দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংসদ সদস্যের সমর্থনে ধন্য দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার বিগত ৭ মাসে তাদের প্রধান দু’টি ওয়াদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে এখন চরম বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। তাদের প্রধান দু’টি অঙ্গীকার ছিল সন্ত্রাস দমন ও দু্র্নীতির উচ্ছেদ। কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের মধুচন্দ্রিমার ঘোর কাটতে না কাটতেই জনগণের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। ক্রমেই ক্ষোভ দানা বাঁধছে সকল মহলে। এমনকি জোট সরকারের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। বিব্রত বোধ করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এক্ষণে প্রশ্ন : অসহায় জনগণ তাহ’লে যাবে কোথায়? তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের একমাত্র কার্যকর মাধ্যম ভোটাধিকার তারা প্রয়োগ করেছে গত ১লা অক্টোবর’০১। নীরব এক ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে তারা বড় আশা নিয়ে বর্তমান জোট সরকারকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিল। ৫ বছরের মধ্যে তাদের আর ভদ্রভাবে কিছুই করার নেই। কিন্তু হতাশায় বিদ্ধ হ’লে ও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যা খুশী তাই করতে চেষ্টা করে। সমাজের অধিকাংশ লোক যখন অনুরূপ অবস্থায় উপনীত হবে, তখন সৃষ্টি হবে গণ অভুত্থান। ফলে তখন সংখ্যাগুরু সরকার হৌক বা জোট সরকার হৌক কোন সরকারই আর টিকে থাকতে পারবে না। এর নযীর বাংলাদেশেই রয়েছে। অতএব সরকারে ও প্রশাসনে যারা আছেন, তাদের আলস্যে দিন কাটাবার অবকাশ নেই। তাদের অবশ্যই সমস্যার গভীরে যেতে হবে এবং শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের বর্তমান অবস্থাকে ১৯৭২-৭৫ সালের অরাজক অবস্থার সাথে অনেকে তুলনা করেছেন। তখন শেখ মুজিব প্রায় ১০০% জনসমর্থন নিয়ে সরকারী ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। সেই সাথে ছিল তার বিশাল ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও একচ্ছত্র শাসনের নিরংকুশ দলীয় ম্যান্ডেট। বর্তমান জোট সরকার সেদিক দিয়ে তুলনীয় না হ’লেও দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধনের মত নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমান যুগে কোন গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করাটাও কম ভাগ্যের ব্যাপার নয়। সরকার উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশকে ইচ্ছামত পরিচালনা করতে পারে। অতএব বিরোধী দলকে তোয়াজ করার পিছনে সময় ব্যয় না করেও সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে তাঁদের কোন বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টা। সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত। সরকার পরিবর্তনের পরপরই চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা কিছুদিন ঘাপটি মেরে ছিল। অথবা পার্শ্ববর্তী দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে বিলাসভ্রমণে সময় কাটিয়েছিল। ইতিমধ্যেই তারা সবকিছু ম্যানেজ করে নিয়ে পুরোদমে তাদের অপকীর্তি শুরু করে দিয়েছে। রাজধানীর রাজপথে প্রকাশ্য দিনমানে কীলিং স্কোয়াড নিয়মিতভাবে মানুষ খুন করে চলেছে। বিগত সরকারের আমলে দেশে প্রতিদিন ১১ জন করে খুন হ’ত বলে একটি হিসাবে বলা হয়েছিল। বর্তমানে তেমন অবস্থায় উপনীত হ’তে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
ঢাকা এখন মৃত্যুপুরী। কিছুই আঁচ করার আগে সন্ত্রাসীর ব্রাশফায়ার যেকোন সময় নিরীহ মানুষের বক্ষ ঝাঝরা করে দেবে। স্কুলগামী সন্তান হাসতে হাসতে বাড়ী ফিরবে কি-না সেই আশংকায় বাপ-মায়ের আরাম হারাম হয়ে যায়। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হওয়াটা এখন খুনের সহজ পদ্ধতি হিসাবে গণ্য হয়েছে। ৭ম শ্রেণীর বাচ্চা ছেলে শিহাবকে খুন করে টুকরা টুকরা করেছে তারই সমবয়সী বন্ধুরা অত্যন্ত ধীর মস্তিষ্কে। আশুলিয়ায় নৌকা ভ্রমণে ডেকে এনে হত্যা করে পানিতে ছুঁড়ে ফেলেছে বা গাযীপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এনে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে যারা, তারা সবাই সমবয়সী এবং ছোট থেকেই বিশ্বস্ত বন্ধু।
গত ৯ই মে ঢাকায় রাস্তার ধারে দাঁড়ানো পিতার কোলে থাকা বিশ মাসের কচি মেয়ে নওশীন সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছে। ১০ই মে শুক্রবার বেলা ১১-টায় মীরপুরের নবনির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার তরুণ যুবক ছায়েদুর রহমান নিউটন নিহত হয়েছেন। রাজধানী সহ সারা দেশের বিবেকমান মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আরও বিস্মিত হয়ে গেছে সবাই কাঁটা ঘায়ে নূনের ছিটার মত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি নওশীনের পিতাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ছবর করুন। আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গ্যাছে। গুলিটা ভুলক্রমে বাচ্চার গায়ে লেগেছে’। এ সত্য কথাটি যে সন্তানহারা পিতার জন্য কত নির্মম তা কে না জানে? এতে সন্ত্রাসকে আরও উস্কে দেবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন সন্ত্রাসীদের আযরাঈল স্বরূপ। আর তিনি যদি এভাবে ওয়ায শুনাতে থাকেন, তাহ’লে ওদের টুটি চেপে ধরবে কে? পিতার কোলে শিশু নওশীন হত্যা ফোরাত নদীর তীরে হোসায়েন কোলে শিশু আছগার হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশ কি তবে কারবালা হ’তে চলেছে?
