গত ১০ই অক্টোবর’১৪ শুক্রবার বাদ আছর ময়মনসিংহ যেলার সদর থানাধীন দাপুনিয়া বাজার সংলগ্ন গোষ্ঠা দক্ষিণ পাড়া আইনুদ্দীন মুন্সীবাড়ী মারকায মসজিদে উপরোক্ত বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বাহাছ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বাহাছে ১ম পক্ষ অর্থাৎ সঊদী আরবের সঙ্গে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করার পক্ষে অংশগ্রহণ করেন দলনেতা আবুল কাসেম (কুড়িগ্রাম), রেজাউল হক, জুলহাস উদ্দিন, আনোয়ারুল হক, জহিরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও আব্দুল্লাহ আল-নোমান (ময়মনসিংহ), আমিনুল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম (মাদারীপুর) প্রমুখ। উল্লেখ্য, উক্ত মতের প্রবক্তা এনামুল হক মাদানী (চাঁপাই নবাবগঞ্জ), মতীউর রহমান (মীরপুর), আমীনুল ইসলাম (বংশাল, ঢাকা) এবং মুরাদ বিন আমজাদ (খুলনা) উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও উপস্থিত হননি। অপরদিকে ২য় পক্ষে অর্থাৎ নিজ নিজ দেশে চাঁদ দেখে ছিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস’-এর বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক ড. আব্দুল্লাহ ফারূক (বগুড়া), ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ জামালপুর যেলার সাধারণ সম্পাদক ও বেলটিয়া কামিল মাদরাসার প্রধান মুহাদ্দিছ ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারী (জামালপুর), শরীফবাগ ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, ধামরাই, ঢাকার মুহাদ্দিছ আব্দুল্লাহ আল-মাহমূদ (ঢাকা), মাওলানা মুনীরুদ্দীন (খুলনা), আব্দুল্লাহ বিন সুরুজ (ময়মনসিংহ), মুযযাম্মিল হক (জামালপুর), মুজাহিদুল ইসলাম (নারায়ণগঞ্জ), আব্দুল ওয়াহহাব (জামালপুর), তালেবুদ্দীন (ময়মনসিংহ) ও ক্বারী মফীযুদ্দীন (ময়মনসিংহ) প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, বাহাছের পূর্বে উভয় পক্ষ ২০০ টাকার ষ্ট্যাম্পে লিখিত অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। যেখানে বলা হয়, ‘আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে অঙ্গীকার করিতেছি যে, উপরোক্ত বিষয়ের পক্ষে আমরা ১ম পক্ষগণ কুরআন ও সহীহ, মারফু, মুত্তাসিল হাদিস হতে প্রমাণ করবো যে, একই দিনে সারা পৃথিবীতে সৌদি আরবের সাথে সিয়াম ও ঈদ পালন করতে হবে। এই মর্মে আরও অঙ্গীকার করছি যে, উক্ত বিষয়ে কোন প্রকার যুক্তি কিয়াস বা কোন ব্যক্তির কথা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করিব না এবং আমরা উক্ত বিষয়ের পক্ষে সঠিক প্রমাণে ব্যর্থ হলে ২য় পক্ষের আমল সঠিক বলিয়া মানিয়া চলিব এবং ভবিষ্যতে ইহার বিরুদ্ধে কথা বলিব না। ইহার ব্যতিক্রম করিলে কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে যে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। আমরা উপরোক্ত বিষয়ে স্বজ্ঞানে ও সুস্থ্য মস্তিষ্কে কারো প্ররোচনা ব্যতিত নিম্নে স্বাক্ষর করিলাম’। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস’-এর সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মীর আব্দুল ওয়াহহাব লাবীব। সহ-সভাপতি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদরাসা, ময়মনসিংহের অধ্যক্ষ আব্দুল ওয়াহহাব মাদানী ও আরামনগর কামিল মাদরাসা, সরিষাবাড়ী, জামালপুরের অধ্যক্ষ নূরুল হুদা ইবনে আবেদ। অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন স্থানীয় গোলপুকুরপাড় আহলেহাদীছ জামে মসজিদের খতীব মাওলানা আব্দুল্লাহ আল-মামূন।
