দেশে প্রাচীন
কাবুলিওয়ালাদের নয়া সংস্করণ ‘এনজিও’র ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার বেড়াজালে আটকে গেছে
গ্রামগঞ্জের নারী-পুরুষ। ‘গরিবী হটাও’ আর ‘স্বাবলম্বী’র নামে বিদেশী টাকায়
শত শত এনজিও মাকড়সার জালের মতো সারাদেশে ক্ষুদ্রঋণের জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। এ
ঋণের জালে আটকে গেছে লাখ লাখ অসহায় নারী-পুরুষ। নারী স্বাবলম্বী এবং আত্ম
কর্মসংস্থানের নামে এনজিওগুলো গ্রামের মানুষের মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে। চড়া
সূদে সে ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তির যোগান দিতে গিয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ছে ঋণ
গ্রহীতারা।
স্বাবলম্বী হওয়া তো দূরের কথা ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে ভিটা-মাটি, ঘটি-বাটি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী বিক্রি করতে হচ্ছে। ঋণের কিস্তির যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা এবং কিডনী বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি বংশ পরম্পরায় ক্ষুদ্রঋণের সূদের ঘানি টানতে হচ্ছে। ঋণের কিস্তি নিয়ে বিরোধে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অবক্ষয় এবং ঘর-সংসার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
সম্প্রতি বগুড়ার ধনুটের গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের যমুনার চরের কয়েকজন ঋণ গ্রহীতা জানান, কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। তারপরও কিস্তির জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। ফলে এনজিও’র মাঠকর্মীদের দেখলেই তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হন।
জয়পুরহাট যেলার কালাই গ্রামের আখতার আলম নামের এক ব্যক্তি এনজিও’র ঋণের কিস্তি নিয়মিত দিতে পারেনি। অতঃপর একপর্যায়ে ঋণের দায় মেটাতে কিডনী বিক্রি করেছে। কালাই গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা মুকাররম হোসাইনও ক্ষুদ্রঋণের চক্করে পড়ে কিডনী বিক্রি করেছে।
রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, পাবনাসহ ২০/২২টি যেলার শতাধিক গ্রামের অভিন্ন চিত্র জানা গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক, প্রশিকা, ব্রাক, আশার মতো বড় বড় এনজিও ছাড়াও যেলা-উপযেলা পর্যায়ে ও স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এনজিও জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নের নামে ক্ষুদ্রঋণ দানের চটকদার ব্যবসায় নেমে পড়েছে।
রংপুরের কাউনিয়ার আছিয়া খাতুন জানান, তার মা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন আশির দশকে। মা মারা যাওয়ার পর ঋণের কিস্তি সে চালিয়েছিল। এখন নিজে কাজকর্ম করতে পারেন না। এখন সে কিস্তি চালায় তার ছেলে।
বগুড়া সারিয়াকান্দির এক মাদরাসার অধ্যক্ষ লুৎফর রহমান জানান, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে এনজিওগুলো কার্যত গরীব মানুষকে ঋণের ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। যারা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই যেন হয়ে গেছে কিস্তি পরিশোধ করা। বছরের পর বছর কিস্তি দিয়েও তারা ঋণের জাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
ওমর আলী নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগী পালন, কুটিরশিল্প, রবিশস্য ফলানো সবকিছুতেই এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে ঋণ দেয়া হয়। সে ঋণের সূদ নেয়া হয় শতকরা ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরিবী হটানোর নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে কোন কোন এনজিও শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত সূদ আদায় করে থাকে। উত্তরাঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে এমন এনজিওর সন্ধানও পাওয়া গেছে যারা শতভাগও সূদ আদায় করছে। তাদের আদায়ের পদ্ধতিও অদ্ভূত।
রংপুরে, লালমণিরহাট, গাইবান্ধা প্রভৃতি যেলার বিভিন্ন গ্রামের ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক গ্রামীণ ব্যাংক, প্রশিকাসহ কয়েকটি এনজিও ঋণ নেয়ার পরের সপ্তাহ থেকে কিস্তি আদায় শুরু করে। আর ফসল ভালো না হ’লে ঋণগ্রহীতাকে ঘরের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, ঘটি-বাটি বিক্রি করে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। যখন তাতেও কুলায় না তখন ভিটা-মাটি ও ঘর বিক্রি করতে হয়। এমনও বহু ঘটনা ঘটেছে যে কিস্তি আদায়কারীরা ঋণের দায়ে ঋণ গ্রহীতার ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। এ বীভৎসতায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
এনজিওর ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই ঋণের দায়ে অতিষ্ঠ। তারা এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু এনজিওগুলির কৌশলী তৎপরতায় তারা কোনভাবেই এ জাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
উল্লেখ্য, ৭০-৮০-এর দশকে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মানবদরদীরা এদেশের অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং অক্সফাম, ডানিডা, খ্রিস্টান সোসাইটিসহ কয়েকটি এনজিও’র মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহায়তা দিতে থাকে। কিন্তু এভাবে চাহিদা না মেটায় পরবর্তীতে তা বেসরকারী পর্যায়ে এনজিও’র মাধ্যমে পরিচালিত হ’তে শুরু করে। শর্ত ছিল তারা অসহায় গরীবদের না লাভ-না লোকসানের ভিত্তিতে ঋণ ও সহায়তা দিবে। তখন থেকেই ধনী দেশগুলোর সরকার ও বেসরকারী সাহায্য প্রতিষ্ঠান তাদেরকে অকাতরে অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের গরীব মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে এনজিওগুলো এখন দাদন ব্যবসায় নেমে পড়েছে। একদিকে তারা গরীবের জন্য বিদেশ থেকে আনা অর্থে দামি গাড়ি-বাড়ী, অট্টালিকার মালিক হচ্ছে; অন্যদিকে গরীবদের ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে ফেলে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়ছে। অথচ ক্ষুদ্রঋণের জালে আটকে অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছে গ্রামের দরিদ্র মানুষ।
এদিকে সরকার এসব বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার। স্বাধীনতার পর থেকে যে সরকারই ক্ষমতাসীন হয়েছেন, কারোরই এ বিষয়ে সামান্য কোন মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায়নি।
(সংকলিত)।