‘আল্লাহু
আকবর’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)। দু’টি শব্দের এই বাক্যটি আল্লাহর
সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এটি মুমিনের ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। এটি সৃষ্টিকর্তার
প্রতি সৃষ্টিজগতের স্বভাবজাত ঘোষণা। অতি বড় নাস্তিকও বিপদে পড়লে স্রেফ
আল্লাহকে ডাকে। কিন্তু যুগে যুগে শয়তান মানুষের এই স্বভাবধর্মের উপর হানা
দিয়ে ঈমানদারগণকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। শিরক ও কুফরের চাকচিক্য দিয়ে
তাওহীদকে আড়াল করতে চেয়েছে। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানুষকে আল্লাহর
দাসত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষকে তার নিজের প্রতি
দাসত্বের আহবান জানিয়েছে। অবশ্য এজন্য সে আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে স্বীকার
করেছে। অতঃপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ হায়াত লাভ ও সে পর্যন্ত মানুষকে
পথভ্রষ্ট করার অনুমতি প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ তার সে প্রার্থনা মনযূর
করেছেন। সাথে সাথে বলে দিয়েছেন, তুমি আমার মোখলেছ বান্দাদের কখনোই পথভ্রষ্ট
করতে পারবে না (হিজ্র ৩৬-৪২)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যখন পথভ্রষ্ট
হয়েছে, তখন তাদের পাপের প্রতিফল হিসাবে একে একে পৃথিবীর ৬টি জাতি
ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তারা হ’ল কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত, মাদিয়ান ও কওমে
ফেরাঊন। এরপরেও শয়তান থেমে যায়নি। ইরাকের সম্রাট নমরূদের উপর সওয়ার হয়ে সে
তাওহীদের আপোষহীন বাণীবাহক জীবন্ত ইব্রাহীমকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ
করে পুড়িয়ে ভস্ম করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে আগুন ঠান্ডা হয়ে যায় ও
ইব্রাহীমের উপর শান্তিদায়ক হয়ে যায়’ (আম্বিয়া ৬৯)।
পরবর্তীতে ইব্রাহীম ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র ইসমাঈলের হাতে গড়া কা‘বাগৃহের খাদেম ও তত্ত্বাবধায়ক কুরায়েশ বংশের নেতাদের উপর সওয়ার হয়ে শয়তান তাদেরকে মূর্তিপূজায় প্রলুব্ধ করে। ফলে তাওহীদের স্বচ্ছ আকাশে শিরকের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়। ‘আল্লাহু আকবর’-এর সাথে লাত-মানাত, ওযযা-হোবলের জয়ধ্বনি ওঠে। শিরকের শিখন্ডী হ’লেও তারা কিন্তু কথায় কথায় আল্লাহর নামে শপথ করত। সবকাজে আল্লাহকেই সাক্ষী মানত। অতঃপর আল্লাহ চাইলেন বিশ্বের এই সেরা বংশটিকে খালেছ তাওহীদে ফিরিয়ে আনতে। তাই তাদের মধ্য থেকেই পাঠালেন বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে। সেই সাথে পাঠালেন চিরন্তন সত্যের উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। শয়তান সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করল এই দুর্বার তাওহীদী আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য। মক্কার প্রায় সব নেতাকে শয়তান কব্জায় নিল। ফলে শুরু হ’ল হিজরত ও নুছরতের পালা। ছড়িয়ে গেল তাওহীদের দাওয়াত হাবশা, ইয়াছরিব ও পারস্য এলাকায়। জান্নাত পাগল হৃদয়গুলি সব জমা হয়ে গেল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ঝান্ডাতলে। শুরু হ’ল সম্মুখ সমর। একে একে সৃষ্টি হ’ল বদর, ওহোদ, খন্দক ও সবশেষে তাবূকের বিজয়াভিযান সমূহ। সবখানেই শ্লোগান ছিল ‘আল্লাহু আকবর’।
মুসলমান দৈনিক আযান-এক্বামত ও ছালাতে, ঈদায়নে, হজ্জ ও ওমরাহতে, আইয়ামে তাশরীক্বে, জানাযাতে সর্বত্র ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করে। হজ্জের অনুষ্ঠান সমূহে বিশেষ করে ৩টি জামরায় শয়তানের প্রতি কংকর নিক্ষেপের সময় উচ্চ কণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে। অর্থাৎ এটি শয়তানের বিরুদ্ধে আল্লাহর একত্বের ও বড়ত্বের দ্ব্যর্থহীন শ্লোগান।
