(১) সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নামধারী কিছু রাজনৈতিক ধর্মনেতা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবিরতভাবে মিথ্যাচার করে চলেছেন। তারা হানাফীদেরকে আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেবার অপকৌশল নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছেন এবং লিফলেট ছেড়ে ও বই লিখে অপপ্রচার করছেন। তাদের সকলের ভাষা প্রায় একইরূপ। যেমন,
‘ভারতবর্ষে মুসলমানদের দ্বারা বৃটিশ তাড়াও আন্দোলনের অগ্রনায়ক সৈয়দ আহমদ (রহঃ) বালাকোটের যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর ১৮৪০ সালের দিকে আব্দুল হক বেনারসী নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই দলটির উদ্ভব ঘটে। তার শরীয়ত বিরোধী কথাবার্তার কারণে মক্কা-মদীনার আলেমগণ তাকে হত্যার ফতোয়া দেন। এরাই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন ও জিহাদকে হারাম বলে ঘোষণা দেয়। প্রথমে তারা নিজেদের ওহাবী অথবা মোহাম্মদী বলে পরিচয় দিত। এদেশের মানুষ তাদেরকে রাফাদানী বা লা-মাযহাবী বলেই জানে। বৃটিশ সরকারের পদলেহী এই রফাদানী বা লা-মাযহাবী দলটির নেতা পাঞ্জাব প্রদেশের মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালভী নামক ব্যক্তি পাঞ্জাব প্রদেশের ইংরেজ গভর্ণরের নিকট ১৮৮৬ সালে এই বলে দরখাস্ত করে যে, আমরা সর্বদা ইংরেজ সরকারের হিতাকাঙ্খী ও শুভাকাঙ্খী। আমাদের নাম ওহাবী বা লা-মাযহাবীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তার পরিবর্তে আহলেহাদীছ রাখা হৌক।
পাঞ্জাব প্রদেশের ইংরেজ সরকারের ৩.১২.১৮৮৬ইং তারিখের ১৭৫৮ নং স্মারকে বাটালভীকে তার দরখাস্ত মঞ্জুরীর খবর দেওয়া হয়। এই আহলেহাদীছরাই ভারতে এভাবেই ইংরেজদের দালালী করেছিল।
এরপর থেকে তারা আহলেসুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিশেষ করে হানাফীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। খৃষ্টানদের অর্থে বেড়ে ওঠা এই গুমরাহ দলটি হানাফীদের মুশরিক বলতেও দ্বিধা করে না। তারা বলে হানাফীদের নামাজই হয় না’।
উপরের বিজ্ঞপ্তিটি সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত দু’টি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত। শুধু তাই নয়, এগুলি নিয়ে মেহেরপুর যেলা প্রশাসনের কাছে গিয়ে আহলেহাদীছের সভা-সমিতি বন্ধ করার জন্য গাংনীর স্থানীয় ‘বেদয়াতী দমন কমিটি’-র পক্ষ হ’তে লিখিতভাবে দাবী জানানো হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দকে গাংনী শহরে তারা ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠার শীর্ষ শিরোনাম ছিল, ‘হানাফীদের মধ্যে উত্তেজনা, ডঃ গালিবকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা’। তারা আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে জুম‘আর ছালাতের পর গাংনী উপযেলা শহরে মিছিল বের করার জন্য হানাফী জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। যদিও তারা তাতে সফল হয়নি। বরং সেখানে নির্ধারিত দিনে ও নির্ধারিত সময়ে আমীরে জামা‘আতের উপস্থিতিতে আহলেহাদীছের স্মরণকালের বৃহত্তম ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কোনরূপ বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই এবং এই সম্মেলনের মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে সেখানকার শতাধিক ব্যক্তি ‘আহলেহাদীছ’ হয়ে গেছেন এবং এখনো হচ্ছেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ। এক্ষণে এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য নিম্নরূপ :
আহলেহাদীছ-এর পরিচয় : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী ব্যক্তিকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে শর্তহীনভাবে মেনে নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের তরীকা অনুযায়ী নিজের সার্বিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন, কেবলমাত্র তিনিই এ নামে অভিহিত হবেন। এটি ইসলামের আদিরূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যা ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে এ যাবৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল শর্ত নয়।
ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন জামা‘আতে আহলেহাদীছের প্রথম সারির সম্মানিত দল। যাঁরা এ নামে অভিহিত হ’তেন। যেমন প্রখ্যাত ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কোন মুসলিম যুবককে দেখলে খুশী হয়ে বলতেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে ‘মারহাবা’ জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদীছ বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী আহলুল হাদীছ’।[1]
‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (মৃঃ ৫৬১ হিঃ) ‘নাজী’ ফের্কা হিসাবে আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বর্ণনা দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিদ‘আতীদের ক্রোধ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, বিদ‘আতীদের নিদর্শন হ’ল আহলেহাদীছদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন নামে তাদের সম্বোধন করা। এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় বিদ্বেষ ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আছহাবুল হাদীছ’ বা আহলেহাদীছ।[2] স্পেনের বিখ্যাত মনীষী হিজরী পঞ্চম শতকের ইমাম ইবনু হযম আন্দালুসী (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেন, আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যাদেরকে আমরা হকপন্থী ও তাদের বিরোধীদের বাতিলপন্থী বলেছি, তারা হলেন, (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ) আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছে’।[3] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেন, মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছদের অবস্থান এমন মর্যাদাপূর্ণ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের অবস্থান’।[4]
ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-৭৬/১৭০৩-৬২খৃঃ) বলেন, চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপর সংঘবদ্ধ ছিল না’।[5] হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১হিঃ) বলেন, মাযহাবী তাক্বলীদের এই বিদ‘আত আবিষ্কৃত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভাষায় নিন্দিত ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে[6] শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, আববাসীয় খলীফা হারূনুর রশীদের খেলাফতকালে (১৭০-৯৩/৭৮৬-৮০৯ খৃঃ) আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফ (রহঃ) প্রধান বিচারপতি থাকার কারণে ইরাক, খোরাসান, মধ্য তুর্কিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতি ঘটে’।[7] পরে হানাফীরা শাফেঈদের বিরুদ্ধে মোঙ্গলবীর হালাকু খাঁকে ডেকে আনলে ৬৫৬/১২৫৮ খৃষ্টাব্দে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়ে যায়।
এ সময়ের কিছু পূর্বে গযনীর সুলতান মোহাম্মাদ ঘোরীর তুর্কী গোলাম কুতুবুদ্দীন আইবক ও ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজীর মাধ্যমে ৬০২ হিঃ/১২০৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লী হ’তে বাংলা পর্যন্ত সামরিক বিজয় সাধিত হয়। এঁরা ছিলেন নওমুসলিম তুর্কী হানাফী। যাতে মিশ্রণ ঘটেছিল তুর্কী, ঈরানী, আফগান, মোগল, পাঠান এবং স্থানীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ আক্বীদা ও রীতি-নীতি সহ অসংখ্য ভারতীয় কুসংস্কার। ছাহাবা, তাবেঈন এবং আরব বণিক ও মুহাদ্দিছগণের মাধ্যমে ইতিপূর্বে প্রচারিত বিশুদ্ধ ইসলামের সাথে যার খুব সামান্যই মিল ছিল’। এ সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে খ্যাতনামা ভারতীয় হানাফী বিদ্বান আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (১৮৪৮-৮৬ খৃঃ) বলেন, ‘ফিক্বহ ব্যতীত লোকেরা কুরআন ও হাদীছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ...আহলেহাদীছগণকে তারা জানত না। কেউ কেউ ‘মিশকাত’ পড়লেও তা পড়ত বরকত হাছিলের জন্য, আমল করার জন্য নয়। তাহকীকী তরীকায় নয়। বরং তাকলীদী তরীকায় ফিক্বহের জ্ঞান হাছিল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য’।[8] সুলায়মান নাদভী (১৮৮৪-১৯৫৩) বলেন, ‘তুর্কী বিজয়ী যারা ভারতে এসেছিলেন, দু’চারজন সেনা অফিসার ও কর্মকর্তা বাদে তাদের কেউই না ইসলামের প্রতিনিধি ছিলেন, না তাদের শাসন ইসলামী নীতির উপর পরিচালিত ছিল। এরা ছিলেন আরব বিজয়ীদের থেকে অনেক দূরে’।[9]
তাই বলা চলে যে, মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত হয়ে তুর্কী-ঈরানী সাধক-দরবেশদের মাধ্যমে ও রাজশক্তির ছত্রছায়ায় পরবর্তীতে বাংলাদেশে যে ইসলাম প্রচারিত হয়, তা ইতিপূর্বে আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আগত প্রাথমিক যুগের মূল আরবীয় ইসলাম হ’তে বহুলাংশে পৃথক ছিল। ফলে হানাফী শাসক ও নবাগত মরমী ছূফীদের প্রভাবে বাংলাদেশের মুসলমানেরা ক্রমে হানাফী ও পীরপন্থী হয়ে পড়ে। তারা বহুবিধ কুসংস্কার এবং শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদেশের মূল শরীয়তী ইসলাম পরবর্তীতে লৌকিক ইসলামে পরিণত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ঘোড়াপীর, তেনাপীর, ঢেলাপীর প্রভৃতি অসংখ্য ভুয়া পীর বাংলার মুসলমানের পূজা পায়।[10]
শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, হানাফী মাযহাবের ক্বিয়াসী ফৎওয়া সমূহ এবং ফিক্বহ ও উছূলে ফিক্বহের নামে যেসব মাসআলা-মাসায়েল ও আইনসূত্র সমূহ লিখিত হয়েছে, সেগুলিকে ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর দুই শিষ্যের দিকে সম্বন্ধিত করার ব্যাপারে একটি বর্ণনাও বিশুদ্ধ নয়’।[11] তিনি ‘আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর পার্থক্য’ শিরোনামে তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্র মধ্যে (১/১৪৭-৫২) আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের দলীল গ্রহণের নীতিমালা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি মযহাবপন্থী মুক্বাল্লিদগণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি তাদের অনুসরণীয় বিদ্বানের তাক্বলীদ হতে সে বেরিয়ে আসে, তাহলে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে’।[12] তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে, ঐ ব্যক্তি আমার নিকট অধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তির চাইতে, যে ব্যক্তি রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে না। কেননা রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীছ সংখ্যায় অধিক এবং অধিকতর মযবুত’।[13] হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থ হেদায়া, আল-ওয়াজীয প্রভৃতির অমার্জনীয় হাদীছবিরোধিতা সম্পর্কে আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী বলেন, এগুলি মওযূ বা জাল হাদীছ দ্বারা পরিপূর্ণ।[14] ইমাম ইবনু দাক্বীকুল ঈদ (মৃ: ৭০২ হিঃ) চার মাযহাবে প্রচলিত ছহীহ হাদীছ বিরোধী ফৎওয়াসমূহের একটি বিরাট সংকলন তৈরী করেছিলেন। যার ভূমিকাতে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, এই মাসআলাগুলিকে চার ইমামের দিকে সম্বন্ধ করা ‘হারাম’।[15] কারণ চার ইমামের প্রত্যেকে ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন এবং তারা প্রত্যেকে বলে গেছেন, যখন তোমরা ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনে রেখ সেটাই আমাদের মাযহাব’।[16] আহলেহাদীছগণ তাঁদের সেকথাই মেনে চলেন এবং তাদের সার্বিক জীবন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
এক্ষণে লিফলেট-এর জবাব সমূহ :
১. ‘বালাকোট যুদ্ধের পর ১৮৪০ সালের দিকে আব্দুল হক বেনারসী নামক ব্যক্তির মাধ্যমে দলটির উদ্ভব ঘটে’।
