দুর্নীতি ও কোটা সংস্কার আন্দোলন

সম্প্রতি দেশের সরকার ও প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির যে ভয়াল চিত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রায় প্রতিদিন হচ্ছে, তা কল্পনাকেও হার মানায়। সেই সাথে বিসিএস ও পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফঁাস জালিয়াতিতে জড়িত ড্রাইভারসহ ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের জনৈক কর্মচারীর শত শত কোটি টাকার অঢেল সম্পদের হিসাব হৃদকম্পন ধরিয়েছে দেশের সচেতন নাগরিকদের। যার বিক্ষুব্ধ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক কোটা বাতিল বা সংস্কার আন্দোলনে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকারী চাকুরীতে কোটা রাখা হয়। যেমন মুক্তিযোদ্ধা কোটা, যেলা কোটা, নারী কোটা, উপজাতি তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ইত্যাদি। কিন্তু এটি চিরন্তন কোন ব্যবস্থা নয়। আর বর্তমানে সরকারী চাকুরীতে যে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, তা কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বিশেষত আমাদের পর্যবেক্ষণের বিষয় হ’ল বিদ্যমান মুক্তিযোদ্ধা কোটা। প্রশ্ন হ’ল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? তাদেরকে সনদ দিতে গেলেও তারা সনদ নেননি। বরং পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি, সার্টিফিকেটের জন্য নয়। এর বিনিময়ে আমরা কিছুই চাই না। আমাদের পরিচিত ৮৬ বছরের শয্যাশায়ী জনৈক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমার জানা মতে সাড়ে ৬ হাযারের বেশী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি আরেক বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ উদ্দীন আহমাদ বলেছেন, ৮০ হাযারের বেশী নয়। অথচ আমরা শুনতে পাই সরকারী হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছেন আড়াই লাখের মত। এখন তাদের নাতি-নাতনীদের ও তস্য নাতি-নাতনীদের যুগ যুগ ধরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিতে হবে। অথচ তারা নিজেরাই এটা চায় না এবং তারাই কোটা বাতিলের আন্দোলন করছে। আর বর্তমানে তারা পিছিয়ে পড়া কোন জনগোষ্ঠীও নয়। সুতরাং বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা একটা বৈষম্যমূলক কোটা ছাড়া কিছুই নয়। অতঃপর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটার সুবিধা পাওয়ার কথা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৫টি ও অন্যান্য যেলায় বসবাস রত ১৫টি সহ ৫০টি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের। কিন্তু সেখানে একচেটিয়াভাবে পেয়ে আসছে কেবল চাকমারা। একই পরিবেশে বসবাসকারী পার্বত্য বাঙালী মুসলমানদের কোন কোটা নেই। এগুলি নিঃসন্দেহে অবিচার। আমরা মনে করি, কেউ যখন একবার কোটা পেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে চলে আসবে, তখন তাদের বাদ দিয়ে একই কোটাভুক্ত পিছিয়ে পড়াদের অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক।

বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরীতে মোট কোটা ৫৬ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯৬ শতাংশই কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। যার অধিকাংশই মেয়েদের জন্য নির্ধারিত। বাকি ক্ষুদ্র যতটুকু আছে, তাতেও চলে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফঁাসের অনৈতিক ব্যবসা। ফলে মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় সরকার ও প্রশাসনের সর্বত্র এখন অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য। আর সেকারণেই কোটা বাতিলের আনেদালনে সকল দল-মতের শিক্ষার্থীরা জান বাজি রেখে এগিয়ে এসেছে। তাদের বিষয়টি সহনশীলতার সাথে বিচার না করে সরকার নিষ্ঠুরের মত গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করেছে। বলা হয়ে থাকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানী পুলিশের গুলিতে সালাম-বরকত, রফীক-জববার নিহত হয়। তাদের পথ বেয়ে দেশ স্বাধীন হয়। এখন গত কিছু দিনে যে শতাধিক তাজা প্রাণ বুলেটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল, যাদের খেটে খাওয়া বাপ-মাদের নিকটে এই সরকার কি নামে চিহ্নিত হবে? এটা কি তাহ’লে গণতন্ত্রের বুলেট হিসাবে প্রশংসিত হবে? রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ কখনো ভাবতেও পারেনি যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের পুলিশ তার বুক ঝঁাঝরা করে দিবে। সে টিউশনী করে গরীব বাপ-মায়ের সংসার চালাতো। সরকার কি এখন তাদের দায়িত্ব নিবে? আমরা মনে করি, যে পুলিশ সদস্য তাকে হত্যা করেছে, তাকে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় আনা হোক। সঙ্গে সঙ্গে কোটা বাতিলের আন্দোলনে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, যাদেরকে আহত করে পঙ্গু করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হৌক! সেই সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহৃত ‘ছাত্র রাজনীতি’ চিরতরে নিষিদ্ধ করা হৌক! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাজনীতি মুক্ত এবং সেখানে শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা হৌক!

বর্তমান কোটা বাতিলের আন্দোলন দল-মত নির্বিশেষে সকল মানুষের হৃদয় কেড়েছে। কেননা এটিকে তারা দুর্নীতি দমন ও মেধাহীনদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য আন্দোলন হিসাবে গ্রহণ করেছে। যদিও আন্দোলনের নামে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অপরদিকে কোটা বাতিল বা সংস্কার আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের অদূরদর্শী ও বালখিল্য পদক্ষেপ আমাদেরকে হতবাক করেছে। আলোচনার টেবিলে বসেই যে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল, সেখানে অনর্থক বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে পুরা দেশকে অচল করে দেওয়া কোন দায়িত্বশীলতার কাজ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় ন্যাক্কারজনক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।

আমরা সরকারের প্রতি জোরালো দাবী জানাই, কোটা ব্যবস্থা যেন চিরস্থায়ী কোন ব্যবস্থা না হয়। যদি রাখতেই হয়, তবে সেটা যেন কোনক্রমেই ১০ শতাংশের বেশী না হয়। মেধাবী ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে এর কোন বিকল্প নেই। অপরদিকে দেশের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেয়ার নামে জনগণের উপর ভ্যাট ও নানাবিধ ট্যাক্সের বোঝা চাপানো বন্ধ করতে হবে এবং টাকা পাচারকারী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সঁাড়াশি অভিযান চালাতে হবে। সর্বাগ্রে সরকারী অফিস ও আদালতগুলিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের দেশ ও সমাজকে সকল প্রকার দুর্নীতি ও বৈষম্য হ’তে রক্ষা করুন- আমীন! (স.স.)






বিষয়সমূহ: রাজনীতি
অস্ত্র ব্যবসা বনাম মানবিক কূটনীতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইল্ম ও আলেমের মর্যাদা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাঁচার পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভালোবাসি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আহলেহাদীছ তাবলীগী ইজতেমা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বাংলাদেশের সংবিধান হৌক ইসলাম - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
করোনা ও রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংবিধান পর্যালোচনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুরসির বিদায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আত্মহত্যা করবেন না - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
নিউজিল্যান্ড ট্রাজেডী : চরমপন্থার পরাজয় ও মানবতার বিজয় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিশু আয়লানের আহবান : বিশ্বনেতারা সাবধান! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.