বাংলাদেশের
পূর্ব সীমান্তের কুমিল্লা যেলার তিতাস থানার সন্নিকটে গোপালপুর গ্রাম
অবস্থিত। এর আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অতি মনোরম। এখানকার কিছু মানুষ
ধর্মীয় ফিৎরাতের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে, নিজেদের স্বকীয়তা ও অনন্য
বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে, চির জাগ্রত তাওহীদকে আলিঙ্গন করেছে। শিরক ও
জাহেলিয়াতের শিখন্ডী বিজাতীয় মতবাদকে ডাষ্টবিনে নিক্ষেপ করে, কুচক্রী মহলের
সকল চক্রান্তকে উপেক্ষা করে, তাক্বলীদের জিঞ্জির ছিন্ন করে, গীবত-তোহমত ও
মিথ্যাচারকে তুচ্ছজ্ঞান করে, বিশ্ববিজয়ী মুহাম্মাদী আদর্শকে এরা গ্রহণ
করেছে। অসীম ধৈর্যের সাথে সকল ষড়যন্ত্রকে পদদলিত করে এই তরুণ ছাত্র ও যুব
সমাজের দুর্দমনীয় কাফেলা অহী-র আলোকে নিজেদের সমাজকে ঢেলে সাজাতে দৃঢ়
প্রত্যয়ী।
একদিকে আপোষহীন সুন্নাত পন্থী গুটি কতক মানুষের দুর্বার কাফেলা অন্যদিকে খৈ ভাজা বালুর চাইতেও উত্তপ্ত তাক্বলীদপন্থী জনসমুদ্র। একদিকে ডাকা হচ্ছে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসরণের দিকে। অন্যদিকে চরম দাম্ভিক আত্মগরিমা সম্পন্ন দস্যুস্বভাব পাপাত্মা ও রক্ত লুলোপ জিহবা বার বার ধেয়ে আসছে এ আদর্শকে দংশন করে নির্মূল করে দেয়ার জন্য।
শত নির্যাতন-নিপীড়ণ, হাযারো প্রতিকূলতা, বাধার হিমাদ্রিশিখর পেরিয়েও হকের পথে টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টারত জান্নাত পিয়াসী একদল মানুষ তাদের জিহাদী জীবনের ছিটেফোঁটা তুলে ধরার প্রয়াসেই এ লেখার অনুপ্রেরণা।
১৯৯৯ইং সালের কথা। জীবিকার তাকীদে ডা. সাখাওয়াত হোসাইন নামক জনৈক ব্যক্তি সঊদী আরবের তায়েফে যান। সেখানে প্রায় চার মাস অতিবাহিত হ’লে ‘তায়েফ ইসলামিক সেন্টার’-এর একজন বাঙ্গালী শিক্ষকের মাধ্যমে ছহীহ আক্বীদার দাওয়াত পান। আক্বীদা-আমল, তাওহীদ-শিরক, সুন্নাত-বিদ‘আত সহ বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স করেন এবং দীর্ঘদিনের লালিত আক্বীদা পরিবর্তন করেন। ৫ বছর ২ মাস পর দেশে ফিরে এসে অর্জিত অহী-র জ্ঞানের মর্মকথা একই গ্রামের আখতার বিন আব্দুল বারেককে জানান। তাকে এ দাওয়াত দিলে তিনি তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেন। আবার একই গ্রামের তরুণ আবুল বাদশা বিন আব্দুর রাযযাক সঊদী থেকে সংগ্রহকৃত মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈলের অডিও ক্যাসেটের দলীল ভিত্তিক বস্ত্তনিষ্ঠ আলোচনা শুনে তার বক্তব্য পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করে এক পর্যায়ে সেও আহলেহাদীছ হয়ে যায়।
এই তিন জন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল যেহেতু হক্বের সন্ধান পেয়েছি এ হক্বের অমিয় বাণী গ্রামের অন্যদেরকেও জানিয়ে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা কাজ করতে থাকে। তারা দিকভ্রান্ত মুসলমানদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য আত্মনিয়োগ করে। ফলে তরুণরা মাযহাবী তাক্বলীদের জিঞ্জির মুক্ত হয়ে বাঁধভাঙ্গা গতিতে সঠিক আক্বীদার প্লাটফরমে সমবেত হ’তে থাকে।