এটি ডাহা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। এর বড় প্রমাণ বালাকোট যুদ্ধের সিপাহসালার আল্লামা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) নিজেই ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। যিনি ১২৪৬ হিঃ মোতাবেক ১৮৩১ সালের ৬ই মে শুক্রবার পূর্বাহ্নে বালাকোটে শহীদ হন। তাঁর সাথী শত শত মুজাহিদ ছিলেন আহলেহাদীছ। বাংলা ও বিহারের আহলেহাদীছ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদ আন্দোলনের ফসল। আব্দুল হক বেনারসী (১২০৬-৮৬হিঃ) ছিলেন আল্লামা শহীদের সহপাঠি এবং তিনি তাদের সাথে একত্রে হজ্জ করেন। দিল্লীতে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ইয়ামনে গিয়ে ইমাম শওকানীর (১১৭২-১২৫০ হিঃ) নিকট হাদীছ শিক্ষা করেন ও সনদ লাভ করেন’।[17] এর বেশী তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় না। বিরোধীরা অনেক নির্দোষ মানুষকে দোষী বানিয়েছে। তাঁকে নিয়ে যদি কেউ মিথ্যা রটনা করে থাকে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে তাঁর মাধ্যমে আহলেহাদীছ দলের উদ্ভব ঘটেছে বলে যে দাবী করা হয়েছে, এটা আকাট মূর্খরাই কেবল করতে পারে। বাংলাদেশে এমনামন বংশ রয়েছে, যারা কয়েক শত বছর যাবৎ আহলেহাদীছ। যেমন বৃহত্তর খুলনা-যশোর, ২৪ পরগনা, হুগলী, বর্ধমান অঞ্চলের আহলেহাদীছ আন্দোলনের নেতা মাওলানা আহমাদ আলীর (১৮৮৩-১৯৭৬ইং) বংশ। তাঁর ৭ম ঊর্ধ্বতন পুরুষ মাওলানা সৈয়দ শাহ নযীর আলী আল-মাগরেবী প্রথম আরব দেশ থেকে এদেশে হিজরত করেন এবং তাঁর বংশের শুরু থেকে এযাবৎ প্রায় সাতশো বছরের অধিককাল ধরে সবাই ‘আহলেহাদীছ’। তাছাড়া এই বংশে চিরকাল প্রতি স্তরে অন্ততঃ একজন করে যোগ্য আলেম ছিলেন’।[18]
২. ‘এরাই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন ও জিহাদকে হারাম বলে ঘোষণা দেয়’।
অথচ ইংরেজ-বিরোধী জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আহলেহাদীছগণ। খোদ আল্লামা শাহ ইসমাঈল (১১৯৩-১২৪৬/১৭৭৯-১৮৩১খৃঃ) ছিলেন যার প্রধান সেনাপতি। বালাকোট-পূর্ববর্তী পাঁচ বছর শিখবিরোধী জিহাদে আহলেহাদীছ হানাফী সকলে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বিরোধী আলেমদের চক্রান্তে বিশেষ করে মাওলানা মাহবূব আলী প্রমুখের প্ররোচনায় হানাফীদের অনেকে জিহাদ থেকে সটকে পড়েন। মৌলানা কারামত আলী জৌনপুরী (১২১৫-৯০/১৮০০-৭৩খৃঃ) তাদের অন্যতম। তিনি বাংলাদেশে এসে জিহাদ বিরোধী মত প্রকাশ করেন এবং ইংরেজের পক্ষে ফৎওয়া দেন। ১৮৭০ সালের ২৩শে নভেম্বর কলিকাতা মোহামেডান ল’ সোসাইটিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় বৃটিশ ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, এক্ষণে মুসলমান প্রজারা তাদের (ইংরেজ) শাসককে সাহায্য করতে এবং শাসকের সহযোগিতায় বিদ্রোহীদের (অর্থাৎ জিহাদী আহলেহাদীছদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য থাকবে। এই সময় শী‘আ নেতারাও হানাফী নেতাদের ন্যায় জিহাদ বিরোধী ফৎওয়া প্রকাশ করেন।[19]
উপরোক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, হানাফী ও শী‘আ নেতারাই ইংরেজ বিরোধী জিহাদ আন্দোলনকে হারাম ঘোষণা করেছিলেন। নবাব, নাইট, খানবাহাদুর ও পীর-মাশায়েখ নামধারীরা যখন আরাম-আয়েশে প্রাসাদে ও খানক্বায় বসে হালুয়া-রুটি আর ওরস-মীলাদ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন মুহাম্মাদী-আহলেহাদীছরা ইংরেজ শাসকদের জেল-যুলুম, ফাঁসি ও দ্বীপান্তরে অকাতরে জীবন বিলাচ্ছিলেন দেশের স্বাধীনতা ও ইসলামের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যেমন বাংলাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও গবেষক আব্দুল মওদুদ বলেন,
‘কালক্রমে বাঙালী জেহাদীরা আহলেহাদিস, লা-মাযহাবী, মওয়াহেদ, মুহম্মদী, গায়ের মুকাল্লিদ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত হয়েছিল ... শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ লড়তে বাঙালী মুসলমানেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং অগণিত অর্থ ও সৈন্য পাঠিয়ে নিজেদের কর্তব্য পালনে তৎপর হয়েছে। সেকালীন বাংলাদেশের প্রত্যেক শহরে তাদের অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহের ঘাঁটি ছিল। ... মালদহের (বর্তমানে চাঁপাই নবাবগঞ্জের পাকা-নারায়ণপুর) রফিক মিয়াঁ ও তাঁর পুত্র আমীরুদ্দীনের নাম ইতিহাসের অন্তর্গত হয়েছে’।[20] সে সময় বিহার ও বাংলা ছিল মুজাহিদ ও রসদ প্রেরণের কেন্দ্রস্থল। আর সেকারণে বিহার, পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশে আহলেহাদীছের সংখ্যা সর্বাধিক। আহলেহাদীছদের সেদিনের ত্যাগের ফলেই বৃটিশ তাড়ানো সম্ভব হয় ও যার ফলশ্রুতিতে পরে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান ও বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
এদিকে ইঙ্গিত করেই কলিকাতা বিশ্ববিবদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ডঃ ওসমান গণী বলেন, ‘এই মহৎ আন্দোলন স্বাধীনতার পূর্বতন বীজরূপে না রয়ে গেলে আজকের দিনের স্বাধীনতার সোনার ফসল সবুজ শালবন এত সত্বর আদৌ আমাদের হাতে আসত কি? সুতরাং এই আন্দোলনের আবেদন ও অবদান দুই-ই অবর্ণনীয় ও অবিস্মরণীয়’।[21] অতএব অপপ্রচারকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী আহলেহাদীছরা কখনোই ইংরেজের দালালী করেনি এবং খৃষ্টানদের অর্থে বেড়ে ওঠেনি। এটি স্রেফ মূর্খতা সূলভ ও বিদ্বেষপ্রসূত প্রোপাগান্ডা মাত্র।
