পৃথিবীতে এযাবত মৌলিকভাবে দু’টি শাসনব্যবস্থা দেখা গিয়েছে। রাজতন্ত্র ও খেলাফত। দু’টির মধ্যে দু’টি আদর্শের প্রতিফলন রয়েছে। রাজতন্ত্রে রাজার ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তাঁর হাতেই থাকে সার্বভৌমত্বের চাবিকাঠি। যেমন বিগত যুগে নমরূদ, ফেরাঊন ও সর্বযুগে তাদের অনুসারী শাসকরা। (২) নবীদের শাসন। যেমন দাঊদ, সুলায়মান ও যুগে যুগে নবীদের অনুসারী খলীফাগণ। শেষনবীর পরে খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া, আববাসীয়, ফাতেমীয়, স্পেনীয়, ওছমানীয় খেলাফত সমূহ। যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১০০ বছর পূর্বে ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক বিশ্বাসঘাতক প্রধান সেনাপতি কামাল পাশার মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্ব মুসলিমের রাজনৈতিক ঐক্য শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় ইহূদী-নাছারাদের চালান করা বস্ত্তবাদী মতাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বিষবাষ্প। যার কুপ্রভাবে অখন্ড মুসলিম খেলাফত আজ টুকরা টুকরা হয়ে ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে এবং কার্যত প্রায় সকল ক্ষেত্রে অমুসলিমদের গোলামী করে যাচ্ছে। ‘গণতন্ত্রে’ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ শাসন করে। বিরোধী দল সমূহ সংসদে গিয়ে কেবল হৈচৈ করে। অবশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে সব বাতিল হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হ’ল দেশের অধিকাংশ বৈধ নাগরিক ভোট দেয় না। ফলে গণতন্ত্রের নামে অধিকাংশ দেশেই চলে সংখ্যালঘুর শাসন। গণতন্ত্রে নেতৃত্বের জন্য কোনরূপ যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মানদন্ড নির্ধারিত থাকেনা। ফলে সর্বত্র অযোগ্য ও অদক্ষ নেতৃত্বের বিস্তার ঘটে। সর্বোপরি জনমতের কোন স্থিরতা না থাকায় এবং ঘন ঘন জনমতের পরিবর্তন হওয়ায় গণতান্ত্রিক সংবিধান কখনোই জনকল্যাণের স্থায়ী সংবিধান নয়। তাছাড়া গণতন্ত্রে দু’টি শিরক রয়েছে। (ক) জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস। (খ) অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। পক্ষান্তরে ইসলামে আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস এবং অহি-র বিধানই চূড়ান্ত। আর মুসলমান কোন অবস্থায় শিরকের সঙ্গে আপোষ করতে পারে না। পক্ষান্তরে ইসলামী খেলাফত খলীফা বা আমীর ও তাঁর পুরা প্রশাসনযন্ত্র আল্লাহ প্রেরিত অহি-র বিধানের বাস্তবায়নকারী হয়। তাই ‘খেলাফত’ ব্যতীত বাকী সকল ব্যবস্থাই মানুষের ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার বাহন ব্যতীত কিছু নয়।
রাজতন্ত্র ও খেলাফতের মধ্যকার পার্থক্য সমূহ : (১) রাজতন্ত্র ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারী শাসন। পক্ষান্তরে ‘খেলাফত’ আল্লাহ প্রেরিত ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নাম। (২) রাজতন্ত্রে মানুষের হাতেই থাকে সার্বভৌম ক্ষমতা। পক্ষান্তরে খেলাফতে আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এবং বান্দা মালিকের প্রতিনিধি মাত্র। (৩) রাজতন্ত্রে মানব রচিত বিধান অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়। পক্ষান্তরে খেলাফতে আল্লাহ প্রেরিত বিধান অনুযায়ী দেশ শাসিত হয়। (৪) রাজতন্ত্রে মানুষ মানুষের দাসত্ব করে। পক্ষান্তরে খেলাফতে মানুষ কেবল আল্লাহর দাসত্ব করে। (৫) রাজতন্ত্রে মানুষের রচিত আইন সদা পরিবর্তনশীল। পক্ষান্তরে খেলাফতে আল্লাহর বিধান সর্বদা অপরিবর্তনীয়। (৬) রাজতন্ত্রে হালাল-হারাম নির্ধারণের মালিক হ’ল মানুষ। পক্ষান্তরে খেলাফতে উক্ত অধিকার কেবল আল্লাহর। (৭) রাজতন্ত্রে ‘রাজা’ সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। পক্ষান্তরে খলীফা বা আমীরের ক্ষমতা আল্লাহর বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। (৮) রাজতন্ত্রে রাজার নাবালক এমনকি অযোগ্য পুত্র-কন্যাগণ রাজা হ’তে পারেন। পক্ষান্তরে ইসলামী খেলাফতে বিজ্ঞ নির্বাচক মন্ডলীর পরামর্শের মাধ্যমে শরী‘আত নির্ধারিত শর্তাদি পূরণ সাপেক্ষে খলীফা বা আমীর নির্বাচিত হ’তে পারেন। (৯) খলীফা বা আমীর আল্লাহভীরু শূরা সদস্যদের নিকটে পরামর্শ আহবান করেন এবং তাঁরাও ইসলামী আদব রক্ষা করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁকে যথাযথ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরামর্শ সভায় ভিন্ন ভিন্ন মত এলেও আমীর সামগ্রিক বিবেচনায় কল্যাণকর কোন সিদ্ধান্ত নিলে সবাই তা শ্রদ্ধার সাথে মেনে নেন। শূরার সিদ্ধান্ত সকলের সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। অতঃপর সকলে মিলে আল্লাহর উপর ভরসা করে তা বাস্তবায়নের সাধ্যমত চেষ্টা করেন (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
