মানুষের
মধ্যে নফসানিয়াত ও রববানিয়াত অর্থাৎ প্রবৃত্তিমুখী ও আল্লাহমুখী দু’টি
প্রবণতা সর্বদা কার্যকর রয়েছে। প্রবৃত্তি পরায়ণতা সবসময় মানুষকে দেহ
সর্বস্ব চিন্তায় ব্যাকুল রাখে। পক্ষান্তরে রববানিয়াত সর্বদা মানুষকে তার
স্রষ্টামুখী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। এ দু’য়ের অহরহ দ্বন্দ্বে মানুষের
পরীক্ষা হয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে এ পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এ
পরীক্ষায় হারজিতের উপরেই নির্ভর করে তার ইহকালীন মঙ্গল বা অমঙ্গল এবং
পরকালীন জান্নাত অথবা জাহান্নাম। আর এব্যাপারে তার শেষ আমলটাই কার্যকর হয়।
রামাযানের
মাসব্যাপী ফরয ছিয়াম ও অন্যান্য সময়ের নফল ছিয়াম সমূহ বান্দার দেহযন্ত্রকে
যেমন সুস্থ, সুঠাম ও সবল রাখে, তেমনি তাকে নফসানিয়াত থেকে মুক্ত করে
রববানিয়াতের উচ্চমার্গে নিয়ে যায়। ছিয়ামের কঠোর সংযম তার ষড় রিপুকে দমিত
রাখে। মাসব্যাপী নিয়মিত ছিয়াম এই সংযমকে স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত করে। পরবর্তী
শাওয়াল মাসের ৬টি ছিয়াম ও প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারের নফল ছিয়াম
তাকে ঐ অভ্যাসের দিকে বারবার ধাবিত করে। যেন রববানী বান্দা শয়তানের ফেরেবে
পড়ে আবার নফসের পূজারী না হয়ে পড়ে। রামাযানের মাসব্যাপী ছিয়ামে সে
জামা‘আতের সাথে নিয়মিত তারাবীহ পড়ে। এতে তার মধ্যে সাম্য ও মৈত্রীর সমাজ
চেতনা জাগ্রত হয়। ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু সবাই এক আল্লাহর সামনে এক কাতারে
শামিল হয়ে তার রহমত কামনায় ব্রতী হয়। এতে তার অহংকার চূর্ণ হয়। আল্লাহর
দাসত্বের অধীনে সকল বান্দা যে সমান, এ অনুভূতি শাণিত হয়। রামাযানের প্রতিটি
সৎ কর্মের পুরস্কার ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ বর্ধিত হয়, এমনকি আল্লাহ তার চেয়ে
অগণিত ছওয়াব দান করে থাকেন। এই ঘোষিত পুরস্কার লাভের জন্য ছায়েম সকল পাপ
বর্জন করে ও পুণ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। শুধু তাতেই সে ক্ষান্ত হয় না। বরং সে
নেকীর কাজে প্রতিযোগিতা শুরু করে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৎকর্মকেও সে বড় বলে
মনে করে। জীবনের এ খেলাঘরে হঠাৎ কখন মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠবে, সে জানেনা। তাই
সৎকর্মের সামান্যতম সুযোগকেও সে হাতছাড়া করতে চায় না। ছায়েম তাই ছিয়াম
অবস্থায় নিজেকে সকল হারাম থেকে দূরে রাখে। ছিয়াম ভঙ্গ হয়, এমন কোন কাজ সে
গোপনেও করে না। কারণ সে জানে যে, কেউ না দেখলেও আল্লাহ তাকে দেখছেন। এই
অনুভূতি তার কর্মজীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যখন প্রতিভাত হয়, তখনই সে হয় প্রকৃত
রববানী মানুষ, প্রকৃত ইনসানে কামেল। ছিয়াম অবস্থায় সে লুকিয়েও একটা
সিঙ্গাড়া খায়নি আল্লাহর ভয়ে। অনুরূপভাবে সে লুকিয়েও কোন পাপ করবে না, ঘুষ
খাবেনা, অতিলোভে খাদ্যে ও ঔষধে বিষ ও ভেজাল মিশাবে না, মিথ্যা সাক্ষী দেবে
না, মিথ্যা ভাউচারে সই করবে না, কারু নামে মিথ্যা মামলা দেবে না, মিথ্যা
প্রচার করবে না। কেননা তার সবকিছু আল্লাহ দেখছেন ও শুনছেন। তার কাঁধের দুই
ফেরেশতা তার দৈনন্দিন আমলনামা লিখছেন। সিসিটিভি ক্যামেরার ন্যায় তার সবকিছু
সেখানে রেকর্ড হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, যদি সে তওবা করে ও পাপ বর্জন করে এবং
অনুতপ্ত হয়ে বান্দা ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায়, তাহ’লে কম্পিউটার থেকে লেখা
