কক্সবাজার ১২-১৪ই মার্চ বৃহস্পতি-শনিবার: ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কেন্দ্রীয় ‘শিক্ষা ও দাওয়াতী সফর’ অনুষ্ঠিত হয়। এবারের সফর ছিল ৬ষ্ঠ বার্ষিক শিক্ষা সফর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের সাগরকোলের নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত যেলা কক্সবাজারের সোনাদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, হিমছড়ি, ইনানী বীচ ইত্যাদি ছিল এবারের শিক্ষা সফরের নির্ধারিত স্থান। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের নেতৃত্বে দেশের মোট ৩৩টি যেলা থেকে সর্বমোট ২৬০জন কর্মী ও সুধী এবারের শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণ করেন। যেলা গুলো হচ্ছে- ১. রাজশাহী-সদর ২. রাজশাহী-পূর্ব ৩. রাজশাহী-পশ্চিম ৪. চাঁপাই নবাবগঞ্জ-উত্তর ৫. নওগাঁ ৬. নাটোর ৭. বগুড়া, ৮. গাইবান্ধা-পশ্চিম ৯. রংপুর-পশ্চিম ১০. দিনাজপুর-পূর্ব ১১. দিনাজপুর-পশ্চিম ১২. পঞ্চগড় ১৩. কুড়িগ্রাম-দক্ষিণ, ১৪. লালমণিরহাট ১৫. নীলফামারী-পূর্ব ১৬. পাবনা ১৭. সিরাজগঞ্জ ১৮. জামালপুর-উত্তর ১৯. কুষ্টিয়া-পূর্ব ২০. কুষ্টিয়া-পশ্চিম ২১. মেহেরপুর ২২. চুয়াডাঙ্গা ২৩. ঝিনাইদহ ২৪. খুলনা ২৫. সাতক্ষীরা ২৬. ঢাকা-উত্তর ২৭. ঢাকা-দক্ষিণ ২৮. নারায়ণগঞ্জ ২৯. নরসিংদী ৩০. গাযীপুর ৩১. কিশোরগঞ্জ ৩২. চট্টগ্রাম ও ৩৩. কক্সবাজার।

মজলিসে আমেলার মধ্যে সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল লতীফ, অর্থ সম্পাদক মুহাম্মাদ বাহারুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন. সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক দুররুল হুদা, সমাজকল্যাণ সম্পাদক গোলাম মুক্তাদির ও দফতর সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম শিক্ষা সফরে যোগদান করেন। এছাড়া ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, সহ-সভাপতি মুস্তাফীযুর রহমান সোহেল ও সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক শামীম আহমাদ এতে উপস্থিত ছিলেন। সুশৃঙ্খল এই শিক্ষা সফরে সফরকারীদেরকে মোট ১৩টি টিমে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক টিমে ২০ জন করে সদস্য একজন টিম লিডার ও একজন সহকারী দ্বারা পরিচালিত হন। তিন দিন ব্যাপী এই শিক্ষা সফরে দেশের বিভিন্ন যেলা থেকে অংশগ্রহণকারীগণ কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র ঝাউতলা মেইন রোডে অবস্থিত ‘হোটেল সী কুইনে’ ১২ তারিখ ভোরে এসে একত্রিত হন। উল্লেখ্য যে, সফরের স্থান সমূহের ‘পরিচিতি’ এবং সফর ও সংগঠনের উপর আমীরে জামা‘আতের প্রস্ত্ততকৃত ‘কুইজ’ পৃথক শীটে সফরকারীদের মধ্যে ১ম ও ২য় দিন বিতরণ করা হয়।

কক্সবাজার যেলার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কি.মি. দক্ষিণে কক্সবাজার যেলা শহর অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ৪১৪ কি.মি.। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর ও আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে ১২২ কি.মি. বিস্তৃত বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত।

১৬১৬ সালে মুঘল অধিগ্রহণের আগ পর্যন্ত কক্সবাজার-সহ চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কক্সবাজারের প্রাচীন নাম ‘পালংকী’। একসময় এটি ‘প্যানোয়া’ নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া অর্থ হলুদ ফুল। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকমক করত। কক্সবাজার নামটি এসেছে পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামে ব্রিটিশ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’র এক অফিসারের নাম থেকে। ভারতবর্ষের ১ম ইংরেজ গভর্ণর ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭৪-১৭৮৫)-এর শাসনকালে হিরাম কক্স পালংকীর প্রশাসক নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী ও স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান পুরোনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেন। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় কক্স ছাহেবের বাজার। তখন থেকেই ‘কক্সবাজার’ নামের উৎপত্তি।

১ম দিন : ১২ই মার্চ বৃহস্পতিবার

হোটেল সী কুইন থেকে যাত্রা শুরু: সফরকারীগণ ১২ই মার্চ বৃহস্পতিবার ভোরে কক্সবাজার পৌঁছে আগে থেকে বরাদ্দকৃত ‘হোটেল সী কুইন’-এর নির্ধারিত কক্ষসমূহে বিশ্রাম নেন। অতঃপর সকাল ৮-টা থেকে নির্দিষ্ট কুপনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘হোটেল জামানে’ সকালের নাশতা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, আগের দিন দুপুরে আমীরে জামা‘আত বিমানে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম আসেন। অতঃপর সেখানে চট্টগ্রাম যেলা সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে বাদ মাগরিব ভাষণ দেন। পরদিন সকাল ৫-টায় তিনি মাইক্রোযোগে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রওয়ানা হন। যানজটে কক্সবাজার পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় মোবাইলে তাঁর অনুমতি নিয়ে সফরকারীগণ সকাল ৯-টায় সোনাদিয়া ও মহেশখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮টি জীপ (চাঁদের গাড়ী) যোগে প্রথমে শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া বিআইডব্লিওটিএ ঘাটে, অতঃপর  সেখান থেকে ২৫টি স্পীডবোট যোগে প্রথমে সোনাদিয়া ও পরে মহেশখালী দ্বীপে যান।

মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

(১) মহেশখালী উপযেলাটি মূলতঃ কক্সবাজার যেলার অন্তর্গত দেশের একমাত্র পাহাড় সমৃদ্ধ দ্বীপ। এর আয়তন ৩৮৮.৫০ বর্গ কিলোমিটার। কক্সবাজারের পশ্চিমাংশে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উপযেলা আরো তিনটি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলি হ’ল: সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা। ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এক প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়।

মহেশখালীর সাথে নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস যুক্ত। এই সম্প্রদায়ের প্রভাবের কারণে মহেশখালীতে ‘আদিনাথ মন্দির’ নির্মিত হয়।

২০১১ সালের সরকারী হিসাব অনুযায়ী মহেশখালী উপযেলার মোট জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ২১ হাযার ২১৮। তন্মধ্যে ৯০.০৮% মুসলিম, ৭.৮০% হিন্দু, ১.৩০% বৌদ্ধ এবং ০.৮২% অন্য ধর্মাবলম্বী।

উপযেলাটিতে সাক্ষরতার হার ৩০.৮০%। এখানে ১টি ডিগ্রী কলেজ, ১টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ১টি ফাযিল মাদ্রাসা, ৩টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ৪টি আলিম মাদ্রাসা, ১৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি দাখিল মাদ্রাসা, ৬টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া ৪৩২টি মসজিদ, ১৫টি মন্দির ও ৫টি বৌদ্ধ বিহার রয়েছে।

১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল দ্বীপটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়েছিল এর বিস্তীর্ণ এলাকা। ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬.১ মিটার। সরকারী হিসাবে এতে নিহত হয় ৫০ হাযার মানুষ।

মাতারবাড়ী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প : জানুয়ারী ২০১৮-তে শুরু হওয়া প্রায় ৫০ হাযার কোটি টাকা ব্যয়ের এই মেগা প্রকল্প জানুয়ারী ২০২৪-য়ে শেষ হতে পারে। পূর্বে কোহেলিয়া নদী। দক্ষিণে ও পশ্চিমে বিশাল বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। উপযেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের ১৪১৪ একর জমিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে মাতারবাড়ী সমন্বিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি বড় (মেগা) প্রকল্পের একটি। এই প্রকল্প এলাকায় ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জাইকার সহায়তা চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সিপিজিসিএলের আওতায় ওই এলাকায় আরও ৪৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

(২) সোনাদিয়া : মহেশখালী উপযেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ‘সোনাদিয়া’। এই দ্বীপটির আয়তন ৭ বর্গ কিলোমিটার। কক্সবাজার যেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী উপযেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে সোনাদিয়া অবস্থিত। একটি খাল দ্বারা সোনাদিয়া মহেশখালীর মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন।

স্থানীয় অধিবাসীদের মতে সোনাদিয়া দ্বীপে মানব বসতির ইতিহাস আনুমানিক দেড়শত বছরের। দ্বীপের মানুষেরা মূলতঃ দু’টি গ্রামে বসবাস করে, সোনাদিয়া পূর্বপাড়া এবং সোনাদিয়া পশ্চিমপাড়া। দ্বীপটির বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১৭০০। মাছ ধরা, মাছ শুকানো এবং কৃষিকাজ এই দ্বীপবাসীর মূল পেশা। এই দ্বীপে ২টি মসজিদ, ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১টি সাইক্লোন সেন্টার আছে। সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের মহা পরিকল্পনা বাতিল হয়। সরকার এটিকে বর্তমানে ইকোপার্ক হিসাবে ঘোষণা করেছে।

সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপে কিছু সময় :

২৫টি স্পীডবোটের বহর বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে ছুটে চলে কক্সবাজার শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মহেশখালী উপযেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে এক সাথে এতগুলো স্পীডবোটের পথ চলা যেন সাগরের বুকে কোন মিছিলের মহড়া। অতঃপর সোনাদিয়া চরে নেমে ঘণ্টা ব্যাপী আল্লাহর অপূর্ব নিদর্শন সমূহ প্রত্যক্ষ করেন সকলে। অনেকে দ্বীপের জেলেদের নিকট থেকে শুটকি মাছ ক্রয় করেন। অতঃপর সেখান থেকে পুনরায় স্পীড বোটের কাফেলা চলতে শুরু করে দেশের একমাত্র পাহাড়ী দ্বীপ মহেশখালীর উদ্দেশ্যে।

অতঃপর ঘাটে নেমে মহেশখালীর প্রবেশ পথেই পাহাড়ের উপর আদিনাথ মন্দির। পাহাড়ের পাদদেশে ডাব বিক্রেতাদের সারি। অনেকে মহেশখালীর সুমিষ্ট পানির এই ডাব খেয়ে তৃপ্ত হন। বাধ সাধে জনৈক হিন্দু বিক্রেতা। ডাব কাটার সময় সে ‘মা কালীর নামে’ দায়ের কোপ দেয়। থমকে দাঁড়ান সফরকারী ক্রেতা। দোকানদারকে বললেন, আপনি দেবতার নামে ডাব কাটলেন? এই ডাব আমি খাব না। অতঃপর তাকে টাকা দিয়ে দেন। এই সংবাদ জানার পর অনেকেই ডাব খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

