হাসান বিন আলী (রাঃ)(শেষ কিস্তি)

রোগশয্যায় হাসান (রাঃ) :

আবুবকর ইবনু আবিদ দুনিয়া আব্দুর রহমান ইবনু সালিম আতিকী...উমায়র ইবনু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, دخلتُ أنا ورجل آخر مِن قريش على الحسن بن علي، فقام فدخل إلى الخلاء، ثم خرج، فقال: لقد لفظتُ طائفةً (قطعة) مِن كَبِدي أقلبها بهذا العود، ولقد سُقِيتُ السَّمَّ مرارًا، وما سُقيتُ مرةً هي أشد مِن هذه، قال: وجعل يقول لذلك الرجل: سَلْني قبل ألا تَسْأَلَني، فقال: ما أسألك شيئًا، يعافيك الله؛ ‘আমি ও একজন কুরায়শ বংশীয় লোক একদিন হাসান ইবনু আলী (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। আমাদেরকে দেখে তিনি উঠে শৌচাগারে গিয়ে (প্রয়োজন সেরে) সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। অতঃপর বললেন, ‘আমি আমার কলিজার কিছু অংশ এখন ফেলে এলাম। এই কাঠি দিয়ে আমি সেটি নেড়ে নেড়ে দেখে এলাম। আমাকে বহুবার বিষ পান করানো হয়েছে। কিন্তু এবারের বিষ পান করানো ছিল সবচেয়ে কঠিন। তখন হাসান (রাঃ) ঐ কুরায়শী লোকটিকে বলতে লাগলেন, ‘আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হারিয়ে ফেলার আগে যা জিজ্ঞেস করার জিজ্ঞেস করে নাও’। লোকটি বলল, ‘এখন আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না। আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থ করে তুলুন’।[1] বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আমরা তাঁর নিকট থেকে বিদায় নিলাম। পরদিন আমরা তাঁর নিকট গেলাম। তখন তিনি ছিলেন মুমূর্ষু অবস্থায়, তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাঁর ভাই হুসায়ন (রাঃ) এসে তাঁর মাথার নিকটে বসে বললেন, ‘ভাইজান! কে আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? হাসান (রাঃ) বললেন, ‘তুমি কি তাঁকে হত্যা করতে চাও? হুসায়ন (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ। হাসান (রাঃ) বললেন,لَئِنْ كَانَ صَاحِبَيِ الَّذِي أَظُنُّ للَّه أَشَدُّ نِقْمَةً. وَفِي رِوَايَةٍ: فالله أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا، وَإِنْ لَمْ يَكُنْهُ مَا أُحِبُّ أَنْ تَقْتُلَ بِي بَرِيئًا. ‘আমি যাকে সন্দেহ করি সে-ই যদি প্রকৃত শত্রু হয়ে থাকে (বিষ পান করিয়ে থাকে) তাহ’লে আল্লাহ্ই তার কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। অপর বর্ণনায় আছে, তবে আল্লাহ শক্তিতে প্রবলতর ও শাস্তিদানে কঠোরতর। আর যদি আমি যাকে সন্দেহ করি সে প্রকৃত দোষী না হয়, তাহ’লে আমার কারণে তুমি একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করবে তা আমি চাই না’।[2]

মুহাম্মাদ ইবনু ওমর আল-ওয়াকিদী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফর উম্মু বকর বিনতু মিসওয়ার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হাসান (রাঃ)-কে কয়েকবার বিষ পান করানো হয়েছে। প্রতিবারই তিনি রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু শেষবারে তিনি আর রক্ষা পেলেন না, মারা গেলেন। তখন বিষক্রিয়ায় তাঁর কলিজা ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওয়াক্বিদী আরো বলেন, কথিত আছে যে, তাঁকে বিষ পান করানো হয়েছিল তাতে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার বিষ পান করোনো হয়েছিল, তিনি আবার রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর তৃতীয়বার তাঁকে বিষ পান করানো হয়েছিল এবং সেবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[3]

