পর্ব ১। পর্ব ২।

ভূমিকা : পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুন্বত করার জন্য দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। নবী-রাসূলগণ সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে স্ব স্ব কওমের নিকটে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাহেলী যুগে যুল-মাজায বাযারে গিয়ে যখন জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوْا، ‘হে লোক সকল! তোমরা বল, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, এতে তোমরা সফলতা লাভ করবে’ তখন তার আপন চাচা আবু লাহাব সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং রাসূল (ছাঃ)-এর পিছনে পিছনে গিয়ে লোকদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল এই বলে যে,  يَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ، ‘হে লোক সকল! তোমরা তার অনুসরণ করো না। কেননা সে মহা মিথ্যাবাদী’।[1] একবার কা‘বায় ছালাত রত অবস্থায় অপর প্রভাবশালী চাচা আবূ জাহাল তাঁর ঘাড়ের উপর উটের নাড়ীভূঁড়ি চাঁপিয়ে দিয়ে নিমর্মভাবে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এভাবে অন্যূন ১৫ বার হত্যা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি নিজ আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি যেমন নিজ পরিবার, সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতাদের নিকটে তাওহীদের অমীয় বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, তেমনি সমাজের অসহায় গরীব, ক্রীতদাস ও অধীনস্থদের নিকটেও তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলেন। নবী-রাসূলগণের ইন্তেকালের পর দ্বীন প্রচারের এ মহান দায়িত্ব প্রধানত ওলামায়ে কেরামের। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ ‘নিশ্চয়ই আলেমগণ হ’লেন নবীগণের উত্তরাধিকারী’।[2] তবে সাধারণভাবে এই দায়িত্ব সকলের। রাসূল (ছাঃ) বলেন,بَلِّغُوْا عَنِّى وَلَوْ آيَةً، وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِى إِسْرَائِيْلَ وَلاَ حَرَجَ، وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হ’লেও পৌঁছে দাও। আর বনী ইসরাঈলের কাহিনী বর্ণনা কর, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি আমার উপর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যারোপ করে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে প্রস্ত্তত করে নেয়’।[3]

ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব  যেমন অপরিসীম তেমনি দাঈর নেকীও অফুরন্ত। হাল যামানার সাথে তাল মিলিয়ে দাওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে বিস্তর। বলতে গেলে দাওয়াত পৌঁছানো এখন আগের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেকাংশে সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে অল্প সময়ের মধ্যে অধিক মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তে। আলোচ্য নিবন্ধে দাওয়াতের পদ্ধতি, দাঈর মর্যাদা ও ফযীলতসহ দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ তুলে ধরা হ’ল।-

দাওয়াতের পদ্ধতি : আল্লাহ স্বীয় রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন,ادْعُ إِلى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ- ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দর পন্থায়। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি ভালভাবেই জানেন কে সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে’ (নাহল ১৬/১২৫)

বাতিলের সাথে আপোষহীনতা এবং জামা‘আতবদ্ধ দাওয়াতের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, قُلْ هذِهِ سَبِيلِي أَدْعُوا إِلَى اللهِ عَلى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحانَ اللهِ وَما أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ- ‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (ইউসুফ ১২/১০৮)। একই মর্মে তিনি আরো বলেন,وَلا يَصُدُّنَّكَ عَنْ آياتِ اللهِ بَعْدَ إِذْ أُنْزِلَتْ إِلَيْكَ وَادْعُ إِلى رَبِّكَ وَلا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘আর তোমার প্রতি আল্লাহর আয়াত সমূহ অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা যেন তোমাকে সেগুলি থেকে ফিরিয়ে না নেয়। তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে আহবান কর এবং অবশ্যই তুমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৭)

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে স্বীয় কওমের নিকটে সদুপদেশের মাধ্যমে, হিকমত বা দলীল-প্রমাণ সহকারে এবং আপোষহীনভাবে দাওয়াত দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। আর বিতর্ক হ’লে তা উত্তম পন্থায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে নম্র আচরণের কথা উল্লেখ করে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ، ‘আর আল্লাহর রহমতের কারণেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হ’তে তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত। কাজেই তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উপর ভরসাকারীদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)

আলোচ্য আয়াতে পাঁচটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। (১) পরস্পরে কোমল হৃদয় হওয়া (২) পরস্পরকে ক্ষমা করা (৩) আপোষে পরামর্শ করা (৪) সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তা বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ হওয়া এবং (৫) আল্লাহর উপর ভরসা করা। আল্লাহর পথের দাঈদের জন্য উক্ত গুণগুলো অর্জন করা অত্যন্ত যরূরী।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, দাওয়াত গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। যা চরমপন্থী খারেজীদের আক্বীদা। আল্লাহ বলেন, لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ তুমি তাদের উপরে দারোগা নও (গাশিয়াহ ৮৮/২২)

