পটল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এটি একটি প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে প্রায় ২৩,৫১০ হেক্টর জমিতে পটল চাষ করা হয়। যার মোট উৎপাদন ৬৮,৪১৫ মেট্রিক টন। পটলের উৎপাদন অনেক সবজি থেকে অধিক এবং প্রাপ্তি কালও দীর্ঘ (ফেব্রুয়ারী-অক্টোবর)। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে যখন সবজির অভাব দেখা দেয় তখন পটল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সবজি হিসাবে কাজ করে, যা প্রায় মোট সবজি চাহিদার ২০% পূরণ করে থাকে।

আবহাওয়া : সাধারণত পটলকে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার উপযোগী ফসল বলে উল্লেখ করা হয়। পটলের জন্য উচ্চতর তাপমাত্রা এবং অধিক সূর্যালোক প্রয়োজন হয়। বৃষ্টিপাতের আধিক্য ফুলের পরাগায়নে বিঘ্ন ঘটায় এবং ফলন কমে যায়।

মাটি : বন্যামুক্ত ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এমন দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি পটল চাষের জন্য ভালো।

জাত : আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ পর্যন্ত ৬৪টি জাত সংগ্রহ করেন এবং এদের গুণাগুণ পরীক্ষা করেছেন। সংগৃহীত জাত থেকে বারি পটল-১ ও বারি পটল-২ নামে দু’টো উচ্চফলনশীল, রোগবালাই ও পোকামাকড় সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়।

জাতের বৈশিষ্ট্য :

বারি পটল-১

* ফলের আকার মাঝারি, বেলুনাকৃতি ও দু’প্রান্ত ভোতা। * ফলের রঙ গাঢ় সবুজ, গায়ে ৯-১০টি হালকা সবুজ রঙের ডোরা থাকে। * ফল ৯-১০ সে.মি. লম্বা এবং প্রস্থ ৪.০-৪.৫ সে.মি.। * প্রতিটি ফলের ওযন ৫০ গ্রাম। * প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ২৪০টি ফল ধরে। * গাছপ্রতি ফলন প্রায় ১০ কেজি। * হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ টন।

বারি পটল-২

* ফলের আকার বড়, সিলিন্ডারাকৃতি ও দু’প্রান্ত সূঁচালো। * ফলের রঙ হালকা সবুজ, গায়ে ১০-১১টি সাদা রঙের ডোরা থাকে। * ফল ১১-১২ সে.মি. লম্বা এবং প্রস্থ ৩.৫-৪.০ সে.মি.। প্রতি ফলের ওযন প্রায় ৫৫ গ্রাম। * প্রতিটি গাছে সর্বোচ্চ ৩৮০টি ফল ধরে। * গাছপ্রতি ফলন প্রায় ১৪ কেজি। * হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৮ টন।

রোপণের সময় : অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত যে কোন সময় জমিতে পটলের লতা লাগানো যায়। তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে পটলের লতা না লাগানোই ভালো। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে লাগালে গাছ থেকে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ফসল সংগ্রহ করা যায় এবং ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে লাগালে মে-জুন মাসে ফল ধরে।

চারা উৎপাদন : পটল চাষের জন্য বীজ, শাখা কলম ও কন্দ মূল (শিকড়) সব পদ্ধতিতেই পটলের বংশ বিস্তার করা যায়। বাণিজ্যিক চাষের জন্য শাখা কলম ও কন্দ মূল ব্যবহার করা ভালো এবং লাভজনক। বীজতলায় কিংবা সরাসরি জমিতে শাখা কলম বা কন্দ মূল লাগিয়ে চারা উৎপাদন করা যায়। কন্দ মূল ৩-৪টি চোখসহ কেটে মাদায় লাগালে কম কন্দ মূল দিয়ে বেশী জমিতে পটল চাষ করা যায়। বীজ থেকে চারা পাওয়া সম্ভব হ’লেও নিম্নলিখিত কারণে বংশবিস্তারের জন্য বীজ ব্যবহৃত হয় না। (১) বীজের অঙ্কুরণ অনিয়মিত। (২) বীজের চারার মধ্যে শতকরা ৫০% পুরুষ জাতের হয়। (৩) বীজের চারা থেকে ফল পেতে অনেক বেশী সময় লাগে।

রিং পদ্ধতিতে উন্নত শাখা কলম উৎপাদন : এক বছর বয়সী গাছের যেকোন শাখা মাঝামাঝি অংশ থেকে এক মিটার লম্বা শাখা দিয়ে রিং বা চুড়ি তৈরি করে পিট বা মাদায় লাগাতে হবে। পটলের শাখা কলম ৫০ পিপিএম ইনডোল বিডটারিক অ্যাসিড দ্রবণে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে মাদায় বা পিটে লাগালে তাড়াতাড়ি এবং বেশীসংখ্যক মূল গজায়।