তাঁর মৃত্যু যখন খুব নিকটে তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলেছিলেন, বিষে তাঁর নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। এ চিকিসৎক তখন বারবার হাসান (রাঃ)-কে দেখতে আসতেন। এক পর্যায়ে হুসায়ন (রাঃ) বললেন, ‘ভাই আবূ মুহাম্মাদ! আপনি আমাকে বলে দিন, কে আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? হাসান (রাঃ) বললেন, কেন ভাই! তুমি কি করবে? হুসায়ন (রাঃ) বললেন, আমি আপনাকে দাফন করার আগে তাকে হত্যা করব। এখনি তাকে ধরতে না পারলে সে এমন কোন স্থানে চলে যেতে পারে যেখানে তাকে আর ধরা যাবে না। হাসান (রাঃ) বললেন, ভাই! দুনিয়াতো কয়েক দিনের সংসার! এটি ধ্বংসশীল। ওকে ছেড়ে দাও। আমি ও সে উভয়েতো আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হব। হাসান (রাঃ) ঐ দোষী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেননি।

মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ বলেন, ইয়াহইয়া ইব‌নু হাম্মাল...উম্মু মূসা থেকে বর্ণনা করেছেন, জা‘দা বিনতু আশ‘আছ ইবনে ক্বায়েস হাসান (রাঃ)-কে বিষ পান করিয়েছিলেন। তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না রাক্বাবাহ ইবনে মুছক্বালাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হাসান (রাঃ) যখন মৃত্যু পথযাত্রী তখন তিনি বললেন, তোমরা আমাকে উঠানে নিয়ে যাও, আমি আল্লাহর এই বিশাল জগত দেখে নিই। তারা বিছানাসহ তাঁকে উঠানে নিয়ে আসল। তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আমার প্রাণ বিসর্জনের বিনিময়ে আপনার নিকট ছওয়াব কামনা করছি। কারণ আমার এই প্রাণ আমার অত্যন্ত প্রিয় বস্তু। বর্ণনাকারী বলেন, বস্তুত মহান আল্লাহ তাঁর যে পরিণতি ঘটালেন তার বিনিময়ে তিনি আল্লাহর নিকট ছওয়াব কামনা করলেন।[4]

আবূ নু‘আয়ম বলেছেন, হাসান (রাঃ)-এর বেদনা যখন বেড়ে গেল তখন তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। তখন একজন লোক তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘হে আবূ মুহাম্মাদ! এত অস্থিরতা কেন? এখন শুধু এতটুকু হবে যে, আপনার দেহ থেকে প্রাণ পৃথক হবে আর তারপর আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার পিতা-মাতা আলী ও ফাতিমা (রাঃ)-এর নিকটে, আপনার মামা আল-কাসেম, ত্বাইয়েব ও ইবরাহীম (রাঃ)-এর নিকটে, আপনার নানা-নানী নবী করীম (ছাঃ) ও খাদীজা (রাঃ)-এর নিকটে। আপনার চাচা হামযাহ ও জা‘ফর (রাঃ)-এর নিকটে, আপনার খালা রুকাইয়া, উম্মু কুলছূম ও যায়নাব (রাঃ)-এর নিকটে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে হাসান (রাঃ) সম্বিৎ ফিরে পেলেন এবং সুস্থির হয়ে উঠলেন।[5]

বিষ প্রয়োগে হত্যার সন্দেহ ও তার খন্ডন :

হাসান (রাঃ) কিভাবে মারা গেছেন, তার সঠিক তথ্য কোন ছহীহ সূত্রে পাওয়া যায় না। তবে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, তিনি বিষপানে মারা গেছেন। উমায়ের ইবনু ইসহাক বলেন, আমি এক সাথীকে নিয়ে হাসান (রাঃ)-এর নিকটে গেলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে একাধিকবার বিষ পান করানো হয়েছে। কিন্তু এত বিষাক্ত বস্ত্ত ইতিপূর্বে কখনও পান করিনি। এরই মধ্যে তার ভাই হুসাইন সেখানে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনাকে বিষ পান করিয়েছে? তিনি সেটা বলতে অস্বীকার করলেন।[6] ক্বাতাদা থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[7]

বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, মু‘আবিয়া (রাঃ) বা তাঁর ছেলে ইয়াযীদের নির্দেশনায় হাসান (রাঃ)-এর স্ত্রী তাঁকে বিষ পান করিয়েছিলেন। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এগুলি অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন।[8] শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, মু‘আবিয়া (রাঃ) হাসান (রাঃ)-কে বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছেন মর্মে কিছু লোক যা বলে থাকে, তা কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এ ব্যাপারে কিছু বলা না জেনে বলার ন্যায় হবে।[9] অন্যত্র তিনি আরো বলেন,فيما تزعمه الشيعة من أن معاوية سم الحسن: لم يثبت ذلك ببينة شرعية، ولا إقرار معتبر، ولا نقل يجزم به، وهذا مما لا يمكن العلم به، فالقول به قول بلا علم، ‘এ ব্যাপারে শী‘আরা ধারণা করে যে, মু‘আবিয়া (রাঃ) হাসান (রাঃ)-কে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। এটা কোন শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, কোন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক স্বীকৃত নয় এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত নয়। আর এটা এমন বিষয় যে সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয় না। সুতরাং এ ব্যাপারে কিছু বলা অজ্ঞতা প্রসুত কথার ন্যায়’।[10]

হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রহঃ) বলেন, আমি বলব, আমার গবেষণায় এটা (বিষ প্রয়োগের ঘটনা) বিশুদ্ধ নয়।[11] ইবনু খালদূন (রহঃ) বলেন, এটা শী‘আদের প্রচারণা।[12]

আবুবকর আল-আরাবী (রহঃ) বলেন,فإن قيل : قد دس يعني معاوية على الحسن من سمه؟ قلنا هذا محال من وجهين، أحدهما : أنه ما كان ليتقي من الحسن بأسًا، وقد سلم الأمر. الثاني : أنه أمر مغيب لا يعلمه إلا الله، فكيف تحملونه- بغير بينة- على أحد من خلقه، في زمان متباعد لم نثق فيه بنقل ناقل، بين أيدي قوم ذوي أهواء، وفي حال فتنة وعصبية، ينسب كل واحد إلى صاحبه ما لا ينبغي، فلا يقبل منها إلا الصافي، ولا يسمع فيها إلا من العدل المصمم.

‘যদি বলা হয়, মু‘আবিয়া (রাঃ) হাসান বিন আলী (রাঃ)-কে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। আমরা বলব যে, এটা দু’টি দিক দিয়ে অসম্ভব। ১. তিনি হাসান (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে কোন ক্ষতির আশংকা করতেন না। আর বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। ২. এটা ছিল গায়েবের বিষয়, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানেন না। সুতরাং প্রমাণ ছাড়া বিষয়টি আল্লাহর সৃষ্টির কারো উপরে কিভাবে আরোপ করা যেতে পারে, এমন দূরবর্তী সময়ের ঘটনার ব্যাপারে, যা নির্ভরযোগ্য কোন সংকলক সংকলন করেননি? যখন গোলযোগপূর্ণ ও দলপ্রীতির অবস্থা বিরাজ করছিল। সে সময় একজন অপরজনের প্রতি অবাঞ্ছিত বিষয় আরোপ করত। সুতরাং নিরেট নির্ভেজাল ব্যক্তি ব্যতীত কারো নিকট থেকে ঐসব গ্রহণ করা যাবে না। আর এ ব্যাপারে ন্যায়নীতির উপরে দৃঢ় ব্যক্তি ব্যতিরেকে কারো নিকট থেকে কিছু শ্রবণ করাও যাবে না।[13]