এই অগ্রগতি কুচক্রী মহলের সহ্য হ’ল না। সূক্ষ্ম দূরভিসন্ধি এঁটে দুর্দমনীয় যুব কাফেলাকে বাঁধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। গোপালপুরের আকাশ যখন ষড়যন্ত্রের ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেল, যমীনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হ’ল ঠিক ঐ মুহূর্তে পূর্ব গগনে ঘন মেঘ ভেদ করে আল-হেরার আলোর ঝিলিক উদ্ভাসিত হ’ল এবং তার আলোয় আলোকিত হ’ল এক ঝাঁক তরুণ। গোপালপুর ও পার্শ্ববর্তী চেঙ্গারতুলী, বাঘাইরামপুর, যিয়ারকান্দি, দড়িকান্দির প্রায় অর্ধশত পুরুষ-মহিলা শরীক হয় ঐ কাফেলায়। অতঃপর তারা সমাজে প্রচলিত শিরক-বিদ‘আত ও বিভিন্ন প্রকার জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে, প্রচলিত আক্বীদার বিরুদ্ধে আপোষহীন দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। তারপর দুর্নীতিবাজ সমাজ মোড়লদের যোগসাজশে শুরু হয় বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ, আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বৈঠক, লিয়াজো সমাবেশ, কখনো হুমকি ধমকি, কখনোবা দা-বটি নিয়ে ধাওয়া। আবার কখনো সমাজ থেকে বহিষ্কারের হুমকি, কখনো বাপ-দাদার ধর্মে পুনরায় ফিরে এলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফুলের মালা দিয়ে গ্রহণ করার আশ্বাস সহ নানান প্রস্তাব পেশ করা হয়। উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে কেটে গেল ১০-১২টি বছর।
সাম্প্রতিক কালে নতুন আহলেহাদীছগণের ব্যাপারে বিচার দায়ের করা হয় এ মর্মে যে, নতুন দলের লোকজন মসজিদে এসে ছালাতে জোরে আমীন বলে, ঘোড়ার লেজের মতো হাত নাড়াচাড়া করে, এতে আমাদের ছালাতের মনোযোগ নষ্ট হয়। এরা ওহাবী, এদের ব্যাপারে যরূরী ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে গ্রাম্য সালিশে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এরা মসজিদের জামা‘আতের আগে অথবা পরে ছালাত আদায় করবে। সমাজের অন্যান্য লোকের সাথে জামা‘আতে এদের স্থান দেওয়া যাবে না। এর প্রেক্ষিতে আহলেহাদীছগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ‘গোপালপুর ড. মোশাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে’র বারান্দায় জুম‘আর ছালাত আদায় করবেন। এহেন পরিস্থিতিতে নিজেদের একজন মসজিদ তৈরীর জন্য জায়গা দিতে চাইলে স্থানীয় মসজিদের মুয়াযযিন বাধা সৃষ্টি করে। আর এ ব্যাপারটি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় সামাজিক বিশৃংখলা, হুংকার, তর্জন-গর্জনের নীনাদ। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, দোকানপাট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুখে মুখে একই কথা গুঞ্জরিত হচ্ছে। এরা পালাবার পথ খুঁজে পাবে না। কারণ তারা দীর্ঘদিনের সাজানো গোছানো সামাজিক অবয়বকে নষ্ট করেছে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয়-স্বজনের দীর্ঘ দিনের বন্ধনে ফাটল সৃষ্টি করেছে। প্রাচীন কাল হ’তে চলে আসা ধর্মীয় বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছে। সমাজের সার্বিক পরিস্থিতিকে যন্ত্রণাদায়ক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই এদেরকে দমাতে হবে। তাদের নতুন কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে।
