উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ)

ইসলামের প্রচার-প্রসারে ও দ্বীনের হেফাযতে যারা অমর অবদান রেখেছিলেন এবং আমলে ছালেহ করে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন, উক্কাশা ইবনু মিহছান (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে রক্ষার জিহাদে জীবন বাজি রেখে যেমন তিনি যুদ্ধ করেছিলেন তেমনি পরকালীন জীবনে নাজাতের লক্ষ্যে সাধ্যমত সৎআমল করার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিলেন। আর তাই দুনিয়াতেই তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। নিম্নে এ ছাহাবীর জীবনী সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হ’ল।-

নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম উক্কাশা, কুনিয়াত বা উপনাম আবু মিহছান। পিতার নাম মিহছান ইবনু হারছান। পূর্ণ বংশ পরিচয় হচ্ছে- উক্কাশা ইবনু মিহছান ইবনে হারছান ইবনে ক্বায়েস ইবনে মুররাহ ইবনে কাছীর[1] ইবনে গানাম ইবনে দূদান ইবনে আসাদ ইবনে খুযায়মাহ।[2] জাহিলী যুগে বনী আবদে শামসের হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ ছিলেন।[3] তিনি অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ ছিলেন।[4]

জন্ম : তার জন্মসন জানা যায় না। তবে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর সময় (১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার)[5] উক্কাশা বিন মিহছানের বয়স হয়েছিল ৪০ বছর[6] মতান্তরে ৪৪ বছর।[7] সে হিসাবে উক্কাশা বিন মিহছান ৫৯২ মতান্তরে ৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণ ও হিজরত : তিনি হিজরতের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অন্যদের সাথে মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যান।[8]

যুদ্ধে অংশগ্রহণ : বদর যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য দারুণ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। উক্কাশা বিন মিহছান বদর যুদ্ধের দিন তার ভাঙ্গা তরবারি নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে একটি কাঠের টুকরা দিয়ে বলেন, তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ কর। অতঃপর যখন তিনি এটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করেন তখন তা লম্বা, শক্ত ও ধবধবে সাদা তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর এটি নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। যতক্ষণ না আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করেন। সেদিন থেকে উক্ত তরবারিটির নাম হয় ‘আল-‘আওন’ (العَوْن) বা সাহায্যকারী। এরপর থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়ে যোগদান করেন। এমনকি আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে রিদ্দার যুদ্ধে উক্ত তরবারি নিয়েই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আল-আসাদী তাঁকে হত্যা করেন’।[9] ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। সেকারণ এটি যঈফ।[10] ওহোদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি চরম বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।[11]

২য় হিজরীর রজব মাসে (জানুয়ারী ৬২৪ খৃঃ) আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নাখলা অভিযানে উক্কাশা ইবনে মিহছান অংশগ্রহণ করেন।[12]

দায়িত্ব পালন : ৬ষ্ঠ হিজরীর রবীউল আউয়াল অথবা রবীউল আখের মাসে ৪০ জনের একটি সেনাদল বনু আসাদ গোত্রের ‘গামর’ প্রস্রবণের (ماء غَمْر) দিকে উক্কাশার নেতৃত্বে প্রেরিত হয়। কেননা বনু আসাদ গোত্র মদীনায় হামলা করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করছিল। মুসলিম বাহিনীর আকস্মিক উপস্থিতিতে তারা পালিয়ে যায়। পরে গণীমত হিসাবে ২০০ উট নিয়ে অত্র বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।[13]

জান্নাতের সুসংবাদ :

উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর মাধ্যমে সরাসরি জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি ঐসব ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদের ব্যাপারে আমভাবে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল। যেমন-

১. ইসলামের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাদেরকে জান্নাতের প্রবেশ করানোর প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন। উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) তাদের অন্যতম ছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ،

‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবা ৯/১০০)। অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন,لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ، ‘(ফাই-এর সম্পদ) অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য। যারা তাদের ঘর-বাড়ি ও মাল-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। এরাই হ’ল সত্যবাদী’ (হাশর ৫৯/৮)

২. উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) ছিলেন ঐসব ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা হুদায়বিয়ায় বাবলা গাছের নীচে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন মুমিনদের প্রতি, যখন তারা বৃক্ষের নীচে তোমার নিকট বায়‘আত করেছে। এর মাধ্যমে তিনি তাদের অন্তরে যা ছিল তা জেনে নিলেন। ফলে তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়’ (ফাতহ ৪৮/১৮)

৩. উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) বদরী ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বদরী ছাহাবীগণের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَعَلَّ اللهَ اطَّلَعَ إِلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ وَجَبَتْ لَكُمُ الْجَنَّةُ، أَوْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ. ‘তুমি কি জানো না, আল্লাহ অবশ্যই বদরে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছা কর, তোমাদের জন্য জান্নাত অবধারিত অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন,جَاءَ جِبْرِيلُ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ مَا تَعُدُّونَ أَهْلَ بَدْرٍ فِيكُمْ قَالَ مِنْ أَفْضَلِ الْمُسْلِمِينَ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا قَالَ وَكَذَلِكَ مَنْ شَهِدَ بَدْرًا مِنَ الْمَلاَئِكَةِ. ‘একদা জিবরীল (আঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বললেন, আপনারা বদর যুদ্ধে যোগদানকারী মুসলিমদেরকে কিরূপ গণ্য করেন? তিনি বললেন, তারা সর্বোত্তম মুসলিম অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) এরূপ কোন শব্দ তিনি বলেছিলেন। জিবরীল (আ.) বললেন, ফেরেশতাদের মধ্যে বদর যুদ্ধে যোগদানকারীগণও তেমনি মর্যাদার অধিকারী’।[15]

৪. উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) ছিলেন ঐসব ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رضى الله عنهما قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فَقَالَ عُرِضَتْ عَلَىَّ الأُمَمُ فَجَعَلَ يَمُرُّ النَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلُ وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّجُلاَنِ، وَالنَّبِىُّ مَعَهُ الرَّهْطُ، وَالنَّبِىُّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ، وَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ فَرَجَوْتُ أَنْ يَكُونَ أُمَّتِى، فَقِيلَ هَذَا مُوسَى وَقَوْمُهُ. ثُمَّ قِيلَ لِى انْظُرْ. فَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ فَقِيلَ لِى انْظُرْ هَكَذَا وَهَكَذَا. فَرَأَيْتُ سَوَادًا كَثِيرًا سَدَّ الأُفُقَ فَقِيلَ هَؤُلاَءِ أُمَّتُكَ، وَمَعَ هَؤُلاَءِ سَبْعُونَ أَلْفًا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ. فَتَفَرَّقَ النَّاسُ وَلَمْ يُبَيَّنْ لَهُمْ، فَتَذَاكَرَ أَصْحَابُ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوا أَمَّا نَحْنُ فَوُلِدْنَا فِى الشِّرْكِ، وَلَكِنَّا آمَنَّا بِاللهِ وَرَسُولِهِ، وَلَكِنْ هَؤُلاَءِ هُمْ أَبْنَاؤُنَا، فَبَلَغَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ هُمُ الَّذِينَ لاَ يَتَطَيَّرُونَ، وَلاَ يَسْتَرْقُونَ، وَلاَ يَكْتَوُونَ، وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ. فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ أَمِنْهُمْ أَنَا يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ نَعَمْ. فَقَامَ آخَرُ فَقَالَ أَمِنْهُمْ أَنَا فَقَالَ سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ.