বাংলাদেশে প্রচলিত শিরকী বিশ্বাস ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ সমূহের বিরুদ্ধে বারাসাতের সৈয়দ নিছার আলী তীতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খৃঃ)-এর পরিচালিত ‘মুহাম্মাদী আন্দোলন’ ও ফরিদপুরের (বর্তমান মাদারীপুরের) হাজী শরী‘আতুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০খৃঃ)-এর পরিচালিত ‘ফারায়েযী আন্দোলন’ ছিল মূলতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই প্রতিরূপ। তীতুমীর ১৮২২ সালে হজ্জে গিয়ে সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর হাতে বায়‘আত করেন। তিনি দেশে ফিরে এসে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদারের বসানো দাড়ির ট্যাক্স ও অন্যান্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন এবং অত্যাচারিত হিন্দু-মুসলিম কৃষক শ্রেণীর পক্ষে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে জিহাদ ও শাহাদাত নছীব হয়। হাজী শরী‘আতুল্লাহ ১৭৯৯ থেকে ১৮১৮ খৃঃ পর্যন্ত ১৯ বছর সঊদী আরবে অবস্থান করেন ও সেখানে ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হন। অতঃপর দেশে ফিরে সামাজিক কুসংস্কার সমূহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এদেশকে ‘দারুল হরব’ (বিধর্মীর রাজ্য) বলে ফৎওয়া দেন। তাতে তিনি মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩) ও তার অনুসারী এবং অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের চক্ষুশূল হন।[22] ফলে তাঁকেও নানাবিধ যুলুম ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের বহু আহলেহাদীছ আজও ‘মুহাম্মাদী’ ‘ফারাযী’ নামে পরিচিত।[23]
বিজ্ঞপ্তিতে মক্কা-মদীনার আলেমদের যে ফৎওয়ার কথা বলা হয়েছে সেটা ছিল ইংরেজদের সমর্থনে হানাফী আলেমদের পক্ষে। সে ফৎওয়া তারাই এনেছিলেন এবং তারাই এটা আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে প্রচার করেছিলেন। যেমন আব্দুল মওদুদ বলেন, ‘সমুদ্যত অস্ত্র ও আইনে শৃংখলা পর্যাপ্ত না হওয়ায় দেশপ্রসিদ্ধ আলেমদের, এমনকি মক্কা শরীফের চার মযহাবের প্রধান মুফতীদের ফতোয়া প্রচারের দরকার হয়েছিল ভারতীয় বিশেষতঃ বাঙালী মুসলমানদের ধর্মবুদ্ধিকে প্রভাবিত করবার জন্য। বিদেশী ও বিধর্মীদের শাসনাধিকারে চলে গেলেও এদেশটাকে ‘দারুল ইসলাম’ হিসাবে মেনে নিয়ে এখানে শান্তিতে ও নিরুপদ্রবে বসবাস করতে ধর্মীয় অনুমোদনও এসব ফতোয়ার দ্বারা লাভ করা হয়েছিল’।[24] অতএব কারা সে সময় ইংরেজের দালালী করেছিল ও বৃটিশ সরকারের পদলেহী ছিল, উক্ত লেখনী থেকেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
অনেকে ওলামায়ে দেউবন্দকে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ‘হিরো’ বানাবার চেষ্টা করেন। যাকে আদৌ ‘জিহাদ’ বলা যাবে না। কেননা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। অতঃপর যে ঘটনার ভিত্তিতে উক্ত দাবী করা হয় তা এই যে, ১৮৫৭ সালের মে মাসে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনাপর্বে সাহারানপুর যেলার থানাভুন পরগণার অন্যতম সর্দার কাযী আব্দুর রহীম হাতি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সাহারানপুর শহরে যান। সেকালে হাতি ছিল আমীর ও রঈসদের শোভা বর্ধনের মাধ্যম। কিন্তু কাযী ছাহেবের শত্রুরা গোপনে ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেটকে তথ্য দেয় যে, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য হাতি কিনতে এসেছেন। ম্যাজিষ্ট্রেট এই খবর পেয়েই তাঁকে গ্রেফতার করেন ও কোনরূপ যাচাই-বাছাই না করেই কয়েকজন সঙ্গীসহ তাকে হত্যা করেন। এতে এলাকার লোক ক্ষিপ্ত হয় এবং তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
উল্লেখ্য যে, থানাভুন পরগণার ৩৫ হাযার জনসংখ্যার সাত হাযারই ছিল ইংরেজ সেনাবাহিনীতে কর্মরত’। তার মধ্যে ৩২ জন ছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা’।[25] অতএব তাদের ইংরেজ বিরোধী হওয়ার কোন কারণ ছিল না। বরং এটি ছিল প্রতিশোধমূলক একটি স্থানীয় ঘটনা মাত্র।[26] আর সম্ভবতঃ সেকারণেই উইলিয়ম উইলসন হান্টার প্রদত্ত রিপোর্ট, যা ‘আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমান্স’ নামে ১৮৭২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, তার সর্বত্র ওয়াহহাবী ও ছাদিকপুরী মুজাহিদদের ইংরেজবিরোধী তৎপরতার আলোচনায় ভরপুর থাকলেও কোথাও সাহারানপুর বা দেউবন্দের মাশায়েখদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি ‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’ (হিন্দুস্তানী আলেমদের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত’ ১ম প্রকাশ ১৯৩৯, পরবর্তী প্রকাশ ১৯৫৭) বইয়ের লেখক মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়াঁ খুব বাড়িয়ে-চাড়িয়ে লিখেও অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ইতিহাসের একজন ছাত্র বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মালাগড় ও ফরখনগরের মত অখ্যাত স্থান সমূহের নাম পাওয়া গেলেও মুযাফফর নগর ও সাহারানপুর যেলার নাম পাওয়া যায় না (যেখানে দেউবন্দ অবস্থিত)’।[27] বরং ১৮৭৫ সালে উক্ত মাদরাসা কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি মিঃ পামার দেউবন্দ মাদরাসা পরিদর্শন করে এই বলে রিপোর্ট দেন যে, ‘এই মাদরাসা সর্বদা বৃটিশ সরকারের অনুগত ও সহযোগী’।[28]
পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্ররোচনায় তৎকালীন মুহতামিম শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান ১৯১৪ সালের পর ‘রেশমী রুমাল’ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি ও মাওলানা হোসায়েন আহমাদ মাদানীসহ আটজন মাল্টায় ৪ বছর নির্বাসিত থাকেন। বলা হয়ে থাকে যে, এইসব হলুদ রুমালে মাওলানা মাহমূদুল হাসান তুরষ্কের খলীফা ও হিজাযের শাসকদের কাছে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়ে কিছু লোককে ঐসব দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই গোপন তথ্য ফাঁস হলে তারা গ্রেফতার হন। এতে দেউবন্দ মাদরাসার পরিচালনা কমিটি বা অন্য কোন নেতৃবৃন্দের সম্মতি ছিল না এবং এ কারণে ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে ১৯১৩ সালে মাদরাসার শিক্ষকতার চাকুরী হ’তে বহিষ্কার করা হয়। উল্লেখ্য যে, ইনি নও মুসলিম শিখ ছিলেন এবং ১৯০৯ সালে ইনি দেউবন্দের শিক্ষক হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মাদরাসার কোন ব্যক্তি ইংরেজের আনুগত্য বিরোধী কোন কাজে অংশ নেননি।[29] বরং ১৯১১ সালে ‘জমঈয়াতুল আনছার’ (সাহায্যকারীদের দল) নামে শায়খুল হিন্দ যে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে গৃহীত প্রস্তাবনা সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রস্তাবনা ছিল, ‘সরকারের আনুগত্যের প্রতি জনগণকে নির্দেশনা প্রদান’।[30]
