তাওহীদের সাথে শিরকের সম্পর্ক যেমন ওযূর সাথে বায়ু নিঃসরণের সম্পর্ক। তাওহীদ থাকলে শিরক থাকবেনা, শিরক থাকলে তাওহীদ থাকবেনা। দু’টির মাঝে আপোষের কোন সুযোগ নেই। তাওহীদের চেতনা হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা। আর শিরকের চেতনা হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সৃষ্টির দাসত্ব করা। যেখানে শরীক হয় মুখ্য এবং আল্লাহ হন গৌণ। যেমন মক্কার মুশরিকরা কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করার সময় বলত, লাববাইকা লা শারীকা লাকা, ইল্লা শারীকান হুয়া লাক; তামলিকুহু ওয়া মা মালাক’ (আমি হাযির; তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক ব্যতীত যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক’) (মুসলিম হা/১১৮৫)। নিজ বংশীয় এই শরীক পূজারী কুরায়েশদের সাথেই রাসূল (ছাঃ)-এর আজীবন যুদ্ধ করতে হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত হও’ (নাহল ১৬/৩৬)। ত্বাগূত অর্থ মূর্তি, শয়তান ইত্যাদি। বস্ত্ততঃ সকল শক্তি ও সকল সম্মান কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত (বাক্বারাহ ২/১৬৫; ইউনুস ১০/৬৫)। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনি স্থায়ী ও চিরঞ্জীব। তিনিই রূযীদাতা, তিনিই পালনকর্তা, তিনি বিধানদাতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তিনি ব্যতীত অন্য কেউই আমাদের শর্তহীন আনুগত্য ও উপাসনা পাবার যোগ্য নয়। তিনি ব্যতীত অন্য কারু নিকটে মানুষের উন্নত মস্তক অবনত হবেনা।
এক্ষণে সম্মানের উদ্দেশ্যে ছবি-মূর্তি, ভাষ্কর্য-প্রতিকৃতি, বেদী-মিনার, শিখা-প্রদীপ এমনকি একটি বাঁশকেও যদি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, তবে সেটাই হবে পূজা। একইভাবে সূর্য-চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজির উদ্দেশ্যে যদি সম্মান প্রদর্শন করা হয়, সেটাও পূজা। কোন বৃক্ষ-নদী, পাহাড়-পর্বত বা স্থানকে সম্মান প্রদর্শন করাটাও পূজা। মানুষের উন্নত মস্তক কেবল আল্লাহর কাছে নত হবে। তাঁর কাছেই সবকিছু চাওয়া-পাওয়া থাকবে। এটাই হ’ল ‘তাওহীদ’। এর বিপরীত হ’ল শিরক। এই পার্থক্য যেকোন মুসলিম এমনকি হিন্দুনেতারাও বুঝেন। যেমন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বলেন, ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম’, ‘ভক্তেরা সব লুটায়ে শির করিছে প্রণাম’। ‘পথ ভাবে আমি দেব’, রথ ভাবে আমি’, ‘মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘মুগ্ধ ওরে স্বপ্নঘোরে’ ‘যদি প্রাণের আসন-কোণে’ ‘ধুলায় গড়া দেবতারে’ ‘লুকিয়ে রাখিস আপন মনে’, ‘চিরদিনের প্রভু তবে, তোদের প্রাণে বিফল হবে’, ‘বাইরে সে যে দাঁড়িয়ে রবে, কত-না যুগ-যুগান্তরে’। একইভাবে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। তিনি সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার তীব্র বিরোধিতা করে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রচার করেন। তাঁর সমমনাদের মধ্যে এইচ.এল.ভি ডিরোজিও ও তার বিপ্লবী শিষ্যবৃন্দ, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুসারীগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার পিতা-মাতার ১৪ সন্তানের কনিষ্ঠতম।
অতএব সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে কেবলমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং তাঁর বিধান মেনে চলাই সৃষ্টিসেরা মানুষের একমাত্র কর্তব্য। নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূল মানবজাতিকে এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন এবং সাথে সাথে তারা শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু মানুষ শয়তানী ধোঁকায় পড়ে বিভিন্ন ধর্মনেতা ও সমাজনেতার মূর্তি বা ভাষ্কর্য তৈরী করে সেখানে ভক্তি নিবেদন করে এসেছে। এর বিরোধিতা করলে নূহ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে তার কওমের নেতারা বলেছিল, নূহ নেতৃত্বের অভিলাষী (মুমিনূন ২৩/২৪-২৫)। নেতারা তাদের জনগণকে বলেছিল, ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করোনা এবং পরিত্যাগ করোনা ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব ও নাসরকে’ (নূহ ৭১/২৩)। এই পাঁচটি মূর্তি ছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন মৃত ব্যক্তির। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পাপরাশির কারণে তাদেরকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। অতঃপর তাদেরকে (কবরের) আগুনে প্রবেশ করানো হয়েছে। সেদিন তারা আল্লাহর মুকাবিলায় কাউকে তাদের সাহায্যকারী পায়নি’ (নূহ ৭১/২৫)।
