অনেকদিন আগের কথা। গভীর বনে বাস করত এক শিয়াল এবং তার পাশে বাস করত এক গরু। গরু সহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনের কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তারা প্রতিনিয়ত বনের হিংস্র প্রাণীদের দ্বারা আক্রান্ত হ’ত। তাই শিয়াল ও গরু মিলে চিন্তা করল বনের নিরীহ প্রাণীদের নিরাপত্তার একটি ব্যবস্থা করা দরকার। তারা দু’জন একমত হ’ল যে, বনের সকল নিরীহ প্রাণীদের নিয়ে একটি সমাজ গঠন করা হবে। তাদের এই সিদ্ধান্তে বনের নিরীহ প্রাণীরা খুশীতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল এবং তারা বনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এই সমাজের আওতাভুক্ত হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। বনের নিরীহ প্রাণীদের নিয়ে গঠিত এই সমাজকে গরু ও শিয়াল মিলে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পারস্পরিক সহমর্তিতার মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। এভাবে তারা হিংস্র প্রাণীদের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার পথ প্রশস্ত করল।

এভাবে চলতে চলতে একদিন শিয়াল ও গরু দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে নিজেদের সামাজিক বলয় অতিক্রম করে গভীর বনে ঢুকে পড়ে। হঠাৎ তাদের সামনে উপস্থিত হয় বিশাল দেহী ভয়ংকর সিংহ। তার চোখ দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিংগ ছিটকে পড়ছে এবং রাগের প্রচন্ডতায় থরথর করে কাঁপছে। কেননা তাদের দু’জনের কারণেই তার শিকার আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। সাথে সাথে তার আধিপত্যও কমে গেছে।

সিংহের এই রাগ দেখে শিয়াল ভড়কে যায় এবং সে মাথায় কুটিল বুদ্ধি আটে। সে গরুকে বলল, বন্ধু! তুমি এখানে থাক আমি সিংহকে গিয়ে অত্যন্ত চতুরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করছি। এই বলে সে সিংহের কাছে গিয়ে বলল, মামা! আমি চিরজীবন তোমার সাথেই ছিলাম, এখনো তোমার সাথেই আছি। এই দেখনা বনের নিরীহ প্রাণীদের নব জাগরণের অগ্রদূত তোমার চির শত্রু শয়তান গরুটাকে তোমার জন্যই এনেছি। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও এবং তোমার কলিজা ঠান্ডা কর।

জবাবে সিংহ বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আগে গরুটাকে বনের পাশের একটা গোপন গর্তে নিয়ে যাও। কেননা গরুকে প্রকাশ্যে খেলে তার অনুগত জন্তুদের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। শিয়াল হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে গরুর কাছে এসে তাকে বলল, সিংহ আমাদের পাশের গর্তে যেতে বলল, তাহ’লে আমরা রক্ষা পাব। গরু শিয়ালের কথা সরল মনে বিশ্বাস করে পাশের গর্তে চলে গেল। এদিকে শিয়াল এসে সিংহকে বলল, সে যেতে চাইছিল না অনেক বুঝিয়ে নিয়ে গেছি। যান এবার আপনার দিলটা জুড়িয়ে আসেন। সিংহ সে কথার দিকে কর্ণপাত না করে শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিয়াল চিৎকার করে বলল, হুযূর আমাকে কেন? আপনার জন্যতো গরুকে গর্তে রেখে এসেছি। হুযূর অনুরোধ আমাকে খাবেন না। জবাবে সিংহ বলল, ‘ওরে শিয়াল তুই যদি তোর চিরদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং বিপদ-আপদ ও তোদের সমাজ গঠনের অন্যতম সাথী গরুর সাথে শুধুমাত্র তোর নিজ স্বার্থের জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারিস তাহ’লে তুই যে পরে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবি না এর কি নিশ্চয়তা আছে?

ওরে মুনাফিক! এজন্য আগে তোকেই খাব। আর গরু তো গর্তে ধরাই আছে, ওকে পরে খেয়ে নেব। এই বলে সে শিয়ালের ঘাড়ে কামড় দিল। অন্যদিকে বনের প্রাণীরা এই অবস্থা জেনে ফেলে এবং তারা সবাই গর্তে আটকা পড়া তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার কাছে সমবেত হয়ে ঘটনা কী তা জানতে চায়। গরু শিয়ালের বিশ্বাসঘাতকতা সহ তার বিপদের ঘটনা পুরো খুলে বলে। বনের প্রাণীরা ঘটনা শুনে শিয়ালের উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তার করুণ পরিণতিতে আনন্দ প্রকাশ করে।

এদিকে সিংহ শিয়ালকে শেষ করে গরুকে খাওয়ার জন্য সামনে অগ্রসর হয়। বনের প্রাণীরা তার এই আগমনের কথা জানতে পেরে অত্যন্ত সুসংঘবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় গরুকে ঘিরে এক নযীরবিহীন নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে এবং সকলেই একসাথে নিজ নিজ কণ্ঠে ভীষণ আওয়াজে হুংকার দিতে থাকে। তাদের এই সমবেত হুংকার বনের চারিদিকে এক রণতরঙ্গ সৃষ্টি করে। তাদের এই রণতরঙ্গে হিংস্র সিংহের হুংকার দিগন্তে বিলীন হয়ে যায়।

সিংহ তাদের এই অবিচ্ছেদ্য অটুট একতা দেখে এবং তাদের হুংকারে ভড়কে যায়। গরুকে খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে পিছুটান দেয় এবং পালিয়ে বনের ভিতর চলে যায়।

অন্যদিকে নিরীহ হাযার হাযার প্রাণীর সমবেত উচ্চারণ বনের দিগ-দিগন্তে পৌঁছে যায় এবং সবাই তাদের একতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতার কথা জানতে পারে এবং হিংস্র প্রাণীরা ছাড়া সমস্ত বনে আরো যত প্রাণী ছিল সবাই গরুর নেতৃত্বে সমবেত হয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একই সমাজভুক্ত হয়। এইভাবে পুরো বন নিরীহ প্রাণীদের আওতাধীন হয় এবং সমস্ত বনের নেতা হয় গরু।

শিক্ষা: উপরোক্ত ঘটনায় শিয়াল স্বজাতি ও বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের স্বার্থ হাছিল করতে গিয়ে সিংহের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করে। তেমনিভাবে যুগে যুগে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের পরিণতিও হয়েছে একইরূপ। সুতরাং আজকের যুগেও যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের পরিণতিও হবে অনুরূপ। জামা‘আতবদ্ধ মানুষ সুসংঘবদ্ধভাবে সততা, একতা, মৈত্রী ও সহমর্মিতার সাথে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে একজন নেতার অধীনে সমবেত হয়ে যদি সম্মুখপানে অগ্রসর হয় তাহ’লে যেকোন শক্তিই হার মানতে বাধ্য।

আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক

 আলিম ২য় বর্ষ, নওদাপাড়া মাদরাসা, রাজশাহী।






আরও
আরও
.