দাওয়াতী কাজে বাধা : বরাবরের ন্যায় এবারও শিক্ষা সফরের একটি মূল অনুসঙ্গ ছিল দাওয়াতী কাজ। মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের লেখা ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?, মীলাদ প্রসঙ্গ, শবেবরাত বই, মাসিক আত-তাহরীক এবং এক নযরে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত, প্রত্যেক মুসলমানের যা জানা প্রয়োজন, মদ ও জুয়া থেকে বিরত থাকুন, ‘বাংলাদেশে ইসলামের আগমন’ প্রভৃতি লিফলেট বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় প্রত্যেক স্পটে। সফরের প্রথম স্পট হিসাবে মহেশখালীতে নেমে রাজশাহী-সদর যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা অধ্যাপক মুবীনুল ইসলামের নেতৃত্ব ৫টি টিম উক্ত বই-পুস্তক ও দাওয়াতী লিফলেট বিতরণ করেন। বাজারে, মসজিদে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও দোকানপাটে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় লিফলেট ও বই-পুস্তক। সবাই আগ্রহ ভরে এগুলি গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে স্থানীয় মুফতী নামধারী ২/৩ জন সহ প্রায় ২০/২৫ জন লোক মহেশখালী বাজারে বিতরণকারীদের একটি অটোরিকশার গতিরোধ করে এবং আচমকা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাবনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা বেলালুদ্দীন সহ ৬ জন এই অটোতে ছিলেন। এ সময় অটোর পিছনে বসা পাবনা যেলার মাদারবাড়িয়া শাখা ‘যুবসংঘে’র সেক্রেটারী তাওফীক হোসাইনের জামার কলার ধরে অটো থেকে নামিয়ে হাতে থাকা লিফলেটগুলি কেড়ে নেয় এবং গালাগালি করতে থাকে যে, তোরা ইহুদী-নাছারাদের দালাল, কার অনুমতি নিয়ে এগুলো বিতরণ করছিস? ফিৎনা ছড়াচ্ছিস, তোদেরকে থানায় দিব ইত্যাদি। এক পর্যায়ে স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় তারা ঘাটে ফিরে আসেন।

অতঃপর স্পীডবোট যোগে দুপুর ১-টার মধ্যেই কক্সবাজার ফিরে আসেন সবাই। হোটেল সী কুইনে পৌঁছে যোহর ও আছর ছালাত জমা ও ক্বছরের সাথে আদায় শেষে ‘হোটেল জামানে’ দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন।

মহেশখালীতে ষড়যন্ত্রের কবলে আমীরে জামা‘আত : আগের দিন সুধী সমাবেশ শেষ করে চট্টগ্রামেই রাত্রি যাপন করেন আমীরে জামা‘আত। অতঃপর বৃহস্পতিবার ভোরে মাইক্রো যোগে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সফরসঙ্গী হিসাবে চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি শেখ সা‘দী, যেলার আগ্রাবাদ শাখার সভাপতি তাজুল ইসলাম, সুধী ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসাইন, ‘আল-আওন’-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ জাহিদ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকির তাঁর সাথে ছিলেন। বেলা পৌনে ১১-টায় কক্সবাজার পৌঁছে প্রথমে তিনি হোটেলে ওঠেন। অতঃপর কিছুসময় পর সাথীদের নিয়ে পৃথক একটি স্পীডবোটে সোনাদিয়া ও মহেশখালী গমন করেন। কক্সবাজার থেকে তাঁর সাথে কুষ্টিয়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সভাপতি মরহূম আব্দুল ওয়াহহাব-এর বড় ছেলে মুজাহিদুল ইসলামসহ আরো দু’জন যোগ দেন।

সোনাদিয়া সফর শেষে মহেশখালী পৌঁছে একটি অটো যোগে তারা মহেশখালীর বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময়ে উপযেলা বাজার সংলগ্ন মসজিদে যোহর-আছর ছালাত জমা ও ক্বছর করে ফেরার পথে স্থানীয় মুফতীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদিনাথ মন্দিরের নিকটে পুলিশ তাঁদের গতিরোধ করে এবং থানায় নিয়ে যায়। অতঃপর সেখানকার ভারপ্রাপ্ত হিন্দু অফিসার ইনচার্জ তাদের সাথে অভদ্র ভাষায় কথা বলেন। কিছু পরেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে তিনি পুলিশের গাড়ীতে করে সবাইকে ঘাটে পৌঁছে দেন। উল্লেখ্য, ‘আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে বই-পুস্তক ও লিফলেট বিতরণের ফলে স্থানীয় বিদ‘আতী আলেমদের গায়ে আগুন ধরে যায়। তারা স্থানীয় কিছু লোককে ক্ষেপিয়ে থানায় অভিযোগ করে। ফলে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। অতঃপর বেলা ২-টার মধ্যে স্পীডবোট যোগে আমীরে জামা‘আত কক্সবাজারে হোটেলে ফিরে আসেন।

হিমছড়ি ও পাটুয়ার টেক বীচ পরিদর্শন :

বিকাল ৩-টায় ১৮টি জীপ যোগে শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত অনিন্দ্য সুন্দর পর্যটন স্থল হিমছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সফরকারী দল। একপাশে সুবিস্তৃত সমুদ্র সৈকত ও অন্যপাশে খাড়া সবুজ পাহাড়ের সারি এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। রয়েছে পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত ঝর্ণাধারা। যদিও এখন তাতে পানি নেই। সব মিলিয়ে মহান আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টিনিদর্শন হচ্ছে হিমছড়ি। হিমছড়ি পৌঁছানোর আগেই ‘দরিয়া নগর’ পয়েন্টে ‘প্যারাসেইলিং’ স্পট রয়েছে। দেড় হাযার টাকা ফি দিয়ে প্যারাসুটে চড়ে ৩ থেকে ৪শ’ ফুট উপরে উঠে প্রায় সোয়া কিলোমিটার সাগরের ভিতরে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট উড়ে বেড়ানোর দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় এর মাধ্যমে।

