ভূমিকা :

পরিবার হ’ল সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথম ধাপ। মানব জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজের অস্তিত্বের জন্য সুষ্ঠু-সুন্দর ও অপরাধমুক্ত পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। আজকাল পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হয় না এমন কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অপরাধেরও নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইসলামী অনুশাসন মেনে চললে এ ধরনের অপরাধ দূরীভূত হ’তে বাধ্য। ইসলাম অন্যায়-অপরাধকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَا تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا، ‘শৃংখলা স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না’ (আ‘রাফ ৭/৫৬, ৮৫)। মূলতঃ মানবতার কল্যাণের জন্যই মুসলিম জাতির আবির্ভাব। আল্লাহ বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ‘তোমরাই হ’লে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকার্জের আদেশ দিবে এবং অসৎকাজ (অপরাধ) থেকে নিষেধ করবে’ (আলে ইমরান ১১০)। আলোচ্য নিবন্ধে উল্লেখযোগ্য কিছু পারিবারিক অপরাধ এবং এর কারণ ও প্রতিকার তুলে ধরা হ’ল।-

পরিবারের পরিচয় :

আভিধানিক অর্থে পরিবার বলতে পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পোষ্যবর্গ, একান্নবর্তী সংসার, পত্নী ইত্যাদি বুঝায়।[1] পারিভাষায় পরিবার বলতে নিকটতম ব্যক্তিবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনদের বুঝায়।

মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রবার্ট মরিসন ম্যাকাইভার ওপেজ (&১৮৮২-১৯৭০ খৃ.)-এর মতে, ‘পরিবার হ’ল এমন একটি গোষ্ঠী যাকে সুস্পষ্ট জৈবিক সম্পর্কের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করা যায়। অর্থাৎ এটি সন্তান-সন্ততি জন্মদান ও লালন-পালনের এক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান’।

আল-মাওসূআতুল ফিক্বহিইয়াহ-তে বলা হয়েছে, ‘পরিবার হ’ল কোন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও তার ঘরের লোকজন’। ব্যাপক অর্থে মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয় এবং দাস-দাসী বা চাকর-চাকরানী নিয়েই হচ্ছে পরিবার।[2]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমদ (১৯৩৩-২০২০) বলেন, ‘পরিবার হ’ল সমাজের সেই প্রাথমিক সংগঠন, যেখানে এক বা একাধিক পুরুষ তাদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও অন্যান্য পরিজন নিয়ে একত্রে বসবাস করেন’।

সুতরাং মানুষের স্বভাবগত প্রবণতা অনুযায়ী বৈধ পন্থায় সম্পর্কিত একজন পুরুষ ও নারী তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে গড়ে ওঠে যে ক্ষুদ্র জনসমষ্টি তা-ই হ’ল পরিবার। আর এ পরিবারের সূত্র ধরেই বিস্তার লাভ করে মানববংশ। এ সম্পর্কে আললাহ বলেন,ياَيُّهاَ النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثَى وَجَعَلْناَكُمْ شُعُوْبًا وَّفَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا- ‘হে মানুষ! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও নারী থেকে। অতঃপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)

অপরাধের পরিচয় :

অপরাধ শব্দটি ব্যাপকার্থবোধক। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল দোষ-ত্রুটি, আইন-বিরুদ্ধ কাজ, দন্ডণীয় কর্ম, পাপ, অধর্ম ইত্যাদি।[3] সাধরণত যেসব কাজ সামাজিক রীতিনীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ ও শান্তি-শৃঙ্খলার পরিপন্থী এবং আইনবিরোধী তাকে অপরাধ বলে।

