৮ জন নিরীহ শ্রমিকের
লাশের উপর দাঁড়িয়ে ল্যাংটা মেয়েদের নাচানাচি ও আতশবাজির মধ্য দিয়ে ল্যাটিন
আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে ফুটবলের ২০তম বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে গত ১৩ই জুন’১৪
শুক্রবার থেকে। যা শেষ হবে আগামী ১৪ই জুলাই সোমবার। অর্থাৎ ১৫ই শা‘বান থেকে
১৬ই রামাযান পর্যন্ত মাসাধিক কাল যাবৎ। লেখাপড়া, ইবাদত ও অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম সমূহ চরমভাবে ব্যাহত হবে। ২২০টিরও বেশী দেশে এই ফুটবল
খেলা দেখানো হচ্ছে। যা বাংলাদেশে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬-টা পর্যন্ত চলে।
৩২টি দল যে সোনার ট্রফির জন্য লড়ছে, সেটি নকল ট্রফি। আসলে ব্যাপারটি
অন্যখানে। এটি এখন খেলা নয়। বরং পুঁজিপতিদের বিশ্ববাণিজ্যের জন্য পাতানো
ফাঁদ মাত্র। সার্কাসের হাতি-বানরগুলির মত এরা ভাড়াটে খেলোয়াড়দের কাজে লাগায়
পয়সা উপার্জনের জন্য। সেকারণ বিশ্বকাপকে এখন বলা হয় ‘মানি মেশিন’ বা টাকা
বানানোর যন্ত্র। অথচ বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষ এর মাধ্যমে কিছুই পায়না কেবল
ক্ষতি ছাড়া। আর তাই খোদ ব্রাজিলেই চলছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও
মিছিল-মিটিং। সেদেশের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য খ্যাতনামা ফুটবলার রোমারিও
পর্যন্ত বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ
আফ্রিকার খ্যাতনামা ক্রিকেটার অ্যালান ডোনাল্ড বিশ্বকাপ ক্রিকেট বন্ধ করে
দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা? সর্বত্র
বিবেকহীনদের জয়-জয়কার। নিষ্ঠুর পুঁজিপতিচক্র ও তাদের বশংবদ জাতীয় সরকার এবং
মিডিয়ার মত আসুরিক শক্তি এর পিছনে কাজ করছে। সবকিছু ধ্বংস হৌক, তাদের চাই
টাকা, কেবলি টাকা। আল্লাহ বলেন, অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে)
গাফেল রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও। কখনই না। শীঘ্র তোমরা
জানতে পারবে। অতঃপর কখনোই না। শীঘ্র তোমরা জানতে পারবে’ (তাকাছুর ১-৪)।
ক্ষতিসমূহ :
১. সময়ের অপচয় : এটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি। অথচ এটাই সবচেয়ে সস্তায় ব্যয় হয়। সময়ের মূল্য সম্বন্ধে মানুষ উদাসীন। অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদের হিসাব মতে একটানা টিভি দেখলে প্রতি ঘণ্টায় ২২ মিনিট আয়ু কমে যায়। এক্ষণে কেউ যদি দিবারাত্রি ক্রিকেট আর রাত জেগে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখে, যা প্রায় সারা বছর ধরেই চলে প্রায় সব দেশে, তাহ’লে মানুষের বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ কি? তাদের দ্বারা দেশ ও জাতি কি আশা করতে পারে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তুমি পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত মনে কর। (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে’ (হাকেম হা/৭৮৪৬)।
২. অর্থের অপচয় : প্রিয় দলের জার্সি ও সেদেশের পতাকা বানানো ও টাঙানো থেকে শুরু করে কত ধরনের যে অর্থের অপচয় হয়, তার হিসাব করা সম্ভব নয়। খেলা হচ্ছে ব্রাজিলে কিন্তু উন্মাদনায় কাঁপছে বাংলাদেশ। মনে হচ্ছে যেন দেশে কোন সমস্যাই নেই। সম্প্রতি ঝিনাইদহে ১০ কিলোমিটার ব্যাপী দীর্ঘ পতাকা ও তার পিছনে কয়েকশ’ তরুণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে বিশ্বকে দেখিয়েছে যে, আমরা অমুক দলের সমর্থক। অথচ তারা ভালভাবেই জানে যে, এতে কোন ফায়েদা নেই। কেননা খেলায় হারজিত থাকবেই। এটা ভাগ্যের ব্যাপার। এ বছরের শুরুতে ঢাকায় আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট আয়োজনে আমাদের সরকার নাকি ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। যার সবটুকুই পানিতে গেছে। যে দেশের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেদেশের সরকারের এই অপচয়ের শাস্তি জনগণ দিতে পারবে না। কিন্তু মহান বিচারক আল্লাহর শাস্তি থেকে কেউ বাঁচতে পারবে কি? আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী যারা হজ্জ ও কুরবানী না করে সে পয়সা গরীবদের দিতে বলেন, তারা কিন্তু বিশ্বকাপের সর্বগ্রাসী অপচয়ের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেন না। সেই সাথে রয়েছে বাজিকরদের জুয়া। যাতে দৈনিক সর্বস্ব খোয়ায় হাযারো মানুষ।