বাহাছের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
(১) বাহাছের শুরুতে সঊদী আরবের সঙ্গে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষের প্রথম বক্তা আবুল কাসেম কুরআনুল কারীমের সূরা বাক্বারার ১৮৯ নং আয়াতের প্রথমাংশ يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ উল্লেখ করে বলেন, আয়াতে الْأَهِلَّةِ দ্বারা একাধিক নতুন চাঁদকে বুঝানো হয়নি; বরং এ বহুবচন দ্বারা বার মাসের ১২টি নতুন চাঁদকে বুঝানো হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা চাঁদের জন্য ২৯টি মন্যিল নির্ধারণ করেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যকে মধ্যস্থল করেছেন। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন চাঁদ উদয়ের সংবাদের ভিত্তিতে বিশ্ববাসীকে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করতে হবে।
জবাবে স্ব স্ব দেশে নতুন চাঁদ দেখে ছিয়াম ও ঈদ পালনের পক্ষের প্রথম বক্তা ড. আব্দুল্লাহ ফারূক বলেন, প্রতিপক্ষের প্রথম বক্তা উল্লিখিত আয়াতের যে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন তা সঠিক নয়। আয়াতে الْأَهِلَّةِ দ্বারা একাধিক নতুন চাঁদকে বুঝানো হয়েছে, যা একেক ‘মাত্বলা’য় (উদয়স্থল) একেক দিন উদিত হয়। প্রতিপক্ষের বক্তা চাঁদের মনযিল ২৯টি বলেছেন। কিন্তু চাঁদের মনযিল হচ্ছে ২৮টি। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ ‘তোমরা নতুন চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ এবং নতুন চাঁদ দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর’ (বুখারী ও মুসলিম)। সুতরাং নতুন চাঁদ না দেখে সঊদী আরবের সাথে একই দিনে কিভাবে ছিয়াম ও ঈদ পালন করা যাবে? তিনি আরও বলেন, ১৪০১ হিজরী সালে সঊদী আরবে এই বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম বৈঠকে বসেছিলেন। ঐ বৈঠকে বিশ্বব্যাপী একই দিনে ছিয়াম পালন করা সম্ভব নয় বলে ফৎওয়া দেওয়া হয়েছে। উক্ত ফিক্বহ বোর্ডে সাবেক সঊদী গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ বিন বায, শায়খ উছায়মীনসহ বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি উক্ত ফৎওয়া বোর্ডের সিদ্ধান্তের কপি সকলকে প্রদর্শন করেন।
(২) প্রথম পক্ষের দ্বিতীয় বক্তা রেজাউল হক ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারী প্রণীত ‘বিশ্বব্যাপী একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনকারীদের ভ্রান্তিবিলাস’ বইটির প্রচ্ছদ দেখিয়ে বলেন, প্রচ্ছদে তিনটি পৃথিবীর তিনটি চাঁদ দেখানো হয়েছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে القمر তথা চাঁদ একবার ব্যবহার করেছেন। চাঁদ ও সূর্য দু’টিই পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়।