অপরাধের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী বার্নস বলেন, ‘অপরাধ হচ্ছে এমন এক ধরনের সমাজ বিরোধী আচরণ যা জনসাধারণের স্বাভাবিক অনুভূতির বিরুদ্ধে কাজ করে এবং যা দেশের আইনে নিষিদ্ধ’।[4] সমাজকর্ম অভিধানে বলা হয়েছে, Crime is any behavior that violates a law অর্থাৎ ‘অপরাধ হচ্ছে যে কোন ধরনের আচরণ যা আইন লঙ্ঘন করে’। সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষের ভাষায়- সমাজ স্বীকৃত পথ ব্যতীত অন্য পথে চলা, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেআইনী কাজ করাই অপরাধ।[5] সমাজবিজ্ঞানী Gillin Jhon-এর মতে ‘অপরাধ হচ্ছে এমন ধরনের কাজ যা সমাজবদ্ধ মানুষ মূলত সমাজের জন্য ক্ষতিকারক মনে করে’।

সমাজ বিজ্ঞানী স্টিফেন-এর মতে, ‘অপরাধ হচ্ছে সেসব কাজ করা বা না করা, যার জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে।[6]

আদম (আঃ)-এর পুত্র ক্বাবীল কর্তৃক হাবীলকে হত্যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংঘটিত অপরাধ। সাধারণত পিতা-মাতা ও অভিভাবকের অবহেলা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক শিক্ষা না পাওয়া, অসৎ সঙ্গ, অর্থনৈতিক সমস্যা, অর্থের প্রাচুর্য, হতাশা, লোভ, ক্ষোভ, ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, ক্ষমতাসীনদের সহায়তা, জবাবদিহিতার অভাব, আমানতদারীতা ও আল্লাহর ভয় না থাকা প্রভৃতি কারণে মানুষ অপরাধী হয়ে থাকে।

পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধসমূহ :

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি পারিবারিক অপরাধ দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- যৌন নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, খুনের জন্য প্ররোচিত করা, খুনের হুমকি দেয়া, হত্যার চেষ্টা করা, শারীরিক নির্যাতন, যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করা, লাঞ্ছিতকরণ, সা^াধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, আত্মহত্যার প্ররোচনা, পরকীয়া, মানসিক নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করা, স্বামী-স্ত্রীর কলহ, যৌতুকপ্রথা, স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা, ভরণ-পোষণ না দেয়া, পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া প্রভৃতি।

পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহের কারণ :

নানা কারণে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি এমন সব অকল্পনীয় পারিবারিক অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে যা আমাদের চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। নৈতিক অবক্ষয়, মুল্যবোধের অভাব, আকাশ সংস্কৃতি, ইণ্টারনেটের অপব্যবহার, মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর অনুপস্থিতি, নৈতিকতাহীন শিক্ষা, অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, আস্থার অভাব, অধিক হতাশা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, জোরপূর্বক বিবাহ, জোরপূর্বক গর্ভপাত, অপসংস্কৃতি, পারিবারিক মূল্যবোধ না থাকা, দাম্পত্য কলহ, যৌতুক প্রথা, কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, পর্দা ব্যবস্থা না থাকা, পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিরোধ এবং সম্পর্কচ্ছেদ, গোপনীয় বিষয় প্রকাশ, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা, আখেরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি না থাকা প্রভৃতি কারণে পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। নিমেণ পারিবারিক অপরাধ সমূহের কতিপয় কারণ উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) পরকীয়া :

পরকীয়া বলতে সাধারণত নিজের স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্যের স্বামী বা স্ত্রী কিংবা অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করাকে বুঝায়। পরকীয়ার কারণে পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে। সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে পরকীয়ার ঘটনা শুনা যায়।

হিন্দুস্থান টাইমসের তথ্য মতে, একটি অনলাইন ডেটিং সাইট সারা পৃথিবী জুড়ে পরকীয়ার একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে পরকীয়ার প্রথম সারিতে রয়েছে আয়ারল্যান্ড। এদেশে পরকীয়ার হার প্রায় ২০ শতাংশ। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে জার্মানী। তাদের পরকীয়ার হার ১৩ শতাংশ। আর তিন নম্বরে রয়েছে কলাম্বিয়া। এদেশে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের পরিমাণ ৮ শতাংশের মতো। তবে এর আগে ২০১৫ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল থাইল্যান্ডে প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষই পরকীয়ায় জড়িত। এর পরে ছিল- ডেনমার্কে ৪৬ শতাংশ, ইতালিতে ৪৫ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৫ শতাংশ, ফ্রান্সে ৪৩ শতাংশ, নরওয়েতে ৪১ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৪০ শতাংশ, স্পেনে ৩৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্টে ৩৬ শতাংশ এবং ফিনল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ।[7] উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশও পরকীয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়।

