
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যেসব বিদেশী অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেসবের অন্যতম হ’ল ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ (Valentine's Day) বা ভালবাসা দিবস। প্রতিবছর ১৪ই ফেব্রুয়ারীর এদিনে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের প্রতি ভালবাসায় উন্মাতাল হয়ে পড়ে। পরস্পরের প্রতি লাল গোলাপের উপহার বিনিময় করে। কলিজার লাল ছাপ মারা গেঞ্জি ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। বড় বড় শহরের ধনীর দুলালেরা কিংবা লক্ষ্যহীন যুবক-যুবতীরা এদিনটা তাদের অমিত যৌনাচারের মোক্ষম সুযোগ হিসাবে কাজে লাগায়। বিশেষ বিশেষ বিল্ডিংকে তারা এসব কাজে ব্যবহার করে এবং সেখানে নানাবিধ অনুষ্ঠান করে। প্রশ্ন হ’ল এই যে, এগুলি আসল কোত্থেকে এবং এগুলির উৎস কি? উৎসের সন্ধানে গেলে আমরা নিম্নোক্ত তিনটি বিষয় দেখতে পাই।- ১. ১৪ই ফেব্রুয়ারী হ’ল রোমকদের বিবাহ দেবী ‘ইউনু’-এর বিবাহের পবিত্র দিন। ২. ১৫ই ফেব্রুয়ারী হ’ল রোমকদের ‘লেসিয়াস’ দেবীর পবিত্র দিন। এদিন তিনি দু’টি শিশুকে দুধ পান করিয়েছিলেন। যারা পরবর্তীতে রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিল। ৩. রোম সম্রাট ক্লডিয়াস তার বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে গিয়ে যখন এতে বিবাহিত পুরুষদের অনাসক্তি দেখলেন, তখন তিনি পুরুষদের জন্য বিবাহ নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন। কিন্তু জনৈক রোমান বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এটাকে অস্বীকার করেন ও গোপনে বিয়ে করেন। সম্রাটের কানে এ খবর গেলে তাকে পাকড়াও করা হয় ও ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেদিন থেকে এ দিনটি ‘ভালবাসা দিবস’ হিসাবে অথবা ঐ সাধুর নামানুসারে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
আধুনিক মিডিয়ার কল্যাণে ইদানিং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি পরিচিতি লাভ করেছে এবং বেশ জোশের সাথে পালিত হয়ে আসছে। ইংল্যান্ড ও ইতালীতে নাকি অবিবাহিত তরুণীরা এদিন সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে স্ব স্ব বাড়ীর জানালা পথে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে তারা প্রথম যে ব্যক্তিকে দেখতে পায়, সেই ব্যক্তি অথবা তারই মত আরেক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করবে এক বছরের মধ্যে এরূপ একটি বিশ্বাস তাদের মধ্যে গেঁথে গেছে। ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬ খৃঃ) তার বিখ্যাত হ্যামলেট (Hamlet) নাটকে এ বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি করেন ওফেলিয়ার (Ophelia) মুখ দিয়ে গাওয়ানো একটি গানে এভাবে- Tomorrow is St. Valentine's Day, all in the morning betime, and I a maid at your window, To be your Valentine. ‘আগামীকাল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে। সমস্ত সকাল জুড়ে জানালায় দাঁড়িয়ে আছি তোমার ‘ভ্যালেন্টাইন’ হ’তে’।
উপরের আলোচনায় একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কথিত ‘ভালবাসা দিবস’ মূলতঃ রোমক সংস্কৃতি। যা শিরকী আক্বীদা হ’তে উৎসারিত। ইসলামী আক্বীদার সাথে যা পুরাপুরি সাংঘর্ষিক। বর্তমানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইংরেজী নববর্ষের পূর্বরাত ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সুন্দরী প্রতিযোগিতা প্রভৃতির বেলেল্লাপনার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় ও খবরের কাগজের পাতায় যেভাবে প্রদর্শিত ও প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশ পাশ্চাত্য দেশগুলির ন্যায় অনৈতিক দেশে পরিণত হবে। যেখানে সতীত্ব ও বিশুদ্ধ চরিত্র বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এক্ষণে আমরা দেখব, এইসব অনুষ্ঠানের সাথে ইসলামের সম্পর্ক কেমন।
প্রথমতঃ এটি প্রতি বছর আনন্দের ও ভালবাসার দিবস তথা ‘ঈদুল হুবব’ হিসাবে পালিত হয়। অথচ ঈদুল ফিৎর ও ঈদুল আযহা ব্যতীত কোন স্বীকৃত ‘ঈদ’ ইসলামে নেই।[1] উল্লেখ্য যে, ঈদও দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই সকল জাতির জন্য ঈদ রয়েছে এবং এটি হ’ল আমাদের ঈদ’।[2]
দ্বিতীয়তঃ ভ্যালেন্টাইন্স ডে মূলতঃ একটি শিরকী উৎসব। তাছাড়া এর মাধ্যমে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া হয় মাত্র। যা নিঃসন্দেহে অনৈতিক। ইসলাম কখনোই কোন শিরকী আক্বীদা ও অনৈতিক আচরণকে সমর্থন করে না। বেগানা নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত সকল প্রকার মেলামেশাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তৃতীয়তঃ এ অনুষ্ঠান পালনে কাফির ও মুশরিকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে’।[3] চতুর্থতঃ অমুসলিমদের পালিত যেকোন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে মুসলমানদের যোগদান করা অর্থ তাদের অনুষ্ঠানে উৎসাহ যোগানো ও সহযোগিতা করা। মুসলমান কখনোই নিজেদের তাওহীদী আক্বীদা ও ছহীহ সুন্নাহ বিরোধী কোন অনুষ্ঠানে যোগদান দূরে থাক, কোনরূপ উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নেকী ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর। পাপ ও শত্রুতার কাজে সহযোগিতা করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)।
আমরা মুসলমান। আমরা আখেরাতে বিশ্বাস করি। আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আমরা দুনিয়াকে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র হিসাবে মনে করি। দুনিয়াবী আয়েশ-আনন্দের চাইতে আমরা আখেরাতে মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। যে কাজে রাসূল-এর অনুমোদন নেই, যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই, যে কাজে আখেরাতে কিছু পাওয়ার নেই, সে কাজকে আমরা অহেতুক ও অপচয় মনে করি। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ অনুরূপ একটি ফাল্তু কাজ ব্যতীত কিছুই নয়। দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য এটা শয়তানের পাতানো একটি ফাঁদ মাত্র। শয়তান আমাদের প্রকাশ্য দুশমন। আমরা যেকোন মূল্যে শয়তানী ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের ছালাত, আমাদের কুরবানী, আমাদের জীবন, আমাদের মরণ সবকিছু কেবল আল্লাহর জন্যই উৎসর্গীত। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে বর্তমান ফিৎনার যামানায় যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা দাও এবং আমাদের দেশের প্রশাসনকে ইসলামের পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার তাওফীক দাও! আমীন।[4]
[1]. আবুদাঊদ হা/১১৩৪; মিশকাত হা/১৪৩৯ ‘ঈদায়েনের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/৯৫২; মুসলিম হা/৮৯২; মিশকাত হা/১৪৩২ ‘ঈদায়েনের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪০৩১; আহমাদ হা/৫১১৪; মিশকাত হা/৪৩৪৭ ‘পোষাক’ অধ্যায়।
[4]. ৭ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা মার্চ ২০০৪।