বস্ত্ততঃ ১৯১৩ সালে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেউবন্দ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সর্বদা ইংরেজ শাসকদের সাথে পুরোপুরি সম্পর্ক রেখে চলেন এবং ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে বের করে দেবার পর তারা ইউ,পি-র ইংরেজ গভর্ণরকে মাদরাসায় আমন্ত্রণ জানান। গভর্ণর জেম্স মিসটন খুশীমনে এখানে আসেন ও বক্তৃতা করেন। অতঃপর মুহতামিম হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদকে ‘শামসুল ওলামা’ (আলেমদের সূর্য) উপাধিতে ভূষিত করেন। এই মুহতামিম ছিলেন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানুতুবীর পুত্র।[31] ১৯১৭ সালের ৬ই নভেম্বর মাওলানা মাহমূদুল হাসান ও অন্যদের মুক্তির জন্য ‘ওলামায়ে দেউবন্দ’-এর পক্ষ হ’তে ইংরেজ সরকারের নিকটে যে আবেদন পেশ করা হয়, তাতে তারা বলেন যে, স্রেফ সন্দেহবশে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নইলে বিগত ৩০/৪০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলছি যে, তিনি সহ সমস্ত দেউবন্দী জামা‘আত সর্বদা নিশ্চুপ ও রাজনীতিমুক্ত একটি জামা‘আত।[32] এতে বুঝা যায় যে, ১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহ বা ১৯১৪ সালের ‘রেশমী রুমাল ষড়যন্ত্র’ কোনটাতেই তারা যুক্ত ছিলেন না। বরং সর্বদা ইংরেজ তোষণে ব্যাপৃত থেকেছেন।
৩. সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী (রহঃ) ও তাঁর আক্বীদা :
আমীরুল মুজাহেদীন সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী (১২০১-৪৬/১৭৮৬-১৮৩১খৃঃ) ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকালে দিল্লীর মাদরাসা রহীমিয়াতে দু’বছর পড়াশুনা করেন। পরে তিনি টোংকের নবাব আমীর খান পিন্ডারীর সেনাবাহিনীতে সাত বছর চাকুরী করেন। কিন্তু আমীর খান ইংরেজের সঙ্গে আপোষ করায় তিনি ক্ষুব্ধ হন এবং ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের পরিকল্পনা করেন। তিনি তৎকালীন ভারতের ইলমী রাজধানী দিল্লীর অলিউল্লাহ পরিবারের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করেন। অতঃপর উস্তাদ মাওলানা আব্দুল আযীয দেহলভীর ইঙ্গিতে মাওলানা আব্দুল হাই ও মাওলানা শাহ ইসমাঈল তাঁর হাতে জিহাদের বায়‘আত করেন।
সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার সবটুকুই ছিল শাহ অলিউল্লাহ ও শাহ আব্দুল আযীযের লেখনী ও শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত। তিনি বাহ্যত হানাফী ছিলেন। এজন্য সেযুগের কঠিন সামাজিক কুপমন্ডুকতাই সম্ভবতঃ দায়ী ছিল। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সমষ্টি ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর মধ্যে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, ‘সাধারণভাবে যে চার মাযহাবের অনুসরণ করা হয়ে থাকে, তা সঠিক। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ)-এর ইল্মকে কোন নির্দিষ্ট একজন মুজতাহিদ-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ধারণা করা ঠিক নয়। যদি কোন মাসআলায় বিশুদ্ধ, স্পষ্ট ও গায়ের মানসূখ হাদীছ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করা চলবে না। মুহাদ্দিছগণকে এ ব্যাপারে অনুসরণীয় গণ্য করতে হবে’।[33] এখানে তিনি তৎকালীন নিয়মানুযায়ী কোন হানাফী বিদ্বানের তাকলীদ না করে মুহাদ্দিছ তথা আহলেহাদীছ বিদ্বানের নিকট থেকে মাসআলা জেনে নেবার নির্দেশ দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য, সৈয়দ আহমদের উপরোক্ত বক্তব্য আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই যথার্থ প্রতিধ্বনি’।[34] অতএব সৈয়দ আহমদ (রহঃ)-কে শিরক ও বিদ‘আতপন্থী সাধারণ হানাফী ভাবা ঠিক নয়।
অনেকে তাঁদের আন্দোলনকে ‘তরীকায়ে মুহাম্মাদীয়া’ আন্দোলন বলতে চেয়েছেন[35] এবং আহলেহাদীছদেরকে সেই আন্দোলনের একটি ‘বিচ্ছিন্ন উপদল’ হিসাবে গণ্য করতে চেয়েছেন। অথচ বাস্তব কথা এই যে, তারা প্রচলিত চিশতিয়া, কাদেরিয়া ইত্যাদি তরীকার ন্যায় নিয়মবদ্ধ কোন তরীকার প্রবর্তক ছিলেন না। বরং তাক্বলীদ-নির্ভর যে ইসলাম তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম সমাজে চালু ছিল, শাহ অলিউল্লাহ ও শাহ ইসমাঈলের শিক্ষা ছিল তার বিপরীত। মুসলিম সমাজকে ‘আমল বিল হাদীছে’র প্রতি উদ্বুদ্ধ করা ও বিদ্বানদের উদ্ভাবিত তরীকার বদলে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসরণের প্রতি আহবানই ছিল শাহ অলিউল্লাহ, শাহ ইসমাঈল, সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভী ও বেলায়েত আলী-এনায়েত আলীর আন্দোলনের মূল সুর। তাদের এই দাওয়াত ছিল মূলতঃ আহলেহাদীছ আন্দোলনেরই দাওয়াত’।[36] আর সেকারণেই তাঁদের আন্দোলনের ফলে হাযার হাযার মানুষ তাক্বলীদ ছেড়ে ‘আহলেহাদীছ’ হয়েছেন।
৪. ৩/১২/১৮৮৬ ইং তারিখের ১৭৫৮ নং স্মারকে পাঞ্জাব সরকার আবেদনকারী লা-মাযহাবী দলটির নেতা মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালভীর দরখাস্ত মনযুর করেন এবং তখন থেকে এদের নাম ওহাবী বা লা-মাযহাবীর পরিবর্তে আহলেহাদীছ রাখা হয়। উক্ত অপপ্রচারের জবাব নিম্নরূপ :
বালাকোট পরবর্তী জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব পাটনার ছাদিকপুরী আহলেহাদীছ পরিবারের উপরে আসে। ফলে এর পরবর্তী শতবর্ষব্যাপী জিহাদ আন্দোলন মূলতঃ আহলেহাদীছদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। ইংরেজের অনুগত হানাফী আলেমরা তখন আহলেহাদীছদেরকে ওয়াহহাবী, রাফাদানী, লা-মাযহাবী, গায়ের মুক্বাল্লিদ, বেদ্বীন ইত্যাদি নামে সর্বত্র অপবাদ রটাতো। আর তাদেরই নিরন্তর অপপ্রচারে ও ষড়যন্ত্রে ইংরেজ শাসকরা আহলেহাদীছ পেলেই তাকে জিহাদী, ওয়াহহাবী বলে গ্রেফতার করত। আর তাদের ভাগ্যে নেমে আসত জেল-যুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর ইত্যাদি নানাবিধ নির্যাতনের স্টীম রোলার।
