আল্লাহ
তা‘আলা অবাধ্য বান্দাদের সোজা পথে ফিরিয়ে আনার জন্য মাঝে-মধ্যে খরা,
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, প্রভৃতি আযাব প্রেরণ করে থাকেন। মূলতঃ এগুলো
মানুষের পাপের ফল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি জনপদের অধিবাসীরা বিশ্বাসী হ’ত ও
আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর প্রবৃদ্ধিসমূহ
উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। ফলে আমরা তাদের
পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের কারণে’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)। ‘স্থলে ও জলে
মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্য ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের
কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। ‘গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করায়, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে’ (সাজদা ৩২/২১)। আলোচ্য নিবন্ধে সাম্প্রতিক সময়ে হাইতিতে সংঘটিত ভূমিকম্প সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।
ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে বৃহত্তম দ্বীপ হিসপ্যানিওলা। এই দ্বীপের পশ্চিমাংশের এক-তৃতীয়াংশ হ’ল হাইতি প্রজাতন্ত্র। রাজধানীর নাম ‘পোর্ট অব প্রিন্স’। যার আয়তন ১০ হাযার ৭শ’ বর্গমাইল। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। হিসপ্যানিওলা দ্বীপের পূর্বাংশের বাকী দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র। হাইতির লোকসংখ্যা প্রায় এক কোটি, যার ৭০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। একজন মানুষের প্রতিদিনের আয় দুই ডলারের কম। আটটি পর্বত প্রধান অঞ্চল নিয়ে দেশটি গঠিত, যা তার ৮০ ভাগ ভূখন্ড দখল করে আছে; বাকী ২০ ভাগ সমতল। আবহাওয়া ঊষ্ণ ও আর্দ্র। এক সময়কার বনজ ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ এ দ্বীপ রাষ্ট্রটি সাম্প্রতিককালে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বনসম্পদ শতকরা ২ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই দেশটি ব্যাপক ভূমিক্ষয় ও প্রাকৃতিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। দিগন্ত প্রসারিত দৃষ্টিতে মাইলের পর মাইল শুষ্ক ও ন্যাড়া পাহাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ভাত ও রুটি।
স্পেন অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ৫ ডিসেম্বর ১৪৯১ সালে এই ভূখন্ডটি আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই প্রথমে স্পেনীয় ও পরে ফরাসীরা দেশটিতে উপনিবেশ গড়ে তোলে। তখন থেকে এদেশের মহা মূল্যবান খনিজ সম্পদ সোনাসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ ইউরোপে পাচার হ’তে থাকে। পক্ষান্তরে ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা অজানা রোগ ও মহামারিতে হাইতির অজস্র আদিবাসী মানুষের মৃত্যু ঘটে। দখলদারদের বর্বরতায় এক পর্যায় হাইতি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৬৭০ সালে ফরাসীদের দখলে যাওয়ার পর হাইতিতে আবার জনবসতি গড়ে উঠে। ১৭ ও ১৮ শতকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে প্রায় আট লাখ মানুষ হাইতিতে ধরে এনে দাস বানিয়ে খামারে ও খনিতে কলুর বলদের মত খাটানো হয়। হাইতির এই নিরীহ জনগণ বার বার দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই শক্তি প্রয়োগ করে তাদের বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করা হয়েছে। অবশেষে ফরাসী বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্যাঁ জ্যাক ডেসালিনির নেতৃত্বে ১৮০৪ সালের ১ জানুয়ারী হাইতি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ২ বছর পার হ’তে না হ’তেই ডেসালিনিকে আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হ’তে হয়। এরপর থেকে প্রায় ২শ’ বছরের হাইতির ইতিহাস ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও রক্তাক্ত ইতিহাস। ডেসালিনির পর আরও পাঁচজন রাষ্ট্রপ্রধান আততায়ীর হাতে নিহত হন। ক্যারিবীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে হাইতিই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রথম কোন দাসবিদ্রোহ জয়ী হয় এবং ঈপ্সিত স্বাধীনতা লাভ করে। এ কারণে হাইতির বিপ্লব ফরাসী বিপ্লবের মতই গুরুত্ববহ।
হাইতি ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম স্বাধীন দেশ এবং পশ্চিম গোলার্ধে আমেরিকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হ’লেও গোড়া থেকেই হাইতি মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়ে এসেছে। ১৯১১ সালে হাইতির একমাত্র কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকারী কোষাগার এবং ১৯১৬ সালে ঋণের অজুহাতে গোটা দেশটাই আমেরিকা দখল করে নেয়। তাদের এ দখলদারিত্ব নৃশংসভাবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কায়েম থাকে। আমেরিকার মেরিন সেনারা আফগানিস্তান ও ইরাকের মত দেশটিতে পুতুল সরকার ও তাদের পছন্দমত সংবিধান রচনা করে। যে সংবিধানে হাইতির ভূমি বিদেশীদের মালিকানায় দেয়ার বিধান রাখা হয়। কিন্তু হাইতির সংসদ সেটা পাস করতে সম্মত না হওয়ায় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। হাইতির অধিকাংশ জনগণকে মার্কিন মালিকানাধীন চিনি ও কফি খামারগুলোতে দাসের মত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তাদেরকে কৃষি উৎপাদন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় রপ্তানিমুখী অর্থনীতিতে। এভাবে মার্কিন রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরে হাইতিকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়।