হিমছড়িতে কিছু সময় কাটিয়ে পাটুয়ার টেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হয়। হিমছড়ি থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাটুয়ার টেক বীচ। প্রবাল পাথরে পূর্ণ স্বচ্ছ পানির এই সৈকতটি ভ্রমণের আদর্শ স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

পাটুয়ার টেক সংলগ্ন হেলিপ্যাডে ছালাত :

সফরকারীগণ এই বীচে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন।  অতঃপর বীচ সংলগ্ন হেলিপ্যাডে ছালাতের উদ্দেশ্যে জমা হন। আমীরে জামা‘আতের ইমামতিতে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছরের সাথে আদায় করা হয়। ছালাত শেষে আলো-অাঁধারীর মধ্যে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে আমীরে জামা‘আত সংক্ষিপ্ত নছীহত মূলক ভাষণ দেন। এসময়ে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সভাপতি মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ জনাব আব্দুর রহীমের সালাম সকলকে পৌঁছে দেন ও তার মুক্তির জন্য সকলের নিকট দো‘আ চান। উল্লেখ্য, গতকাল সকালে তিনি এবং ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ও হাদীছ ফাউন্ডেশন গবেষণা বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব গাযীপুরের কাশিমপুর কারাগারে তার সাথে সাক্ষাত করেন এবং তার ও তার সাথীদের সার্বিক খোঁজ-খবর নেন। অতঃপর স্পট দু’টি সফর শেষে সবাই পুনরায় কক্সবাজার ফিরে আসেন ও হোটেল সী কুইনে রাত্রি যাপন করেন।

২য় দিন : ১৩ই মার্চ শুক্রবার

সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা :

আগের দিনের ন্যায় চাঁদের গাড়ী যোগে সকাল সাড়ে ৬-টায় হোটেল সী কুইন থেকে উত্তর নুনিয়াছড়া (এয়ারপোর্ট রোড) বিআইডব্লিওটিএ জেটির উদ্দেশ্যে সকলে যাত্রা করেন। ভাটার কারণে দু’টি ইঞ্জিন চালিত বড় ট্রলারে করে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয় দূরে নোঙ্গর করা মূল জাহাযে। অতঃপর সফরকারীগণ জাহাযের ২৪০ আসন বিশিষ্ট ‘মেরিগোল্ড’ কেবিনে আসন গ্রহণ করেন। 

উল্লেখ্য যে, ৩১শে জানুয়ারী ২০২০ থেকে প্রতিদিন সকাল ৭-টায় কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া (এয়ারপোর্ট রোড) বিআইডব্লিওটিএ ঘাট থেকে বিলাসবহুল ‘এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ জাহাযের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায়। যা সেন্ট মার্টিন থেকে ছাড়ে প্রতিদিন বিকাল ৩-টায়। উভয় দিক থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। প্রতিদিন যাতায়াতে মোট ১৯০ কিলোমিটার রোমাঞ্চকর সমুদ্র ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন যাত্রীরা।

অতঃপর এক ঘন্টা দেরিতে সকাল ৮-টায় ‘সেন্টমার্টিনে’র উদ্দেশ্যে বাড়তি যাত্রীসহ প্রায় সাড়ে সাত শত যাত্রী নিয়ে এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে। মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি বঙ্গোপসাগরের অথৈ পানিরাশি দেখতে দেখতে তাঁর সৃষ্টিনিদর্শনের নিম্নোক্ত বাণীগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে বারবার এবং উচ্চারিত হয় তাঁর মহত্ত ও বড়ত্বের ঘোষণা।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর অনুগ্রহে নৌযানগুলি সাগরবক্ষে চলাচল করে। যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ প্রদর্শন করেন। এর মধ্যে অবশ্যই নিদর্শন সমূহ রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য’ (লোকমান ৩১/৩১)। ‘তোমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রে নৌযান পরিচালনা করেন। যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সমূহ সন্ধান করতে পার। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু’(বনু ইস্রাঈল ১৭/৬৬)

সেন্টমার্টিন দ্বীপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এটি টেকনাফ হ’তে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালের সরকারী হিসাব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা প্রায় ৮ হাযার।

ইতিহাস : ইসলামের প্রথম যুগে খৃষ্টীয় ৭ম শতকে আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিকে আবিষ্কার করেন এবং নাম দেন ‘জাযীরাহ’ অর্থাৎ দ্বীপ। তারা এটাকে বিশ্রামস্থল হিসাবে ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালী ও রাখাইন মুসলমান এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসেন। ১৯০০ সালে চট্টগ্রামের যেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে এটি বাইরের মানুষের কাছে ‘সেন্টমার্টিন’ দ্বীপ নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূখন্ডের অংশ ছিল স্থানটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নীচে চলে যায়, ফলে এটি পৃথক দ্বীপে পরিণত হয়। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ১৯৩৭ সালে যখন বার্মা ও ভারত ভাগ হয়, তখন সেন্টমার্টিন ভারতে পড়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সেন্টমার্টিন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি এটি বাংলাদেশের অংশ।

ভৌগোলিক আয়তন : এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার ব্যাপী প্রবাল প্রাচীর।

ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিঞ্জিরা বা উত্তর পাড়া। জাহায ঘাট দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত। দক্ষিণ অংশকে বলা হয় দক্ষিণ পাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সংকীর্ণ লেজের মতো এলাকা। এর সংকীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি ছোট দ্বীপ আছে। যা ছেঁড়া দ্বীপ নামে পরিচিত। এটি একটি জনশূন্য দ্বীপ। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় নৌকা প্রয়োজন হয়।

ভূ-প্রকৃতি : সেন্টমার্টিন দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হ’ল চুনাপাথর। দ্বীপটিতে কিছু কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। ৮-১০ ফুট নীচেই সুপেয় মিঠা পানি পাওয়া যায়। যা দ্বীপবাসীর মিঠাপানির অভাব মিটায়। চারদিকে তিক্ত লোনাপানির সমুদ্রের মধ্যে এভাবে মিঠা পানির সঞ্চয় সত্যিই আল্লাহর এক অমূল্য নে‘মত।

অধিবাসী : প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোক বসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে আট হাযারের মত লোক বসবাস করে। সবাই মুসলমান। পর্যটন মৌসুমে গড়ে ১০ হাযার লোক থাকে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানত তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন।

এখানে ১৯টি মসজিদ, কয়েকটি মাদ্রাসা এবং একাধিক মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ও ১টি কলেজ রয়েছে। 

যাতায়াত : পর্যটন মৌসুমে (নভেম্বর-এপ্রিল) প্রতিদিন সকালে ভাটার সময় সকাল ৯-টা থেকে ৯-৩০-এর মধ্যে কয়েকটি জাহায টেকনাফ থেকে ছেড়ে যায় এবং জোয়ারের সময় বিকাল ৩-টা থেকে ৩-৩০-এর মধ্যে সেন্টমার্টিন থেকে ফিরতি যাত্রা করে। প্রতি যাত্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এছাড়া সারাবছর স্পীডবোট ও ট্রলার যোগে সেখানে চলাচল করা যায়। এছাড়া এবছর নতুন সংযোজন হয়েছে ‘এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ নামক বিলাসবহুল জাহায। যা প্রতিদিন সকাল ৭-টায় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে বেলা ১-টায় সেন্টমার্টিনে পৌঁছে এবং বিকাল ৩-টায় ছেড়ে রাত ১০-টায় কক্সবাজার ফিরে আসে। তবে জোয়ার-ভাটার কারণে মাঝে-মধ্যে এই সময়ের তারতম্য ঘটে।

আমীরে জামা‘আতের সাথে ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎ :

কক্সবাজারের সভাপতিসহ আমীরে জামা‘আত জাহাযের সর্বোচ্চ ডেকে কৃত্রিম সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো উন্মুক্ত স্থানে সোফায় আসন গ্রহণ করেন। এমন সময় জাহাযের প্রবীণ ক্যাপ্টেন জনাব হাবীব মুহাম্মাদ বদরুল আলম ছুটে আসেন আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাত করার জন্য। ময়ময়নসিংহ শহরের কলেজ রোডের স্থায়ী বাসিন্দা জনাব বদরুল আলম জন্মগতভাবেই আহলেহাদীছ। আমীরে জামা‘আতের আগমন সংবাদ শুনে তাঁর সর্বোচ্চ নেভিগেশন ব্রীজ থেকে দ্রুত নেমে আসেন সাক্ষাতের জন্য। কুশল বিনিময়ের পর সংক্ষেপে জানান তার কর্মজীবনে ‘আহলেহাদীছ’ হওয়ার কারণে নানা বিড়ম্বনার কথা। বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে এক পর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। আনন্দের সাথে জানান, যে সমস্ত জায়গায় চরম ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হ’ত, সে সমস্ত জায়গা বা মসজিদে এখন অনেকে সশব্দে আমীন বলেন, রাফউল ইয়াদায়েন করেন, ইমামের পিছনে সূরা ফাতেহা পাঠ করেন। যা দেখে বুকটা ভরে যায়। আমীরে জামা‘আতও তার সাক্ষাৎ পেয়ে খুশী হন ও তার জন্য দো‘আ করেন। এ সময় আমীরে জামা‘আতের লেখা ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?, মীলাদ প্রসঙ্গ, শবেবরাত বই এবং মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকা ও প্রচারপত্র সমূহ তাঁকে হাদিয়া প্রদান করা হয়। অতঃপর তাঁর একটি সাক্ষাৎকার আত-তাহরীক টিভির পক্ষ থেকে ধারণ করা হয়। তিনি বললেন, মাত্র কিছুদিন পূর্বে জাহাযের উপরে ছোট্ট ‘শহীদ মিনার’টি বসানো হয়েছে’। হায়! কর্তৃপক্ষ সম্ভবতঃ জানেনই না যে, এটি পরিষ্কারভাবে শিরক। অথৈ সাগরের বুকে জীবন-মৃত্যুর মাঝে আল্লাহর ইবাদতের সাথে বেদীপূজার এমন শিরকী দৃশ্য ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। বিজ্ঞানের এই যুগে নিজেদের তৈরী ছবি-মূর্তি ও মিনার-বেদীর পূজা কিভাবে সম্ভব হ’তে পারে, ভাবতেও অবাক লাগে। আল্লাহ হেদায়াতের মালিক।

জাহায চালু হওয়ার কিছুক্ষণ পর পুনরায় তিনি এসে আমীরে জামা‘আতকে তাঁর নেভিগেশন ব্রীজে নিয়ে যান এবং জাহায চালনার কলাকৌশল সম্পর্কে অবগত করান।

শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান : এসময় ‘মেরিগোল্ড’ কেবিনে নানা শিক্ষামূলক আয়োজন করা হয়। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল ও কর্মীগণ তাদের নানা অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল ও খুলনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম। ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে আল-হেরার জাগরণী। এছাড়া জাহাযে অবস্থানরত প্রায় সকল পর্যটকের মধ্যে বই ও লিফলেট বিতরণ করেন আন্দোলন ও যুবসংঘের দায়িত্বশীল ভাইয়েরা।

জুম‘আর ছালাত আদায় :

জাহাযে কেন্দ্রীয় সাউন্ড সিস্টেম থাকায় সকল যাত্রীকে নিয়ে জুম‘আর ছালাত আদায়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিষয়টি ক্যাপ্টেনকে জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন। অতঃপর সাড়ে বারটায় হাফেয আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকিরের আযানের মাধ্যমে ক্যাপ্টেনের রুমে খুৎবা শুরু হয়। বিভিন্ন কেবিন, করিডোর, ডেক ও উন্মুক্ত স্থান থেকে জাহাযের প্রায় সকল যাত্রী এই খুৎবা শোনেন ও জামা‘আতে শরীক হন। সাগরের বুকে চলন্ত জাহাযে জুম‘আর ছালাত আদায়ের এ এক অন্যরকম অনুভূতি। পরিপূর্ণ আত্মনিবেদনের সাথে আল্লাহকে ডাকার এ অনন্য দৃষ্টান্ত। সাগরের ঢেউয়ের সাথে সাথে জাহায সামান্য দুলছে। ফলে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসে খুৎবা দেন আমীরে জামা‘আত।

১৭ মিনিটের সারগর্ভ ও হৃদয়গ্রাহী খুৎবা শেষে জামা‘আত শুরু হয়। ক্যাপ্টেনের কক্ষে দরজার সাথে দেয়ালে একটি আরবী তাবীযের নকশা লাগানো ছিল, যা জাহাযের মালিকের পক্ষ হ’তে বালা-মুছীবত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে লাগানো হয়। জুম‘আর ছালাতের সময় আমীরে জামা‘আত সেদিকে ইঙ্গিত করতেই ক্যাপ্টেন ছাহেব নিজে উঠে তা টেনে উঠিয়ে ফেলেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

ছালাতের পর জাহাযের সহকারী ক্যাপ্টেন কাযী আব্দুল হক এবং ইঞ্জিনিয়ার মশীউর রহমান আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের বাড়ী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। তারা খুৎবা শ্রবণ ও আহলেহাদীছ আক্বীদা সম্পর্কে বুঝার পর আমীরে জামা‘আতের নিকটে ছহীহ আক্বীদা ও মানহাজ মত চলার ওয়াদা করেন। আমীরে জামা‘আত তাদের জন্য দো‘আ করেন। সহকারী ক্যাপ্টেন আব্দুল হক এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং বলেন, এই জাহাযে আমীরে জামা‘আত সহ আপনাদের মত দ্বীনদার সফরকারী দল আগে কখনও উঠেনি, আর ভবিষ্যতেও কখনও উঠবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে সফরের সাথে সাথে আপনারা যেভাবে দাওয়াতী কাজ করছেন, তা অভূতপূর্ব। পরদিন ফেরার পথে আমীরে জামা‘আতের সাথে মাগরিব ও এশার ছালাত আদায়ের পর ক্যাপ্টেনগণ তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। আব্দুল হক ছাহেব ইতিপূর্বে তাবলীগ জামাত করার দীর্ঘদিনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। সহকারী ক্যাপ্টেনের দু’জনেই আহলেহাদীছ তরীকায় ছালাতের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নেন। তারা ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ নেন এবং ভবিষ্যতে এই দাওয়াত চালিয়ে যাবেন বলে ওয়াদা করেন। উল্লেখ্য যে, জুম‘আর ছালাত শেষে জাহাযের ১ম শ্রেণী থেকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের দু’জন উচ্চপদস্থ প্রবীণ কর্মকর্তা নেভিগেশন ব্রীজে এসে আমীরে জামা‘আতের সাথে কুশল বিনিময় করেন ও তাঁদের হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করেন। যাদের একজন মুসলমান ও অন্যজন হিন্দু।    

সেন্টমার্টিন দ্বীপে :

দীর্ঘ ৭ ঘন্টা পর বেলা ৩-টায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভিড়ল জাহায। অতঃপর বাজার সন্নিকটে পূর্ব নির্ধারিত দু’টি হোটেল ‘স্বপ্নবিলাস’ ও ‘সী ইনে’ নিজ নিজ কক্ষে ওঠেন সফরকারীগণ। আমীরে জামা‘আত হোটেল সী-ইনে থাকেন। অতঃপর হোটেল ‘ইউরো বাংলা’য় দুপুরের খাবার গ্রহণ করা হয়। হালকা বিশ্রামের পর বিকালে আমীরে জামা‘আত সহ সফরসঙ্গীগণ সেন্টমার্টিনের উত্তর-পশ্চিমাংশে সী বীচ দেখতে যান। এ সময় এক স্থানে নারিকেল বাগানে বসে সকলে ডাব খান। অতঃপর সকলে এগিয়ে গিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাগরের ঢেউয়ের গর্জন ও দক্ষিণের নির্মল বায়ু উপভোগ করেন। এ সময় অনেকে পানিতে নামেন। এমনকি আমীরে জামা‘আতও সাথীদের সাথে আধ হাঁটু পানিতে নেমে যান। অতঃপর বীচের বালুর উপরেই সাথীদের নিয়ে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছরের সাথে আদায় করেন। অতঃপর সবার উদ্দেশ্যে তিনি সংক্ষিপ্ত নছীহত করেন। যা ছালাতে যোগদানকারী অন্যেরাও শ্রবণ করেন। এ সময় অস্থায়ী হোটেল মালিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পলিথিন সাপ্লাই দেন ছালাতের জন্য। অতঃপর সকলে ফিরে আসেন হোটেলে। 