(১০) রাজতন্ত্রে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রধান বিবেচ্য হয়। পক্ষান্তরে খেলাফতে আল্লাহর বিধানই প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকে। এমনকি কুরআন বা ছহীহ হাদীছের দলীল থাকলে ‘আমীর’ শূরা সদস্যদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে পারেন। (১১) রাজতন্ত্রে রাজাগণ আমৃত্যু স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু খেলাফত ব্যবস্থায় খলীফা ও কর্মকর্তাগণের কার্যকালের মেয়াদ নির্ভর করে তাদের সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের উপর। (১২) রাজতন্ত্রে রাজা হওয়ার লড়াই চলে। পক্ষান্তরে ‘খেলাফত’ ব্যবস্থায় পদ ও ক্ষমতা দখলের আকাংখা ও প্রচেষ্টা দু’টিই নিষিদ্ধ। এখানে কেবল মজলিসে শূরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে একজনকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করেন। আমীর তাদের নিকটে ও আল্লাহর নিকটে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকেন। (১৩) ইসলামকে যেমন কোন একটি দল বা সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট বলে গণ্য করা যায় না, ইসলামী খেলাফতকেও তেমনি নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের জন্য গণ্য করা যায় না। এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য কল্যানকর। যেমন আল্লাহর দেওয়া আলো-বাতাস, মাটি ও পানি সবার জন্য সমভাবে কল্যাণকর।
১৫ হিজরীতে ইরাক বিজয়ের সময় ক্বাদেসিয়া যুদ্ধে পারস্য সেনাপতি রুস্তম মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ)-এর নিকট দূত প্রেরণ করে তার নিকটে মুসলিম পক্ষের একজন জ্ঞানী প্রতিনিধি পাঠাতে বলেন। তখন হযরত মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ)-কে তার নিকটে পাঠানো হয়। তিনি উপস্থিত হ’লে সেনাপতি রুস্তম তাকে বলেন (ক) আপনারা আমাদের প্রতিবেশী। আপনাদের প্রতি আমরা সদ্ব্যবহার করব। আপনারা ব্যবসা করতে এলে আমরা সুযোগ দেব। উত্তরে মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য দুনিয়া নয়, বরং আখেরাত। আল্লাহ আমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছেন। যিনি একটি সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন। তা থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে লাঞ্ছিত হবে। আর যে তাকে আঁকড়ে ধরবে, সে সম্মানিত হবে’। রুস্তম বললেন (খ) সে দ্বীনটি কি? তিনি বললেন, এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। সেই সাথে তিনি আল্লাহর নিকট থেকে যা নিয়ে আগমন করেছেন, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। রুস্তম বললেন (গ) এছাড়া আর কি? মুগীরা বললেন, ‘মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে বের করে আল্লাহর গোলামীতে ফিরিয়ে নেওয়া’। এদিকে খলীফা ওমর (রাঃ) যুদ্ধের খবর জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে মদীনার বাইরে অনেক দূর হেঁটে আসেন। ইতিমধ্যে সেনাপতি সা‘দের পাঠানো দূত সেখানে পৌঁছে যায়। ওমর তার নিকট যুদ্ধে বিজয়ের ঘটনা শুনতে শুনতে মদীনায় পৌঁছে যান। এসময় লোকদের আগমনে দূত বুঝতে পারে যে, ইনিই খলীফা। তখন সে দ্রুত ঘোড়া থেকে নেমে খলীফাকে বলে, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি বলবেন না যে আপনি খলীফা? ওমর বললেন, ‘তোমার কোন দোষ নেই হে আমার ভাই!’ (আল-বিদায়াহ ৭/৪৪ পৃ.)।
উপরোক্ত বিবরণে ইসলামী খেলাফতের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি সাধারণ মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির ভ্রাতৃসুলভ আচরণ ও তার সারল্য বিশ্বকে চমকিত করে। ইতিহাসে যার তুলনা নেই। বিশ্বব্যাপী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ তার বান্দাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।