ইসলাম
যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, রামাযান মাসের ‘ছাওম’ তার মধ্যে
অন্যতম। ‘ছাওম’-এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শারঈ অর্থে ছুবহে ছাদিক হ’তে
সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানাপিনা, যৌনাচার ও যাবতীয় শরী‘আত নিষিদ্ধ কর্মকান্ড
হ’তে বিরত থাকাকে ছাওম বলা হয়। ছাওম একজন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য
কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর ‘ছিয়াম’ ফরয করা
হ’ল যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা
আল্লাহভীতি অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।
ছিয়ামের মধ্যে মানুষের জন্য বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অথচ আমরা ছিয়াম পালন না করার জন্য নানা অজুহাত দাঁড় করাই! এ অজুহাতগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- ছিয়াম রাখলে স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যায়, স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর, ছিয়াম গ্যাষ্ট্রিক রোগসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। এ কথাগুলো যারা বলে থাকেন, তারা ভুল করেন।
ছিয়াম কেবল ইসলাম ধর্মেই নয়; বরং পৃথিবীর অতীত-বর্তমান সকল ধর্ম ও সমাজে ছিয়াম বা উপবাস রীতি প্রচলিত ছিল এবং আজও আছে। যেমন রোমান, ব্যাবিলনীয় ও আসিরীয়দের মধ্যে ছিয়াম রাখার প্রথা বিদ্যমান ছিল। হিন্দু-বৌদ্ধ, ইহুদী-খৃষ্টান, জৈন, কনফুসিয়াস সব ধর্মেই উপবাস রীতি এখনও প্রচলিত আছে। এ সম্পর্কে ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বৃটানিকা’র নিবন্ধকার ‘ফাস্টিং’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ‘পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যাতে ছিয়াম নেই’। মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী বলেন, ‘ছিয়াম আদম (আঃ) থেকেই চলে আসছে’।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ছিয়াম বা উপবাস ধর্মে আস্থাশীল সর্বকালের সকল জাতির মধ্যে প্রচলিত একটি সার্বজনীন প্রথা হিসাবে বিদ্যমান। তবে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মে এর নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন। এক্ষণে আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ছিয়ামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করতে চাই। যাতে ছিয়ামের বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সকলের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অনেকে মনে করে, ছিয়াম রাখলে দেহের রোগ বৃদ্ধি পায়, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় প্রভৃতি। এ কারণে কোন কোন ডাক্তারের পরামর্শে ও নিজেদের হীনমন্যতায় কেউ কেউ ছিয়াম রাখতে চায় না কিংবা সামান্য কারণে ছিয়াম ভেঙ্গে ফেলে।
তবে
কঠিন রোগের কথা ভিন্ন। সে অবস্থায় ছিয়াম রাখার ব্যাপারে শরী‘আতেও ছাড় দেয়া
হয়েছে। মুসাফির ও পীড়িত ব্যক্তিদের জন্য ছিয়াম রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। এ
সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হ’লে কিংবা সফরে
থাকলে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে’ (বাক্বারাহ ১৮৪)।
মূলতঃ ছিয়াম পালন অতি কষ্টসাধ্য বা শ্রম সাপেক্ষ নয়। এই সাধনায় একজন ধনী, বিলাসী, অতিভোজী ব্যক্তি খুব সহজেই বুঝতে পারেন, না খেয়ে থাকার বা অভুক্ত থাকার কষ্টটা কি। আর এই অনুভূতির অভ্যন্তরে থাকে মানবকল্যাণে হস্তদ্বয় সম্প্রসারণ করার পরম শিক্ষা। ছিয়ামের হুকুম-আহকাম পালনে নিজেকে কেবল কষ্ট, পরিশ্রম ও দুঃসহ ক্লেশে ফেলা হয় না; বরং দেহে যে সামান্য কষ্ট অনুভূত হয় পরিণামে তা হয়ে উঠে ফলপ্রসূ। অধুনা উন্নত বিজ্ঞান এ সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৫৮-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ডাঃ গোলাম মুহাম্মাদ মুআযযাম ও তাঁর সহযোগীদের রামাযান মাসে মানব শরীরের উপর ছিয়ামের প্রভাব সম্পর্কে পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, ছিয়ামের কারণে মানব শরীরের কোন ক্ষতি হয় না, কেবল ওযন সামান্য কমে, তাও উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে ছিয়াম আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (Diet Control) অপেক্ষা বহু দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। ১৯৬০ সালে তাঁদের গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয় যে, ছিয়াম দ্বারা পেটের শূলবেদনা বৃদ্ধি পায়- এ ধারণা নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক। কারণ উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলে এটা বাড়ে- এই সত্য কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূলবেদনার রোগীকে ছিয়াম রাখতে নিষেধ করেন। ১৭ জন ছিয়াম পালনকারীর পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশী, ছিয়ামের ফলে তাদের এই উভয় দোষই সেরে গেছে। এই গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয় যে, ছিয়াম দ্বারা রক্তের ‘পটাশিয়াম’ কমে যায় এবং তাতে শরীরের ক্ষতি সাধিত হয়- এই ধারণাও অমূলক। কারণ পটাশিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা যেতে থাকে হৃদপিন্ডের উপর, অথচ ১১ জন ছিয়াম পালনকারীর হৃদপিন্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিও গ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (ছিয়ামের পূর্বে ও ছিয়াম রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ছিয়াম দ্বারা এদের হৃদপিন্ডের ক্রিয়ার কোনই ব্যতিক্রম ঘটেনি। সুতরাং বুঝা গেল যে, ছিয়াম দ্বারা রক্তের যে পটাশিয়াম কমে, তা অতি সামান্য এবং স্বাভাবিক সীমারেখার মধ্যে। তবে ছিয়াম দ্বারা কোন কোন মানুষ কিছুটা খিটখিটে মেযাজের হয়ে যায়, তা রক্তে সামান্য শর্করা কমার দরুণই হয়ে থাকে। কিন্তু তা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ক্ষতিকর নয়। অন্য কোন সময় ক্ষুধা পেলেও এরূপ হয়ে থাকে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ডাঃ হিপোক্রেটিস বহু শতাব্দী পূর্বে বলেছেন, The more you nourish a deseased body, the worse you make it. অর্থাৎ অসুস্থ দেহে যতই খাবার দিবে, ততই রোগ বাড়তে থাকবে।
ছিয়াম একজন মানুষের শুধু পাকস্থলি বা হৃদপিন্ডকে সক্রিয়ই রাখে না; বরং অন্যান্য প্রায় সকল রোগের জন্যও যথেষ্ট উপকারী। যেমন-
মস্তিষ্কের কার্যক্রম : ছিয়াম মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিক খাদ্য গ্রহণে শরীরের ওপর যেমন চাপ বৃদ্ধি পায়, তেমনি এই চাপ মস্তিষ্কের ওপরও পড়ে। এজন্যই বলা হয়, Empty stomuch is the powerhouse of knowledge. ‘ক্ষুধার্ত উদর জ্ঞানের অাঁধার’।
কোলেস্টেরল কমায় : মানবদেহে চর্বি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে হৃদরোগ, রক্তচাপ, বহুমূত্র রোগসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। ছিয়াম চর্বি বা কোলেস্টেরল-এর পরিমাণ কমিয়ে শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে নিরাপদ রাখে।
লিভার ও কিডনীর ক্ষেত্রে : কিডনীর মাধ্যমে শরীরে প্রতি মিনিটে ১-৩ লিটার রক্ত সঞ্চালিত হয়। খারাপ পদার্থগুলি মূত্রথলিতে প্রেরণ করে। ছিয়ামাবস্থায় কিডনী ও লিভার বিশ্রাম পায়। ফলে এ সময়ে অঙ্গদ্বয় বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ডায়াবেটিস রোগে ছিয়াম : বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আর ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ছিয়াম যথেষ্ট উপকারী। কারণ ছিয়াম অবস্থায় ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী বহু ইনস্যুলিন তৈরী হয়।