সুধী সমাবেশ : সৈকত পরিদর্শন শেষে সবাই হোটেল সী ইনের লবিতে একত্রিত হন। অতঃপর একটানা রাত ১০-টা পর্যন্ত চলে সুধী সমাবেশ। এ সময় সফরসঙ্গীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন মুহতারাম আমীর জামা‘আত। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মাওলানা মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল ও মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি শেখ সা‘দী।

রিজার্ভ ফান্ড গঠন : এসময় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত কেন্দ্রে একটি ‘রিজার্ভ ফান্ড’ গঠনের পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। যে ফান্ড হ’তে আপৎকালীন সময়ে ব্যয় করা হবে। তিনি প্রত্যেককে ন্যূনতম ৫০০০/- (পাঁচ হাযার টাকা) প্রদানের আহবান জানান। নগদ সম্ভব না হ’লে বাকীতে নাম লেখাতে বলা হয়, যা আসন্ন রামাযান মাসে পরিশোধ করতে হবে। উক্ত আহবানে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ৭৫ জন এবং পরদিন ফেরার পথে জাহাযে ৩২ জন মোট ১০৭ জন উক্ত ফান্ডে অনেক নগদ দেন ও অনেকে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। আমীরে জামা‘আত সবার জন্য কল্যাণের দো‘আ করেন।

দাওয়াতী কাজ এবং বাধা : মহেশখালীর ন্যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপেও দাওয়াতী কাজের অংশ হিসাবে ব্যাপকভাবে বইপত্র ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। বাদ মাগরিব ৯টি মসজিদে একযোগে ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) বই এবং দোকানপাটে বই, আত-তাহরীক ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। ফলে এখানেও মহেশখালীর ন্যায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যার প্রেক্ষিতে রাত দশটায় হোটেল সী ইনে এসে হাযির হন দু’জন ইমাম। সাথে গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল ও স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের ২/৩ জন নেতা। তারা বলেন, ‘আমরা যা নিয়ে আছি তাতে শান্তিতে আছি। এর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না’। এসময় ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, কক্সবাজার যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি এ্যাডভোকেট শফীউল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজীবর রহমান প্রমুখ তাদেরকে দাওয়াতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেন। ফলে কোনরূপ অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে।

উল্লেখ্য যে, এক সপ্তাহ পূর্বে আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী নওদাপাড়া মাদ্রাসার বার্ষিক শিক্ষাসফর উপলক্ষ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক ফায়ছাল মাহমূদের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের ৪৫ জনের একটি দল ৫ ও ৬ই মার্চ সেন্ট মার্টিন সফর করে। অতঃপর ৬ই মার্চ শুক্রবার তিনি হোটেল সংলগ্ন ‘আবুবকর জামে মসজিদে’ ইমাম ও মুওয়াযযিনের অনুরোধে জুম‘আর খুৎবা দেন। তারা দ্বীপে ও জাহাযে বই ও প্রচারপত্র সমূহ বিতরণ করেন। পরের সপ্তাহে ‘আন্দোলন’-এর বর্তমান সফর হয়। পরপর দু’টি সফরে ও প্রচারে এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।

‘আন্দোলন’-এর প্রচার টীমের প্রধান অধ্যাপক মুবীনুল ইসলাম বলেন, আমরা সেখানকার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ছালাত পড়ি ও ব্যাপকভাবে প্রচারপত্র বিতরণ করি। অতঃপর মসজিদের বিপরীতে অবস্থিত ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদরাসায় যাই এবং শিক্ষকদের আগ্রহে প্রথমে ১৫ কপি ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) প্রদান করি। পরে তারা স্যারের নাম শুনে দারুণ আগ্রহ দেখান এবং স্যারকে দাওয়াত দিয়ে এনে ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার দাবী জানান। কিন্তু অন্য প্রোগ্রাম থাকায় স্যারকে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় তারা পুনরায় আমাদের দাওয়াত দেন এবং ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)-এর বাকী সব কপি অর্থাৎ ৪৮ কপি চেয়ে নেন। এভাবে মোট ৫৩ কপি ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) সহ আত-তাহরীক ও প্রচারপত্র সমূহ তারা আগ্রহভরে গ্রহণ করেন।

৩য় দিন : ১৪ই মার্চ শনিবার

ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা : পরদিন বাদ ফজর ১টি স্পীড বোট ও ৬টি ইঞ্জিন চালিত বড় ট্রলার যোগে ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সকালে ভাটার কারণে ছেঁড়া দ্বীপে ধারালো প্রবাল প্রাচীরের গায়ে ট্রলার ভিড়তে পারেনি। ফলে ট্রলার থেকেই দ্বীপ দেখতে দেখতে ফিরে আসা হয়। 

অতঃপর হোটেলে এসে সকালের নাশতা গ্রহণ করে দুপুর পর্যন্ত সফরকারীরা দ্বীপের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। অনেকে হেঁটে হেঁটে সকালের বীচ ও সাগরের সৌন্দর্য দেখে তৃপ্তিলাভ করেন। এর মধ্যে দু’তিনজন ভাড়া হোন্ডায় ও সাইকেলে করে ছেঁড়া দ্বীপেও যান।

দু’জন আলেমের সাক্ষাৎ :

