পর্ব ১পর্ব ২ । 

ভূমিকা :

হুযায়ফা (রাঃ) ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাহাবী। ফিক্বহ ও হাদীছ ছাড়াও ক্বিয়ামত পর্যন্ত যে সকল ফিৎনা নাযিল হবে সে সম্পর্কে তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মুনাফিকদের সম্পর্কেও তাঁর জানা ছিল। এ কারণে তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গোপন জ্ঞানের অধিকারী বা ‘ছাহিবুস সির্র’ বলা হ’ত। হুযায়ফা বলেন, অতীতে পৃথিবীতে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা ঘটবে তা সবই রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেছেন।[1] এই জলীলুল কদর ছাহাবীর জীবন চরিত নিম্নে আলোচিত হ’ল।-

নাম ও বংশ পরিচয় :

তাঁর আসল নাম হুযায়ফা, ডাক নাম আবু আব্দিল্লাহ।[2] লকব বা উপাধি হচ্ছে ‘ছাহিবুস সির্র’।[3] তার পিতার নাম হুসাইল মতান্তরে হিসল ইবনু জাবির। পিতার উপাধি হচ্ছে আল-ইয়ামান। তাঁর পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- হুযায়ফা ইবনু হিসল বা হুসাইল ইবনে জাবের ইবনে আমর ইবনে রবী‘আ ইবনে জারওয়াহ ইবনিল হারেছ ইবনে মাযেন ইবনে ক্বাতী‘আহ ইবনে আবস ইবনে বাগীয ইবনে রীছ ইবনে গাতফান ইবনে সা‘দ ইবনে ক্বায়েস আইলান ইবনে মুযার ইবনে নাযর ইবনে মা‘আদ ইবনে আদনান আল-আবসী।[4] তিনি গাতফান গোত্রের আবস শাখার সন্তান। এজন্য তাঁকে আল-আবসীও বলা হয়। তাঁর মাতার নাম রিবাব বিনতু কা‘ব ইবনে আদী ইবনে আব্দিল আশহাল। তিনি মদীনার আনছার গোত্র আউসের আব্দুল আশহাল শাখার কন্যা।[5] ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, হুযায়ফা একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাহাবী।[6]

হুযায়ফার পিতা হুসাইল ছিলেন মূলতঃ মক্কার বনী আবস গোত্রের লোক। ইসলামপূর্ব যুগে তিনি নিজ গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়াছরিবে আশ্রয় নেন। সেখানে বনী আব্দুল আশহাল গোত্রের সাথে প্রথমে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন এবং পরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে বসবাস করতে থাকেন। মদীনার আনছার গোত্রসমূহের আদি সম্পর্ক মূলতঃ ইয়ামানের সাথে। হুসাইল তাদের মেয়ে বিয়ে করায় তাঁর গোত্রের লোকেরা তাঁর পরিচয় দিত ‘আল-ইয়ামান’ বলে। এজন্য হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান বলা হয়।[7] এ ইয়ামান আব্দুল আশহাল গোত্রে বিয়ে করেন। সেখানে তাঁর নিম্নোল্লেখিত সন্তানগণ জন্মগ্রহণ করেন- ১. হুযায়ফা, ২. সা‘দ, ৩. ছাফওয়ান, ৪. মুদলিজ ও ৫. লায়লা। তারা ইতিহাসে ইয়ামানের বংশধর নামে খ্যাত।

আল-ইয়ামানের মক্কায় প্রবেশে যে বাধা ও ভয় ছিল ধীরে ধীরে তা দূর হয়ে যায়। তিনি মাঝে-মধ্যে মক্কা ও ইয়াছরিবের মধ্যে যাতায়াত করতেন। তবে তিনি বেশী থাকতেন ইয়াছরিবে। এদিকে রাসূল (ছাঃ) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে হুযায়ফার পিতা আল-ইয়ামান বনী আবসের এগারো ব্যক্তিকে সংগে করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (ছাঃ) তখনও মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেননি। সুতরাং হুযায়ফা মূলের দিক থেকে মক্কার। তবে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন।[8]

ইসলাম গ্রহণ :

হুযায়ফা (রাঃ)-এর পিতা আল-ইয়ামান মক্কায় ইসলামের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বনু আবস গোত্রের দশম ব্যক্তি।[9] হুযায়ফা (রাঃ)-এর মাও প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে হুযায়ফা মুসলিম পিতা-মাতার কোলে বেড়ে ওঠেন এবং প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর একদা তিনি রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন। তাকে রাসূল (ছাঃ) হিজরত ও নুছরাতের যে কোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেন। হুযায়ফা (রাঃ) নুছরাতকে বেছে নেন।[10]