মুছে দেওয়ার ন্যায় আল্লাহ তার আমলনামা থেকে ঐ পাপটুকু মুছে দেবেন। নইলে
দুনিয়াতে বাহবা কুড়ালেও আখেরাতে তাকে সাহায্য করার কেউ থাকবে না। প্রতিটি
সৎ ও অসৎ কর্মের প্রতিদান ও প্রতিফল তাকে পেতে হবে। আল্লাহর সুক্ষ্ম বিচারে
কোন কিছুই সেদিন লুকানো থাকবে না।
একইভাবে রববানী বান্দা যখন হারাম
বর্জন করে ও হালাল উপার্জন করে এবং যাকাত ও ছাদাক্বা দেয়, তখন তার হৃদয়
প্রশান্ত হয়, অন্তর পবিত্র হয়, ত্যাগের আনন্দে তার হৃদয়জগত নির্মল আলোয়
উদ্ভাসিত হয়। সে দুনিয়াতেই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে। সে তার ধনে অসহায়
বান্দার অধিকার স্বীকার করে। তার কাছে গচ্ছিত ধনকে সে আল্লাহর ধন ও তাঁর
আমানত বলে বিশ্বাস করে। তাই আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর ধন আল্লাহর বান্দাকে
দিয়ে সে দায়মুক্ত হয়, ভারমুক্ত হয়। অন্যকে দিতে না পারলে সে অস্থির হয়ে
ওঠে। পাগলপরা হয়ে সে প্রার্থী খুঁজে বেড়ায়। রামাযানের শেষ দশকে ই‘তিকাফের
নিরিবিলি সুযোগে বান্দা আল্লাহর আরও নিকট সান্নিধ্যে চলে যায়। অতঃপর
রামাযান শেষে মাথাপ্রতি এক ছা‘ অর্থাৎ আড়াই কেজি চাউলের ফেৎরা আদায় করে সে
আরো তৃপ্ত হয়। এরপর আসে ঈদুল ফিতর বা পাপ মুক্তির ঈদ। ঈদের দিনের নির্মল
আনন্দ মুসলমানকে দুনিয়া ভুলিয়ে আখেরাতের মিলনমেলায় নিয়ে যায়। মন চায় জীবনের
প্রতিদিন যদি ঈদের দিন হ’ত। এদিন নামী-দামী প্রাসাদ, এমনকি বড় বড় মসজিদ
ছেড়ে বান্দা ময়দানে গিয়ে সিজদা করে। উপরে নীলাকাশ, নীচে সবুজ ঘাস, ঐ মাটির
নীচেই হবে তার শেষ নিবাস-এ চিন্তা যখন নিজের মধ্যে কাজ করে তখন তার মধ্যে
কোন অহংকার থাকে কি? পাশের মুছল্লী ও তার মধ্যে সে তখন কোন প্রভেদ খুঁজে
পায় না। মাটির উপরে দাঁড়িয়ে সে যখন ভাবে যে, সে নিজে এই মাটি থেকে সৃষ্ট,
সে একদিন মরে এই মাটিতে মিশে যাবে। অতঃপর প্রথম সৃষ্টির ন্যায় পুনরায়
আল্লাহ তাকে এখান থেকে ক্বিয়ামতের দিন উঠাবেন ও বিচারের সম্মুখীন করবেন-
তখন তার ভিতরের অবস্থাটা কেমন হয়, বুঝতে কষ্ট হয় কি?
;প্রশ্ন হ’ল : একই
মানুষ একজন অন্ধকারের কৃমিকীট, আরেকজন আলোর পথের পথিক, কোন সে দর্শন যা
তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায়? এখানে একটাই দর্শন কাজ করছে- আর তা হ’ল
রববানিয়াতের দর্শন। নফসের পূজারী ব্যক্তি স্থুল দেহ ও তার চাহিদা নিয়ে
সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। পক্ষান্তরে রববানী ব্যক্তি নফসের প্রয়োজনীয় দাবী
মিটিয়ে রববানিয়াত অর্জনে মশগুল থাকেন। নফসানী ব্যক্তির চিন্তা সর্বদা
সংকীর্ণ ও নিম্নমুখী। পক্ষান্তরে রববানী ব্যক্তির চিন্তা-দর্শন সর্বদা উদার
ও ঊধ্বর্মুখী। সে সর্বদা সেদিনকে ভয় করে, যেদিন তাকে ফিরে যেতে হবে তার
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে। আর সেই দিন শুরু হয়ে যায় তার মৃত্যুর সাথে সাথে।
ছিয়ামের এ রববানী দর্শন বান্দা যত বেশী আত্মস্থ করবে, সমাজ তত বেশী সুন্দর
ও শান্তিময় হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন!! (স.স)।
১৩তম বর্ষ শেষে ১৪তম বর্ষের আগমনে এবং ঈদুল ফিৎরের শুভক্ষণে আমরা আমাদের সকল পাঠক-পাঠিকা ও শুভানুধ্যায়ীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং আত-তাহরীকের অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে রামাযানের এ পবিত্র মাসে আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে সেই প্রার্থনা জানাচ্ছি। -সম্পাদক