তবে কোন মুনকার বা অন্যায় কর্ম হতে দেখলে ক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ- ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় হ’তে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। তাতে সক্ষম না হ’লে যবান দিয়ে প্রতিবাদ করবে। তাতেও সক্ষম না হ’লে অন্তর  থেকে ঘৃণা করবে। আর এটা হ’ল দুর্বলতম ঈমান’।[4]

দাঈর মর্যাদা ও ফযীলত : দাঈদের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صالِحاً وَقالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ- ‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম কথা কার, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত’ (ফুছছিলাত ৪১/৩৩)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ  مِنَ  الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ  شَيْئًا  وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا- ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তির সমপরিমাণ নেকী রয়েছে কিন্তু তার নেকী থেকে বিন্দু পরিমাণ হ্রাস পাবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে তার জন্য তার অনুসারী ব্যক্তির সমপরিমাণ পাপ রয়েছে কিন্তু তার পাপ থেকে বিন্দু পরিমাণও হ্রাস পাবে না’।[5] অন্য হাদীছে আছে,

عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ الأَنْصَارِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّى أُبْدِعَ بِى فَاحْمِلْنِى فَقَالَ مَا عِنْدِى فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ أَنَا أَدُلُّهُ عَلَى مَنْ يَحْمِلُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ.

আবু মাসঊদ আল-আনছারী (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, আমার সওয়ারী ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং আমাকে একটি সওয়ারী দান করুন। তিনি বললেন, সওয়ারী আমার কাছে নেই। এক ব্যক্তি বলল,  হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি তাকে এমন লোকের কথা বলে দিতে পারি, যে তাকে সওয়ারীর পশু দিতে পারবে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি কল্যাণের দিকে পথ দেখায় তার জন্য কল্যাণকর কাজ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ নেকী রয়েছে’।[6]

অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির হোদায়াত লাভকে সমবচেয়ে দামী লাল উটের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। খায়বর যুদ্ধে ইহূদীদের ‘নায়েম’ দুর্গ জয়ের প্রক্কালে আলী (রাঃ)-এর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, فَوَاللهِ لَأَنْ يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ، ‘যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের (কুরবানীর) চাইতে উত্তম হবে’।[7]

দাওয়াতের ক্ষেত্র সমূহ

ক্ষেত্র অর্থ জায়গা বা স্থান। দাওয়াতের ক্ষেত্র অর্থ দাওয়াতের স্থান। অর্থাৎ যেসকল স্থান বা স্তরে দাওয়াত প্রদান যরূরী। দাওয়াতের উল্লেখযোগ্য কিছু ক্ষেত্র নিম্নে তুলে ধরা হ’ল।-  

১. পরিবার :

দাওয়াতের প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার। নবী-রাসূলগণ দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিজ পরিবারকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুঅত লাভের পর সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেছিলেন তাঁর স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পিতা আযরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلَالٍ مُبِيْنٍ، ‘আপনি কি (আল্লাহকে বাদ দিয়ে) মূর্তিগুলিকে উপাস্য গণ্য করে নিয়েছেন? আমি তো দেখছি আপনি ও আপনার সম্প্রদায় স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে আছেন’ (আনআম ৬/৭৪)। তিনি আরও বলেন, وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِيْ بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُوْنَ ‘স্মরণ কর যখন ইবরাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা যে সবের পূজা কর, আমি সেসব থেকে মুক্ত’ (যুখরুফ ৪৩/২৬)

লোকমান তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেন,يَابُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথ কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় পাপ’ (লোকমান ৩১/১৩)। তিনি আরও বলেন,

يَابُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللهُ إِنَّ اللهَ لَطِيفٌ خَبِيْرٌ- يَابُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوْفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُوْرِ- وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ- وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ-

‘হে বৎস! তোমার পাপ-পুণ্য যদি সরিষাদানা পরিমাণও হয়, আর তা যদি পাথরের গর্তে বা আকাশে বা ভূগর্ভে থাকে, আললাহ তা হাযির করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মবিদ এবং (গোপন ও প্রকাশ্য) সব খবর রাখেন। হে বৎস! ছালাত কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও ও অসৎকাজে নিষেধ কর এবং বিপদে ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই এটি শ্রেষ্ঠ কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আর অহংকারবশে তুমি মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালবাসেন না। তুমি পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে বিকট স্বর হ’ল গাধার কণ্ঠস্বর’ (লোকমান ৩১/১৬-১৯)

