ভূমিকা :
ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা মাসিক ‘আত-তাহরীক’ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর একমাত্র মুখপত্র। শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ সদৃশ এ পত্রিকার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। এটি বিজাতীয় ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, ইসলামী সাহিত্যিক সৃষ্টির চূড়ান্ত ঠিকানা, মুসলিম মিল্লাতের অখন্ডতা রক্ষায় প্রয়াসী, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক কিংবা ধর্মীয় ক্ষেত্রে যাবতীয় ষড়যন্ত্রের বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সোচ্চার, যুগ-জিজ্ঞাসার দলীল ভিত্তিক জবাবদানে সিদ্ধহস্ত। যার ব্যাঘ্র হুংকারে পর্যুদস্থ হয় বাতিলের প্রাসাদ। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হরতাল, ধর্মঘট, খুন-রাহাজানি, ভাংচুর-লুটপাট, গুম-হত্যা-ধর্ষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আদর্শিক স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত এক আপোষহীন পত্রিকার নাম ‘আত-তাহরীক’। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও মস্তিষ্ক প্রসূত যাবতীয় ভ্রান্ত মতবাদের যুক্তি খন্ডনে এবং চিরতরে উৎখাত ও স্তব্ধ করতে বদ্ধপরিকর। এজন্যই মাসিক ‘আত-তাহরীক’ ঐ সমস্ত হক্বপিয়াসী নিরপেক্ষ মানবতার মুখপত্র, যারা নিজের চিন্তা-চেতনা ও বুদ্ধিমত্তার উপরে কেবলমাত্র অহি-র জ্ঞানকে বিনা শর্তে গ্রহণ করে, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত প্রত্যেকটি নির্দেশকে সানন্দে মাথা পেতে নেয়, সর্বক্ষেত্রে আখেরাতকে দুনিয়ার উপরে প্রাধান্য দেয়। মূলতঃ আধুনিক জাহিলিয়াতের গাঢ় তমিস্রায় নিমজ্জিত মুসলিম মানবতাকে জাগ্রত করার প্রত্যয়েই ‘আত-তাহরীক’-এর আত্মপ্রকাশ ও অগ্রযাত্রা। সমাজ সংস্কারে নিবেদিত এ পত্রিকাটি দেশের আইন-শৃংখলা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং সকল প্রকার নেতিবাচক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নিম্নে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ‘আত-তাহরীক’-এর ভূমিকা উপস্থাপন করা হ’ল।-
জঙ্গীবাদের উত্থান ও কিকাশ :
‘জঙ্গীবাদ’ শব্দটি মূলত আধুনিক বিশ্বের তথাকথিত পরাশক্তি ও বিশ্বমোড়ল বলে খ্যাত এবং ইসলাম ও মুসলমানের চিরন্তন শত্রু ইহুদী-খ্রিষ্টান সাম্রাজ্য কর্তৃক চালুকৃত একটি নব্য পরিভাষা। এর দ্বারা তারা শুধুমাত্র মুসলমানদেরকেই বুঝিয়ে থাকে। যদিও উক্ত পরিভাষাটি প্রাচীন ‘চরমপন্থা’র সাথে ব্যবহারগত ও কর্মগতভাবে পুরোপুরি সম্পৃক্ত। আর চরমপন্থা হ’ল কোন বিষয়ে সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বন করা। উগ্রতা প্রদর্শন পূর্বক মধ্যম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতিকে চরমত্বে আসীন করানোই চরমপন্থা।
পৃথিবীতে ধর্মকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম চরমপন্থা বা জঙ্গীবাদের উত্থান হয়। অপরিপক্ক, জ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী একশ্রেণীর অতি প্রবৃত্তিপুজারী নির্বোধ লোকের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। ইসলামের ইতিহাস যাদেরকে ‘খারেজী’ নামে আখ্যায়িত করেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিকে চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যেমন ছিলেন সোচ্চার, অনুরূপভাবে তিনি তাদের সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে তিনি বলেন,
يَأْتِى فِى آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ حُدَثَاءُ الأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الأَحْلاَمِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ يَمْرُقُونَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ لاَ يُجَاوِزُ إِيْمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ قَتْلَهُمْ أَجْرٌ لِمَنْ قَتَلَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