মহাপ্লাবনে ধ্বংসের পর নূহ (আঃ)-এর কিশতীতে উদ্ধার পাওয়া অল্প সংখ্যক মুমিন নর-নারীর উত্তরসূরীরাই হ’ল বর্তমান পৃথিবীর সমস্ত মানুষ (ছাফফাত ৩৭/৭৭; ইসরা ১৭/৩)। এজন্য আদি পিতা আদমের পর নূহ (আঃ)-কে মানবজাতির ‘দ্বিতীয় পিতা’ বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সন্তানদের মধ্যে পূর্বের ন্যায় আবার শিরকের পাপ মাথা চাড়া দেয়। নূহের যুগের ন্যায় পরবর্তী যুগেও জ্ঞানান্ধ ধর্মনেতা ও সমাজনেতারাই মূর্তি-ভাষ্কর্যের শিরকের পক্ষে তাওহীদপন্থী জনগণকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করেছে।
সম্প্রতি ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার পর সরকারের মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত মন্ত্রী সবাইকে বললেন, ‘দেশে একদিকে সাম্প্রদায়িকতা, আরেকদিকে অসাম্প্রদায়িকতার দু’টি ধারা চলছে। একদিকে ৪৭-এর চেতনা, অন্যদিকে ৭১-এর চেতনা। বিজয়ের এই দিনে আমাদের শপথ হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির যে বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তার করেছে; সেই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করা’। তার আগের দিন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলা হ’ল, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না’। উপরোক্ত ভাষণগুলিতে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে যে, নেতারাই দেশকে বিভক্ত করতে চাচ্ছেন ও সহিংসতায় উসকে দিচ্ছেন। এই ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও অদূরদর্শী নীতি। এই চিন্তা থাকলে কোন নেতা কখনোই জাতীয় নেতা হ’তে পারেন না। কখনো দেশ ঐক্যবদ্ধ হবেনা এবং সেখানে নিরপেক্ষ শাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবেনা। ‘৫/৭টি মসজিদ-মাদ্রাসার মিলন মোহনায়, দু’টি মসজিদের অবকাঠামো ভেঙ্গে পদ্মা সেতুর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ঢাকা কেন্দ্রের প্রবেশ দ্বারে ধোলাইপাড় মোড়ে ভাষ্কর্য স্থাপনের ফলে স্থানীয় ইমাম মুছল্লী ও তৌহিদী জনতা সেখানে ভাষ্কর্যের বদলে বিকল্প কোন উত্তম পন্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখার দাবী জানিয়েছিল’ (দৈনিক ইনকিলাব, ৯ই ডিসেম্বর ২০২০, ১/৩ কলাম)। ঈমানদার জনগণের এই অনুভূতিকে সরকার কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এজন্যেই আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি মুখের উপর ভর দিয়ে চলে, সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত, নাকি যে ব্যক্তি সোজা হয়ে সরল পথে চলে (সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত)? (মুল্ক ৬৭/২২)।
কে না জানে যে, ধর্মান্ধ হিন্দুনেতাদের উন্মত্ত হিংস্রতা থেকে বাঁচার জন্য দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি লাভের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল। সেদিন ৪৭-এর মূল চেতনা ছিল ইসলাম। আজকের ৭১-এর চেতনার দাবীদারগণের পিতা-মাতারা সবাই ছিলেন ৪৭-এর চেতনাধারী। ঢাকার নওয়াব সলীমুল্লাহ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশেম, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান সবাই ছিলেন ৪৭-এর চেতনা বাস্তবায়নের সম্মুখ সারির যোদ্ধা। তারা কিন্তু কেউ তাদের মূর্তি-ভাষ্কর্য স্থাপনের কথা বলে যাননি। পরবর্তীতে পাকিস্তানী নেতাদের অদূরদর্শিতা ও ব্যাপক যুলুমের বিরুদ্ধে মযলূমের সংগ্রাম শুরু হয়। যার পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রের উপর ৭১-য়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যালেমের বিরুদ্ধে মযলূমের এই চেতনা ছিল মূলতঃ ইসলামের চেতনা। যেখানে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ মুনকার বা অন্যায় দেখলে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ কর। না পারলে যবান দিয়ে। না পারলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। আর সেটা হ’ল সবচাইতে দুর্বলতম ঈমান (মুসলিম হা/৪৯)। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আশির ঊর্ধ্ব বয়সের যারা এখনো বেঁচে আছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি এবং সনদের তোয়াক্কাও করেননা তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, আমরা যেখানেই নিষ্ঠুর যুলুম দেখেছি, সেখানেই প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়েছি।