হাইতির জনগণ যতবার বিদ্রোহ করেছে, ততবারই মার্কিন মদদপুষ্ট সেনা অভ্যুত্থান কিংবা সরাসরি তাদের সেনাবাহিনী দ্বারা সে আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে। বার বার নির্বাচিত সরকারকে হয় হত্যা করা হয়েছে, না হয় উচ্ছেদ করা হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালে ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের বিদায়ঘণ্টা বাজে। এরপরও সেখানে একবার নির্বাচিত সরকার, একবার সামরিক শাসন দেশ চালাতে থাকে। ১৯৯০ সালের পর সেদেশে যতবার নির্বাচন হয়েছে ততবারই জনপ্রিয় লাভালাস আন্দোলন জয়ী হয়েছে, কিন্তু তাদেরকে সরকার চালাতে দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট অ্যারিস্টিডকে মার্কিন মদদে সেনাপ্রধান রাউল সিড্রাসকে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেনে প্রেভালও তাদের ক্রীড়নক হয়ে দেশ চালাচ্ছেন।
পৌনঃপুনিক স্বৈরশাসন, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতায় বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত এই ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রে এখন নেমে এসেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প। এ যেন মরার উপরে খাঁড়ার ঘা। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, গত ১২ জানুয়ারী মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে এ ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্স থেকে ১৫ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে। প্রথম ভূমিকম্পের কিছুক্ষণের মধ্যেই ৫.৯, ৫.৫ ও ৫.১ মাত্রার আরও তিনটি মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের পরপরই ক্যারিবীয় অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। ১৬ জানুয়ারী দেশটিতে আবারো ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। হাইতির ইতিহাসে গত ২শ’ বছরেরও বেশী সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প রাজধানীজুড়ে কয়েক হাযার ভবন নিমিষে বিধ্বস্ত করেছে। যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, কর ভবন, বাণিজ্য ভবন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবন, সমুদ্র বন্দর, জাতিসংঘ মিশনের সদর দপ্তর, মন্টানা হোটেল, ক্রিস্টোফার হোটেল প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। নিমিষে পুরো রাজধানী ধূলি-ধোঁয়ার আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের প্রধান অ্যালেইন লি রয় জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে মিশনের সদর দপ্তর বিধ্বস্ত হয়েছে। সদর দপ্তরের পাঁচতলা মূল ভবনটি বিধ্বস্ত হয়েছে, যেখানে সাধারণত দুই থেকে আড়াই শ’ লোক কাজ করে।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আহত ও বাস্তূচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মুতদেহগুলো পচে-গলে লাশের গন্ধে হাইতির বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। নিহতদের মধ্যে আর্জেন্টিনা, অষ্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জর্ডান ও মেক্সিকোর প্রায় ৫০ জন নাগরিক রয়েছে বলে জানা গেছে। দারিদ্র্য, জনসংখ্যার ভারে নিমজ্জিত, প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার চরমে থাকা দেশটি আজ তীব্র মানবিক সংকটে নিপতিত। উপর্যুপরি ভূমিকম্পে খোদ রাজধানী বিধ্বস্ত হওয়ায় নিজেদের পক্ষে উদ্ধার ও পুনর্গঠনের কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাঁপা পড়া হাযার হাযার মানুষের উদ্ধার কাজও ঠিকমত করা সম্ভব হয়নি। ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারছে না।
এদিকে ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে যাওয়া খাদ্য, পানি ও বাসস্থানহীন লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। প্রথম দু’এক দিন ধৈর্য ধরে থাকলেও যত দিন যাচ্ছে ততই তারা ত্রাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। হাইতিতে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মুখপাত্র ডেভিড উইমহার্স্ট বলেন, ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় থাকা দুর্গত লোকজন ধীরে ধীরে অধৈর্য ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। অপরদিকে ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় লুটতরাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণে দুর্গত মানুষ চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাদের এক মুখপাত্র বলেন, ‘এখন আমাদের প্রধান সমস্যা নিরাপত্তাহীনতা। ক্ষুব্ধ মানুষ আগের দিন আমাদের কয়েকটি ট্রাক ছিনতাই করতে চেষ্টা করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রের মুখে কিছু সামগ্রী লুট হয়েছে বলে দু’একটি সংবাদ মাধ্যম প্রচার করেছে। পোর্ট অব প্রিন্সের নিরাপত্তাব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। ভূমিকম্পে রাজধানীর একটি জেলখানা বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে প্রায় চার হাযার সন্ত্রাসী আটক ছিল। ভবন ধসে তাদের কেউ কেউ মারা গেছে। যারা বেঁচে আছে তারা পালিয়ে গেছে। এসব সন্ত্রাসীরাই লুটতরাজে লিপ্ত বলে অনেকের ধারণা।