৩. লেখাপড়ার ক্ষতি : বিশ্বকাপ উন্মাদনার বড় শিকার হ’ল তরুণ ছাত্র ও যুবসমাজ। এরা লেখাপড়া ছেড়ে রাত জেগে খেলা দেখছে। আর নিজ হাতে নিজেদের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। সারা দিন হৈ হৈ আর শ্লোগান দিচ্ছে প্রিয় দলের নামে। ওঠায়-বসায়-খাওয়ায় একটাই আলোচনা ‘বিশ্বকাপ’। এভাবে জাতির মেরুদন্ড তরুণ সমাজ ধ্বংস হচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
৪. নৈতিক স্খলন, পাপাচার ও হত্যাকান্ড : বিশ্বকাপের উন্মাদনায় পৃথিবীতে পাপাচারের সয়লাব বয়ে যায়। বিশেষ করে যেসব দেশে ধর্মীয় কালচার নেই বা থাকলেও শিথিল, সেসব দেশকে নৈতিক স্খলন ও পাপাচার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত গ্রাস করে। ব্রাজিল হ’ল ফ্রি সেক্সের দেশ। তদুপরি বিশ্বকাপ মওসুমে সেদেশের হোটেলগুলিতে এখন দেহ ব্যবসা রমরমা। সেখানকার বিশ্বকাপ ভেন্যুগুলি এখন অঘোষিত পতিতাপল্লী। সেই সাথে রয়েছে প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে ছিনতাই, রাহাযানি ও হত্যাকান্ড। যার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে সেদেশের বিবেকবান মানুষ। গত ১৮ই জুন নাটোরে জনৈকা কৃষকবধু (২২) তার রাত জেগে টিভিতে খেলা দেখা স্বামীকে (২৫) হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে নিজ ঘরেই হত্যা করেছে। কিন্তু তাতে কি বিবেক জেগেছে আমাদের?
আগামী ২০২২ সালের বিশ্বকাপ হবে কাতারে। ২০১২ সাল থেকেই শুরু হয়েছে তার প্রস্ত্ততি। কেবল অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হবে ২০০ বিলিয়ন ডলার। খেলার পরে যা পড়ে থাকবে নষ্ট বর্জ্যের মত। তাহ’লে কেন এই অপচয়? অথচ আল্লাহ বলেন, অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই (ইসরা ২৭)। লন্ডনের বিখ্যাত ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের প্রচন্ড গরমে হাড়ভাঙ্গা খাটুনীতে প্রয়োজনীয় পানি ও ন্যায্য পারিশ্রমিক বঞ্চিত হতভাগ্য শ্রমদাসদের অধিকাংশ নেপাল, ভারত ও শ্রীলংকার নাগরিক। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ জন শ্রমিক মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বকাপের পর্দা ওঠার আগেই সেখানে অন্ততঃ ৪০০০ শ্রমিক মারা যাবে। এদের অধিকাংশের বয়স ২০ বছরের নীচে। বর্তমানে সেখানে দৈনিক ১২ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। আগামীতে আরও ১০ লাখ যোগ দেবে। ব্যাপক সমালোচনার জবাবে আয়োজক কমিটি ও সরকার মুখস্ত গৎ বলছেন, সবকিছু আইন মোতাবেক চলছে। কোন অসঙ্গতি থাকলে প্রমাণ সাপেক্ষে তারা ব্যবস্থা নেবেন’। অসহায় বিদেশী শ্রমিকরা হিংস্র সরকারী ঠিকাদার ও নিষ্ঠুর প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিভাবে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করবে? তাহ’লে কি মরু বালুকার বুক চিরে বেরিয়ে আসা আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা তেলের টাকায় ফেঁপে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেররা শ্রমিকদের রক্তে ভেজা মাটিতে বিশ্বকাপের জাহান্নামী আসর সাজাতে চায়?
পরিশেষে বলব, বিশ্বকাপ খেলা কখনো বিশ্বকে বাঁচায় না, বরং বিনাশ করে। তাই এসব সর্বনাশা প্রতিযোগিতা অবিলম্বে বন্ধ করুন। মুসলিম রাষ্ট্রনেতারা আল্লাহর নিকটে জবাবদিহিতার ভয় থেকে সর্বাগ্রে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হৌন। তরুণ সমাজ এগুলি বয়কট কর। যদি তোমরা বাঁচতে চাও। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।