ইতিহাসের পবিত্রতম শ্লোগান হ’ল ‘আল্লাহু আকবর’। এই শ্লোগান বিশ্বাসী হৃদয়ে বিদ্যুতের চমক সৃষ্টি করে। এর ফলে তার মধ্যে বিশ্বজয়ী শক্তির উত্থান ঘটে। আল্লাহর পথে সবকিছুকে সে তুচ্ছ জ্ঞান করে। আল্লাহর উপর ভরসা করে সে নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার মূল চেতনা হ’ল ‘আল্লাহু আকবর’। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়েছে। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে ‘বাংলাদেশ’ নামে পৃথিবীর বুকে পৃথক রাষ্ট্রীয় মানচিত্র দান করেছে। পিছন দিকে তাকালে দেখতে পাই, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ১৪ই সেপ্টেম্বর সিলেট আগমন উপলক্ষ্যে ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে প্রচারিত বিজ্ঞাপন : নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর। দেখতে পাই ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর, আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’। দেখতে পাই ১৯৭০ সালের ৬ই নভেম্বর বগুড়ার গুজিয়া হাইস্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভার বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর’। শুনতে পাই ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী রবিবার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) প্রধান অতিথির ভাষণ শেষে শেখ মুজিবের ভরাট কণ্ঠের গগণভেদী সমাপ্তি শ্লোগান ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ (সূত্র : ঢাকা, দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা জানুয়ারী সোমবার ১৯৭১/১৯শে পৌষ ১৩৭৭)।
অতঃপর ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ভোরের দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ৪ দিন যাবত বন্দী মেজর জিয়া সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে সিপাহী-জনতা হাযারো কণ্ঠে ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেয়। সেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দল ‘বিএনপি’ নেতাদের এখন এই শ্লোগানে এলার্জী কেন? এর বিরুদ্ধে বস্ত্তনিষ্ঠ তকমাধারী সাংবাদিক ও কোন কোন পত্রিকার গাত্রদাহ কেন?
‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান যে এদেশের মানুষকে কিরূপ উজ্জীবিত করে, সেটা অতি সম্প্রতি সবাই দেখেছে গত ১২ই অক্টোবর’২২ বুধবার বিকালে চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ড ময়দানে ‘বিএনপি’ আয়োজিত জনসভায় সাবেক ডাকসাইটে ‘বিএনপি’ নেতার পুত্রের ‘নারায়ে তাকবীর’ শ্লোগানের সাথে সাথে লাখো জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি। কিন্তু পরের দিন ‘বিএনপি’র স্থানীয় প্রবীণ নেতা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে দিলেন যে, এটি তাদের দলীয় শ্লোগান নয়। বরং দাতার ব্যক্তিগত শ্লোগান’। এতে দলের মধ্যে ও সারা দেশে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রশ্ন হ’ল, এর মাধ্যমে নেতারা কাদের খুশী করতে চান? রাজনৈতিক দলগুলি কি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে? নাকি নেপথ্যের অন্য কারও? পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে যখন ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে অস্বীকার করায় প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যখন সেদেশে মাইকে আযান দিতে নিষেধ করা হয়, তখন এইসব রাজনীতিকদের মুখে কুলুপ অাঁটা থাকে কেন? আল্লাহ বলেন, ‘যারা আখেরাতে বিশ্বাস করেনা, তাদের সামনে যখন এককভাবে কেবল আল্লাহর কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তরগুলো ভয়ে সংকুচিত হয়ে যায়। আর যখন তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কথা বলা হয়, তখন তারা উল্লসিত হয়’ (যুমার ৪৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আযান ও এক্বামতে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শুনলে শয়তান বায়ু নিঃসরণ করতে করতে ছুটে পালায় ও পরে ফিরে আসে’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৬৫৫)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর একে একে জুনাগড়, মানভাদর, গোয়া, হায়দরাবাদ, কাশ্মীর এবং সবশেষে ১৯৭৫ সালের ১লা মে সিকিম প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্যগুলি প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির গ্রাসে চলে যায় কেবল নেতাদের ভুলের কারণে। অতএব নেতারা সাবধান! পরিশেষে বলব, কথায় ও কর্মে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগানের সত্যিকার অনুসারীরাই এদেশে সর্বদা বিজয়ী থাকবে এবং তারাই আল্লাহর রহমত লাভে ধন্য হবে ইনশাআল্লাহ (স.স.)।