এটি প্রচলিত অর্থে কোন ব্যক্তি ভিত্তিক মাযহাব, মতবাদ বা ইজম-এর নাম নয়। বরং এটি একটি পথের নাম। যে পথ আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র পথ। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। এপথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবনের সমস্ত হেদায়াত এপথেই মওজুদ রয়েছে। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম ও সালাফে ছালেহীন সর্বদা এপথেই মানুষকে আহবান জানিয়ে গেছেন। আহলেহাদীছ তাই চরিত্রগত দিক দিয়ে একটি দাওয়াত, একটি ‘আন্দোলন’ এর নাম। এ আন্দোলন ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ আন্দোলন দুনিয়ার সকল মানুষকে বিশেষ করে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকায় বিভক্ত শতধা বিচ্ছিন্ন মুসলিম উম্মাহকে সকল প্রকারের সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামী ছেড়ে এবং সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে চিরশান্তির গ্যারান্টি আল্লাহর কিতাব ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের মর্মকেন্দ্রে জমায়েত হবার আহবান জানায়। কিতাব ও সুন্নাতের অভ্রান্ত পথনির্দেশকে কেন্দ্র করেই এ আন্দোলন গতি লাভ করেছে। উম্মতের কোন ফক্বীহ, মুজতাহিদ, অলি-আউলিয়া, ইমাম বা ইসলামী চিন্তাবিদের দেওয়া কোন নিজস্ব চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন গড়ে উঠেনি। তারা হুকূমত প্রতিষ্ঠাকে ‘বড় ইবাদত’ এবং ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদত সমূহকে উক্ত বড় ইবাদত প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ট্রেনিং কোর্স’ মনে করেন না। তারা বুলেট বা ব্যালট নয়, বরং নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি দাওয়াত এবং শিরকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ বলে বিশ্বাস করেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ব্যতীত এ আন্দোলনের কর্মীদের অন্য কোন ‘গাইড বুক’ নেই। মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত তাদের অন্য কোন অভ্রান্ত ইমাম নেই। ইসলাম ব্যতীত তাদের অন্য কোন ‘মাযহাব’ বা চলার পথ নেই। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ফিক্বহ গ্রন্থ নেই। প্রচলিত চার মাযহাবের ইমামদেরকে তারা যথাযোগ্য সম্মান করে থাকেন। কিন্তু ভুল ও শুদ্ধ সবকিছু মিলিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ বা তাক্বলীদ করাকে তারা অন্যায় ও অযৌক্তিক বলে মনে করেন।
খালেছ তাওহীদে বিশ্বাসী আহলেহাদীছগণ দুঃখে ও বিপদে কেবলমাত্র আল্লাহরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাঁরই নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করেন। তাঁরই নিকটে কাঁদেন, তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য ছাদাক্বা করেন। ‘তাক্বদীরের’ ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস রেখে যথাসাধ্য ‘তদবীর’ করে চলেন। পরকালীন মুক্তির জন্য তারা শিরক ও বিদ‘আতমুক্ত এবং শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমলকেই একমাত্র ‘অসীলা’ হিসাবে মনে করেন। যে সকল কথায় ও কর্মে শিরক ও বিদ‘আতের সামান্যতম ছিটে-ফোঁটা থাকে, তা হ’তে তারা দূরে থাকেন। কোন মানুষকে ‘ইলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে তারা বিশ্বাস করেন না। নবী ব্যতীত অন্য কাউকে তারা মা‘ছূম বা নিষ্পাপ বলে মনে করেন না।
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে তারা নূরের সৃষ্টি বা ‘নূরনবী’ নয় বরং মাটির সৃষ্টি বা ‘মানুষ নবী’ বলে বিশ্বাস করেন। তারা কোন মৃত ব্যক্তিকে কোনরূপ মঙ্গলামঙ্গলের অধিকারী মনে করেন না। এমনকি কোন জীবিত ব্যক্তিও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত অপরের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। কবরে সিজদা করা, সেখানে মানত করা, ফুল দেওয়া, বাতি দেওয়া, গেলাফ চড়ানো, গোসল করানো, নযর-নেয়ায পাঠানো, মোরগ বা খাসি যবেহ করে ‘হাজত’ দেওয়া, কবরবাসীর অসীলায় মুক্তি কামনা করা, তার নিকটে ফরিয়াদ পেশ করা ইত্যাদিকে তারা প্রকাশ্য শিরক মনে করেন। এমনিভাবে একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হওয়ার অলীক ধারণা ও তাঁর সম্মানে সকলে দাঁড়িয়ে (ক্বিয়াম করে) সালাম জানানোকে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার গুণ কল্পনার মতই ঘৃণ্যতম পাপ বলে মনে করেন। তাঁর নামে ‘জশনে জুলূস’ ও র্যালী করাকে স্রেফ ‘রিয়া’ ও ভক্তির নামে ভান করা বলে মনে করেন। যা নিকৃষ্টতম বিদ‘আত সমূহের অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে কোন মৃত মানুষের সম্মানে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা, নিজেদের বানানো স্মৃতিসৌধে বা কথিত শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, বিভিন্ন মানুষের তৈলচিত্র, ছবি-মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণ ও সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ইত্যাদি সবকিছু জাহেলী যুগের ফেলে আসা অগ্নিপূজা ও মূর্তিপূজার আধুনিক রূপ বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ মনে-প্রাণে একথা বিশ্বাস করেন যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ইসলামের কোন হুকুম গোপন করে যাননি। বরং বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে এবং ইসলামী চরিত্রের নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ রূপকার হিসাবে দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুঅতী জীবনে স্বীয় কথায়, কর্মে ও আচরণে ইসলামী শরী‘আতের ভিতর-বাহির ও খুঁটি-নাটি সব কিছুই তিনি স্বীয় উম্মতের জন্য স্পষ্ট করে গিয়েছেন এবং ‘অহিয়ে এলাহীর’ সবটুকু উম্মতের নিকট পূর্ণ সততার সাথে যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর জীবন সায়াহ্নে বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত লক্ষাধিক ছাহাবীর নিকট হ’তে সাক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর নিকট হ’তে সরাসরি ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার নিশ্চয়তাও লাভ করেছেন। অতএব আহলেহাদীছগণ মনে করেন যে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে ইসলামী জীবন বিধানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র লাভ করার পর নিজেদের আবিষ্কৃত হাক্বীক্বত, তরীক্বত ও মা‘রেফাত তত্ত্বের তথাকথিত সীনা ব-সীনা বাত্বেনী ইলমের তালাশে অযথা সময় নষ্ট করা ইসলামের সহজ-সরল ও পরিচ্ছন্ন জীবন বিধান হ’তে দূরে সরে যাওয়ারই নামান্তর। সঙ্গে সঙ্গে এটা শেষনবী (ছাঃ)-এর শরী‘আত সংক্রান্ত আমানতদারীর ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা ঈমানের প্রকাশ্য বিরোধী।
আহলেহাদীছগণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে বিশ্বাস করেন এবং এই বিশ্বাসকে ঈমানের অন্যতম প্রধান রুকন বা স্তম্ভ বলে মনে করেন। এই রুকনকে অস্বীকার বা অমান্যকারী কিংবা এতে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তি কখনোই মুসলমান হ’তে পারে না। তাঁর পরে আর কোন নবী নেই। অতএব তিনি মুসলিম-অমুসলিম, জিন-ইনসান ও সৃষ্টিজগতের একমাত্র নবী। তাঁর অনুসারী বিশ্বের সকল মুসলমান একই মিল্লাতভুক্ত একটি মহাজাতি। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ মুসলিম মিল্লাতকে আপোষে সকল দলাদলি ভুলে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর একক নেতৃত্বে শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়।
পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে আহলেহাদীছগণ ইসলামকে সর্বযুগীয় সমাধান বলে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামের গতিশীল (Dynamic) হওয়ার স্বার্থেই ‘ইজতিহাদ’কে সকল যুগে অবশ্য প্রয়োজনীয় এবং ‘তাক্বলীদে শাখছী’কে অবশ্য বর্জনীয় বলে মনে করেন। যার সাক্ষাৎ পরিণতিতে অবশেষে আমরা হয়তবা সারাটি জীবন ধরে একজনের দেওয়া একটি ভুলের অনুসরণ করে চলি। অথচ স্ব স্ব ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থেই তা পরিত্যাগ করে নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে চলা জান্নাতপিয়াসী মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য ছিল। বলা আবশ্যক যে, আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল দাবী চিরদিন এটাই।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ‘আহলেহাদীছ’-এর পরিচয় এবং এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যাবলী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সকল আহলেহাদীছ মুসলমান, কিন্তু সকল মুসলমান আহলেহাদীছ নন। কেননা অন্যেরা কেবল ঐ হাদীছগুলিই মানেন, যেগুলি তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা আলেমদের গৃহীত মাযহাবের অনুকূলে হয়। কিন্তু আহলেহাদীছগণ নিরপেক্ষভাবে যেকোন ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করে থাকেন। উপরের আলোচনায় একথাও প্রমাণিত হয় যে, আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল, ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। এই তাক্বলীদ ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন মাযহাব বা তরীকার হৌক কিংবা বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রগতির নামে কোন বিজাতীয় মতবাদের হৌক।
পরিশেষে আমরা সবিনয়ে নিবেদন রাখতে চাই যে, যেভাবে নির্দিষ্ট ইমাম, মাযহাব, ফিক্বহ ও তরীকা রচনা করে লোকেরা বিভিন্ন দলীয় নামে বিভক্ত হয়েছেন, এ ধরনের কোন বৈশিষ্ট্য প্রকৃত আহলেহাদীছের মধ্যে নেই। অতএব ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে এযাম ও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণকে যেমন কেউ কোন ব্যক্তি পূজারী ফের্কায় চিহ্নিত করতে পারেন না, তেমনি তাঁদেরই নামে নামাংকিত ও তাঁদেরই একনিষ্ঠ অনুসারী আহলেহাদীছগণকেও প্রচলিত অর্থে কোন ফের্কায় চিহ্নিত করা যায় না। তবে উদার ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যগত কারণে আহলেহাদীছগণ নিঃসন্দেহে একটি পৃথক জামা‘আতী সত্তা। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকেও ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হয়ে থাকে। আল্লাহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে আমাদের সার্বিক জীবন গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন- আমীন! (স.স.)।