জমি তৈরি ও চারা রোপণ : প্রথমে মাটি ভাল করে চাষ দিয়ে প্রস্ত্তত করে নেয়া উচিত। জমিকে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান করে নিতে হবে। বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করলে ফলন ভাল হয় এবং বর্ষাকালে বেড নষ্ট হয় না। সাধারণত একটি বেড ১.০-১.৫ মিটার চওড়া হয়। বেডের মাঝামাঝি এক মিটার থেকে দেড় মিটার বা দু’হাত থেকে তিন হাত পর পর মাদায় চারা রোপণ করতে হয়। এক বেড থেকে আর এক বেডের মাঝে ৭৫ সেমি. নালা রাখতে হবে।

মাদা বা পিট তৈরি : মাদা বা পিটের আকার- দৈর্ঘ্য- ৫০ সেমি. প্রস্থ- ৫০ সেমি. গভীরতা- ৪০ সেমি. নালা- ৭৫ সেমি। মাদা থেকে মাদার দূরত্ব-১.০-১.৫ মিটার। মাদায় গাছের দূরত্ব-৭.০-১০.০ সে.মি. গভীরতা-৫০ সেমি।

অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা : পটল একটি লতানো উদ্ভিদ। এজন্য পটলের বাউনি/মাচা দেয়া অত্যাবশ্যক। বাঁশের কাঠির সাহায্যে চারা গাছকে মাচায় তুলে দেয়া হয়। এক মিটার উচ্চতায় বাঁশের মাচা/বাউনি দিলে পটলের ফলন দ্বিগুণ হবে। কারণ এতে অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা ভাল হয়, কম পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ হয়। তা ছাড়া বাউনির বদলে মাটির ওপর খড়-কুটা বা কচুরিপানা বিছিয়ে দিয়ে তার ওপর পটলের গাছ তুলে দিলেও ফলন ভাল পাওয়া যায়। এতে উৎপাদন খরচ কম হয়। প্রতিবার ফসল সংগ্রহের পর মরা, রোগ ও পোকা আক্রান্ত পাতা ও শাখা ছাঁটাই করা প্রয়োজন। এতে ফলধারী নতুন শাখার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ফলন বেশী হয়।

আগাছা দমন : আগাছা জমি থেকে খাদ্য, আলো-বাতাস ও স্থান দখল করে পটলের গাছকে দুর্বল করে ফেলে। তাছাড়া আগাছা বিভিন্ন রোগও পোকামাকড়ের আবাসস্থল হিসাবে কাজ করে। তাই পটলের জমি সর্বদা আগাছামুক্ত রাখা উচিত।

পানি নিষ্কাশন : পটল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

পরাগায়ন : পটল চাষের ক্ষেত্রে কৃত্রিম পরাগায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জমিতে স্ত্রী গাছের তুলনায় পুরুষ গাছের সংখ্যা কম থাকলে হাত দিয়ে পরাগায়নের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য সকাল ৬-৭-টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ এ সময় পটলের ফুল পরাগায়নের উপযোগী থাকে। পটল গাছে পরাগায়নের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ ফুল দরকার। একটি সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল তুলে নিন এবং পুংকেশর ঠিক করে ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলুন। তারপর প্রতিটি স্ত্রী ফুলের গর্ভকেশরের মুন্ডু পুংকেশর দ্বারা আস্তে আস্তে ২-৩ বার রেণু ছুয়ে দিন। এর ফলে গর্ভকেশরের মুন্ডু রেণু আটকে পরাগায়ন হবে। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে সাধারণত ৭-৮টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা সম্ভব। তাছাড়া পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে তা থেকে পরাগরেণু আলাদা করে পানিযুক্ত একটি প্লাস্টিক পাত্রে নিয়ে হালকা ঝাকি দিয়ে পরাগরেণু মিশ্রিত করে টিউবের মাধ্যমে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডের ওপর ২-৩ ফোঁটা ব্যবহার করেও পরাগায়ন সম্পন্ন করা যায়। এ পদ্ধতিতে পটলের ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়।

ফসল সংগ্রহ : কচি অবস্থায় পটল সংগ্রহ করা উচিত। সাধারণত জাতভেদে ফুল ফোটার ১০-১২ দিনের মধ্যে পটল সংগ্রহের উপযোগী হয়। ফসল এমন পর্যায়ে সংগ্রহ করা উচিত যখন একটি ফল পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশী পরিপক্ব হয়নি। বেশী পরিপক্ব ফলের বীজ বেশী হয় এবং বীজ শক্ত হয়ে যায় ফলে সবজি খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.