ভ্রাতৃ সম্পর্ক :

রাসূল (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় আসার পর মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার রীতি চালু করেন। রাসূল (ছাঃ) হুযায়ফা ও আম্মার বিন ইয়াসার (রাঃ)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন।[11]

রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্য :

হুযায়ফা (রাঃ) ছিলেন ঐসকল ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্যকে আবশ্যিক করে নিয়েছিলেন। তিনি রাসূলের সান্নিধ্যে থেকে দ্বীনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইলম হাছিল করেন। হুযায়ফা (রাঃ)-এর মা তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর সান্নিধ্যে থাকতে উৎসাহিত করতেন। এমর্মে তিনি বলেন, আমার মা আমাকে প্রশ্ন করেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট তুমি কখন যাবে? আমি বললাম, আমি এতদিন যাবত তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়া পরিত্যাগ করেছি। এতে তিনি আমার উপর রাগান্বিত হন। আমি তাকে বললাম, নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে আমাকে মাগরিবের ছালাত আদায় করতে ছেড়ে দিন। তাহ’লে আমি তার কাছে আমার ও আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করব। অতএব নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট আমি হাযির হয়ে তাঁর সাথে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। তারপর তিনি নফল ছালাত আদায় করতে থাকলেন। অবশেষে তিনি এশার ছালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি বাড়ির দিকে যাত্রা করলেন এবং আমি তাঁর পিছু পিছু গেলাম। তিনি আমার আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে, হুযায়ফা? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমার কি দরকার, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ও তোমার মাকে ক্ষমা করুন’।[12]

যুদ্ধে অংশগ্রহণ :

ক. বদর যুদ্ধ : হুযায়ফা (রাঃ) বদর যুদ্ধে যোগদান করেননি। এ যুদ্ধে হুযায়ফা ও তাঁর পিতার যোগদান না করার কারণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, আমার বদরে যোগদানে কোন বাধা ছিল না। তবে আমার আববার সাথে আমি তখন মদীনার বাইরে ছিলাম। আমাদের মদীনায় ফেরার পথে কুরাইশ কাফিররা পথরোধ করে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? বললাম, মদীনায়। তারা বলল, তাহ’লে নিশ্চয়ই তোমরা মুহাম্মাদের কাছেই যাচ্ছে? আমরা বললাম, আমরা শুধু মদীনায় যাচ্ছি। তাছাড়া আমাদের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। অবশেষে তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে যে, আমরা মদীনায় গিয়ে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে কোনভাবে সাহায্য করব না। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা মদীনায় পৌঁছলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কুরাইশদের নিকট কৃত অঙ্গীকারের কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমরা কি করব? তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ কর। আর আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইব।[13]

খ. ওহোদ যুদ্ধ : হুযায়ফা (রাঃ) ওহোদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন। এ যুদ্ধে তাঁর বৃদ্ধ পিতা মুসলিম সৈনিকদের হাতে শাহাদত বরণ করেন। ঘটনাটি নিম্নরূপ-

ওহোদ যুদ্ধের সময় তাঁর পিতা আল-ইয়ামান ও ছাবিত ইবনু ওয়াক্শ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন। যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এই দুই বৃদ্ধকে রাখা হয় ঐ দুর্গের তত্ত্বাবধানে। যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন আল-ইয়ামান সঙ্গী ছাবিতকে বললেন, তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মত আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে এসেছে। আমরা খুব বেশী হ’লে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি উচিত নয়, তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে চলে যাওয়া? হ’তে পারে, আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-এর  সাথে আমাদের শাহাদত দান করবেন।