ধূমপান ও নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার : ছিয়ামের জন্য সকল প্রকার ধূমপান ও নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন বন্ধ থাকে। ফলে মানুষের দেহে জটিল রোগ যেমন- ক্যান্সার, হার্ট-স্ট্রোক, ব্রেইন স্ট্রোক সহ বহু জটিল রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ভাজা-পোড়া খাবার পরিত্যাগ : সকল ডাক্তার একমত যে, ছিয়াম পালনের পর ভাজা-পোড়া খাবার পরিবেশন স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যেমন- বাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁয় তৈল একাধিকবার ব্যবহার করা হয়। এই তৈল আবার উত্তপ্ত করা হয় ৩০০-৪০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। অথচ তৈলের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তেল হচ্ছে এক প্রকার স্নেহ জাতীয় পদার্থ। এটি উচ্চ তাপমাত্রায় 'Acrolene' নামে এক ধরনের জৈব হাইড্রোকার্বন তৈরী করে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা ধীরে ধীরে মানুষের হজমশক্তি নষ্ট করে ফেলে। ফলে পেটে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, ডায়রিয়া, পাকস্থলি জ্বালা-পোড়া সহ নানা প্রকার জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। সুতরাং খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকা যরূরী। ডাক্তারদের মতে, ইফতারীর সময় খেজুর, পানি, হালকা ও শরবত জাতীয় খাদ্য খাওয়া ভাল।
ছিয়াম সম্পর্কে বিভিন্ন ডাক্তার ও মনীষীদের উক্তি : বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা রোগী দেখার সময় রোগীকে ৩ সপ্তাহের জন্য উপবাস বা ছিয়াম থাকতে বলতেন। ডাঃ নাফিউন বলেন, শরীর ভাল থাকে তিনটি কারণে। এর অন্যতম একটি হ’ল- এক মাস ছিয়াম রাখা। ডাঃ মেঘনাথ সাহা বলেন, ছিয়াম বা উপবাসে আমি নিজে উপকৃত হয়েছি। ছিয়াম/উপবাস থাকলে পেটে গোলমাল থাকে না’। পন্ডিত বিদ্যাসাগর কাশ্মীরী বলেন, ‘ছিয়াম পালন পৃথিবীর সমস্ত উপবাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’। জনাব ফিরোজ রাজ মহাত্মাগান্ধীর জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি (মহাত্মাগান্ধী) ছিয়াম রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। মহাত্মাগান্ধী বলেন, ‘যদি তোমরা শরীরকে সতেজ ও সচল রাখতে চাও তাহ’লে শরীরকে ন্যূনতম আহার দাও এবং পূর্ণদিবস ছিয়াম রাখ’।
নৈতিক শিক্ষায় ছিয়াম : হেনরী মূর বলেন, মানুষের চরিত্র গঠনে ছিয়াম খুবই ফলদায়ক ব্যবস্থা। ডাঃ এমারসন বলেন, ছিয়ামে মানুষের মনের ওপর দারুণ প্রভাব পড়ে। যেমন- কর্মে মনোযোগ আসে, পশুত্ব দূরীভূত হয়, সমাজ গঠনে সহায়তা করে। ইমাম গায্যালী বলেন, ছিয়াম মুসলমানদের কেবল পরকালের মুক্তির পথ দেখায় না, নৈতিক চরিত্র গঠনেও এর দারুণ ভূমিকা রয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ছিয়ামের ফযীলত কেবল আখেরাতেই নয়; বরং তা দুনিয়াতে মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রদ। তাই আমাদের সুস্থ, সুন্দর, দেহ-মন ও স্বাস্থ্য নিয়ে অতি সহজ ও শান্তিময় জীবন গড়ার ব্যবস্থা হিসাবে মহান আল্লাহ তা‘আলা ছিয়াম প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের উপর সাধ্যের বাইরে কিছুই চাপিয়ে দেননি। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা- ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান ও তোমাদের পক্ষে যা কঠিন তা তিনি চান না’ (বাক্বারাহ ১৮৫)। ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না’ (বাক্বারাহ ২৮৬)।
অতএব আমরা যেন সকলে রামাযানের মাহাত্ম্য বজায় রেখে সকল গর্হিত কাজকে ছুঁড়ে ফেলে ছিয়াম সাধনায় নিমগ্ন থেকে সুস্থ-সুন্দর দেহ ও মন-মানসিকতার অধিকারী হয়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে সফলকাম হ’তে পারি- আল্লাহ আমাদেরকে সে তাওফীক দান করুন- আমীন!
শামসুল আলম
সহকারী শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।