মাওলানা মুহাম্মাদ হোসায়েন বাটালবী (মৃত: ১৯২০ খৃঃ) তাঁর দরখাস্তের মাধ্যমে ওয়াহহাবী ও আহলেহাদীছ এক নয় সেটা বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন এবং এর দ্বারা তিনি সাধারণ নিরীহ আহলেহাদীছদেরকে ইংরেজের জেল-যুলুম হ’তে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর জন্য সমস্ত আহলেহাদীছকে ইংরেজের অনুগত প্রমাণ করার যে ব্যর্থ চেষ্টা কোন কোন মহল থেকে লক্ষ্য করা গেছে, তা কোনক্রমেই ঠিক নয়’।[37] মনে রাখা আবশ্যক যে, এই থিসিসের পরীক্ষক মন্ডলী ছিলেন রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য হানাফী প্রফেসরগণ এবং তাঁদের অনেকে ছিলেন পীরপন্থী। এরপরেও তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে উক্ত থিসিস পাস করে দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে এটি গ্রন্থাকারে (৫৩৮ পৃঃ) প্রকাশিত হয়েছে এবং বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
৫. ‘এরা হানাফিদের মুশরিক বলতেও দ্বিধা করে না’।
জবাব: যেসব লোক কবরপূজা করে এবং কবরবাসী মৃতব্যক্তির অসীলায় আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিলে বিশ্বাস করে, সেসব ব্যক্তি নিঃসন্দেহে মুশরিক। আরবের মুশরিকরাও মূর্তিপূজার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিলে বিশ্বাস করত (যুমার ৩)।
বাংলাদেশের প্রায় সকল কবরপূজা কথিত হানাফী নামধারী কিছু বিভ্রান্ত লোকেরাই করে থাকে। অতএব তাদেরকে মুশরিক বলায় কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচের অবকাশ নেই। যদিও তাদেরকে সরাসরি কেউ মুশরিক বলেন না। তবে কথায় বলে, ‘ঠাকুর ঘরে কে? কলা খাইনি’।
৬. ‘তারা বলে হানাফীদের নামাজই হয় না’।
জবাব : এর অর্থ হানাফীদের ছালাত রাসূল (ছাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী হয় না। উদাহরণ স্বরূপ: (১) হানাফীরা ছালাতের পূর্বেই জায়নামাযের দো‘আ পড়েন (২) তাহরীমা বাঁধার পর নিয়তের নামে ‘নাওয়াইতু আন’ পড়েন, যা একেবারেই বানোয়াট (৩) যঈফ হাদীছ জানা সত্ত্বেও স্রেফ মযহাবের দোহাই পেড়ে হানাফী পুরুষেরা নাভির নীচে হাত বাঁধেন ও মহিলারা বুকের উপর হাত বাঁধেন (৪) একই দোহাই পেড়ে হানাফী মুক্তাদীগণ সূরা ফাতিহা বর্জন করেন (৫) একই দোহাই পেড়ে জেহরী ছালাতে সূরা ফাতিহা শেষে ‘আমীন’ নীরবে পড়েন (৬) একই দোহাই পেড়ে রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠা এবং তৃতীয় রাক‘আতে দাঁড়াবার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন- এর ছহীহ মুতাওয়াতির সুন্নাত পরিত্যাগ করেন (৭) একই দোহাই পেড়ে সিজদা থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় মাটিতে হাতে ভর না দিয়ে তীরের মত সোজা উঠে দাঁড়ান (৮) একই দোহাই পেড়ে কাতারে দাঁড়িয়ে দুই মুছল্লীর পায়ের মাঝে ফাঁক রাখেন এবং এভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য অনুযায়ী কাতারের মাঝে ‘কালো বকরীর ন্যায় শয়তান’কে সর্বদা লালন করেন (৯) একই দোহাই পেড়ে তা‘দীলে আরকান তথা ধীরে-সুস্থে ছালাত আদায় না করে দ্রুত ছালাত পড়েন (১০) একই দোহাই পেড়ে হানাফী মহিলাগণ সিজদায় গিয়ে মাটিতে নিতম্ব রাখেন। ফলে সারা জীবন তারা সঠিকভাবে সিজদা ছাড়াই ছালাত আদায় করেন (১১) একই দোহাই পেড়ে হানাফী মুছল্লীগণ দুই সিজদার মাঝে বৈঠকে বসে সুন্নাতী দো‘আ পাঠ করা হ’তে বিরত থাকেন (১২) একই দোহাই পেড়ে হানাফী খত্বীবগণ জুম‘আর দিন মুছল্লীদের মাতৃভাষায় মূল খুৎবা না দিয়ে আগেই মিম্বরে বসে বাংলায় তৃতীয় আরেকটি খুৎবা চালু করেছেন। অথচ আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) সর্বদা স্বীয় মাতৃভাষায় দাঁড়িয়ে দুই খুৎবা দিয়েছেন (১৩) একই দোহাই পেড়ে হানাফী মুছললীগণ ঈদায়নের ছালাতে অতিরিক্ত ১২ তাকবীরের স্থলে ৬ তাকবীর দেন। তাও আবার দুই রাক‘আতে দুই তরীকায় (১৪) একই দোহাই পেড়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিয়মিত সুন্নাত ৮ রাক‘আত তারাবীহ-তাহাজ্জুদ বাদ দিয়ে তারা ২০ রাক‘আত পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ওমর (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণের উপর ইজমা-এর নামে মিথ্যারোপ করেন (১৫) একই দোহাই পেড়ে তারা জানাযার ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর জ্বলজ্যান্ত সুন্নাত সূরা ফাতেহা পাঠ করেন না। অথচ যেটা রাসূল (ছাঃ) করেননি, সেই ‘নিয়ত’ পাঠ করেন ও ‘ছানা’ পড়েন (১৬) একই দোহাই পেড়ে তারা সফরে ছালাত জমা ও ক্বছর করেন না। এমনকি হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানেও যোহর ও আছর জমা ও ক্বছর না করে পৃথকভাবে সুন্নাত সহ পুরা ছালাত আদায় করেন।
এসবই তারা সারা জীবন করে যাচ্ছেন হানাফী মাযহাবের দোহাই পেড়ে। অথচ মাযহাব মানা ফরয নয়, বরং ছহীহ হাদীছ মানা ফরয। তাছাড়া সবই করা হচ্ছে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নামে। অথচ তিনি পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন ‘ছহীহ হাদীছই আমার মযহাব’।[38] অতএব প্রকৃত হানাফী কেবল তিনিই হ’তে পারেন, যিনি সর্বক্ষেত্রে ছহীহ হাদীছ মেনে চলেন। আহলেহাদীছগণ যেটা করে থাকেন।
আমরা বলতে চাই যিনি জেনে-শুনে সারা জীবন বাপ-দাদা কিংবা মাযহাবের দোহাই দিয়ে ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য করেন, তিনি কি রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্য নন? তাঁর ছালাত কিভাবে কবুল হবে? তিনি কিভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আত আশা করতে পারেন? রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা আল্লাহ্র অবাধ্যতার শামিল। অতএব হে অবাধ্য মুছল্লী! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা করে কোন্ আকাশ তোমাকে ছায়া দিবে? কোন যমীন তোমাকে আশ্রয় দিবে? অতএব সাবধান হও! মৃত্যুর আগেই তওবা করে ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়। নইলে ক্বিয়ামতের দিন আফসোস ব্যতীত তোমার ভাগ্যে আর কিছুই জুটবে না (বাক্বারাহ ১৬৭)। কোন ইমাম, পীর বা মুরববী তোমার জন্য সেদিন সুফারিশ করবে না।
৭. এই গুমরাহ দলটি...
