অবশেষে মুছে গেল দীর্ঘ সাত দশক ধরে বাংলাদেশ-ভারতের মানচিত্রে ‘ছিটমহল’ নামে বিরাজ করা কাল দাগগুলো। গত ৩১শে জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাত ১২-টা ১ মিনিটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলে বাংলাদেশের পতাকা এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ৫১টিতে ভারতের পতাকা উড়ার পর আক্ষরিক অর্থে ইতিহাস হয়ে গেল মোট ১৬২টি ছিটমহলের ৫২ হাযার মানুষের নিরপরাধ বন্দী জীবনের অভিশপ্ত অধ্যায়। ছিটমহল বিনিময়ে ভারত পেল তাদের অভ্যন্তরে বাংলাদেশী ৫১টি ছিটমহলের ৭,১৫১ একর জমি এবং ১৪ হাযার মানুষ। বাংলাদেশ পেল তার অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের ১৭,১৬০ একর জমি এবং ৪৪ হাযার মানুষ। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশীর ভাগই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসবের মধ্যে ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারীতে ৪টি রয়েছে। আর বাংলাদেশের ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহারে ৪৭টি এবং জলপাইগুড়িতে ৪টি।

ছিটমহলগুলিতে কাঁটাতারের কোনো বেড়া ছিল না, ছিল না কোন সীমানা পিলার। অথচ এক দেশের মানুষ হয়েও তাদের বসবাস করতে হয়েছে অন্য দেশের ভূখন্ডে। ফলে ভিন দেশের মানুষ বিবেচনায় তারা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবধরনের মৌলিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হ’ত।

ছিটমহলগুলো ছিল উপমহাদেশের রাজন্যবর্গের খামখেয়ালিপনা অথবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের নির্মম প্রতীক। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে ব্রিটিশ আইনজীবী সেরিল র‌্যাডক্লিফ ঐ বছরের ১৩ই আগস্ট সীমানা নির্ধারণের যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন, তার অনুসরণে ১৬ই আগস্ট প্রকাশ করা হয় ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র। তড়িঘড়ি এ ধরনের সীমান্ত নির্ধারণে ছিটমহলের মানুষগুলোর ভাগ্য ঝুলে থাকে। তারা রয়ে যায় মানচিত্রের বাইরের মানুষ হিসেবে।

সীমান্তের এই জটিলতা অবসানের জন্য ১৯৫৮ সালে সই হয় নেহরু-নূন চুক্তি। ঐ চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি।

১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি সই হয় বিষয়টি সুরাহার জন্য। বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তা না করায় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদাভাবে তালিকা তৈরীর কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় গরমিল। পরে ১৯৯৭ সালের ৯ই এপ্রিল চূড়ান্ত হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। কিন্তু ঐ চুক্তিও আলোর মুখ দেখেনি।

চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকলে সই করেন। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ভারতের সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার তা বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাসে ব্যর্থ হয়। অতঃপর বর্তমান নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত মে মাসে সর্বসম্মতভাবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। এভাবে অবসান ঘটে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অপেক্ষার। যে সমস্যার সমাধান ১৯৫৮ সালেও হ’তে পারত, হ’তে পারত ১৯৭৪ সালে তা হ’ল ২০১৫ সালে। ভারতের সদিচ্ছার অভাব ও অসহযোগিতার কারণেই যে এই বিলম্ব তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

[আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি এবং উভয় দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাথে সাথে ভারত যেভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে নগ্নভাবে তার ট্রানজিট সুবিধা সহ অন্যান্য স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে, সেজন্য তাদেরকে ধিক্কার জানাচ্ছি (স.স.)]







আরও
আরও
.