শায়খ ওছমান আল-খুমাইস বলেন,المشهور أن الحسن مات مسموما، لكن لا يعلم إلى اليوم من الذي وضع له السم، الله أعلم، ولعل الراجح أنه مات كما يموت الناس موتا عاديالم يسمّه أحد، ‘প্রসিদ্ধ আছে যে, হাসান (রাঃ) বিষ প্রয়োগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত জানা যায়নি যে, কে তাকে বিষ প্রয়োগ করেছে। আল্লাহ অধিক জ্ঞাত। অগ্রাধিকারযোগ্য কথা হ’ল তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন, যেভাবে মানুষ মারা যায়। কেউ তাকে বিষ প্রয়োগ করেনি’।[14] তাছাড়া হাসান (রাঃ) মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় মু‘আবিয়া (রাঃ) সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন। অতএব মু‘আবিয়া (রাঃ) হাসানের স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগের জন্য পাঠিয়েছিলেন, এটা ধারণাকারীর ধারণা মাত্র।[15] হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আমার মতে, এই বর্ণনা (ইয়াযীদের ইঙ্গিতে জা‘দা বিনতু আশ‘আছ কর্তৃক বিষ পান করানোর ঘটনা) সঠিক নয়। আর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ইশারায় বিষ পান করানোর বর্ণনা বিশুদ্ধ না হওয়াটা তো অধিকতর সুস্পষ্ট।[16] সুতরাং বিষপানে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি যেমন প্রমাণিত নয়, তেমনি কে তাঁকে বিষ পান করিয়েছে, তা অজ্ঞাত। তাই এ বিষয়ে নীরব থাকাই শ্রেয়।

মৃত্যু তারিখ :

হাসান (রাঃ) ৪০ দিন অসুস্থ ছিলেন। অতঃপর তিনি ৪৫ বৎসর ৬ মাস কিছু দিন বয়সে ৫ রবীউল আউয়াল ৪৯ হিজরীতে মদীনা মুনাওয়ারায় মৃত্যুবরণ করেন। বাক্বীউল গারক্বাদ কবরস্থানে ফাতেমাতুয যাহরা (রাঃ)-এর কবরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।[17]

তাকীউদ্দীন মাক্বরীযী (মৃত্যু ৮৪৫হিঃ) বলেন, ومات الحسن بالمدينة في ربيع الأول سنة خمس، وقيل: في سنة تسع وأربعين، وقيل سنة إحدى وخمسين، ودفن بالبقيع، ... وكان سنة يوم مات ستا وأربعين سنة، وقيل: سبعا وأربعين سنة. ‘হাসান (রাঃ) রবীউল আউয়াল মাসে মদীনায় ৪৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। বলা হয়, ৪৯ মতান্তরে ৫১ হিজরীতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে বাক্বীউল গারক্বাদে দাফন করা হয়। ... মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৬ মতান্তরে ৪৭ বছর’।[18]

আল্লামা ইবনু হাজার হায়তামী মাক্কী (রহঃ) বর্ণনা করেন, হাসান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ছিলেন ৭ বছর এবং পিতা আলী (রাঃ)-এর সাথে ৩০ বৎসর। ৬ মাস খলীফাতুল মুসলিমীন ছিলেন, তারপর সাড়ে ৯ বছর মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন।[19]

ইয়া‘কূব ইবনু সুফিয়ান বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া বর্ণনা করেন যে, সুফিয়ান জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদের পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) নিহত হন, যখন তাঁর বয়স ছিল ৫৮ বছর। হাসান (রাঃ)ও একই বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হুসায়ন (রাঃ)ও শহীদ হন ঐ বয়সে।[20]

শু‘বা আবুবকর ইবনু হাফছ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে ১০ বছর অতিক্রম হবার পর কয়েক দিনের মধ্যে সা‘দ (রাঃ) ও হাসান (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। উলাইয়া জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদের পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হাসান (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে ৪৭ বছর বয়সে। আরো একাধিক ব্যক্তি এরূপ বলেছেন। এটিই বিশুদ্ধ অভিমত। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত হ’ল ৪৯ হিজরী সনে তাঁর মৃত্যু হয়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর মৃত্যু ৫০ হিজরীতে মতান্তরে ৫১ বা ৫৮ হিজরীতে হয়েছে।[21]

জানাযাহ ও দাফন :

সাঈদ ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন।[22] হাকেম নাইসাপুরী সালেম ইবনু আবী হাফছাহ হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আবু হাযেমকে বলতে শুনেছি,إني لشاهدٌ يومَ مات الحسن بن علي، فرأيتُ الحسين بن علي يقول لسعيد بن العاص (وهو أمير على المدينة يومئذٍ)، ويطعنُ في عنقه، ويقول: تقدَّم فلولا أنها سُنَّة ما قدَّمتُك، وكان بينهم شيء أي: خلاف، ‘হাসান (রাঃ) যেদিন মৃত্যুবরণ করেন, সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন আমি দেখলাম, হুসাইন বিন আলী (রাঃ) সাঈদ ইবনুল আছ (রাঃ) (মদীনার তৎকালীন গভর্ণর)-এর কাঁধে গুতা মেরে তাকে বললেন, সামনে অগ্রসর হও, এটা সুন্নাত না হ’লে আমি তোমাকে সামনে দিতাম না। তাদের মাঝে কোন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য ছিল’।[23]

ওয়াকিদী বলেন, ইব্রাহীম ইবনু ফাযল আবূ আতীক থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ্ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি ‘যেদিন হাসান (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়, সেদিন আমি সেখানে ছিলাম। তখন হুসায়ন (রাঃ) এবং মারওয়ান ইবনু হাকামের মধ্যে চরম গন্ডগোল সৃষ্টি হবার উপক্রম হয়েছিল। হাসান (রাঃ) তার ভাই হুসায়ন (রাঃ)-কে এ মর্মে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে যেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে দাফন করা হয়। তবে তাতে যদি কোন গন্ডগোল কিংবা ঝগড়া-বিবাদের আশঙ্কা হয় তাহ’লে যেন বাক্বীউল গারক্বাদে দাফন করা হয়। ইবনু কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন,فَأَبَى مَرْوَانُ أَنْ يَدَعَهُ، وَمَرْوَانُ يَوْمَئِذٍ مَعْزُولٌ يُرِيدُ أَنْ يُرْضِيَ معاوية، ولم يَزَلْ مَرْوَانُ عَدُوًّا لِبَنِي هَاشِمٍ حَتَّى مَاتَ، ‘হাসান (রাঃ)-এর লাশ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে দাফন করতে মারওয়ান বাধা দিয়েছিল। ঐ সময় মারওয়ান ছিল চাকুরীচ্যুত। এটা দ্বারা সে আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মানোরঞ্জনের চেষ্টা করেছিল। মারওয়ান কিন্তু আমৃত্যু হাশিমী সম্প্রদায়ের দুশমন ছিল’।[24] জাবের (রাঃ) বলেন,فَكَلَّمْتُ يَوْمَئِذٍ حُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ فَقُلْتُ: يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ اتَّقِ اللهَ ولا تثر فتنة فَإِنَّ أَخَاكَ كَانَ لَا يُحِبُّ مَا تَرَى، فَادْفِنْهُ بِالْبَقِيعِ مَعَ أُمِّهِ فَفَعَلَ. ‘অতঃপর আমি হুসায়ন বিন আলী (রাঃ)-এর সাথে কথা বললাম। আমি বললাম, হে আবূ আব্দিল্লাহ্! আল্লাহকে ভয় করুন, অশান্তির জন্ম দিবেন না (রক্তপাতের সূচনা করবেন না)। কেননা আপনার ভাই এসব পসন্দ করতেন না, যা দেখছেন। আপনার প্রিয় ভাইকে আপনার মায়ের পাশে দাফন করুন। তারপর হুসায়ন (রাঃ) তাই করলেন’।[25]

আব্দুল্লাহ ইবনু নাফে‘ স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ওমর বলেন,حَضَرْتُ مَوْتَ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ فقلت للحسين بن على اتَّقِ اللهَ وَلَا تُثِرْ فِتْنَةً وَلَا تَسْفِكِ الدماء: وادفن أخاك إلى جانب أُمِّهِ، فَإِنَّ أَخَاكَ قَدْ عَهِدَ بِذَلِكَ إِلَيْكَ، قَالَ فَفَعَلَ الْحُسَيْنُ. ‘আমি হাসান বিন আলী (আঃ)-এর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হ’লাম। আমি হুসায়ন বিন আলী (আঃ)-কে বললাম, আল্লাহকে ভয় করুন, অশান্তির জন্ম দিবেন না, রক্তপাতের সূচনা করবেন না। আপনার প্রিয় ভাইকে আপনার মায়ের পাশে দাফন করুন। কেননা আপনার ভাই তাও বলে গিয়েছেন। তারপর হুসায়ন (রাঃ) তাই করলেন’।[26]

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হাসান (রাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় আয়েশা (রাঃ)-এর অনুমতি চেয়েছিলেন, যাতে তাঁকে মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর পাশে দাফন করা হয়। আয়েশা (রাঃ) অনুমতি দিয়েছিলেন। হাসান (রাঃ) মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে দাফন করার উদ্যোগ নেয়া হ’ল। উমাইয়া বংশের লোকজন বাধা দিল। হুসায়ন (রাঃ) ওদের বাধা অতিক্রম করার জন্যে অস্ত্রে সজ্জিত হ’লেন। উমাইয়াগণও অস্ত্রে সজ্জিত হ’ল। তারা বলল, ‘আমরা হাসান (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ)-এর পাশে দাফন করতে দিব না। ওছমান (রাঃ)-কে দাফন করা হয়েছে বাক্বীউল গারক্বাদে আর হাসান (রাঃ)-কে দাফন করা হবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশে? তা হবে না। এ নিয়ে ভীষণ সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিল। এই পরিস্থিতিতে সা‘দ ইবনু

আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ), আবূ হুরায়রাহ (রাঃ), জাবের (রাঃ) ও ইবনু ওমর (রাঃ) প্রমুখ সংঘর্ষে না জড়াতে হুসায়ন (রাঃ)-কে পরামর্শ দিলেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ মেনে নিলেন এবং হাসান (রাঃ)-কে তাঁর মায়ের কবরের নিকট বাক্বীউল গারক্বাদে দাফন করলেন।[27]

ইবনু কাছীর (রহঃ) উল্লেখ করেন, মুহাম্মাদ ইব‌নু ইসহাক বলেছেন, মুসাবির বলেছেন,رَأَيْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ قائما على مسجد رسول الله يَوْمَ مَاتَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ وَهُوَ يُنَادِي بِأَعْلَى صَوْتِهِ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ مَاتَ الْيَوْمَ حب رسول الله فَابْكُوا. وَقَدِ اجْتَمَعَ النَّاسُ لِجِنَازَتِهِ حَتَّى مَا كَانَ الْبَقِيعُ يَسَعُ أَحَدًا مِنَ الزِّحَامِ. ‘যেদিন ইমাম হাসান (রাঃ)-এর মৃত্যু হ’ল সেদিন আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে দেখেছি তিনি মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছেন, ‘হে লোক সকল! আজ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় মানুষের মৃত্যু হ’ল। তোমরা সকলে তাঁর জন্যে কাঁদ’। তাঁর জানাযায় সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হয়। এমনকি বাক্বীউল গারক্বাদে মানুষের ভিড়ে কারো দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না’।[28]

পরিশেষে বলব, ইসলামের ৫ম খলীফা জান্নাতী যুবকদের সর্দার হাসান বিন আলী (রাঃ) ছিলেন অতি বিনয়ী, উদারমনা ও নির্ঞ্ঝাট মানুষ। মুসলিম উম্মাহর প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম মহববত। খিলাফতের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া এবং উষ্ট্র ও ছিফ্ফীনের যুদ্ধে তাঁর অনন্য ভূমিকাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনীতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়ার তাওফীক দিন-আমীন!


[1]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২ পৃঃ।

[2]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ২/৩৮পৃঃ; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২ পৃঃ।

[3]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪২-৪৩ পৃঃ।

[4]. ঐ, ১১/২০৯ পৃঃ।

[5]. ঐ, ৮/৪৫ পৃঃ।

[6]. আল-ইছাবাহ ২/৭৩, বর্ণনাটি ছহীহ; তাহযীবুত তাহযীব ৪/১২৭।

[7]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/২৭৪।

[8]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/২০৮।

[9]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৪৬৯ পৃঃ।

[10]. আবু বকর আল-আরাবী (মৃঃ ৫৪৩হিঃ), আল-‘আওয়াছেম মিনাল ক্বাওয়াছেম, (বৈরূত : দারুল জীল, ২য় প্রকাশ, ১৪০৭ হিঃ/১৯৮৭ খ্রিঃ), পৃঃ ২২১, টীকা ৪১৩ দ্রঃ।

[11]. তারীখুল ইসলাম, পৃঃ ৪০।

[12]. তারীখে ইবনু খালদুন ২/৬৪৯ পৃঃ।

[13]. আল-‘আওয়াছেম মিনাল ক্বাওয়াছেম, পৃঃ ২২০-২১।

[14]. ইসলাম সুয়াল ওয়া জওয়াব, প্রশ্ন নং ২১২৩৮৯।

[15]. ইসলাম ওয়েব. নেট, ফৎওয়া নং ২৪৪২৭৯।

[16]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৩ পৃঃ।

[17]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ৭৬২; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮/৩৪।

[18]. তাকীউদ্দীন মাক্বরীযী, ইমতা‘উল আসমা‘ বিমা লিননবী মিনাল আহওয়াল ওয়াল আমওয়াল ওয়াল হাফাদাহ ওয়াল মাতা‘ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯ খ্রিঃ), ৫/৩৬১ পৃঃ।

[19]. আস-সাওয়ায়েকুল মুহরাকা, পৃঃ ৩৪৬।

[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৮, ১১/২১২ পৃঃ।

[21]. ঐ, ৮/৪৮, ১১/২১২ পৃঃ।

[22]. তারীখুল খোলাফা, সাওয়ানেহে কারবালা, পৃঃ ৬১-৬২; ইবনু আসাকির (মৃত্যু ৫৭১হিঃ), তারীখু দিমাশক, ১৩/৩০৩ পৃঃ।

[23]. আলবানী, আহকামুল জানায়েয, পৃঃ ১২৮, সনদ ছহীহ; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৮ পৃঃ।

[24]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮/৪৪ পৃঃ।

[25]. ঐ, ৮/৪৪, ৪৮; ১১/২১০ পৃঃ।

[26]. ঐ, ৮/৪৪, ৪৮; ১১/২১০ পৃঃ।

[27]. ঐ, ৮/৪৪ পৃঃ।

[28]. ঐ, ৮/৪২, ১১/২১১ পৃঃ।






হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ)(শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মায়মূনা বিনতুল হারেছ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ঈমানী তেজোদীপ্ত নির্যাতিত ছাহাবী খাববাব বিন আল-আরাত (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
হাসান বিন আলী (রাঃ) (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামের প্রথম দাঈ, ওহোদের ঝান্ডাবাহী শহীদ ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়া (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
যয়নাব বিনতু খুযাইমা (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.