হাইতির এই দুর্দিনে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বিশ্বের দরবারে ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার ত্রাণ সাহায্যের আবেদন জানালে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, হাইতির জন্য এ পর্যন্ত ২০টি দেশ, সংস্থা ও কোম্পানির নিকট থেকে প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ৭৪টি বিমান ত্রাণসহায়তা নিয়ে পোর্ট অব প্রিন্সে পৌঁছেছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক না থাকায় ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। হাইতির দুর্গতপীড়িত মানুষের সহায়তায় পুনর্গঠন কার্যক্রমে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বে স্বদেশে তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এই তহবিলের নাম রাখা হয়েছে ‘ক্লিনটন-বুশ হাইতি তহবিল’। বুলডোজার দিয়ে ধ্বংসাবশেষ সরানো অব্যাহত থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। ছোট্ট বিমান বন্দরে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী মালামাল জড়ো হওয়ায় সেখানেও বিমান উঠানামা ব্যাহত হচ্ছে। এমত পরিস্থিতিতে হাইতিতে চলছে চরম মানবিক বিপর্যয়।
হাইতির সরকার অবশ্য এ ভয়াবহ মুহূর্তে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সাথে সাথে সেদেশের প্রসিডেন্ট রেনে প্রেভাল ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় সৃষ্টি করা না গেলে সেখানে চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ত্রাণ বিতরণের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের জন্য তিনি সকল ত্রাণকর্মীকে আহবান জানিয়েছেন। হাইতির ভয়াবহ পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ কল্পে ইতিমধ্যে সেদেশ সফর করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন।
২০০৪ সালের ইন্দোনেশিয়ার উপকূলের সুনামি জলোচ্ছ্বাসের পর হাইতির এ দুর্গতি বৃহত্তম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সুনামির পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুনামি-দুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল। আজ হাইতিরও তেমন সহযোগিতা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে বিশ্বের বড় বড় ধনী দেশ সাহয্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে মানবীয় দৃষ্টিতে আমাদেরও প্রয়োজন এই কঠিন বিপদের মুহূর্তে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বিশেষ করে খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় ও পুনর্গঠনে তাদের যরূরী সাহায্য প্রয়োজন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার মেডিকেল টিম পাঠিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলাদেশের অশনি সংকেত : বাংলাদেশও জনসংখ্যার ভারে নিমজ্জিত এক দরিদ্র দেশ। রাজধানী ঢাকায় প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও উঁচু ভবন নির্মাণের কারণে ঢাকা ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে থাকা এক ভাবি হাইতি। বাংলাদেশে বড় আকারের ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৮৯৭ সালে। তখন ঢাকার বেশিরভাগ ভবন ধসে পড়ে। মাঝখানে ১৯৩৪ ও ১৯৫০ সালে ৮ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প আঘাত হানে। অতি সম্প্রতি ৬ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প হয়ে গেছে। জাতিসংঘের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের পর ঢাকাই সবচেয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগরী। ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী (সিডিএমপি) ঢাকার সাড়ে তিন লাখ ভবনের দুই লাখ ভবনই ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে। অল্প জায়গায় বেশী ভবনের ভারে ঢাকার মাটি দেবে যাচ্ছে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের নাজুকতা আর সরকারী অবহেলা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সামর্থ্যহীনতার জন্য ঢাকা এখন সব দিক থেকেই এক বিপন্ন নগরী।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বেশীর ভাগ ভবনই ভূমিকম্পসহন প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়। ঢাকার ৫৩ শতাংশ ভবন দুর্বল অবকাঠামোর উপর স্থাপিত, ৪১ শতাংশ ভবনের ভরকেন্দ্র নড়বড়ে, ৩৪ শতাংশ ভবনের থাম ও কলাম দুর্বল। জাতিসংঘের আইএসডিআর নামক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বৃহৎ কংক্রিট নির্মিত ভবনের ২৬ শতাংশের বেলাতেই প্রকৌশলগত বিধিমালা অনুসৃত হয়নি। এক কথায় ঢাকা তথা বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলো (চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতি) যে ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন প্রয়োজন সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া। তাই সরকার ও সংশিলষ্ট সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। অন্যথায় সামান্য অলসতায় চোখের পলকে হাইতির মত, সুনামির মত লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণবায়ু উবে যাবে।
ইংরেজ কবি জন ডানের বহু পুরাতন সেই হুঁশিয়ারী স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, যেকোন মৃত্যু আমারও মৃত্যু। আমি মানবতার অংশ, তাই ঘণ্টা কার জন্য বাজে জানতে কাউকে পাঠিও না; জেনো, ঘণ্টা তোমার জন্যই বাজে। হাইতির মৃত্যু তাই খুব দূরে নয়, মৃত্যুপুরীর পাগলা ঘণ্টা ঢাকা শহর থেকেও শোনা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য নানাবিধ বিপদ-আপদ দিয়ে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্য ধারণকারীদের’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)। বিপদে ধৈর্যধারণ করা যেমন মানুষের কর্তব্য, তেমনি যথাসাধ্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও অতীব যরূরী। সাথে সাথে ভূমিকম্প দুর্গত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে মানবতার দাবী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা যমীনবাসীর উপর রহম কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপর রহম করবেন’ (আবুদাঊদ, তিরমিযী)। আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুন! আমীন!!