জবাব : ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী ও অন্যান্য ইমামগণের বক্তব্য মতে প্রকৃত আহলেহাদীছ যারা, কেবল তারাই ‘নাজী’ ফের্কা। ইমাম আবুদাঊদ (২০২-২৭৫ হিঃ) বলেন, এই দলটি না থাকলে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’। বাকী মু‘তাযিলা, মুর্জিয়া, হানাফী সহ সবাই গুমরাহ দল ৭২ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত’। এই ভাগটি করেছেন হানাফীদের শ্রদ্ধেয় ‘বড় পীর’ শায়খ আব্দুল ক্বাদের জীলানী (রহঃ)।[39] যাঁর মৃত্যুদিবস হিসাবে তারা ‘ফাতেহা ইয়াযদহম’ বা এগারো শরীফ পালন করে থাকেন। অতএব এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। আল্লাহ সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছৈর উপর যথাযথভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
৮. প্রচারে : ‘বেদয়াতী দমন কমিটি’ ...
জবাব : কথায় বলে ‘অন্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন’। এভাবে চিরকাল বিদ‘আতীরাই আহলেহাদীছকে বিভিন্ন বাজে নামে অভিহিত করেছে। বস্ত্তত: কুরআন-হাদীছ ছেড়ে কোন ব্যক্তির দিকে সম্বন্ধ করে কোন মুসলমানের নামকরণ করাটাই তো আসল বিদ‘আত। এরপরে নিজেদের রায়-ক্বিয়াস ও জাল-যঈফ হাদীছে ভরা এবং নিজেদের আবিষ্কৃত অসংখ্য বিদ‘আত, যেমন- মীলাদ-ক্বিয়াম, শবেবরাত, কুলখানি-চেহলাম, পীরপূজা, গোরপূজা, ওরস, চিল্লা, আখেরী মুনাজাত এবং তাযকিয়ায়ে নফসের নামে আবিষ্কৃত শত রকমের মারেফতী কসরৎ ও সরকারী হিসাব মতে দেশের অন্যূন ২ লক্ষ ৯৮ হাযার পীরের নতুন নতুন ফৎওয়া ও শিরক-বিদ‘আতের জগাখিচুড়ীকে ঢালাওভাবে ‘হানাফী মাযহাব’ বলে চালানো কি নির্দোষ ইমামের উপর চালানো নিকৃষ্টতম অপবাদ নয়? ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কি এসব করতেন? তিনি কি এসব কাজের অনুমতি দিয়েছেন? তাঁর মাযহাব কি ছিল, সে ব্যাপারে তাঁর লিখিত কোন কিতাব দুনিয়াতে আছে কি? যদি না থাকে, তাহ’লে তাঁর নাম ভাঙিয়ে নিজেদের ‘হানাফী’ বলে মানুষকে প্রতারণা করার অর্থ কি? অতএব ‘বেদয়াতী দমন কমিটি’ না বলে মুখোশ খুলে ফেলে নিজেদেরকে সরাসরি বিদ‘আতী নামে অভিহিত করে সৎসাহসের পরিচয় দেওয়াই ভাল হবে। কেননা সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন হক-এর নিজস্ব শক্তিতে বিদ‘আত অপসৃত হবে ইনশাআল্লাহ। বানোয়াট মাযহাব ও তরীকার মোহজাল ছিন্ন করে হকপন্থী মানুষ সত্যের সন্ধানে ছুটে আসবে চুম্বকের মত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে।
মনে রাখা আবশ্যক যে, ‘আহলেহাদীছ’ প্রচলিত অর্থে কোন ফের্কা বা মতবাদের নাম নয়, এটি একটি পথের নাম। যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। মানুষের ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের যাবতীয় হেদায়াত এ পথেই মওজুদ রয়েছে। এ পথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সেই জান্নাতী পথেই মানুষকে আহবান জানায়।
(২) ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও তার সহযোগী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সমূহের মাধ্যমে এবং সমমনা ব্যক্তিগণের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে যখন ব্যাপকহারে ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গড়ার দাওয়াত ব্যাপ্তি লাভ করছে এবং দলে দলে মানুষ বাপ-দাদার মাযহাব ছেড়ে ‘আহলেহাদীছ’ হচ্ছেন, তখন সমাজের একদল কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক ধর্মনেতার গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। এরা আহলেহাদীছ-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ গীবত-তোহমত ও অপবাদ রটাচ্ছেন। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের পার্টনার হিসাবে এদের একটি দল আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জেল-যুলুমের শিকার বানিয়েছিল। এখন তাদের অন্য দলগুলি মাঠ গরম করছে। এইসব পুঁজিবাদী রাজনৈতিক পীর ছাহেবদের বহুদিনের খাদেম ও মুরীদরা যখন তওবা করে ‘আহলেহাদীছ’ হয়ে যাচ্ছেন, তখন এঁরা চোখে সর্ষেফুল দেখছেন, আর প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। তারা সম্প্রতি ‘হানাফী ঐক্য পরিষদ’ ‘আহলেসুন্নাত ওয়াল জামায়াত পরিষদ’ ‘ওলামা পরিষদ’ ইত্যাদি নামকাওয়াস্তে সংগঠন কায়েম করে আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের কাছে নোংরা তাদের বই-পত্র এবং চ্যালেঞ্জের চিঠি ও কাগজ-পত্র পাঠাচ্ছেন। এরা কেউ দেশে ‘ইসলামী হুকুমত’ কেউ ‘ইসলামী খেলাফত’ কেউ ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’ ইত্যাদি কায়েমের শ্লোগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করেন। এরা নিজেরা মওদূদী-তাবলীগী, চরমোনাই-দেওয়ানবাগী, আটরশী-মাইজভান্ডারী, রিযভী-ওহাবী ইত্যাদি নামে পারস্পরিক দলাদলি ও হানাহানিতে ক্ষত-বিক্ষত। অথচ আহলেহাদীছকে বলছেন ‘মুনকিরে হাদীছ’।[40] লজ্জা-শরমের বালাই থাকলে এরূপ কথা তারা লিখে প্রচার করতেন না। আমরা বলি, অতিভক্তি ও অতি বিদ্বেষ পরিহার করুন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ার শপথ নিন। নিজেদের কিছু ভুল থাকলে তা সংশোধন করুন। মুসলমানদের পরস্পরের ভাই হওয়ার সুযোগ দিন। তাদের মধ্যে পারস্পরিক মহববত বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরী করুন। তাহলে দেশে আল্লাহর বিশেষ রহমত নেমে আসবে ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তুমি তোমার প্রিয় বান্দাদেরকে তোমার নির্ভেজাল দ্বীনের প্রতি এবং তোমার প্রেরিত ছিরাতে মুস্তাক্বীমের প্রতি হেদায়াত দান কর- আমীন! (স.স.)।