উক্ত আয়াতগুলোতে লোকমান স্বীয় সন্তানের উদ্দেশ্যে মোট ১৬টি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। যা একজন সন্তানের জীবন পরিচালনা ও আখেরাতে মুক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মাতের সকল পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে তাদের সন্তানদের সাত বৎসর বয়সে ছালাত শিক্ষার তাকীদ দিয়ে বলেন,مُرُوْا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِيْنَ وَاضْرِبُوْهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِيْنَ وَفَرِّقُوْا بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ، ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে ছালাতের আদেশ দাও এবং যখন তারা ১০ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন ছালাতের জন্য তাদেরকে প্রহার কর এবং তাদের শয্যা পৃথক করে দাও’।[8]

আর এই দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য হবে আখেরাতে নাজাত লাভ তথা জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে নিজেকে ও নিজ পরিবারকে বাঁচানো। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَارًا وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُوْنَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। আল্লাহ যা আদেশ করেন তারা তা অমান্য করে না। তারা তা-ই করে, যা করতে তাদের আদেশ করা হয়’ (তাহরীম ৬৬/৬)

কিন্তু দুঃখজনক যে, আমরা আমাদের পরিবার সম্পর্কে উদাসীন। নিজেরা ধর্ম পালন করলেও পরিবারের প্রতি বেখেয়াল। বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনায় হাবুডুবু খাচ্ছে সমাজের অধিকাংশ পরিবার। এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবারে দাওয়াত ও তাবলীগের কোন বিকল্প নেই। শুধু আমর ও তালীম নয় বরং নিজেদের কর্মে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবারের অধীনস্তরা কর্তা ব্যক্তির কর্ম দেখে শিখবে। অনেক পিতা-মাতা আছেন, যারা ছেলে-মেয়েদেরকে শুধু আদেশ করেন, কিন্তু নিজে সে আমলটি করেন না; ছেলে-মেয়েদের ইসলামী পোষাকের কথা বলেন, কিন্তু নিজের পোষাক ইসলামী নয়। এ ক্ষেত্রে এই আদেশ বা দাওয়াত কখনো ফলপ্রসূ হবে না। আগে নিজে সংশোধন হতে হবে। অতঃপর পরিবারে তা বাস্তবায়নের জন্য নছীহত করতে হবে। এজন্য নিয়মিত সাপ্তাহিক পারিবারিক তা‘লীমী বৈঠক চালু করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

২. আত্মীয়-স্বজন :

দাওয়াতের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে আত্মীয়-স্বজন। আল্লাহ বলেন, وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ‌‌ ‘তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দের সতর্ক কর’ (শুআরা ২৬/২১৪)। আবু হুরায়রা হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَامَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم حِينَ أَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ (وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ) قَالَ: يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ، لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا، يَا بَنِى عَبْدِ مَنَافٍ لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا، يَا عَبَّاسُ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا، وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللهِ لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا، وَيَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِينِى مَا شِئْتِ مِنْ مَالِى لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا-

‘যখন আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল করলেন, (তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর) তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কিংবা অনুরূপ শব্দ বললেন, তোমরা (আল্লাহর আযাব থেকে) আত্মরক্ষা কর। আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে আমি তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হে বনু আবদে মানাফ! আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে আমি তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হে আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব! আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে আমি তোমাদের  কোন উপকার করতে পারব না। হে ছাফিইয়া রাসূলুল্লাহর ফুফু! আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে আমি তোমাদের কোন উপকার করতে পারব না। হে ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ! আমার ধন-সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আল্লাহর শাস্তি থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারব না’।[9]

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূল (ছাঃ) ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে সবাইকে ডেকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন,

يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ كَعْبِ بْنِ لُؤَىٍّ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ هَاشِمٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا عَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا يَا فَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّىْ لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئاً غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِماً سَأَبُلُّهَا بِبَلاَلِهَا -

‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আব্দিল মুত্তালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব! আমি তোমাকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষায় কোনই কাজে আসব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! কেননা আমি  তোমাদের কাউকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না’।[10] সুতরাং নিকটাত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশী সকলকে জান্নাতের সুসংবাদ এবং জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করতে হবে এবং আখেরাতের অনন্ত জীবনে চূড়ান্ত সফলতা লাভের লক্ষ্যে আল্লাহ প্রেরিত বিধান মেনে চলার জন্য তাদের মধ্যে দাওয়াত অব্যাহত রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, আমরা অনেক সময় আত্মীয়-স্বজনকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে লজ্জাবোধ করি। দুনিয়াবী বিষয়ে কথাবার্তা হলেও ধর্মীয় বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই। আবার এমন অনেক খ্যাতিমান আলোচক আছেন, যারা দেশ-বিদেশে দাওয়াতী কাজে ব্যতিব্যস্তথাকেন। কিন্তু নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী সম্পর্কে উদাসীন। যা আদৌ সমীচীন নয়। কেননা তারাই আমাদের নিকট থেকে অধিক কল্যাণ পাওয়ার হকদার।

৩. বন্ধু-বান্ধব :

বন্ধু শব্দের অর্থ সুহৃদ, স্বজন, মিত্র প্রভৃতি। এটি দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কেননা পৃথিবীতে বন্ধুবিহীন চলা দুঃসাধ্য। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষেরই স্ব স্ব স্তর অনুযায়ী বন্ধু রয়েছে। তবে বন্ধুদের মধ্যে ভাল-মন্দ দু’ধরনের বন্ধুই আছে। বন্ধুর সংস্পর্শে একদিকে যেমন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠা যায়, অপরদিকে বন্ধুর কারণেই হয়ে ওঠে শয়তানের শিখন্ডী। কবি বলেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস ও অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। সেকারণ ইসলাম বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ প্রদান করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الرَّجُلُ عَلَى دِيْنِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতি-নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকেই যেন লক্ষ্য করে যে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে’।[11] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেছেন,لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِيٌّ، ‘তুমি মুমিন ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন কেবল পরহেযগার  লোকে খায়’।[12]

নানাবিধ কারণে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে সকল বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় না। তাক্বওয়ার ভিত্তিতে বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সে বন্ধুত্বই হয় সবচেয়ে মযবূত ও স্থায়ী। অপরদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সামাজিকতার দোহাই দিয়ে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তা অস্থায়ী। এজন্যই কাউকে ভালবাসলে আল্লাহর জন্যই ভালবাসতে হবে এবং কাউকে অপসন্দ করলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। আবূ যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,أَفْضَلُ الأَعْمَالِ الْحُبُّ فِى اللهِ وَالْبُغْضُ فِى اللَّهِ. ‘সর্বোত্তম আমল হচ্ছে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা ও আল্লাহর জন্যই কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা’।[13]

মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحَابِّيْنَ فِيَّ، وَالمُتَجَالِسيْنَ فِيَّ، وَالمُتَزَاوِرِيْنَ فِيَّ، وَالمُتَبَاذِلِيْنَ فِيَّ، ‘আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য যারা পরস্পরে ভালোবাসে, একে অপরের সঙ্গে বসে, একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং একে অপরের জন্য খরচ করে, তাদের জন্য আমার মুহববত ও ভালোবাসা ওয়াজিব হয়ে যায়’।[14]

সুতরাং বন্ধু নির্বাচন করতে হবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয়। বন্ধুদের মধ্যে বিশুদ্ধ দ্বীনের অনুশীলন থাকলে বাতিল ও অশুদ্ধ দ্বীন পরাভূত হবে ইনশাআল্লাহ। সেকারণ বন্ধুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দাওয়াতী কাজ চালাতে হবে। কেননা বন্ধু মহলে দাওয়াত দান যতটা সহজ অন্যান্য ক্ষেত্রে ততটা নয়। আল্লাহ তা‘আলা মুমিন পুরুষ ও নারীকে পরস্পর বন্ধু বলে সম্বোধন করে তাদের কর্মসূচী উল্লেখ করে বলেন,

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ-

‘আর মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’ (তওবাহ ৯/৭১)

৪. পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজ :

প্রতিবেশী যদি দ্বীনী অনুশাসন মেনে না চলে বা দ্বীনের জন্য সহযোগী না হয়, তাহ’লে স্বাধীনভাবে দ্বীন পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। বরং পদে পদে অশান্তি ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। সেকারণ পারিবারিক পরিমন্ডলে দাওয়াতের পর প্রতিবেশী ও সমাজের লোকদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে। সমাজে জেঁকে বসা হাযারো কুসংস্কার ও শিরক-বিদ‘আতের শিকড় উপড়ে ফেলে সেখানে তাওহীদ, সুন্নাত ও বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করতে হবে। এতে বিরুদ্ধবাদীদের কোন পরোয়া করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ-  ‘তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) ভয় প্রদর্শন করে, যাতে তারা সাবধান হয়’ (তওবা ৯/১২২)