তাঁরা দু’জন তরবারি হাতে নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।

এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী পরাজয় বরণ করে পালাচ্ছিল। তখন শয়তান চেচিয়ে বলে ওঠে, মুসলমানরা এসে পড়েছে। একথা শুনে পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে দাঁড়ায় এবং মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও ছাবিত দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে ছাবিত শাহাদত বরণ করেন। কিন্তু হুযায়ফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে। মুসলমানরা তাকে চিনতে না পারায় এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়। হুযায়ফা কিছু দূর থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমার আববা, আমার আববা’ বলে। কিন্তু সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়েন তিনি। হুযায়ফা (রাঃ) পিতার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেন, ‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু’।[14]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধে মুশরিকগণ যখন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পড়ল, তখন ইবলীস চীৎকার করে (মুসলমানগণকে) বলল, হে আল্লাহর বান্দাগণ! পিছনের দিকে লক্ষ্য কর। তখন অগ্রগামী দল পিছন দিকে ফিরে (শত্রুদল মনে করে) নিজদলের উপর আক্রমণ করে বসল এবং একে অন্যকে হত্যা করতে লাগল। এমন সময় হুযায়ফা (রাঃ) পিছনের দলে তাঁর পিতাকে দেখতে পেয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমার পিতা, আমার পিতা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! কিন্তু তারা কেউই বিরত হয়নি। অবশেষে তাঁকে হত্যা করে ফেলল। হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। (রাবী হিশাম বলেন,) আমার পিতা উরওয়াহ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! এ কথার কারণে হুযায়ফা (রাঃ)-এর মধ্যে তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কল্যাণের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল’।[15]

রাসূল (ছাঃ) হুযায়ফাকে তাঁর পিতার ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি বললেন, আমার আববা তো শাহাদতেরই প্রত্যাশী ছিলেন, আর তিনি তা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে দিলাম। এতে রাসূল (ছাঃ) দারুণ খুশী হ’লেন।[16]

গ. আহযাব বা খন্দক যুদ্ধ : হুযায়ফা (রাঃ) খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কুরাইশরা এমন তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদীনায় ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। মদীনার চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশরা ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন এবং মদীনার প্রতিরক্ষার জন্য খন্দক খনন করেন। এক রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল। আর তা মুসলমানদের জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কুরাইশরা মদীনার আশ-পাশের বাগানগুলিতে শিবির স্থাপন করে আছে। হঠাৎ এমন প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করল যে, রশি ছিড়ে তাঁবু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল এবং হাড় কাঁপানো শীত আরম্ভ হ’ল। আবু সুফিয়ান বলল, আর উপায় নেই, এখনই স্থান ত্যাগ করতে হবে।[17]

রাসূল (ছাঃ) কুরাইশ বাহিনী নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাতের অন্ধকারে কাউকে কুরাইশ বাহিনীর অভ্যন্তরে পাঠিয়ে তাদের খবর সংগ্রহের ইচ্ছা করলেন। আর এ দুঃসাহসী অভিযানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত হুযায়ফাকে নির্বাচন করেন। একটি বর্ণনা মতে, রাসূল (ছাঃ) সঙ্গীদের বললেন, ‘যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি ক্বিয়ামতের দিন আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি’। একে তো দারুণ শীত, তার উপর প্রবল বাতাস। কেউ সাহস পেল না। রাসূল (ছাঃ) তিনবার কথাটি উচ্চারণ করলেন। কিন্তু কোন দিক থেকে কোন রকম সাড়া পেলেন না। চতুর্থবার তিনি হুযায়ফা (রাঃ)-এর নাম ধরে ডেকে বললেন, ‘তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।’ যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন। সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না।

অন্য একটি বর্ণনা মতে হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, ‘আমরা সে রাতে কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম। আবু সুফিয়ান ও মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের উপরের দিকে। আর নীচে ছিল বনী কুরাইযার ইহুদী গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেই সাথে ছিল প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন দুযোর্গপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার শব্দের মত। আর এমন ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙ্গুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না। এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলতে লাগল, আমাদের ঘর-দরজা শত্রুর সামনে একেবারেই খোলা। তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমতি চাই। মূলতঃ অবস্থা সে রকম ছিল না। কেউ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেই তিনি অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শত বা তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।

এমন সময় রাসূল (ছাঃ) উঠে এক এক করে আমাদের সবার কাছে আসতে লাগলেন। এক সময় আমার কাছেও আসলেন। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। চাদরটি ছিল আমার স্ত্রীর। আর তা খুব টেনেটুনে হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল। তিনি আমার একেবারে কাছে আসলেন। আমি মাটিতে বসেছিলাম। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? বললাম, হুযায়ফা। হুযায়ফা? এই বলে মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই। আমি বললাম, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, কুরাইশদের মধ্যে একটি খবর হচ্ছে। তুমি তাদের শিবিরে গিয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দিবে।

