ভারতের গুজরাটে ও ফিলিস্তীনের জেনিন উদ্বাস্ত্ত শিবিরের মুসলিম জনগোষ্ঠী ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুরতার শিকার হ’ল। আধুনিক মিডিয়া এই দুই জনপদে মনুষ্যরূপী পশুদের অবিশ্বাস্য হিংস্রতার বিস্তারিত রেকর্ড জগদ্বাসীর সম্মুখে উদ্ভাসিত করে দিল। নির্যাতিত ও নিষ্পিষ্ট মানবতার কাতর আর্তনাদ হৃদয়বান মানুষের অন্তর স্পর্শ করল। ধিক্কার দিল নামধারী বিশ্বনেতাদের পশুসুলভ আচরণকে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ হয়তবা এটাকে তাকদীরের লিখন বলে সান্ত্বনা খুঁজে নিলেন। অপরপক্ষে ইহূদী-খ্রিষ্টান ও তাদের সহযোগী অমুসলিম জোট দেখেও না দেখার ভান করে রইল। ‘চোরকে চুরি করার ও মহাজনকে সাবধান থাকার কপট নীতির অনুশীলনে পারদর্শী এইসব বিশ্বনেতারা হয়তবা সান্ত্বনা পেয়েছেন এই ভেবে যে, যারা মরছে ওরা মুসলমান। ওরা মানুষ নয়, ওরা মৌলবাদী, ওরা জঙ্গীবাদী, ওরা সন্ত্রাসী। তাই ওদের সংখ্যা ভূপৃষ্ঠে যত কমে, তত ভাল।
বিভিন্ন কারণে মানুষ অনেক সময় অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। দল ও রাষ্ট্র নেতারাও এর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু বিশ্বের ১৯২টি রাষ্ট্রের একজন বাদে প্রায় সকল নেতাই যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিন্ন সুরে কথা বলতে পারেন, এটা সম্ভবতঃ ইতিহাসের একটি নতুন অভিজ্ঞতা। গুজরাট ও ফিলিস্তীনের সাম্প্রতিক গণহত্যা এবং ইতিপূর্বে সংঘটিত বসনিয়া, চেচনিয়া, কসোভো, সোমালিয়া প্রভৃতি দেশের গণহত্যাগুলি যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত না হয়ে অন্যদের বিরুদ্ধে হ’ত, তাহ’লে হয়তবা বিশ্ববিবেক চুপ করে থাকত না। কিন্তু একথা কে বুঝাবে যে, মুসলমানেরাও মানুষ। তাদেরও রয়েছে আত্মরক্ষার অধিকার।
কাশ্মীরে ভারত যে দখলদার শক্তি, একথা একটা শিশুও বুঝে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলি নিয়ে ‘পাকিস্তান’ গঠিত হয়। সে হিসাবে কাশ্মীর নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের অংশীভূত। কিন্তু কাশ্মীরী বংশোদ্ভূত জওয়াহের লাল নেহরু এটা মানতে না পেরে রাতারাতি সৈন্য পাঠিয়ে রাজ্যটির বৃহদাংশ দখল করে নেন। সেই থেকে শুরু হ’ল অধিকৃত কাশ্মীরে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম। কাশ্মীরী মুজাহিদদের এই মুক্তিযুদ্ধকে এখন বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ ও ‘জঙ্গী তৎপরতা’। যদি এরা সন্ত্রাসী হয়, তবে এদেরকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে হানাদার ভারত। আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে দখলদার শক্তি চিরকাল ‘সন্ত্রাসী’ বলেই অভিহিত করেছে। যেমন করেছিল দখলদার বৃটিশরা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ক্ষুদিরাম, তীতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী, শাহ ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে।
জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হ’ল কাশ্মীরে গণভোটের। কিন্তু ভারত তা মানলো না। কারণ তারা ভালভাবেই জানে যে, গণভোটের ফলাফল ভারতের বিরুদ্ধে যাবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সোল এজেন্ট ইঙ্গ-মার্কিন চক্র ভারতকে নগ্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ শক্তিবলয়ের প্রায় সকল দেশ মুজাহিদদের সমর্থন ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধের জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ একটি দেশও কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ন্যায়সঙ্গত দাবী মেনে নেওয়ার জন্য ভারতকে চাপ দিচ্ছে না। ফলে ভারত এখন বলছে ‘কাশ্মীর’ বলে কোন সমস্যা নেই। পরিণামে হয়ত দেখা যাবে যে, আল্লাহ চাহে তো এই শতাব্দীতেই কাশ্মীর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