শুরু হয়ে গেল পাশাপাশি তিন গ্রামের মোড়লদের যৌথ ইশারায় মসজিদে মসজিদে মাইকিং-শ্লোগান ও মিছিল। ‘ওহাবী ঠেকাও, ঈমান বাঁচাও; ওহাবী মত ছাড়, নূর নবীর পথ ধর; ওহাবীদের আস্তানা, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও; ঈমান চোরদের ধরিয়ে দাও, নগদ ছওয়াব লুফে নাও; আমেরিকার দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান! ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকে। এলাকার মাযহাবী লোকেরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হয়ে হই হই রই রই ও ঘোর হট্টগোলে অংশ নেয়। অতঃপর এশার ছালাতের পর লাঠি-সোটা, ইট-পাটকেল ইত্যাদি সহ হায়েনারা প্রথমে আঘাত হানে বৃহত্তর গোপালপুরের প্রথম আহলেহাদীছ ডা. সাখাওয়াত হোসাইনের চেম্বারে। এরা দোকান ভাংচুর ও বেশ ক্ষয়-ক্ষতি করে সেখানে। শত শত লোক মিছিল করে একের পর এক নতুন আহলেহাদীছদের বাড়ীতে তাদেরকে ধরার জন্য ধাওয়া করে। মিছিল এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে এলোপাথাড়ি। সশস্ত্র মিছিলের তান্ডবে আহলেহাদীছ লোকজন আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে আবু যার নামক নব আহলেহাদীছ আটকা পড়ে যায় তার ভাই ও চাচাদের হাতে। তারা তাকে একটি কক্ষে বন্দি করে এবং চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি ও এলোপাথাড়িভাবে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। মাথায় আঘাতের কারণে ব্রেনে সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি অন্যদের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
পরদিন আবার গ্রাম্য সালিশ আহবান করে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত সমূহ নেওয়া হয় :
(১) ডা. সাখাওয়াতের ডিসপেন্সারী (ঔষধের দোকান) দুই মাসের জন্য খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হ’ল (২) বৃহত্তর গোপালপুরের কোন মসজিদে আহলেহাদীছরা ছালাত আদায় করতে পারবে না (৩) গোপালপুরের মাঠে-ময়দানেও ছালাত আদায় করতে পারবে না (৪) ছালাত আদায় করতে হ’লে একাই নিজ ঘরে ছালাত আদায় করবে (৫) দু’জন একত্রিত হ’তে পারবে না (৬) পারস্পরিক লেনদেন শলা-পরামর্শ, সকল প্রকার লিয়াজো বন্ধ থাকবে (৭) গ্রামে বসবাস করার জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হ’ল। এ ছয় মাসের ভিতরে উভয় পক্ষের আলেমদের এনে বাহাছের মাধ্যমে তাদের এ মতাদর্শ বুঝাতে হবে নতুবা অন্যত্র হিজরত করতে হবে (৮) এলাকার সর্বসাধারণের জন্য ফায়ছালা হ’ল- এখন থেকে ভিন্ন মতাদর্শের কাউকে ‘ওহাবী’ বলে তিরষ্কার করতে পারবে না।
উল্লেখ্য যে, আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কেউ কোনদিন সফল হয়নি। বরং তারা ব্যর্থ হয়েছে। আহলেহাদীছরাই খারেজী, শী‘আ সহ প্রভৃতি ভ্রান্ত দলের ফেৎনাকে অবদমিত করেছে; জাল-যঈফ হাদীছ, রায়-ক্বিয়াস ও বিভিন্ন ভ্রান্ত দর্শনের বিরুদ্ধে মযবূত কদমে আপোষহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; শিরক-বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পুরো বিশ্বকে প্রকম্পিত করেছে; দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন করে বিজয়ী নিশান ছিনিয়ে এনেছে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মর্যাদাকে সমুন্নত করতেই আহলেহাদীছরা যুগে যুগে জেল-যুলুম, ফাঁসি ও শাহাদত বরণ করেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই ভাবে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবে। কারণ তারা আহলেহাদীছ। তারা আল্লাহর সৈনিক।
জামীলুর রহমান বিন আব্দুল মতীন
কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা।