
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক (৭.৯.২০০৩ইং) রিপোর্ট অনুযায়ী পরপর তিন বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে ১নং হিসাবে হ্যাট্টিক করেছে। যা সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তিকে ভূমিতে লুটিয়ে দিয়েছে। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বর্তমানে দেশব্যাপী ছেয়ে গেছে। লোমহর্ষক খবর পড়তে পড়তে এখন আর কোন কিছুই লোমহর্ষক বলে মনে হয় না। গত রামাযানে ‘ক্লীনহার্ট অপারেশন’ চালু থাকার ফলে যেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে বাজার-ঘাট করেছে ও নিশ্চিন্তে নিজ ঘরে ঘুমাতে ও ইবাদত করতে পেরেছে, এবছরের রামাযানে সেখানে একই পরিবারের ৪ জনকে ও অন্যস্থানে ১১ জনকে স্ব স্ব গৃহে জীবন্ত পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়েছে এবং অন্যত্র ঘুমন্ত অবস্থায় ৫ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ অপরাধের হিসাবের সাথে অন্যান্য অপরাধের অনুমান করা খুবই সহজ। আগামী বছরের জুন মাসের পর যে আন্তর্জাতিক হিসাব আসবে, সেখানেও বাংলাদেশ পুনরায় দুর্নীতিতে বিশ্বে এক নম্বর হবে, এটা একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা চলে।
কিন্তু আমরা কি কেবল দুঃখ করেই ক্ষান্ত হব? আমরা কি কখনোই এসবের প্রতিকারের কোন সক্রিয় ব্যবস্থা নেব না? দেশে কি সৎ ও যোগ্য লোক বলে কেউ নেই? তারা কেন আজ দূরে? অথবা ভিতরে থেকেও তারা কেন কাজ করতে পারছে না? এর জবাব আমরা দু’ভাবে দিতে পারি। ১- পদ্ধতিগত কারণে মেধাসম্পন্ন, সৎ ও যোগ্য লোকেরা প্রশাসন ও সামাজিক নেতৃত্ব থেকে দূরে থাকেন। একই কারণে ভেতরকার সৎ ও যোগ্য লোকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। ২- আদর্শগত কারণে যোগ্য লোকেরা সর্বদা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন। প্রথমোক্ত কারণটির বাস্তবতা হ’ল এদেশের প্রচলিত দলীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। আগে রাজনীতি পরিচালিত হ’ত জনকল্যাণে। এখন সেটা হয় আত্মকল্যাণে ও দলকল্যাণে। জনগণের খেদমত করার একটা পবিত্র প্রেরণা ছিল রাজনীতিকদের হৃদয়ে, কথায় ও কাজে। ফলে রাজনীতিকগণ ছিলেন জনগণের সেবক ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টগণ ছিলেন জনগণের চোখের মণি। তাদের আগমনের খবর শুনলে মানুষ ছুটে যেত হৃদয়ের টানে। কিন্তু এখন তাদের গাড়ী বহর যেতে দেখলে মানুষ নানা মন্তব্য করে। রেডিওতে তাদের ভাষণ হ’লে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। একদিন হরতালে দেশের ৪৫০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হয়। অথচ রাজনীতিকরা জনগণের কল্যাণে হরতাল ডাকার মত মিথ্যাচার করেই চলেছেন অহরহ। গাড়ী ভাঙ্গা ও জ্বালাও-পোড়াও-এর এই হরতালের নাম এখন লোকেরা দিয়েছে ‘ভয়তাল’।
দ্বিতীয় কারণটির বাস্তবতা এই যে, মানবতার সুউচ্চ আদর্শ, যা মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে, তা থেকে আমরা বহু দূরে ছিটকে পড়েছি। একজন মানুষ তার বংশ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা দলীয় পরিচয় যাই হৌক না কেন, সবার উপরে সে একজন মানুষ। আল্লাহর নিজ হাতে গড়া প্রিয় সৃষ্টি সে (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। তাকে অসম্মান করা মানে আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টিকে অসম্মান করা। প্রত্যেক মানুষ একই আদম-হাওয়ার সন্তান হিসাবে অন্য মানুষের ভাই। এই আদর্শ চেতনা আজ ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। রামাযানের পবিত্র দিনে রাজধানীর বুকে শত শত মানুষ ও পুলিশের সামনে একজন তরতাযা তরুণকে আরেকদল মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছে আর হিংস্র উল্লাস করতে করতে নির্বিবাদে চলে যাচ্ছে। যে মরল সে একজন মানুষ, সে এক স্নেহশীল বাপ-মায়ের কলিজার টুকরা সন্তান, সে তার ভাই-বোনের অতি আদরের ধন। পেটের তাকীদে বা অসৎ সংস্পর্শে কিংবা দলীয় নেতার নির্দেশের বা কোন চক্রান্তের শিকার নিরপরাধ তরুণ সে। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার বড় পরিচয় সে একজন মানুষ। সে মার খেতে খেতে বারবার কাকুতি-মিনতি করে মানুষের নিকটে মানবতা ভিক্ষা করছিল। কিন্তু তার অন্তিম বাসনা ও করুণ আকুতি ঐ মানুষ নামধারী হায়েনাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। রাজধানীর মতিঝিলের ব্যস্ততম সড়কের উপরে এক হোন্ডারোহীকে সন্ত্রাসীরা হোন্ডার তেল ঢেলে দিয়ে হোন্ডা সমেত তার আরোহীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারল। সে বারবার আগুন থেকে বেরিয়ে বাঁচতে চাচ্ছিল। আর ঐ হিংস্র শ্বাপদেরা তাকে লাথি মেরে আগুনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। একসময় তার দেহটি পুড়ে কয়লা হয়ে গেলে সন্ত্রাসীরা চলে গেল উল্লাস করতে করতে। ক্যামেরাবন্দী ছবি পত্রিকায় দেখে মানুষ অাঁতকে উঠেছে। কিন্তু অাঁতকে ওঠেনি মানুষরূপী ঐ দ্বিপদ জীবগুলি যারা এ নৃশংস কাজটি করল। অাঁতকে উঠেনি প্রশাসন, যাদের দায়িত্ব ছিল মানুষটিকে তার মানবিক মর্যাদায় বাঁচিয়ে রাখার। মাত্র কয়দিন আগে একটি সিটি কর্পোরেশনের অভিজাত হোটেলে নিয়মিত দেহ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য স্থানীয় ছেলেরা অনুরোধ করতে গেলে হোটেল মালিক ও পুলিশের যোগসাজশে ঐ আদর্শবান তরুণগুলি এখন হাজত বাস করছে। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলি হ’ল ‘বিচ্যুত আচরণ তত্ত্বে’র বহিঃপ্রকাশ। মানুষের দুনিয়াবী স্বার্থ যখন প্রবল হয়, তখন সে মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয় এবং সে হিংস্রতম পশুর চাইতে নিম্নস্তরে চলে যায়।[1] বস্ত্তবাদী রাজনীতির মূল স্পিরিট হ’ল ‘দুনিয়া’। যাকে হাদীছে মৃত লাশের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যাকে শকুনের দল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।[2]
Farrie Heady নামক জনৈক গবেষক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের আমলারা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান দর্শন এবং চীনের আমলারা কনফুসিয়াস ধর্ম দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে ঐসব দেশে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি খুবই কম। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের আমলারা ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের অনুসারী হওয়ায় তাদের শতকরা ৮০ ভাগ দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত’। একইভাবে এদেশের রাজনীতিক ও আমলাদের পেশাগত বিশ্ব দর্শন বা Professional Worldview নিতান্তই অস্পষ্ট। ‘ইসলাম’ সম্পর্কেও তাদের ধারণা একেবারেই শিশুসুলভ। এসবের বাইরে যারা দু’চারজন থাকেন, জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মত ক্ষমতা তাদের নেই। শক্তিশালী লুটেরাদের অসহায় দর্শক হিসাবে অথবা তাদের সেফগার্ড হিসাবে কিংবা সরকারের বা প্রশাসনের সততার প্রতীক হিসাবে তাদেরকে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয় মাত্র।
তাহ’লে দেশকে দুর্নীতির পঙ্ক থেকে উদ্ধারের উপায় কি? নিশ্চয়ই উপায় রয়েছে এবং এটি আমাদের ঘরেই রয়েছে। আর সেটি হ’ল আখেরাতভিত্তিক জীবন দর্শনে উজ্জীবিত হওয়া। নেতা হই বা কর্মী হই আমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি কাজ হৌক আখেরাতের লাভ-লোকসান ভিত্তিক। যেকাজে জান্নাত লাভ হবে, সেকাজ করব, যেকাজে জান্নাত হারাতে হবে, সে কাজ করব না, এটাই হৌক আমাদের দিগদর্শন। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সার্বিক জীবন নীতির মূল দর্শন হৌক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তা করতে গেলে যাবতীয় শয়তানী বাধা ও ত্বাগূতী লোভ-লালসা ও চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে দলিত-মথিত করে আপোষহীনভাবে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখ পানে। ঘুষের অর্থ, মদিরার আকর্ষণ, সুন্দরীর চকিত চাহনি সবই ম্লান হয়ে যাবে জান্নাতের সুগন্ধি লাভের দুর্নিবার আকাংখার সম্মুখে। বৃটেনের কোন লিখিত সংবিধানই নেই। তারা চলছে যুগ যুগ ধরে তাদের স্ব স্ব বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে। আমরাও চলতে পারি আমাদের স্ব স্ব ধর্ম দর্শনকে বুকে ধারণ করে।
অতএব এদেশের মানুষের লালিত ইসলামী দর্শন অনুযায়ী দেশ পরিচালনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হৌন। আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতি করুন। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। হে আল্লাহ আমাদের সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতা দিন- আমীন![3]
[1]. আ‘লা ৮৭/১৬, ত্বীন ৯৫/৪, আ‘রাফ ৭/১৭৯।
[2]. মুসলিম হা/২৯৫৭; মিশকাত হা/৫১৫৭ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।
[3]. ৭ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ডিসেম্বর ২০০৩।