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী করীম (ছাঃ) আমাদের নিকট এসে বললেন, আমার সামনে (পূর্ববর্তী নবীগণের) উম্মাতদের পেশ করা হ’ল। (আমি দেখলাম) একজন নবী যাচ্ছেন, তাঁর সাথে আছে মাত্র একজন লোক এবং আরেকজন নবী, যাঁর সঙ্গে আছে দু’জন লোক। অন্য এক নবীকে দেখলাম, তাঁর সঙ্গে আছে একটি দল, আরেকজন নবী, তাঁর সাথে কেউ নেই। আবার দেখলাম, একটি বিরাট দল যা দিগন্ত জুড়ে আছে। আমি আকাঙ্ক্ষা করলাম যে, এ বিরাট দলটি যদি আমার উম্মাত হ’ত। বলা হ’ল, এটা মূসা (আঃ) ও তাঁর কওম। এরপর আমাকে বলা হ’ল দেখুন। দেখলাম, একটি বিশাল জামা‘আত দিগন্ত জুড়ে আছে। আবার বলা হ’ল, এদিকে দেখুন, ওদিকে দেখুন। দেখলাম, বিরাট বিরাট দল দিগন্ত জুড়ে ছেয়ে আছে। বলা হ’ল, ঐসবই আপনার উম্মাত এবং ওদের সাথে সত্তর হাযার লোক এমন আছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর লোকজন এদিক ওদিক চলে গেল। নবী করীম (ছাঃ) আর তাদের (সত্তর হাযারের) ব্যাখ্যা করে বলেননি। নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ এ নিয়ে নানান কথা শুরু করে দিলেন। তাঁরা বলাবলি করলেন, আমরা তো শিরকের মাঝে জন্মেছি, পরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। বরং এরা আমাদের সন্তানরাই হবে। নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এ কথা পৌঁছলে তিনি বলেন, তারা (হবে) ঐসব লোক যারা অবৈধভাবে মঙ্গল অমঙ্গল নির্ণয় করে না, ঝাড়-ফুঁক করে না এবং আগুনে পোড়ানো লোহার দাগ লাগায় না, আর তারা কেবল তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা রাখে। তখন উক্কাশাহ বিন মিহছান দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আর একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাদের মধ্যে আছি? তিনি বললেন, এ বিষয়ে উক্কাশাহ তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে’।[16] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, উক্কাশা ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী। তাঁকে হত্যাকারী তুলায়হা ‘মুরতাদ’ ছিল। পরে সে ইসলামে ফিরে আসে।[17]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِى زُمْرَةٌ هِىَ سَبْعُونَ أَلْفًا، تُضِىءُ وُجُوهُهُمْ إِضَاءَةَ الْقَمَرِ. فَقَامَ عُكَاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ الأَسَدِىُّ يَرْفَعُ نَمِرَةً عَلَيْهِ قَالَ ادْعُ اللهَ لِى يَا رَسُولَ اللهِ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ مِنْهُمْ. ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ سَبَقَكَ عُكَاشَةُ. ‘আমার উম্মাতের মধ্য থেকে সত্তর হাযারের একটি দল (বিনা হিসাবে) জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন তাদের মুখমন্ডল চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল হবে। উক্কাশা ইবনু মিহ্ছান তাঁর পরিহিত রঙিন ডোরাওয়ালা চাদর উপরে তুলে ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আল্লাহর নিকট আমার জন্য দো‘আ করুন, যেন তিনি আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি দো‘আ করলেন, হে আল্লাহ! একে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। তারপর আনছারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, উক্কাশা তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছে’।[18]

ইলমে হাদীছে অবদান : তাঁর নিকট থেকে আবু হুরায়রাহ (রাঃ) ও ইবনে আববাস (রাঃ) হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[19]

মৃত্যু ও দাফন : রাসূল (ছা.)-এর মৃত্যুর ১ বছর পরে হিজরী ১২ সনে প্রথম খলীফা আবুবকর (রাঃ) খালিদ ইবনুল ওয়ালীদকে ভন্ডনবী তুলায়হা আসাদীর বিদ্রোহ নির্মূলের নির্দেশ দেন। উক্কাশা ও ছাবিত ইবনু আরকাম ছিলেন খালিদের বাহিনীর দু’জন অগ্রসৈনিক। তারা বাহিনীর আগে আগে চলছিলেন। হঠাৎ শত্রু সৈন্যর সাথে ‍তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এই শত্রু সৈনিকদের মধ্যে তুলায়হা নিজে ও তাঁর ভাই সালামাও ছিল। তুলায়হা আক্রমণ করে উক্কাশাকে আর সালামা ঝাপিয়ে পড়ে ছাবিতের ওপর। ছাবিত শাহাদত বরণ করেন। এমন সময় তুলায়হা চিৎকার করে ওঠে সালামা শিগগির আমাকে সাহায্য কর। আমাকে মেরে ফেলল। সালামার কাজ তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে তুলায়হার সাহায্যে এগিয়ে যায় এবং দুই ভাই এক সাথে উক্কাশাকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে ফেলে। এভাবে উক্কাশা শহীদ হন।[20] উল্লেখ্য, বুযাখা নামক স্থানে উক্কাশা (রাঃ) শাহাদত বরণ করেন।[21] বুযাখা হচ্ছে বনু আসাদের পানির কুয়া, যেখানে তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আসদীর সাথে আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[22]