জবাবে বিপক্ষের বক্তা ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারী বলেন, প্রতিপক্ষের সম্মানিত বক্তা প্রচ্ছদের সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। চাঁদ ও সৃর্যের উদয় ও অস্ত সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, সেটিও ভুল। তাঁর হয়ত জানা নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যেমন القمر ‘চাঁদ’ উল্লেখ করেছেন, তেমনি الْأَهِلَّةِ ‘নতুন চাঁদ সমূহ’ উল্লেখ করেছেন। চাঁদ ও নতুন চাঁদ এক নয়। আর উক্ত বইয়ের প্রচ্ছদে তিনটি পৃথিবী দেখানো হয়নি বরং একই পৃথিবীর একটি চাঁদের তিনটি ‘মাত্বলা’ অর্থাৎ তিনটি উদয়স্থল বুঝানো হয়েছে। নতুন চাঁদ একেক দিন একেক ‘মাত্বলা’ থেকে উদিত হয়। আর এটাই বাস্তব সত্য। যার বাস্তব প্রমাণ হ’ল ২০১৩ সালে রামাযানের চাঁদ সর্বপ্রথম উদিত হয়েছিল উত্তর আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশে। দ্বিতীয় দিন মধ্যপ্রাচ্যে এবং তৃতীয় দিন ভারতীয় উপমহাদেশে। প্রতিপক্ষের বক্তা বলেছেন, চাঁদ ও সূর্য দু’টিই পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়। অথচ আমরা বাস্তবে দেখতে পাই, সূর্য পূর্ব দিক থেকে ওঠে। আর নতুন চাঁদ পশ্চিম দিক থেকে ওঠে। তিনি শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর মাজমূ‘ ফাতাওয়ার ২৫ খন্ডের ১০৫ পৃষ্ঠা দেখিয়ে বলেন, ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, وأمَّا الهلال: فطلوعه ورؤيته بالمغرب سابق؛ لأنَّه يَطلُع مِن المغرب ‘অতঃপর নতুন চাঁদ, যার উদয় হয় ও প্রথম দর্শন হয় সর্বপশ্চিমে। কেননা নতুন চাঁদ পশ্চিম থেকেই উদিত হয়’। যেমন আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশে হ’ল। মির‘আতুল মাফাতীহ গ্রন্থে ১৮৮৯ নং হাদীছের ব্যাখ্যায়ও এমনটি বলা হয়েছে। জনাব ক্বামারুয্যামান বিন আব্দুল বারী প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা ছিয়াম শুরু ও শেষ করেন সঊদী আরবে চাঁদ উদিত হওয়ার ভিত্তিতে, অথচ সেই ছিয়ামের সাহারী ও ইফতার করেন বাংলাদেশের স্থানীয় সময় অনুযায়ী। এর কারণ সম্পর্কে আপনাদের পক্ষের আলেম এনামুল হক মাদানী ও আনসারুল্লাহ বাংলা টীম প্রধান বরগুনার মুফতী জসীমুদ্দীন রহমানী (বর্তমানে কারাগারে) তাদের বইয়ে লিখেছেন, চাঁদের বিধান (সময়) বিশ্বব্যাপী এবং সূর্যের বিধান স্থানীয়ভাবে কার্যকর হবে’। তাদের এই ভুল বক্তব্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশী বিভ্রান্ত করেছে। অথচ আসল বিষয়টি ঠিক এর বিপরীত। এক্ষণে ‘চাঁদের বিধান বিশ্বব্যাপী এবং সূর্যের বিধান স্থানীয়ভাবে কার্যকর হবে’ কুরআন-হাদীছের কোথাও কি এমন কথা বর্ণিত আছে? যদি থাকে তাহ’লে দয়া করে দেখাবেন। কিন্তু ১ম পক্ষের কোন বক্তাই উপরোক্ত প্রশ্ন সমূহের কোন উত্তর দিতে পারেননি।
(৩) সঊদী পক্ষের বক্তা রেজাউল হক (ময়মনসিংহ) বলেন, আবুদাঊদ ও নাসাঈতে বর্ণিত একজন আরব বেদুঈনের সাক্ষ্য দানের ভিত্তিতে রাসূল (ছাঃ) ছিয়াম পালন করেছেন এবং অন্যদেরকেও পালন করতে বলেছেন এবং দু’জন আরব বেদুঈনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রাসূল (ছাঃ) ঈদ পালন করেছেন। সুতরাং সঊদী আরবের নতুন চাঁদ উঠার সংবাদের ভিত্তিতে আমাদেরকেও ছিয়াম পালন করতে হবে। তিনি বিগত কিছুদিন পূর্বে কোন এক পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের লেখা একটি প্রবন্ধ দেখিয়ে বলেন, এই দেখুন সঊদী আরবের সাথে মিল রেখে আমাদেরকেও ছিয়াম এবং ঈদ পালন করতে হবে, এমনটি এ পত্রিকায় এসেছে। তিনি আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরী সন মানা ওয়াজিব করেছেন। সুতরাং হিজরী তারিখ একেক দেশে একটি হ’লে সে ওয়াজিবের ব্যত্যয় ঘটবে।