মুসলমানের এই জিহাদী চেতনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছেন কথিত ৭১-এর চেতনাধারীরা। ৭ই মার্চ ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে যে মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং ১৬ই ডিসেম্বরে ‘আল্লাহর সাহায্য’ কামনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে যার শেষ, সেই মুক্তিযুদ্ধকেই এখন ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান নেতাদের এইসব বানোয়াট চেতনা যে জনগণ গ্রহণ করেনি, তার বাস্তব প্রমাণ দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ। তারা কোনরূপ উস্কানীতে ভুলে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করেনা। বরং সকলে মিলেমিশে বসবাস করে। হাতেগণা কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে দেখা যায় মাঝে-মধ্যে এইসব চেতনার পুরীষ উদ্গীরণ করতে। ক্ষমতায় গিয়ে তারা ভোটারদের ও বাপ-দাদাদের ঈমানী চেতনা ভুলে যান এবং প্রতিবেশী মূর্তিপূজারী রাষ্ট্রের শিরকী চেতনা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। যাতে এদেশের মুসলিম বৈশিষ্ট্য মুছে যায়। তারা সর্বদা গণতন্ত্রের বুলি আওড়ান। অথচ মূর্তি-ভাষ্কর্য প্রতিষ্ঠার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের সম্মতি নিয়েছেন? এমনকি জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাস করেছেন? তাহ’লে জনগণের জমি জবর দখল করে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে সর্বত্র মিনার ও মূর্তি-ভাষ্কর্য প্রতিষ্ঠার অধিকার তারা কোথায় পেলেন? ক্বিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর নিকটে কি কৈফিয়ত দিবেন? ঐসব স্থানের মাটি এবং নিজেদের হাত-পা ও দেহ-চর্ম সেদিন আল্লাহর নিকট নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিবে (যিলযাল ৪; ইয়াসীন ৬৫; হা-মীম সাজদাহ ২০-২১)। মূর্তি-ভাষ্কর্যের সাথে কোন রাজনীতি নেই। এটি পুরাপুরি ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে জড়িত। সরকারই এই ধর্মীয় বিষয়টিকে রাজনীতিতে এনেছেন। তারা প্রকাশ্য শিরককে তাওহীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। কোন মুসলমান যা কখনোই মেনে নিতে পারে না। যদি সরকার কথা না শুনে এবং মূর্তি-ভাষ্কর্য সরিয়ে না নেয়, তাহ’লে বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি সমূহের ন্যায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম এই মুসলিম রাষ্ট্রটিও আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাবে। নেতাদের পাপে যেমন নূহের কওম প্লাবনে ডুবে মরেছিল, আমাদের নেতাদের পাপে তেমনি দেশ ডুববে।
নেতারা সব কাজ করেন ভোটের স্বার্থে এবং দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে। অথচ সত্যিকারের ভোট হ’লে তারা নিশ্চিতভাবে ঈমানদারগণের ভোট হারাবেন। আর মূর্তি ও মিনার প্রতিষ্ঠায় কোন দারিদ্র্য বিমোচন আছে কি? অথচ শোষণের মূল হাতিয়ার সূদী অর্থনীতি বুক ফুলিয়ে চলছে। ঘুষ-দুর্নীতি, মদ-জুয়া, মুনাফাখোরী-মওজুদদারী সর্বদা জোরদার। প্রতিবেশী দেশটি আমাদের দেশের অভিন্ন প্রধান নদীগুলির উজানে বাঁধ দিয়ে ইচ্ছামত আমাদেরকে শুকিয়ে ও ডুবিয়ে মারছে। পাহাড় প্রমাণ বাণিজ্য বৈষম্য ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশকে তাদের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করেছে। এমনকি সেদেশের হাই কমিশনার চট্টগ্রামকে তাদের দেশের জন্য ‘প্রবেশদ্বার’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারী এই দলটি না থাকলে বাংলাদেশে আমাদের আর কোন বন্ধু নেই’। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ’। আমাদের মন্ত্রীরাও বলছেন, ‘তাদের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, এমনকি নাভির সম্পর্ক রয়েছে’। ফলে এই মধুর সম্পর্কের সুযোগে তারা এখন আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের উপর আঘাত হানতে চাচ্ছে। মূর্তিপূজারী ঐ দেশটি বাংলাদেশকেও তাদের ন্যায় মূর্তিপূজারী বানাতে চাচ্ছে। আর তাদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছেন আমাদের নেতাগণ। ৭১-য়ে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে নেতাদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই এখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। বস্ত্ততঃ প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিই হ’ল সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তব দৃষ্টান্ত। যেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সর্বদা রাষ্ট্রীয়ভাবে লংঘন করা হচ্ছে। অতএব এসবের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের মানুষের উদার ইসলামী চেতনাকে ধ্বংস করা যাবেনা।
