরআনের বার্তা পৌঁছায়নি। হয়ত তারা তাদের নিজস্ব কোন বিশ্বাসের উপর বলবৎ আছে। (গ) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানুষ, যারা রাসূল ও কুরআনের বার্তা বুঝতে অক্ষম। (ঘ) অতীতের এমন কোন সময় যখন কোন নবী-রাসূল আগমন করেনি এবং সেই সময়ের মানুষ কোন নবী বা রাসূল পাননি। (ঙ) এমন কোন মানুষ বা মানুষের দল, যাদের কাছে কোন কারণে নবী-রাসূল ও কুরআনের বার্তা পৌঁছায়নি এবং সেই বার্তার সন্ধান করার মত তাদের কোন উপায় বা সক্ষমতা ছিল না। (চ) বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে এমন কিছু মানুষ যারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা পায়নি নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে। (ছ) হয়ত এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে নবী-রাসূল ও কুরআনের ভুল বার্তা পৌঁছেছে এবং সেটা সঠিক করার সুযোগ তাদের ছিল না। (জ) হয়তবা এমন কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে মুসলমানরা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলমানদের এই ব্যর্থতার কারণে তারা রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। চূড়ান্ত বিচারে আল্লাহই জানেন কারা কারা প্রকৃতই রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের বার্তা থেকে বঞ্চিত থেকেছে এবং তার ফলে নাজাত পেয়েছে।
সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম শব্দটি বাদ দিয়ে সংস্কার কমিশন সুকৌশলে সেক্যুলার আক্বীদা থেকে উৎসারিত আরেক চিন্তা pluralism (বহুত্ববাদ) সংযুক্ত করেছে। আর অন্যদিকে সেক্যুলার সংবিধানকে নতুন মোড়কে উপস্থাপনের সাথে সাথে আমেরিকা-ভারত বাংলাদেশে নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। তার মানে সেক্যুলার সিস্টেম আর সেক্যুলার সংবিধানকে নতুন লাইফলাইন দেয়ার বিষয়টিকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। কারণ তারাও সেক্যুলার সিস্টেমের ধারাবাহিকতা দেখতে চায়। প্লুরালিজম (বহুত্ববাদ) শব্দটি সব ধর্ম, বর্ণ ও চিন্তার মানুষকে সোসাইটিতে অন্তর্ভুক্ত করবে বলে বহুল প্রচার হ’লেও রাজনৈতিকভাবে বহুত্ববাদ একটা জঘন্য মতবাদ। এই আইডিয়া কখনো জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বাস্তবে রাষ্ট্রকে একটা গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে যায়।
বহুত্ববাদ বাস্তবায়নের আতুড়ঘর পশ্চিমা বিশ্বেও রাজনৈতিক ঐক্যের কোন নযীর নেই। আমেরিকা ও ইউরোপও রাজনৈতিকভাবে চরম বিভক্ত। আমেরিকায় ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানরা বন্দুক নীতি, Abortion Rights, LGBTQ ও অভিবাসনের ইস্যুতে ব্যাপকভাবে বিভক্ত। ইউরোপে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা ও ডানপন্থী অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের ফলে Xenophobia ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার জন্য জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও ঘৃণার ইন্ধন জোগাচ্ছে। বহুত্ববাদী ধারণা কোথাও কাউকে এক সুতায় আবদ্ধ করতে পারছে না।
বর্তমান বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ও নির্বাচন ইস্যুতে ছাত্র-জনতা, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেই সুযোগে দেশের রাজনীতিতে মার্কিন-বৃটেনের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা সামনের দিনগুলোতে চরম রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে ইংগিত দিচ্ছে। সুতরাং সেক্যুলার সিস্টেমকে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করে জুলাই অভ্যুত্থানকে ছিনতাই করার পশ্চিমা সকল প্রচেষ্টা চলমান। অথচ দেশের জনগণ ইসলাম চায়, ইসলামী খেলাফত চায়, ইসলামী ব্যবস্থা দিয়ে জীবন গড়তে চায়।
জুয়েল রানা
সহকারী শিক্ষক, উৎকর্ষ ইসলামিক স্কুল, চিরিরবন্দর, দিনাজপুর।