উল্লেখ্য, সমাজে প্রচলিত রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বললে সমাজ নেতারা ক্ষিপ্ত হবে এটিই স্বাভাবিক। সে যুগেও তাই হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেক নবীর ক্ষেত্রেই সমাজের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের দোহাই দিয়েছিল। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ  آبَاءَنَا  أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ  لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا  وَلَا يَهْتَدُونَ ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব, যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জ্ঞান রাখতো না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)

অন্য আয়াতে আছে তারা বলেছিল, وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَى عَذَابِ السَّعِيرِ ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করব। (আল্লাহ বলেন,) শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে আহবান করে, তবুও কি তারা এটা বলবে’? (লোকমান ৩১/২১)। অর্থাৎ বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা জাহান্নামকে আহবান করার শামিল। আলোচ্য আয়াতে বাপ-দাদার অনুসরণকে শয়তানের অনুসরণ বলে ধমক দেওয়া হয়েছে।

প্রিয় পাঠক! সে যুগের তুলনায় এ যুগের অবস্থা আরও বেদনাদায়ক। সে যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা হ’ত (তাকভীর ৮১/৮-৯)। আর এ যুগে তার আধুনিক সংস্করণ হিসাবে মায়ের পেটেই সন্তান হত্যা করা হয়। এমনকি সদ্যজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আড়াই বছরের শিশু থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধাও এ যুগে ধর্ষিতা হচ্ছে। অশ্লীলতা আজ প্রত্যেকের দোরগোড়ায়। অফিস-আদালতের পরতে পরতে ঘুষ-দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আশরাফুল মাখলূকাত হিসাবে মানুষের মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত। জীবন আজ তুচ্ছ। সামান্য টাকার বিনিমিয়ে মানুষ মানুষকে খুন করছে। মদ্যপান, জুয়া, লটারী, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এক কথায় জাহেলী যুগের হেন অপরাধ নেই, যা সভ্যতার এই উৎকর্ষতার যুগে ব্যাপকতা লাভ করেনি। এই ঘোর অমানিশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানবতাকে উদ্ধারের জন্য এলাহী বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ব্যতীত কোন গত্যন্তর নেই। আর এজন্য সর্বাগ্রে দাওয়াত দান অত্যাবশ্যক। সমাজকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে পরিচ্ছন্ন করে তাওহীদের আলোকোজ্জল সমাজে পরিণত করতে হ’লে এবং শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া আদর্শ তথা ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক গড়ে তুলতে হ’লে সমাজের সর্বত্র দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। সমাজের যেখানে অসুখ সেখানেই আসমানী ব্যবস্তাপত্র প্রয়োগ করতে হবে।

[চলবে]


[1]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক হা/৩৯; মুসনাদে আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬৬৫৪; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৫৬২; ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ ছহীহ

[2]. তিরিমিযী হা/২৬৮২; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৮৮

[3]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮

[4]. মুসলিম হা/৭৮; আলবানী মিশকাত ৩/১৪ পৃ; হা/৫১৩৭ ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ।

[5]. মুসলিম হা/৬৯৮০; মিশকাত হা/১৫৮

[6]. মুসলিম হা/৫০০৭; মিশকাত হা/২০৯

[7]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০৮০; ফাৎহুল বারী হা/৪২১০

[8]. আবূদাঊদ হা/৪৯৫; মিশকাত হা/৫৭২, সনদ হাসান

[9]. বুখারী হা/২৭৫৩; মুসলিম হা/২০৬

[10]. বুখারী হা/২৭৫৩; মুসলিম হা/২০৪, ২০৬; আহমাদ হা/৮৭১১; নাসাঈ হা/৩৬৪৪; মিশকাত হা/৫৩৭৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-২৬

[11]. আবূদাঊদ হা/৪৮৩৩; তিরমিযী হা/২৩৭৮, সনদ হাসান

[12]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৩

[13]. আবূদাঊদ হা/৪৫৯৯; মিশকাত হা/৩২

[14]. তিরমিযী, মালেক, মিশকাত হা/৫০১১





নববী চিকিৎসা পদ্ধতি (৪র্থ কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
কিভাবে ইবাদতের জন্য অবসর হব? - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
সর্বনাশের সিঁড়ি - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মাসায়েলে কুরবানী - আত-তাহরীক ডেস্ক
শয়তানের চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষার উপায় (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
বায়তুল মাক্বদিস মুসলমানদের নিকটে কেন এত গুরুত্ববহ? - ড. মুখতারুল ইসলাম
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
গীবত থেকে বাঁচার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.