ছেঁড়া দ্বীপ থেকে ফিরে স্পীডবোট থেকে নামার সাথে সাথে দু’জন আলেম এসে আমীরে জামা‘আতকে স্বাগত জানান। তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কুতুপালং শিবিরে একটি মাদ্রাসার পরিচালক ও শিক্ষক। একজন শায়খুল বুখারী। যিনি আরবী ছাড়া বলেন না। আরেকজন সাধারণ শিক্ষক, যিনি উর্দূ ছাড়া বুঝেন না। আমীরে জামা‘আত তাদেরকে সাথে নিয়ে হোটেলে নাশতা করান। শেষ দিকে তিনি হাসতে হাসতে পরিচালককে আরবীতে বলেন, আপনিতো শায়খুল বুখারী! তো ছালাত পড়েন কি বুখারীর তরীকায়, না হেদায়ার তরীকায়? তখন বেচারার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও ওযরখাহী করেন।

কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা :

বেলা ১১-টার মধ্যে সফরকারীগণ হোটেলের লবিতে একত্রিত হন। অতঃপর যোহর ও আছর ছালাত আদায় করে হোটেল ইউরো বাংলায় দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই জাহাযে আরোহণ করেন। অতঃপর বিকাল ৪-টায় জাহায কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। মাগরিবের পূর্ব মুহূর্তে সাগরবক্ষে সূর্যাস্তের দৃশ্য সকলকে বিমুগ্ধ করে। এসময় জাহাযের ডেক আল-হেরার জাগরণীতে মুখরিত করে তোলেন কর্মীরা।    

কুইজ প্রতিযোগিতা : বাদ মাগরিব কেবিনে কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সংগঠন ও সফর সংশ্লিষ্ট ৩৩টি প্রশ্ন সংবলিত লিখিত কুইজ বিতরণ করা হয়। উত্তর দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয় ১ঘন্টা। এতে ১ম স্থান অধিকার করেন যৌথভাবে খুলনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক মুযযাম্মিল হক ও নীলফামারী-পশ্চিম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি হাকীম মুস্তাফীযুর রহমান। ২য় ও ৩য় স্থান অধিকার করেন যথাক্রমে ‘সোনামণি’ মেহেরপুর যেলার সহ-পরিচালক মুহাম্মাদ তানভীরুযযামান ও গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি ডা. আওনুল মা‘বূদ। ইতিমধ্যে জাহায কক্সবাজারের নিকটে পৌছে যায়। অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত তিনদিন ব্যাপী শিক্ষাসফরের সাথীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বিদায়ী ভাষণ পেশ করেন। এ সময়ে তিনি সুষ্ঠুভাবে সফর সম্পন্ন হওয়ায় মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন এবং সকলের  সুস্বাস্থের ও সুস্থভাবে স্ব স্ব গন্তব্যে পৌঁছার জন্য দো‘আ করে শিক্ষা সফরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

শিক্ষণীয় ঘটনা : অধিকাংশ সফরকারীর কক্সবাজার থেকে ঢাকার বিভিন্ন পরিবহনে অগ্রিম টিকেট কাটা ছিল। সেকারণ তাদের কামনা ছিল যাতে জাহায রাত সাড়ে ১০-টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছে। কেননা আগের দিন জাহায পৌঁছেছিল রাত ১-টায়। ক্যাপ্টেন ছাহেবকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করবেন বলে জানান এবং বলেন সাগরের স্রোত ও বাতাসের গতি বিপরীত না হলে এটা হবে ইনশাআল্লাহ। মাগরিবের পর ক্যাপ্টেন ছাহেব আমীরে জামা‘আতকে নেভিগেশন ব্রীজে তার নিজস্ব বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যান এবং যান্ত্রিক মিটার দেখিয়ে বলেন, স্যার! দেখেন আজকে বাতাসের গতি আমাদের বিপরীতে। অথচ চলছে অন্যদিনের তুলনায় দ্রুতবেগে। আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এর কোন জবাব নেই। আমীরে জামা‘আত তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এতগুলো দ্বীনদার মুমিনের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছেন। এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন!

কক্সবাজারে অবতরণ : রাত সাড়ে ১০-টায় জাহায সরাসরি কক্সবাজার বিআইডব্লিউএ ঘাটে পৌঁছে যায়। অতঃপর যাদের টিকেট করা ছিল তারা স্ব স্ব কোচ যোগে স্ব স্ব গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। অনেকে হোটেলে রাত্রি যাপন করে পরদিন সকালে বাস ও বিমান যোগ কক্সবাজার ত্যাগ করেন। এভাবেই শিক্ষাসফর ২০২০ এর পরিসমাপ্তি ঘটে। ফালিল্লাহিল হাম্দ

উল্লেখ্য যে, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ ছাড়াও জাহাযে আসা-যাওয়ার পথে যাত্রীদের মধ্যে এবং কমলাপুর রেল স্টেশনে ও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ‘মহানগর প্রভাতী’ ট্রেনে, অতঃপর ফেরার পথে ঢাকা থেকে রাজশাহীর ‘বনলতা এক্সপ্রেস’ ট্রেনে আত-তাহরীক, বই ও লিফলেট সমূহ বিতরণ করা হয়। এ সময়ে রেল স্টেশনে এবং বিভিন্ন মসজিদে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ প্রকাশিত ‘পঠিতব্য দো‘আ সমূহ’ ও ‘জীবনের সফরসূচী’র দেওয়ালপত্র সমূহ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে তা চেয়েও নেন।

পরিচালকবৃন্দ : তিনদিন ব্যাপী এই শিক্ষা সফরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, কক্সবাজার যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ মুজীবর রহমান, ঢাকা যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা তাসলীম সরকার ও রাজশাহী-সদর যেলা ‘আন্দোলন’-এর উপদেষ্টা অধ্যাপক মুবীনুল ইসলাম।






আরও
আরও
.