১৯৯৫
সালের ১১ই জুলাই, ইতিহাস সাক্ষী হয়েছিল এক নৃশংস গণহত্যার। এই দিনে বসনিয়া
ও হার্জেগোভিনায় অবস্থিত সেব্রেনিৎসা শহরে সার্ব বাহিনী আট হাযারেরও বেশী
মুসলিমকে হত্যা করেছিল। সেসময় বসনিয়ার সার্ব্রেনিকা জাতিসংঘ-সুরক্ষিত একটি
নিরাপদ অঞ্চল ছিল, যেখানে প্রায় ৫০ হাযার বসনিয়াক আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু
সার্ব বাহিনী ঐ অঞ্চলটি বৃহত্তর সার্বিয়ার অংশ বলে দাবী করে।
তৎকালীন সময়ের সার্ব জেনারেল রাতকোমলাদিচ ঐ দিন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আমরা এখন সার্ব সাব্রেনিকাতে আছি। আমরা এই শহরটি সার্ববাসীদের উপহার হিসাবে দিতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সময় এসেছে।
সেব্রেনিৎসা দখলের প্রথমদিন থেকেই সার্বীয় বাহিনী স্থানীয় বসনীয় জনগোষ্ঠীর সকল পুরুষকে আলাদা করে নেয়। পরে তাদেরকে গণহারে হত্যা করে। ১১ই জুলাই থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন সেব্রেনিৎসার কোথাও না কোথাও এই গণহারে হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে।
হত্যার শিকার ব্যক্তিদেরকে মৃত্যুর আগে নিজেদের কবর খনন করতে বাধ্য করে সার্বীয় বাহিনী। সার্ব বাহিনী সেখানে জাতিসংঘের ডাচ শান্তিরক্ষীদের সামনেই ৮ হাযার ৩৭২ জন বসনিয় মুসলমানকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। গণহত্যা চলার সময় জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব নীরবতা পালন করে। যদিও পরবর্তীতে তারা একে ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ বলে স্বীকৃতি দেয়।
বসনিয়া ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে সাবেক যুগোসলাভিয়া থেকে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। আর ঐ স্বাধীনতা বানচাল করতেই সার্বরা বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বসনিয়ায় সার্ব বাহিনীর হামলায় দুই লাখের বেশী বসনিয় মুসলমান নিহত ও প্রায় বিশ লাখ শরণার্থী হয়। তবে সেব্রেনিৎসার গণহত্যাকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়াবহ গণহত্যা হিসাবে অভিহিত করা হয়।
মাত্র দুই দিনে প্রায় ৩০ হাযার বসনিয়াক মহিলা ও শিশুদের নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। ধর্ষণ করা হয়েছিল অন্তত ৫০ হাযার নারী ও কিশোরীকে।
মানবাধিকারের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সেদিন বসনিয়ায় গণহত্যা ঠেকানোর কোনরূপ প্রচেষ্টা চালায়নি। বরং ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলেছিলেন, ইউরোপে একটি নতুন মুসলিম দেশের আবির্ভাবকে সহ্য করবে না লন্ডন। সেকারণ গণহত্যা যখন শেষ হয়, তখনই পশ্চিমা শক্তি সার্ব নেতা মিলোসেভিচ ও মলাদিচের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসে। পরবর্তী সময়ে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোপন নথি হ’তে দেখা যায় সিআইএ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই গণহত্যার দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও জাতিসংঘ বসনিয়ার কসাই খ্যাত মলাদিচকে গণহত্যা ও অপরাপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও আজও বসনিয়ার গণহত্যার নায়কদের যথাযথ বিচার করতে সক্ষম হয়নি। মুসলমান হওয়ার কারণেই তাদের ওপর এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের যথাযথ বিচার হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।