আমি বের হ’লাম। অথচ আমি ছিলাম সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাযত কর।’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দো‘আ শেষ হ’তে না হ’তে আমার সব ভীতি দূর হ’ল এবং শীতের জড়তাও কেটে গেল। আমি যখন পিছন ফিরে চলতে শুরু করলাম। তখন তিনি আমাকে আবার ডেকে বললেন, হুযায়ফা! আমার কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আক্রমণ করবে না। বললাম, ঠিক আছে। আমি রাতের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চলতে লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন। আমার পৌঁছার কিছুক্ষণ পর আবু সুফিয়ান কুরাইশ বাহিনীর সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেন, ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তা মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কি-না। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ। একথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুঠ করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? সে জবাব দিল অমুকের ছেলে অমুক।

আবু সুফিয়ান বললেন, ‘ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে নও। আমাদের ঘোড়াগুলি মরে গেছে, উটগুলি কমে গেছে এবং মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাও আমাদের ছেড়ে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে এসেছে তা সুখকর নয়। আর কেমন প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছ। আমাদের হাঁড়িও আর নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছে না। সুতরাং ফিরে চল। আমি চলছি’। একথা বলে তিনি উটের রশি খুললেন এবং পিঠে চড়ে তার গায়ে আঘাত করলেন। উট চলতে শুরু করল। কোন কিছু ঘটাতে রাসূল (ছাঃ) যদি নিষেধ না করতেন, তাহ’লে একটি মাত্র তীর ছুড়ে তাকে হত্যা করতে পারতাম।

আমি ফিরে আসলাম। এসে দেখলাম, রাসূল (ছাঃ) তাঁর এক স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছালাত শেষ করে তিনি আমাকে তাঁর দু’পায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি সব খবর তাঁকে জানালাম। তিনি দারুণ খুশী হ’লেন এবং আল্লাহর হামদ ও ছানা পেশ করলেন। হুযায়ফা সেদিন বাকী রাতটুকু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল (ছাঃ) তাঁকে ডাকলেন, ইয়া নাওমান- ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তি ওঠো।[18]

অপর বর্ণনায় এসেছে, যুহায়র ইবনু হারব ও ইসহাক ইবনু ইবরাহীম, ইবরাহীম তায়মীর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আমরা হুযায়ফা (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল, হায়, আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে পেতাম, তবে তাঁর সঙ্গে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং তাতে যথাসাধ্য করতাম (কোনরূপ পিছপা হ’তাম না)। হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, তুমি তাই করতে? কিন্তু আমি তো আহযাবের রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। (সে রাতে) প্রচন্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। এমনি সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘোষণা করলেন, ওহে! এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দিবে? আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন।

আমরা তখন চুপ করে রইলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তার সে আহবানে সাড়া দেয়নি। তিনি আবার বললেন, ওহে! এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যে আমাকে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিবে? আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন। এবারও আমরা চুপ রইলাম আর আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না। তিনি আবার ঘোষণা করলেন, ওহে! এমন কেউ আছে কি যে আমাকে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন তাকে আমার সঙ্গে রাখবেন। এবারও আমরা চুপ করে রইলাম এবং আমাদের কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না। এবার তিনি বললেন, হে হুযায়ফা! ওঠো, তুমি শত্রুপক্ষের খবর আমাদের এনে দাও। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবার যখন আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তখন উঠা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি বললেন, শত্রুপক্ষের খবর আমাকে এনে দাও। কিন্তু সাবধান! তাদেরকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত কর না।

তারপর আমি যখন তাঁর নিকট থেকে প্রস্থান করলাম, তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন হাম্মামের (উষ্ণ আবহাওয়ার) মধ্য দিয়ে চলেছি। এভাবে আমি তাদের (শত্রুপক্ষের) নিকটে পেঁŠছে গেলাম। তখন আমি লক্ষ্য করলাম আবূ সুফিয়ান আগুন দ্বারা তাঁর পিঠে ছেক দিচ্ছেন। আমি তখন একটি তীর ধনুকে সংযোগ করলাম এবং তা নিক্ষেপ করতে মনস্থ করলাম। তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ে গেল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে দিয়েছেন, তাদেরকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুল না। আমি যদি তখন তীর নিক্ষেপ করতাম, তবে তীর নির্ঘাত লক্ষ্যভেদ করত।

অগত্যা আমি ফিরে আসলাম এবং ফিরে আসার সময়ও উষ্ণ হাম্মামের মধ্য দিয়ে অতিক্রমের মতো উষ্ণতা অনুভব করলাম। তারপর ফিরে এসে প্রতিপক্ষের খবর রাসূল (ছাঃ)-কে প্রদান করলাম। আমার দায়িত্ব পালন করে অবসর হ’তেই আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর খোলা অতিরিক্ত জুববার অংশ দিয়ে আমাকে আবৃত করে দিলেন। যা তিনি ছালাত আদায়ের সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় আচ্ছন্ন রইলাম। যখন ভোর হ’ল তখন তিনি বললেন,