[2]. আব্দুল কাদের জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসরী ছাপা, ১৩৪৬ হিঃ), ১/৯০ পৃঃ।
[3]. ইবনু হযম, কিতাবুল ফিছাল, বৈরূত: ১/৩৭১।
[4]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ, বৈরূত: ২/১৭৯।
[5]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বের ও পরের লোকদের অবস্থা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াকক্বেঈন ২/২০৮।
[7]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৪৬ ‘ফক্বীহদের মাযহাবী মতভেদের কারণ সমূহ’ অনুচ্ছেদ।
[8]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ডক্টরেট থিসিস (রাবি ১৯৯২; প্রকাশক, হা.ফা.বা. ১৯৯৬), পৃঃ ২৩০।
[9]. প্রাগুক্ত।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০৩-০৫।
[11]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/১৬০।
[12]. ঐ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ ১/১৫১।
[13]. ঐ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ২/১০।
[14]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী, নাফে‘ কাবীর (জামে‘ ছগীর-এর ভূমিকা, লাক্ষ্ণৌ : ১২৯১ হিঃ), পৃঃ ১৩।
[15]. ছালেহ ফুল্লানী, ঈক্বাযু হিমাম পৃঃ ৯৯।
[16]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী ছাপা, ১২৮৬ হিঃ), ১/৭৩ পৃঃ।
[17]. তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ, ক্রমিক সংখ্যা ৮৫, পৃঃ ২৮০-৮১।
[18]. সাহিত্যিক মাওলানা আহমাদ আলী, ২য় সংস্করণ ২০১১খৃঃ, পৃঃ ৫।
[19]. হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমান্স, অনুবাদ: আনিসুজ্জামান (ঢাকাঃ ১৯৮২) পরিশিষ্ট-৩ পৃঃ ৯৯-১০৪; ১৯৪।
[20]. আব্দুল মওদুদ, ওহাবী আন্দোলন (ঢাকা ১৯৮৫), পৃঃ ১০০।
[21]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ডক্টরেট থিসিস পৃঃ ১৪-১৫।
[22]. কে.এম. রাইছ উদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা (ঢাকা ২০০৬), পৃঃ ৫৭৩-৭৪।
[23]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ডক্টরেট থিসিস, পৃঃ ৬৩।
[24]. আব্দুল মওদুদ, ওহাবী আন্দোলন পৃঃ ১০১; ফৎওয়াগুলি আনিসুজ্জামান অনুদিত দি ইন্ডিয়ান মুসলমান্স, ঢাকা ১৯৮২, পরিশিষ্ট ১, ২, ৩-য়ে রয়েছে। পৃঃ ১৯১-৯৪।
[25]. ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, বঙ্গানুবাদ ঢাকা, ই. ফা. বা. ২০০৩খৃঃ, ৪/২৮৪, ৪৮৮।
[26]. ছালাহুদ্দীন ইউসুফ, তাহরীকে জিহাদ (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান : ১৪০৬/১৯৮৬), পৃঃ ৬৮-৬৯।
[27]. মুহাম্মাদ মিঞা, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, লাহোর ছাপা, ৪/২৪৯ পৃঃ; ঐ, বঙ্গানুবাদ ঢাকা, ৪/২৬৫।
[28]. তাহরীকে জিহাদ, পৃঃ ৭১।
[29]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৭।
[30]. ঐ, পৃঃ ৭৩, টীকা-১।
[31]. তাহরীকে জিহাদ পৃঃ ৭৫-৭৬।
[32]. ঐ, পৃঃ ৮৯, ৯৪।
[33]. ছিরাতে মুস্তাক্বীম, করাচী ছাপা, পৃঃ ১১৩।
[34]. থিসিস পৃঃ ২৫৬-৫৭, ২৬৫।
[35]. তাঁদের এই ধারণার ভিত্তি হ’ল সাইয়িদ (রহঃ)-এর নিম্নোক্ত উক্তি : ‘আমার তরীকা হ’ল তাই-ই, যা আমার ঊর্ধ্বতন দাদা সাইয়িদুল মুরসালীন (ছাঃ) এখতিয়ার করেছিলেন। একদিন শুকনা রুটি পেটভরে খেয়ে নিই ও আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করি। একদিন ভূখা থাকি ও ধৈর্য ধারণ করি’ (থিসিস পৃঃ ২৬৯, দ্রঃ টীকা-২৯)। অথচ একটা উক্তির ভিত্তিতে একটা তরীকার জন্ম হয় না। তাছাড়া উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৯০ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[36]. থিসিস, পৃঃ ২৬৮-৭০।
[37]. থিসিস পৃঃ ২৭৫।
[38]. রাদ্দুল মুহতার ওরফে ফাতাওয়া শামী, (বৈরূত: দারুল ফিকর, ১৩৯৯/১৯৭৯), ১/৬৭।
[39]. কিতাবুল গুনিয়াহ, মিসরী ছাপা, ১/১০৩; শহরস্তানী, আল-মিলাল, বৈরূত ছাপা, ১/১৪৬।
[40]. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান, দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম ও কথিত আহলেহাদীসের আলোচিত বাহাস (প্রকাশক : ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ঢাকা মহানগর-পূর্ব, ঢাকা : ২০১২) পৃঃ ২২।