এছাড়াও ডবল মার্ডার, ট্রিপল মার্ডার, এইট মার্ডার, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, পত্র লিখে বা টেলিফোনে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায়, গৃহ নির্মাণ চাঁদা, ব্যবসা করার চাঁদা, জমি কেনার চাঁদা ইত্যাকার সন্ত্রাসী চাঁদাবাজির সাথে যোগ হয়েছে ফাইল চেপে রেখে বা আইনের ভয় দেখিয়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাঁদাবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতির অবাধ প্রতিযোগিতা। সরকারী প্রশাসনযন্ত্র এখন শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সরকারী অফিসে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয়, একথা হলফ করে বলা যাবে না। সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও মহা সম্মানের আসনে উপবিষ্ট মন্ত্রীদের ব্যাপারেও নানা কথা শোনা যায়। দেশের গুণীজনদের চাইতে দলীয় ক্যাডার ছোকরাদের দেখলে তাদের মুখে বিরল হাসি ফুটে ওঠে। ইলেকশনের পূর্বে দেওয়া শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সেই গরম গরম বক্তৃতা সচিবালয়ের এসি কক্ষে হিমশীতল হয়ে হারিয়ে গেছে। দেশ যেন চলছে নিতান্তই ভাগ্যের জোরে হাতে গণা কিছু সৎ মন্ত্রী, আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ত্যাগে ও সাহসিকতায়। যদিও এসব লোকদের কোন মূল্যায়ন সমাজে ও প্রশাসনে তেমন নেই বললেই চলে।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতির এই ব্যাপক উত্থান ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাবার পিছনে পর্যবেক্ষক মহল কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। (১) সরকারের ভিতরে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা (২) মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। যেহেতু দু’জন বাদে সবাই একদলীয়, সেহেতু এমনটি হওয়া প্রত্যাশিত ছিল না (৩) প্রশাসনের সর্বত্র রাজনৈতিক ও মেধাগত যোগ্যতা বিবেচনা না করে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ-বদলীর ঘটনা। বলা চলে যে, এর মধ্যেই পতনের বীজ লুক্কায়িত রয়েছে। কারণ ঘুষ টাইমবোমার চাইতে ধ্বংসকারী (৪) সুবিধাবাদীদের বেপরোয়া তৎপরতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মন্ত্রণালয়ে তদ্বিরকারীদের টিকিটি দেখা যেত না। এখন তদ্বিরের অত্যাচারে মন্ত্রী, এমপি ও সচিবদের জীবন ওষ্ঠাগত। এতেই বুঝা যায় দেশে আইনের শাসনের নামে এখন দলনেতাদের শাসন চলছে। যা সুবিধাভোগীদেরকে উৎসাহিত করবে (৫) অনেকেই বর্তমান অবস্থার জন্য চিহ্নিত মহলের সুপরিকল্পিত অপতৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বিষয়টি একেবারেই ‘ওপেন সিক্রেট’। প্রশাসন ও সরকারী দলের নীতি নির্ধারকগণ তাদেরকে জানেন ও তাদের অপতৎপরতা ও কূটকৌশল সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত। তবুও তাদেরকে এ সুযোগ তারা কেন দিচ্ছেন এটাই জনগণের প্রশ্ন (৬) সরকার সমর্থক নিবেদিতপ্রাণ পেশাজীবিদের প্রতি অবজ্ঞা ও নীতি-নির্ধারকদের গন্ডিবদ্ধ কোটারী চিন্তা-ভাবনা (৭) ক্ষমতাসীন দলের প্রায় সর্বস্তরে অধিকাংশের মধ্যে রাতারাতি বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার প্রবল উচ্চাশা (৮) অপরিপক্কদের হাতে যরূরী ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ফাইল সমূহ আটকে পড়ায় সিদ্ধান্ত দানে বিলম্ব হওয়া প্রভৃতি।
এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শসমূহ নিম্নরূপ :
(১) ৬০ সদস্যের বিশাল মন্ত্রীসভার আকৃতি ছোট করুন এবং দলের হৌক বা দলের বাইরের হৌক সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, আল্লাহভীরু ও যোগ্য লোকগুলিকে বাছাই করে প্রশাসনের গুরুত্বপূ্র্ণ পদসমূহে দ্রুত নিয়োগ দান করুন (২) ঘুষ, বখশিশ ও পার্সেন্টেজ খাওয়ার বিরুদ্ধে স্তর নির্বিশেষে সকলের প্রতি কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুন (৩) একক ইসলামী শিক্ষা ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা চালু করুন (৪) সর্বোপরি দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কঠোর ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলুন। মনে রাখতে হবে, চিরকাল এই জোট সরকার ক্ষমতায় থাকবে না। অতএব বর্তমানের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যদি তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাহ’লে তারা যেমন জনগণের নিঃস্বার্থ দো‘আ পাবেন, তেমনি আল্লাহর রহমত লাভে ধন্য হবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৫ম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০০২।