হে ঘুমকাতুরে! এখন উঠে পড়’।[19]

ঘ. তাবূক যুদ্ধ : হুযায়ফা (রাঃ) তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[20] তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরে সংঘটিত সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

আকার-আকৃতি :

দৈহিক আকৃতিক দিক দিয়ে হুযায়ফা (রাঃ)-কে হিজাযী বলে চেনা যেত। মধ্যমাকৃতির একহারা গড়ন এবং সামনের দাঁতগুলি ছিল অতি সুন্দর। দৃষ্টিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, ভোরের আবছা অন্ধকারেও তীরের নিশানা (লক্ষ্যস্থল) নির্ভুলভাবে দেখতে পেতেন (হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ২৭)

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :

হুযায়ফা (রাঃ) উত্তম চরিত্রের মূর্তপ্রতিক ছিলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত হওয়ায় তার মধ্যেও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুপম গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটেছিল। আদব-কায়দা ও আচার-ব্যবহারে তিনি অনন্য ছিলেন।[21]

সুন্নাতের পাবন্দ :

সুন্নাতের অনুসরণের ব্যাপারে তিনি অতি সজাগ ও সচেতন ছিলেন। কেউ সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ করলে তিনি ভীষণভাবে রেগে যেতেন। একটি হাদীছে এসেছে, ইবনু আবূ লায়লাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে ছিলেন। তিনি পানি চাইলেন। তখন এক মহাজন একটি রূপার পাত্রে তার জন্য পানি আনলে তিনি পানি ফেলে দিয়ে বললেন, আমি এটা ফেলতাম না। ফেলেছি এজন্য যে, তাকে এ পাত্রে পানি পরিবেশন করতে নিষেধ করেছি। তবুও সে বিরত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রেশমী কাপড় পরতে এবং সোনা-রূপার পাত্রে পান করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঐগুলো দুনিয়াতে কাফেরদের জন্য এবং আখিরাতে তোমাদের জন্য।[22]

ইবাদত-বন্দেগী :

তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সন্তুষ্টির জন্যই সাধ্যমত ইবাদত করার চেষ্টা করতেন এবং এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর মত করার চেষ্টা করতেন।

ক. ছালাত : ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর মত আদায় করতেন। মাঝে-মধ্যে তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে দীর্ঘ ক্বিরাআত ও দীর্ঘ রুকূ-সিজদা সহকারে রাতের ছালাত আদায় করতেন।[23]

খ. ছিয়াম : তিনি নফল ছিয়ামে অভ্যস্ত ছিলেন। ছালাতের ন্যায় ছিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ করতেন।[24]

গ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ : সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেষ্ট। কেননা সৎকাজের আদেশ দানের ফযীলত এবং অসৎকাজের নিষেধের ব্যাপারে অনেক হাদীছ রাসূল (ছাঃ) থেকে তিনি বর্ণনা করেছেন।[25]

ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা :

হুযায়ফা (রাঃ) যে অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অধিকারী ছিলেন, তা ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের হাতে তাঁর পিতার শাহাদত বরণ করা এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া রাসূল (ছাঃ) দিয়াত বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে হুযায়ফা (রাঃ) তা মুসলমানদের জন্য দান করে দেন।[26] এতে তাঁর সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় মেলে।

বুদ্ধিমত্তা :

তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় কুরাইশ বাহিনীর সংবাদ জানতে গিয়ে আবু সুফিয়ান যখন বললেন, তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ- একথা শোনার সাথে সাথে হুযায়ফা (রাঃ) পাশের লোকটির হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?[27] নিজেকে আড়াল করার জন্য তাঁর এই উপস্থিহত বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে।

স্পষ্টবাদিতা :

হুযায়ফা (রাঃ) অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। হক কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধা-সংকোচ করতেন না। তার মত স্পষ্টবাদী লোক সে যুগে ছিল বিরল। তাঁর স্পষ্টবাদিতার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন ওমর (রাঃ) ফিৎনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! সে ব্যাপারে আপনার ভয়ের কোন কারণ নেই। কেননা আপনার ও সে ফিৎনার মাঝখানে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, সে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলা হবে, না খুলে দেয়া হবে? হুযায়ফা (রাঃ) বললেন, ভেঙ্গে ফেলা হবে। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহ’লে তো আর কোন দিন তা বন্ধ করা যাবে না। ঐ দরজা দ্বারা তিনি ওমর (রাঃ)-কে বুঝিয়েছিলেন।[28]