‘শেষ যামানায় একদল তরুণ বয়সী নির্বোধ লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা সর্বোত্তম কথা বলবে। তারা ইসলাম থেকে এত দ্রুত গতিতে বের হয়ে যাবে, যেমন তীর ধনুক থেকে বের হয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে সেখানেই হত্যা করবে। কারণ যে তাদেরকে হত্যা করবে তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট নেকী রয়েছে’।[1] অন্য বর্ণনায় আছে, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা তাদের ছালাতের তুলনায় তোমাদের ছালাতকে তুচ্ছ মনে করবে, তাদের ছিয়ামের তুলনায় তোমাদের ছিয়ামকে এবং তাদের আমলের তুলনায় তোমাদের আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে...। তারা মুসলমানদেরকে হত্যা করবে এবং মূর্তিপূজকদের ছেড়ে দিবে...’। [2]
চরমপন্থার বহিঃপ্রকাশ চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে হ’লেও মূলতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে তাঁর জীবদ্দশাতেই মানবতার এই সর্বগ্রাসী হিংস্রতা প্রকাশ পেয়েছিল। আলী (রাঃ) কর্তৃক ইয়ামন থেকে প্রেরিত গণীমতের মাল যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বণ্টন করছিলেন, তখন চরমপন্থীদের তৎকালীন ও প্রাথমিক নেতা বনু তামীম গোত্রের যুল-খুওয়াইছির নামক জনৈক ব্যক্তি বণ্টনে সন্দিহান হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেছিল, يَا مُحَمَّدُ اتَّقِ اللهَ ‘হে মুহাম্মাদ! (বণ্টনের ব্যাপারে) আল্লাহকে ভয় কর। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, فَمَنْ يُطِيْعُ اللهَ إِذَا عَصَيْتُهُ ‘আমিই যদি আল্লাহর অবাধ্যতা করি, তবে কে তাঁর অনুসরণ করবে?’[3]
যুগের বিবর্তনে চরমপন্থার ক্রমবিকাশ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। পরবর্তীতে ওছমান (রাঃ)-কে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা, আলী ও মু‘আবিয়ার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও পরিশেষে আলীর নির্মম হত্যা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অতঃপর তা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে প্রকাশ লাভ করে।
জঙ্গীবাদ : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটে মূলতঃ ১৯৮৯ সালে। সে সময়ে ‘হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী’ বা হুজি নামে এদেশে প্রথম জঙ্গী গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর ১৯৯৮ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘জামা‘আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ বা জেএমবি নামে আরেকটি জঙ্গী সংগঠন। যার প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান। অতঃপর ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ বা জেএমজেবি নামক উত্তরবঙ্গে আরেকটি জঙ্গী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে। এর প্রধান ছিলেন ছিদ্দীকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই। এছাড়া পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী, সর্বহারা প্রভৃতি নামে প্রায় ডজন খানেক জঙ্গী গ্রুপের আবির্ভাব হয়।
১৯৯৯ সালে জেএমবি সর্বপ্রথম কুষ্টিয়ার বড়কান্দি গ্রামে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এর কিছু দিন পর যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক শক্তিশালী বোমা হামলা চালায়। এতে সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীসহ ১০ জন নিহত হয় এবং আহত হয় অর্ধশতাধিক। অতঃপর তারা ২০০১ সালে রমনার বটমূলে, গোপালগঞ্জের এক ক্যাথলিক গীর্জায়, ২০০২ সালে পল্টন ময়দানে কমিউনিষ্ট পার্টির জনসভায়, ময়মনসিংহের ৪টি সিনেমা হ’লে, টঙ্গীর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনে, একই বছরের ২১ আগষ্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলা চালায়। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। এসব হামলায় বহু নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ধ্বংস্তূপে পরিণত হয় দেশের মূল্যবান স্থাপনা সমূহ। কিন্তু সরকারীভাবে এদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা আরো বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে ২০০৫ সালে ১৭ আগষ্টে নারায়ণগঞ্জ ব্যতীত দেশের ৬৩টি যেলার প্রায় ৫ শতাধিক স্থানে একযোগে বোমা হামলা করে। ত্রাসের রাজ্য কায়েম করে সাধারণ জনগণকে এক ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত করে। তারা দ্বীন ক্বায়েমের ধুয়া তুলে জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে জনসাধারণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার নীল-নক্সা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়।