সকল নবী-রাসূল মূর্তি-ভাষ্কর্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। নূহ, হূদ ও ছালেহ (আঃ)-এর পরবর্তী সকল নবীগণের পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-এর আবির্ভাবকালীন সময়ে ইরাক শিক্ষা ও সভ্যতায় পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় ছিল। এমনকি তারা সৌরজগত নিয়েও গবেষণা করত। কিন্তু শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা বিভিন্ন মূর্তি ও তারকার পূজা করত। ইব্রাহীম (আঃ) উভয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন। কিন্তু তাঁর দাওয়াত প্রথমেই তাঁর পিতা অস্বীকার করে বলেন, ‘হে ইব্রাহীম! তুমি কি আমাদের উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তবে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি আমার সম্মুখ হ’তে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)। এতেই বুঝা যায়, হাতেগড়া প্রাণহীন একটি মূর্তি বা ভাষ্কর্যের প্রতি মানুষের ভালবাসা কিরূপ? অথচ এই ভালবাসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়াটাই হ’ল ‘তাওহীদ’। অতঃপর ইরাকের সম্রাট নমরূদ ইব্রাহীম (আঃ)-কে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করেন। তিনি আগুনকে নির্দেশ দেন, ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইব্রাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। শিরকপন্থীদের বিরুদ্ধে তাওহীদপন্থীদের এই বিজয় কেবল সে যুগেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং পরবর্তী যুগে সকল নবী-রাসূল ও ঈমানদারগণের পক্ষে অব্যাহত ছিল। নিরস্ত্র মূসা (আঃ)-এর দো‘আয় তৎকালীন মিসরের অত্যাচারী সম্রাট ফেরাঊন ও তার বিশাল সেনাবাহিনীর সাগরডুবি, ফিলিস্তীনের দুর্ধর্ষ আমালেক্বা সম্রাট জালূতের বিরুদ্ধে দাঊদ ও তালূতের বিজয়, খন্দক যুদ্ধে সম্মিলিত আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে ও তাবূক যুদ্ধে সম্মিলিত রোমক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বিনা যুদ্ধে বিজয় এবং তার পরবর্তী খলীফাদের সময় ইসলামের বিশ্ব বিজয় আমাদেরকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বস্ত্ততঃ মানুষ বেঁচে থাকে তার স্মৃতির মধ্যে, মূর্তি বা মিনারের মধ্যে নয়। সেটা হ’লে তো নবী-রাসূলদের মূর্তি-ভাষ্কর্যে পৃথিবী ভরে যেত। যুগে যুগে এটাই সত্য যে, শিরকের পরিণতিতে আল্লাহর গযব নেমে আসে। যেমন ইতিপূর্বে ছয়টি জাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উক্ত ৬টি জাতি হ’ল- কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদইয়ান ও কওমে ফেরাঊন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর ভাতিজা লূত-এর কওমের ধ্বংসস্থলটি বর্তমানে ‘মৃত সাগর’ বা ‘ডেড সী’ নামে পরিচিত। যা ফিলিস্তীন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী বিশাল অঞ্চল জুড়ে নদীর রূপ ধারণ করে আছে। যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ৭৭ কি.মি., প্রস্থে ১২ কি.মি. এবং গভীরতায় ৪০০ মিটার। এর পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ এমনকি কোন জলজ প্রাণীও বেঁচে থাকে না। অতএব আল্লাহর গযব থেকে শিক্ষা নিন।
পরিশেষে এটা নিশ্চিতভাবে ধারণা করা চলে যে, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর হঠাৎ সরকারীভাবে অনেকটা গোপনে দেশব্যাপী মূর্তি-ভাষ্কর্য প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে যাওয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক। আমরা সরকারকে বলব, আল্লাহকে ভয় করুন এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে মূর্তি-ভাষ্কর্য প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত থাকুন। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলব, সকল প্রকার সহিংসতা হ’তে বিরত থাকুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)।