অনুরূপভাবে তিনি তার নিজ গোত্র আবস সম্পর্কেও দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। রিবঈ বিন হিরাশ বলেন, যে রাতে লোকেরা ওছমান বিন আফফান (রাঃ)-এর নিকটে গেল, সে রাতে আমি মাদায়েনে হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামানের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, তোমার সম্প্রদায়ের ব্যাপার কী? আমি বললাম, আপনি তাদের কোন্ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে কে কে ঐ ব্যক্তির (ওছমানের) নিকট (বিদ্রোহীরূপে) গেছে? আমি যারা গেছে তাদের মধ্যে কিছু লোকের নাম করলাম। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং আমীরকে অপমান করবে, আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর নিকট সে ব্যক্তির কোন মুখ থাকবে না’।[29]

দুনিয়া বিমুখতা :

তিনি পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি ছিলেন দারুণ উদাসীন। এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, মাদায়েনের ওয়ালী থাকাকালেও তাঁর জীবন যাপনে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি। অনারব পরিবেশ এবং সেই সাথে ইমারতের পদে অধিষ্ঠিত থাকা- এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর কোন সাজ-সরঞ্জাম ছিল না। বাহনের জন্য সব সময় একটি গাধা ব্যবহার করতেন। এমন কি জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাবার ছাড়া কাছে আর কিছুই রাখতেন না। তবে তিনি দুনিয়া ও আখিরাত সমানভাবে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম নয় যারা আখিরাতের জন্য দুনিয়া ত্যাগ করেছে, আবার তারাও নয় যারা দুনিয়ার জন্য আখিরাত ছেড়ে দিয়েছে। বরং যারা এখান থেকে কিছু এবং ওখান থেকে কিছু গ্রহণ করে তারাই মূলতঃ সবচেয়ে উত্তম।[30]

খলীফা ওমর (রাঃ) তাকে মাদায়েনের গভর্ণর নিয়োগ করেন। নতুন গভর্ণর আসছেন- এ খবর মাদায়েনবাসীদের কাছে পৌঁছে গেল। নতুন আমীরকে স্বাগত জানানোর জন্য তারা দলে দলে শহরের বাইরে সমবেত হ’ল। তারা দেখতে পেল কিছু দূরে গাধার ওপর সওয়ার হয়ে দীপ্ত চেহারার এক ব্যক্তি তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। গাধার পিঠে অতি পুরনো একটি জিন। তার ওপর বসে বাহনের পিঠের দু’পাশে পা ছেড়ে দিয়ে এক হাতে রুটি ও অন্য হাতে লবণ ধরে মুখে ঢুকিয়ে চিবাচ্ছেন। আরোহী ধীরে ধীরে জনতার মাঝখানে এসে পড়লেন।

তিনি আবাসস্থলে পৌঁছে উপস্থিত জনতাকে তাদের প্রতি লেখা খলীফার ফরমান পাঠ করে শোনালেন। খলীফা ওমর (রাঃ)-এর নিয়ম ছিল, নতুন ওয়ালী বা শাসক নিয়োগের সময় সেই এলাকার অধিবাসীদের প্রতি বিভিন্ন নির্দেশ ও ওয়ালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু হুযায়ফা (রাঃ)-এর নিয়োগপত্রে মাদায়েনবাসীর প্রতি শুধু একটি নির্দেশ ছিল, ‘তোমরা তাঁর কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’ তিনি যখন তাদের সামনে খলীফার এ ফরমান পাঠ করে শোনালেন, তখন চারদিক থেকে আওয়ায উঠল, বলুন, আপনার কী প্রয়োজন? হুযায়ফা বললেন, ‘আমার নিজের জন্য শুধু কিছু খাবার আর আমার গাধাটির জন্য কিছু ঘাস-খড় প্রয়োজন। যতদিন এখানে থাকব, আপনাদের কাছে শুধু এতটুকুই চাইব’। এ পদে কিছুদিন থাকার পর কোন এক কারণে খলীফা ওমর (রাঃ) তাঁকে রাজধানী মদীনায় তলব করেন। খলীফার ডাকে সাড়া দিয়ে হুযায়ফা (রাঃ) যে অবস্থায় একদিন মাদায়েন গিয়েছিলেন ঠিক ঐ অবস্থায় মদীনার দিকে যাত্রা করেন। হুযায়ফা আসছেন, এ খবর পেয়ে খলীফা মদীনার কাছাকাছি পথের পাশে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকেন। হুযায়ফা (রাঃ) নিকটে আসতেই ওমর (রাঃ) সামনে এসে দাঁড়ান এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘হুযায়ফা! তুমি আমার ভাই, আর আমিও তোমার ভাই।’ তারপর সেই পদেই তাঁকে বহাল রাখেন।[31] এ ঘটনা তার দুনিয়া বিমুখতার উজ্জ্বল উদাহরণ।