গত ২৮শে ফেব্রুয়ারী থেকে সংঘটিত গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য ভারত সরকার ও ক্ষমতাসীন বিজেপি কাউকে দোষারোপ করার ছুঁতো খুঁজে পায়নি। গোধরায় রেলওয়ে কম্পার্টমেন্টে অগ্নিসংযোগের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছে কোনরূপ নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়াই, স্রেফ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ঐ এলাকায় মুসলিম গণহত্যা চালানোর পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অজুহাত সৃষ্টির জন্য। দেশী-বিদেশী প্রতিটি মানবাধিকার সংগঠন এবং কয়েকটি বিদেশী দূতাবাসের নিজস্ব চ্যানেলে পরিচালিত তদন্তে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা ছিল সরকারীভাবে পূর্ব পরিকল্পিত। ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ তাদের ৭৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী রিপোর্টে বলেছে যে, স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষের দেওয়া ভোটার তালিকা ও মুসলিম মালিকানাধীন খতিয়ান দেখে দেখে উগ্র হিন্দুরা মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। এমনকি ভারতীয় পত্র-পত্রিকায়ও গুজরাট সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে এবং সেখানকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গুজরাটের বিজেপি দলীয় প্রাদেশিক সরকারের আশু পদত্যাগ দাবী করেছে। কলিকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘সানন্দা’ ১৫ই এপ্রিল সংখ্যায় ৮ মাসের গর্ভবতী এক মুসলিম মায়ের পেট চিরে বাচ্চা বের করে টুকরো টুকরো করা, মুসলিম মহিলাকে পুলিশ কর্তৃক দাঙ্গাবাজদের হাতে তুলে দেওয়া ও তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা, এক পরিবারের ১৯ জনের সবাইকে পুকুরের পানি বিদ্যুতায়িত করে সেখানে নিক্ষেপ করে হত্যা করা ইত্যাকার লোমহর্ষক অশ্রুতপূর্ব বর্বরতার ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক অরুন্ধতি রায় গুজরাটের মুসলিম গণহত্যাকে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর গণহত্যার সাথে তুলনা করেছেন।
গুজরাট পরিস্থিতিতে দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে জর্জরিত ভারতীয় নেতারা নিজেদের সন্ত্রাসী চেহারা ঢাকার জন্য ও গুজরাট ট্রাজেডী থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন এবং মার্কিন উপ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গত ১৪ই মে ভারত সফরের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে বোমা হামলা করে নারী-শিশু সহ কিছু নিরপরাধ বনু আদমকে হত্যা করে প্রমাণ করতে চান যে, এসবই কাশ্মীরী মুসলিম জঙ্গীদের কাজ। তারপর এটাকে ইস্যু করে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সারা দেশে যুদ্ধের সাজ সাজ রব তুলে দেয়, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিও দেয়। মজার কথা এই যে, বোমা হামলাকারী ৩ জনের কেউ বাঁচেনি। যেমন বিগত ২২শে ডিসেম্বরে ভারতীয় পার্লামেন্টে হামলাকারী ৬ জন বন্দুকধারীর কেউ বাঁচেনি। যাতে আসল তথ্য কখনোই ফাঁস হবার সুযোগ না থাকে। দুর্ভাগ্য, বিশ্ব বিবেক এত ভোতা হয়ে গেছে যে, ভারত যা বলছে, তারা তাই বিশ্বাস করছে। একটি দেশও আসল কথা বলছে না। যত দোষ মুসলমানদের। তারাই সন্ত্রাসী, তারাই জঙ্গীবাদী। অথচ বিজেপির মূল দল হিন্দু মৌলবাদী আরএসএস, বজরং ইত্যাদি সংগঠনগুলিকে, যাদের উত্থিত কৃপাণ-ত্রিশূলে মুসলিম গণহত্যার ছবি সকল পত্র-পত্রিকায় আসছে, তাদেরকে কেউ সন্ত্রাসী বলছে না। বর্তমান বিজেপি সরকারের মূল কলকাঠি তাদের হাতেই সমর্পিত।
ভারতের মুসলিম নাগরিকদের উপর নিয়মিত নির্যাতন, কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের দাবী প্রত্যাখ্যান ও কাশ্মীরী মুজাহিদদের সাহায্য দানের অভিযোগ এনে পাকিস্তানকে যুদ্ধে প্ররোচিত করার সাথে ইসরাঈলের ফিলিস্তীনী নির্যাতন, তাদের জন্মগত অধিকার হরণ এবং তাদেরকে সাহায্য দানের অভিযোগ এনে প্রতিবেশী আরব দেশগুলিকে যুদ্ধে উস্কে দেওয়া ইত্যাদির স্পষ্ট মিল রয়েছে। ভারত ও ইসরাঈলের এই কৌশলগত মিল কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন যাবৎ দু’দেশের সামরিক গোয়েন্দাদের যৌথ পরিকল্পনা ও কর্মকান্ডের ফল। এমনকি ইসরাঈল ভারতের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে যে, তারা যদি এ ধরনের কোন অপ্রচলিত অস্ত্র তৈরীর চেষ্টা করে, তবে তাদের সে চেষ্টা যেকোন মূল্যে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। আমেরিকাও এই অস্ত্র বিক্রিতে সম্মত ছিল। হিন্দু-ইহূদী জোটের এই অপতৎপরতার মূল লক্ষ্য স্রেফ কাশ্মীরীদের দমন করা নয়, বরং তাদের লক্ষ্য ভারতের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভীত করা এবং প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলিকে চোখ রাঙানো। মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের আলস্য নিদ্রা ভাঙবে কি? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন![1]
[1]. ৫ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০২।