জবাবে বিপক্ষের বক্তা আব্দুল্লাহ আল-মাহমূদ (ঢাকা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিজরী সন প্রবর্তন করেননি। হিজরী সন প্রবর্তন করেছিলেন ওমর (রাঃ)। সুতরাং ওয়াজিবে ব্যত্যয় ঘটার কোন প্রশ্নই আসে না। আর কোন পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেই ইসলামের কোন বিধান প্রমাণ করা যায় না। পত্রিকায় অনেকে অনেক কিছুই লিখে, তাই বলে সে সবগুলোই কি ইসলামের বিধান? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরব বেদুঈনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ছিয়াম ও ঈদ পালন করেছেন। উক্ত বেদুঈন অন্য দেশের লোক নয় এবং সে অন্য দেশে চাঁদ দেখে এসে সাক্ষ্য দেয়নি এবং সেটা সম্ভবও ছিল না। তাই আমরাও আমাদের দেশে কেউ নতুন চাঁদ দেখে সাক্ষ্য দিলে সে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ছিয়াম ও ঈদ পালন করি। অন্য দেশে নতুন চাঁদ উঠার ভিত্তিতে নয়।
(৪) সঊদী পক্ষের বক্তা আবুল কাসেম (কুড়িগ্রাম) বলেন, স্ব স্ব দেশে নতুন চাঁদ উঠার ভিত্তিতে আরাফার ছিয়াম পালন করলে সেটা আর আরাফার ছিয়াম থাকবে না। সুতরাং সঊদী আরবের সাথে মিল রেখেই আমাদেরকে সে ছিয়াম ও ঈদ পালন করতে হবে।
জবাবে বিপক্ষের বক্তা মাওলানা মুনীরুদ্দীন (খুলনা) বলেন, আরাফার বিষয়টি স্বতন্ত্র। আরাফা একটি নির্দিষ্ট স্থানের নাম, যা সারা বিশ্বে মাত্র একটাই। আর হাদীছে صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ ‘আরাফা দিবসের ছিয়াম’ বলা হয়েছে। সুতরাং এটি আরাফার দিনের সাথেই সম্পৃক্ত। তিনি প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, সঊদী আরবের সাথে মিল রেখে সারা বিশ্বে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করতে হবে মর্মে একটি স্পষ্ট ছহীহ অথবা যঈফ হাদীছ দেখান। না পারলে একটা জাল হাদীছ থাকলেও দেখান। কিন্তু ১ম পক্ষের কেউ-ই এ চ্যালেঞ্জের কোন জবাব দিতে পারেননি।
(৫) প্রথম পক্ষের আরেক বক্তা মুহাম্মাদ জুলহাস উদ্দিন কুরআন-হাদীছের দলীল পেশ না করে একাধারে তাদের মনগড়া বিভিন্ন যুক্তি পেশ করতে থাকেন।
জবাবে ২য় পক্ষের বক্তা ক্বামারুয্যামান বিন আব্দুল বারী বলেন, যুক্তি দিয়ে ইসলামের কোন বিধান সাব্যস্ত করা যায় না, বরং ইসলামের বিধান সাব্যস্ত হয় প্রামাণ্য দলীলের মাধ্যমে। অতএব আপনারা কুরআন-হাদীছ থেকে দলীল পেশ করুন, কোন যুক্তি নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُمِّىَ عَلَيْكُمُ فَعُدُّوْا ثَلاَثِيْنَ ‘তোমরা নতুন চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ এবং নতুন চাঁদ দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর। আর তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর’ (মুসলিম হা/১০৮১)। উক্ত হাদীছের বিধান যে স্থানীয়ভাবে কার্যকর হবে তার অদ্ব্যর্থ প্রমাণ হ’ল হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর’। কে না জানে যে, সারা পৃথিবীর আকাশ একই দিন একই সাথে মেঘাচ্ছন্ন থাকে না। এক্ষণে বিশ্বের কোন স্থানে নতুন চাঁদ উদিত হ’লেই যদি সেটা গোটা বিশ্ববাসীর জন্য প্রযোজ্য হয়, তাহ’লে তো প্রশ্ন থেকে যায় যে, এক দেশের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে অন্য দেশের আকাশ তো পরিস্কারই থাকে এবং সেখানে নতুন চাঁদ দেখা যাবে। তাহ’লে ‘তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর’ মর্মে হাদীছের শেষাংশের এই নির্দেশটি অকার্যকর হয়ে পড়ে (নাঊযুবিল্লাহ)। এতেই প্রমাণিত হয় যে, সারা বিশ্বে একই সময়ে চাঁদ উদিত হয় না। সেকারণ ছিয়াম ও ঈদ বিশ্বব্যাপী একই দিনে পালন করা সম্ভব নয়।