তাক্বওয়া :

তিনি জীবন যাপনে হারাম-হালাল বেছে চলতেন। কথা-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগী, মানুষের সাথে চলাফেরা ও জীবন ধারণের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক বিষয়ও পরিহার করতেন। শরী‘আতে নির্দেশ পালন ও সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসরণের মধ্যেই তাঁর তাক্বওয়াশীলতা ফুটে ওঠে। নিম্নোক্ত দু’টি ঘটনার মধ্যেই তার আল্লাহভীতির পরিচয় পাওয়া যায়।

১. হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের দু’টি হাদীছ বর্ণনা করেছিলেন, যার একটি আমি দেখেছি (সত্যে পরিণত হয়েছে)। আর অপরটির অপেক্ষায় আছি। তিনি আমাদের বলেন, আমানত মানুষের অন্তর্মূলে প্রবিষ্ট হয়। এরপর তারা কুরআন শিখে, তারপর তারা সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করে। তিনি আমাদের আমানত বিলুপ্তি সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ এক সময় ঘুমাবে। তার অন্তর থেকে আমানত উঠিয়ে নেয়া হবে। তখন একটি বিন্দুর মত চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। এরপর সে আবার ঘুমাবে। তারপর আবার তুলে নেয়া হবে, তখন ফোসকার মত তার চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। যেমন একটা জ্বলন্ত অঙ্গারকে যদি তুমি পায়ের উপর রেখে দাও এতে পায়ে ফোস্কা পড়ে, তখন তুমি সেটাকে ফোলা দেখবে। অথচ তার মধ্যে কিছুই নেই। (এ সময়) মানুষ বেচাকেনা করবে বটে কিন্তু কেউ আমানত রক্ষা করবে না।

তখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার ব্যক্তি আছেন। কোন কোন লোক সম্পর্কে বলা হবে যে, লোকটি কতই না বুদ্ধিমান, কতই না বিচক্ষণ, কতই না বীর, অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান নেই। [এরপর হুযায়ফা (রাঃ) বললেন] আমার উপর দিয়ে এমন একটি যুগ অতিবাহিত হয়েছে তখন আমি তোমাদের কার সঙ্গে লেনদেন করছি এ-সম্পর্কে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করতাম না। কেননা সে যদি মুসলিম হয় তাহ’লে তার দ্বীনই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। আর যদি সে খ্রিস্টান হয়, তাহ’লে তার অভিভাবকরাই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য করবে। কিন্তু বর্তমানে আমি অমুক অমুককে ব্যতীত কারো সঙ্গে বেচাকেনা করি না।[32]

২. হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ইসলাম পুরাতন হয়ে যাবে, যেমন কাপড়ের উপরের কারুকার্য পুরাতন হয়ে যায়। শেষে এমন অবস্থা হবে যে, কেউ জানবে না, ছিয়াম কি, ছালাত কি, কুরবানী কি, যাকাত কি? এক রাতে পৃথিবী থেকে মহান আল্লাহর কিতাব বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং একটি আয়াতও অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের (মুসলমানদের) কতক দল অবশিষ্ট থাকবে। তাদের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা বলবে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই)-এর অনুসারী দেখতে পেয়েছি।

সুতরাং আমরাও সেই বাক্য বলতে থাকব। (তাবিঈ) সিলা (রাঃ) হুযায়ফা (রাঃ)-কে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলায় তাদের কি উপকার হবে? অথচ তারা জানে না ছালাত কি, ছিয়াম কি, হজ্জ কি, কুরবানী কি এবং যাকাত কি? সিলা ইবনে যুফার (রাঃ) তিনবার কথাটির পুনরাবৃত্তি করলে তিনি প্রতিবার তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। তৃতীয় বারের পর তিনি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে সিলা! এই কালেমা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে, কথাটি তিনি তিনবার বলেন।[33]                                                           [চলবে]