পরকীয়া একটি অমানবিক ও বিকৃত মানষিকতার নাম। সুস্থ মস্তিষ্কের কোন নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হ’তে পারে না। পরকীয়ার ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল দেখা দেয়। একসময় তাদের বৈবাহিক জীবনে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। পরকীয়া এত মারত্মক যে, এর সামনে যেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেই হত্যা কিংবা নির্যাতনের শিকার হ’তে পারে। পবিত্র কুরআনে পরকীয়া-ব্যভিচারের ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, وَلاَتَقْرَبُوْا الزِّني اِنَّه كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيْلاً ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩২)

(২) নৈতিক অবক্ষয় :

পারিবারিক জীবনের অপরাধগুলোর পেছনে নৈতিক অবক্ষয়কে দায়ী করা যায়। নীতি-নৈতিকতা এখন শুধু পাঠ্য-পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নৈতিকতাহীন জীবন মানুষকে দানবে পরিণত করে। এখন মানুষের নৈতিক মুল্যবোধের যতটা না উন্নতি হচ্ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ অধিক হচ্ছে অবনতি। হিংস্র জীব-জন্তু যেমন যা ইচ্ছা তাই করে, ঠিক তেমনি নৈতিকতাহীন মানুষও যা ইচ্ছা তাই করে। এদের কারণে পরিবারে অশান্তি বিরাজ করে। এরা খুন-রাহাজানী, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, মানব পাচার প্রভৃতি কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তাই নৈতিক অবক্ষয় পারিবারিক অপরাধের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই অনুঘটকের কাজ করে।

(৩) দাম্পত্য কলহ :

একটি সুষ্ঠু সমাজ গঠনে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব ও ভালোবাসার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। আদর্শ সমাজ গঠন করতে চাইলে প্রয়োজন আদর্শ দাম্পত্য সম্পর্কের। তবে মাঝে-মধ্যে এ সম্পর্ক জটিলরূপ ধারণ করে স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া-বিবাদের মতো হীনকর্মে লিপ্ত করে। এ ধরনের বিবাদকে বলা হয় দাম্পত্য কলহ। দাম্পত্য কলহের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ কারণে শুধু পরিবার ধ্বংসই হয় না বরং অনেক সময় আত্মহত্যা ও খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে।

(৪) অপসংস্কৃতি :

সংস্কৃতির বিকৃত রূপই হ’ল অপসংস্কৃতি। বর্তমানে স্যাটেলাইট মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশী সংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় ও পশ্চিমা সংস্কৃতি এদেশে অবাধে প্রবেশ করছে। যার কারণে দেশের শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীরা সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এসব মাধ্যমে অবৈধ প্রেম, পরকীয়া, বউ-শাশুড়ীর ঝগড়া, দেবর-ভাবীর অবৈধ প্রেম প্রভৃতি বিষয় প্রচার করা হয়। বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালে আসক্ত আজকের যুবক ও যুবতীরা। এসব দেখে সেগুলোকে নিজেদের জীবনাচার হিসাবে গ্রহণ করছে। ফলে এসব অপসংস্কৃতির কু-প্রভাবে পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। বস্ত্ততঃ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে অপসংস্কৃতি।

(৫) পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব :

পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব আমাদের জন্য বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে মানুষের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন। পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙ্গনের সুর। নষ্ট হচ্ছে আমাদের পবিত্র সম্পর্কগুলো। বৃদ্ধি পাচ্ছে আত্মহত্যা সহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, পিতা-মাতা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে, আবার সন্তান তার পিতা-মাতাকে হত্যা করছে। পারিবারিক মূল্যবোধ না থাকার কারণেই হিংস্রতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

(৬) যৌতুক প্রথা :

পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহের অন্যতম কারণ যৌতুক প্রথা। এটা নারীর প্রতি একটি অভিশাপ। এটি নীতি-নৈতিকতা ও মানবতাবোধকে নষ্ট করে দেয়। এ অভিশাপ কেবল গরীবের ঘরেই নয় বরং মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনীসহ প্রায় সকল পরিবারেই ছড়িয়ে আছে।

নারী জাতির প্রতি চরম অবমাননা, অন্যায় ও যুলুমের হাতিয়ার হ’ল যৌতুক প্রথা। এ ঘৃণ্য প্রথার কারণে বহু নারীর সঠিক সময়ে যেমন বিবাহ হয় না, তেমনি সংসার সুখেরও হয় না। নারী জাতির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারী এ অন্যায় চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেক নারীকেই স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে পিতৃগৃহে ফিরে আসতে হয়। কখনো কখনো তালাকের ঘটনাও ঘটে থাকে। আবার অনেকে অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে’র তথ্য মতে, ২০১৮ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১০২ জন নারীকে।[8] পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুকের বিষয় তুলে ধরে ‘আসকের’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৪০ জন নারী। যার মধ্যে মারা যান ৩৭২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। অন্যদিকে ২০২১ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিল মোট ২১০ জন নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৩ জন নারী।[9] উল্লেখ্য যে, এ রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত চিত্র। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ।

(৭) উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন :

উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টনকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ পারিবারিক অপরাধের আরেকটি বড় কারণ। একে কেন্দ্র করে ভাই-ভাই, ভাই-বোন কিংবা চাচা-ভাতিজা অথবা পরিবারের অন্যদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। যা পর্যায়ক্রমে মারামারি থেকে খুন-খারাবী পর্যন্ত গড়ায়। এ দেশের আদালতগুলোতে যত মামলা রয়েছে তার একটা বৃহদাংশই হ’ল জমি-জমা সংক্রান্ত। এসব মামলার কারণে ঝগড়া-বিবাদ, সম্পর্কচ্ছেদ, অর্থের অপচয় এমনকি পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক সময় এটা বংশানুক্রমিক চলতে থাকে।

(৮) মানসিক বিষণ্ণতা :

মানসিক বিষণ্ণতা পারিবারিক জীবনে অনেক সময় দুর্ভোগ নিয়ে আসে। ব্যক্তির মানসিক বিষণ্ণতা তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডকে শুধু ব্যাহতই করে না, বরং তা তাকে অনেক ক্ষেত্রে হিংস্র করে তোলে। তাই মানসিক বিষণ্ণতাকে বিশেষজ্ঞগণ অপরাধের কারণ গণ্য করেন।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ৫ থেকে ১৭ শতাংশ মানুষ বিষণণতায় ভুগছে। ১৭টি রাষ্ট্রে পরিচালিত ওয়াল্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ২০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে ১জনের বিষণ্ণতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়ষ্কদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ আর শিশুদের মধ্যে ১ শতাংশের বিষণ্ণতা রয়েছে বলে জাতীয় জরিপে পাওয়া গেছে। সে হিসাবে দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিদিন তিন হাযার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে অধিকাংশই ঘটে বিষণ্ণতার কারণে।[10]

(৯) তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার :

তথ্য প্রযুক্তির[11] সঠিক ব্যবহারে জাতি যেমন সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধন করতে পারে, তেমনি তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি জাতির ধ্বংসের কারণও হ’তে পারে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে একদল অসাধু লোক বিভিন্ন পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছে। এর প্রভাবে অনেক তরুণ-তরুণী এবং যুবক-যুবতী পথভ্রষ্ট হচ্ছে।

২০২০ সালে DSP সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যান হ’তে জানা যায়, ১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের ৭%, ১৯ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষ-নারীদের ৩৪%, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষ-নারীদের ৩৬%, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষের ২০% এবং ৫৫ থেকে অধিক বয়সী নারী-পুরুষের ৩% তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে।[12] অপর এক পরিসংখানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করছে শুধু তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের শিকার হয়ে।

(১০) মাদকাসক্তি :

বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে নেশা করার প্রবণতাই মাদকাসক্তি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মাদকদ্রব্য তা-ই যা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে’।[13] বর্তমানে বহু ধরনের মাদক রয়েছে। যেমন- হিরোইন, মদ, গাজা, ভাং, মরফিন, আফিম, মারিজুয়ানা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, কোকেন, হাশিশ বা চরস, বিয়ার, তাড়ি, ক্যানাবিস, এল.এস.ডি.আইচ পিল, ভায়াগ্রা, বাংলা মদ, ব্রান্ডি ইত্যাদি। নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। মাদকের অপব্যবহারে ব্যক্তিতো বটেই, পুরো পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যত। মাদকাসক্ত ছেলে-মেয়েরা পিতামাতা সহ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সাথে প্রায়শই দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত থাকে। এরা চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের সাথেও জড়িত থাকে।

(১১) বিচারহীনতা :

বিচারহীনতা পারিবারিক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। বিচারহীনতা আজ জেঁকে বসেছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাই সরকারী ছত্রছায়ায় অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে যায়। বিচারের কণ্ঠরোধ করা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া এবং অবিচারকে লালন করা। আমাদের দেশে আইন আছে; কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ খুবই কম। আবার অনেক সময় বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নেয় না। আর বিচার না হওয়া এবং বিচার কার্যে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা উৎসাহিত ও সাহসী হয়ে উঠে। যা তাদেরকে পরবর্তীতে আরো অপরাধ করতে উৎসাহিত করে।

(১২) ধর্মীয় অনুশাসন না মানা :

ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে ব্যক্তির নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা রোধ করা সম্ভব। ধর্ম মানুষকে নিয়ন্ত্রিত জীবন, মানবিক মূল্যবোধ ও সুন্দর আচরণ করতে শিক্ষা দেয়। ধর্ম মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বিকশিত করে তাকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। ধর্মীয় অনুশাসন পালনকারী ব্যক্তি কখনও অপরাধে জড়িত থাকতে পারে না। কাজেই এসব অপরাধ থেকে জাতিকে মুক্ত রাখতে হ’লে সর্বক্ষেত্রেই নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরী করতে হবে।

[ক্রমশঃ]

মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন

* প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, খাসেরচর মাহমূদিয়া সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসা, ধল্লাবাজার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ।

[1]. ড. মুহাম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০০২), পৃ. ৭২৬।

[2]. ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী ও অন্যান্য, সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ (ঢাকা : অনন্যা, ২০০৯ খ্রি.), পৃ. ১১৬।

[3]. ড. মুহাম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ .৪০।

[4]. মো: আতিকুর রহমান, উচ্চ মাধ্যমিক সমাজকল্যাণ, ২/৮৯।

[5]. ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫।

[6]. মো: আতিকুর রহমান, উচ্চ মাধ্যমিক সমাজকল্যাণ, ২/৮৯।

[7]. www.amarsangbad.com, ৪ঠা জানুয়ারী ২০২০

[8]. www.bbc.com>news-49848088, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯।

[9]. www.dhakatimes24.com. (ই-পেপার, নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১)।

[10]. www.prothomalo.com, ৭ এপ্রিল, ২০১৭।

[11]. কম্পিউটার ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ, একত্রীকরণ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিনিময় ও পরিবেশনের ব্যবস্থাকে তথ্য-প্রযুক্তি বা ইনফরমেশন টেকনোলজি (IT) বলে।

[12]. www.blogacademy.tech, ‘তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারে বর্তমান অবস্থা’ ৯ নভেম্বর, ২০২১।

[13]. বুখারী হা/৫৫৮১, ৫৫৮৮; মুসলিম হা/৩০৩২; মিশকাত হা/৩৬৩৫।






ইসলামে শ্রমিকের অধিকার : প্রেক্ষিত মে দিবস - শেখ আব্দুছ ছামাদ
আদর্শ সমাজ গঠনে সালামের ভূমিকা - মুহাম্মাদ মাইনুল ইসলাম
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (চতুর্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কি চায়, কেন চায় ও কিভাবে চায়? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইস্রাঈলীদের মন্দ পরিণতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ঈদায়নের কতিপয় মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (২য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
চিন্তার ইবাদত (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৫ম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.