এছাড়া কুরাইব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত ছহীহ মুসলিম (হা/১০৮৭) এবং সুনান-এর কিতাবসমূহে বর্ণিত হাদীছটি উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যা স্বরূপ। যা স্পষ্ট মারফূ‘ হাদীছ, আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)-এর ইজতিহাদ নয়। প্রমাণ হিসাবে তিনি তুহফাতুল আহওয়াযী, আওনুল মা‘বূদ, নায়নুল আওতারে উল্লেখিত ইমাম শাওকানী ও অন্যান্য বিদ্বানগণের মন্তব্য পেশ করেন। তিনি প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, সঊদী আরবে নতুন চাঁদ উদিত হ’লে সেটাই যদি গোটা বিশ্ববাসীর জন্য প্রযোজ্য হয়, তাহ’লে সঊদী আরবের আগে বা পরে অন্যান্য দেশে চাঁদ পুনরায় নতুনভাবে উদিত হয় কেন? আপনাদের মতে সঊদী আরবের নতুন চাঁদের ভিত্তিতে সারা বিশ্বে নতুন তারিখ গণনা শুরু হয়। আর নতুন চাঁদের কাজ হ’ল সময় তথা তারিখ নির্ধারণ করা। এক্ষণে যেহেতু সঊদী আরবের পরে আমাদের দেশে নতুন চাঁদ উঠে, তাহ’লে কি এটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় না? আমাদের দেশে আরবী মাসের গণনা কি তাহ’লে সঊদী আরবের হিসাবে হবে, না আমাদের দেশের হিসাবে হবে? প্রতিপক্ষের বক্তারা এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেননি। তাছাড়া সঊদী আরবের সাথে একই দিনে ঈদ পালন করতে হবে মর্মে কোন হাদীছ পেশ করতে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন।
বাহাছের রায় :
১ম পক্ষের বক্তাগণ তাদের মতের সপক্ষে পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত এবং কোন ছহীহ, মারফূ‘, মুত্তাছিল এমনকি কোন যঈফ হাদীছও দলীল হিসাবে পেশ করতে পারেননি। অপরদিকে ২য় পক্ষের বক্তাগণ কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা নিজ নিজ দেশে চাঁদ দেখে ছিয়াম ও ঈদ পালন করার বিষয়টি প্রমাণ করেন। তাঁরা বলেন, একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করা শরী‘আত, বিবেক ও রাষ্ট্রবিরোধী। অতঃপর দীর্ঘ আলোচনার পর সভাপতি, সহ-সভাপতিদ্বয় ও পরিচালনা কমিটি ২য় পক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করেন এবং নিজ নিজ দেশের চাঁদ দেখেই ঈদ পালন করতে হবে মর্মে বাহাছের রায় ঘোষণা করেন।
[সূত্র : উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত চুক্তিনামা ও রায়ের স্বাক্ষরিত ও সীলমোহরকৃত ফটোকপি; দৈনিক ইনকিলাব ও বাংলাদেশ প্রতিদিন ১২ অক্টোবর’১৪-য়ে প্রকাশিত রিপোর্ট এবং ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারীর লিখিত বিবরণ।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন- (১) মাসিক আত-তাহরীক প্রশ্নোত্তর কলাম জানুয়ারী ২০০৫ প্রশ্ন নং ১/১২১, (২) আগষ্ট ২০১১ প্রশ্ন নং ৩৩/৪৩৩, (৩) আগস্ট ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘প্রসঙ্গ : সারাবিশ্বে একইদিনে ছিয়াম ও ঈদ’, (৪) সেপ্টেম্বর’১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত দরসে কুরআন ‘নবচন্দ্রসমূহ’, (৫) ক্বামারুযযামান বিন আব্দুল বারী প্রণীত ‘বিশ্বব্যাপী একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনকারীদের ভ্রান্তিবিলাস’ বই।]