[1]ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩।

[2]. খায়রুদ্দীন যিরিকলী, আল-আ‘লাম ২/১৭১।

[3]. বুখারী হা/৩৭৪৩, ৬২৭৮; আল-আ‘লাম ২/১৭১।

[4]আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইসতি‘আব, ১/৯৮।

[5]আবু বকর আল-ইছফাহানী, রিজালু ছহীহ মুসলিম, ১/১৪৫; আল-ইসতি‘আব, ১/৯৮।

[6]আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; আল-ইসতি‘আব, ১/২৭৭।

[7]শাযারাতুয যাহাব ১/৪৪; আল-ইছাবাহ ১/৩১৭; তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩

[8]ছুওয়ারুম মিন হায়াতিছ ছাহাবাহ ৪/১২২

[9]ইবরাহীম মুহাম্মাদ আল-আলী, হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান আমীনু সির্রে রাসূলিল্লাহি, (দিমাশক : দারুল কলাম, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৬ খ্রীঃ/১৪১৭ হিঃ), পৃঃ ২৯

[10]তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩; আল-ইছাবাহ ২/৪৪; আল-ইসতি‘আব ১/৯৯

[11]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২/৩৬২; সীরাতু ইবনে হিশাম ১/৫০৬

[12]তিরমিযী হা/৩৭৮১; নাসাঈ হা/১৯৩; মিশকাত হা/৬১৭১; তা’লীকুর রাগীব হা/৭০৮২, সনদ ছহীহ।

[13]মুসলিম হা/১৭৮৭; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ২/১৫৩; তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩; আল-ইছাবাহ ২/৪৪।

[14]. হাকেম হা/৪৯০৯, সনদ ছহীহ; সীরাতু ইবনে হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবা ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭।

[15]বুখারী হা/৩২৯০, ৩৮২৪, ৪০৬৫, ৬৬৬৮, ৬৮৮৩, ৬৮৯০।

[16]মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৪৯০৯; সীরাতু ইবন হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবাহ ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭

[17]তাবাকাত ২/৫০।

[18]মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৯২-৯৩; সীরাতু ইবনে হিশাম ৩/২৩১-৩২, সনদ হাসান; মুস্তাদরাকে হাকেম ৩/৩১, সনদ ছহীহ।

[19]মুসলিম হা/১৭৮৮, ‘আহযাবের (খন্দক ও পরীখার) যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ।

[20]হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান আমীনু সির্রে রাসূলিল্লাহি, পৃঃ ৫২

[21]ঐ, পৃঃ ১০৩-৪

[22]. বুখারী হা/৫৬৩৪; মুসলিম হা/২০৬৫; আবূদাউদ হা/৩৭২৩; তিরমিযী হা/১৮৭৮।

[23]মুসলিম হা/৭৭২; আবূদাঊদ হা/৮৭১, ৮৭৪; তিরমিযী হা/২৬২।

[24]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৩৬১; ইবনু মাজাহ হা/১৬৯৫, সনদ হাসান।

[25]. হুযায়ফাহ ইবনুল ইয়ামান, পৃঃ ১৩৩।

[26]মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৪৯০৯; সীরাতু ইবনে হিশাম ২/৮৭; হায়াতুছ ছাহাবাহ ১/৫১৯; ছুওয়ারুন মিন হায়াতিছ ছাহাবা ৪/১২৫-১২৭

[27]মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৯২-৯৩; সীরাতু ইবনে হিশাম ৩/২৩১-৩২, সনদ হাসান; মুস্তাদরাকে হাকেম ৩/৩১, সনদ ছহীহ।

[28]. বুখারী হা/৫২৫; মুসলিম হা/১৪৪; তিরমিযী হা/২২৮৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৫৫।

[29]. আহমাদ হা/২৩২৮৩-৮৪; হাকেম হা/৪০৯, হাদীছ হাসান।

[30]. রিজালুন হাওলার রাসূল, পৃঃ ২০০; তাহযীবুল কামাল ৫/৫০৮; হায়াতুছ ছাহাবাহ ৩/৫১৭।

[31]আল-আ’লাম ২/১৭১; তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৩; হায়াতুছ ছাহাবাহ ৩/২৬৬, ২/৭৩।

[32]. বুখারী হা/৭০৮৬; মুসলিম হা/১৪৩।

[33]. ইবনু মাজাহ হা/৪০৪৯; ছহীহাহ হা/৮৭।





উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারিছ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়া (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হোসাইন বিন আলী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
খুবায়েব বিন আদী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ)(শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
রায়হানা বিনতু শামঊন (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.