ইসলামী ফৌজ এই দুই শহীদের লাশের কাছে পৌঁছে ভীষণ শোকাতুর হয়ে পড়েন। উক্কাশার দেহে মারাত্মক যখমের চিহ্ন ছিল। তার সারা দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। বাহিনী প্রধান খালিদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে বাহিনীর যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। অতঃপর শহীদদ্বয়ের রক্তভেজা কাপড়েই সেই মরুভূমির বালুতে দাফন করেন।[23] মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তিনি নেতৃস্থানীয় ছাহাবীদের মধ্যে শামিল ছিলেন।

পরিশেষে বলব, উক্কাশা বিন মিহছান ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জীবন বাজি রেখে আমৃত্যু কাফের ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। কেননা তার লক্ষ্য ছিল জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং গন্তব্য ছিল জান্নাত। তাই কোন কিছুকে পরওয়া না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় দ্বীনের পথে তিনি নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। এই মহান ছাহাবীর জীবনীতে আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রয়েছে। সুতরাং তার জীবনচরিত থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গঠন করতে পারলে পরকালে নাজাত লাভ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে ছাহাবীগণের ন্যায় হকের পথে চলে পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন-আমীন!


[1]. ইবনু আব্দিল বার্র ‘কাছীর’-এর স্থলে কাবীর বলেছেন। দ্র. আল-ইস্তি‘আব, ৩/১০৮০পৃ.।

[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৪০৭হি./১৯৮৬ খ্রি.), ৬/৩৩৮ পৃ.।

[3]. আবুল ফিদা হাফেয ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৯৮৮খৃ.), পৃ. ৩৪৩।

[4]. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১ম খন্ড (বৈরূত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২য় প্রকাশ, ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খৃ.), পৃ. ৩০৭।

[5]. বুখারী হা/১৩৮৭।

[6]. আবু আব্দুল্লাহ হাকেম আন-নাইসাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০খৃ. /১৪১১হি.), ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।

[7]. মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, মুখতাছার সীরাতুর রাসূল, ১/২৬৮ পৃ.।

[8]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩।

[9]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ২২৪; ইবনু হিশাম ১/৬৩৭ পৃ.।

[10]. তালীক্ব, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ১৩২; মা শা-‘আ, পৃ. ১১৬।

[11]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩।

[12]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৩য় প্রকাশ, ১৪৪৪হি./২০২৩ খৃ.), পৃ. ২৭৯-৮০।

[13]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৫৫০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৫০; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৩২২।

[14]. বুখারী হা/৩৯৮৩; মুসলিম হা/২৪৯৪; মিশকাত হা/৬২১৬।

[15]. বুখারী হা/৩৯৯২, ৩৯৯৪; মিশকাত হা/৬২১৭; ছহীহাহ হা/২৫২৮।

[16]. বুখারী হা/৫৭৫২, ৬৫৪১; মুসলিম হা/২২০; মিশকাত হা/৫২৯৬।

[17]. আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৫৬৪৮।

[18]. বুখারী হা/৫৮১১, ৬৫৪২; মুসলিম হা/২১৬; আহমাদ ৮০২২, ৮৬২২।

[19]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৮।

[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩; আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।

[21]. ঐ; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৮

[22]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৭, ২নং টীকা দ্র.।

[23]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খন্ড, ৬ষ্ঠ জুয, পৃ. ৩৪৩; আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫৩।






শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
রায়হানা বিনতু শামঊন (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (রাঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ)(শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হোসাইন বিন আলী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামের প্রথম দাঈ, ওহোদের ঝান্ডাবাহী শহীদ ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.