সরকার তাদের দমন করার চেষ্টা করলেও তাদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। এমনকি ২০০৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে ঝালকাঠি, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গনে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে বিচারকসহ বহু নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। অতঃপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একদিকে যেমন ক্ষুণ্ণ হয় দেশের ভাবমূর্তি, বিনষ্ট হয় দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা; অন্যদিকে বিপাকে পড়ে যায় দেশের হক্বপন্থী মুসলিম জনসাধারণ। ‘উদোর পিন্ডী বুদোর ঘাড়ে’ চাঁপানোর মত সমস্ত দোষ চাপানো হয় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর ঘাড়ে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় শীর্ষ চার নেতাকে গ্রেফতার করে তাঁদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মিথ্যা মামলা। দীর্ঘদিন কারাভোগ করে তাঁরা জামিনে মুক্তি লাভ করেন। ফালিল্লাহিল হামদ্।
ইসলাম বনাম জঙ্গীবাদ :
জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামের দূরতম কোন সর্ম্পক নেই। এ সম্পর্কে আললাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা পরোপকার কর যেমন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে সন্ত্রাস করতে যেও না। আলাহ শান্তি ভঙ্গকারীকে (সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীকে) ভালবাসেন না’ (ক্বাছাছ ৭৭)। তিনি আরো বলেন, وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ- ‘ফিৎনা (সন্ত্রাস) নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ’ (বাক্বারাহ ২১৭)। তিনি আরও বলেন, وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ. ‘ফিৎনা (সন্ত্রাস) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর’ (বাক্বারাহ ১৯১)। মহান আল্লাহর বাণী হচ্ছে, وَلاَ تُفْسِدُوْا فِى الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلاَحِهَا ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় ঘটাবে না’ (আ‘রাফ ৫৬)। মোদ্দাকথা জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামের কোনরূপ সম্পর্ক নেই। অনুরূপভাবে কোন প্রকৃত মুসলমানও জঙ্গী হ’তে পারে না।[4]
জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে আত-তাহরীক-এর ভূমিকা :
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জঙ্গীবাদ যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তখনই তাদের স্বরূপ-প্রকৃতি, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, আক্বীদা-বিশ্বাস ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা এবং এর বিষময় পরিণতি সম্পর্কে তত্ত্ব ও তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপন করে সর্বপ্রথম তার বিরোধিতা করে মাসিক ‘আত-তাহরীক’। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ‘আত-তাহরীক’ যে ভূমিকা পালন করেছে নিম্নে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
১. সম্পাদকীয় :
‘সম্পাদকীয়’ একটি পত্রিকার হৃদপিন্ড সদৃশ। সম্পাদকীয় পাঠের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায় পত্রিকার নীতি-আদর্শ ও তার মান, অবস্থান। আত-তাহরীকের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধকল্পে ‘আত-তাহরীক’-এর সম্পাদকীয় বিভাগ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ‘প্রকৃত জিহাদই কাম্য’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে জঙ্গীবাদের অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘...তবে বর্তমান অবস্থায় এগুলি জিহাদের নামে সন্ত্রাস ব্যতীত কিছুই নয়। এ সবের সাথে প্রকৃত জিহাদের কোনই সম্পর্ক নেই। মুমিন হিসাবে আমাদের নিকটে প্রকৃত জিহাদই কাম্য’। তার পূর্বে আহলেহাদীছ মাদরাসাগুলোকে জঙ্গীবাদী বলে প্রচারের বিরুদ্ধে ‘আত-তাহরীক’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দেয় যে, ‘যদি আহলেহাদীছ মাদরাসাগুলোকে এভাবে ঢালাওভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের শ্রদ্বেয় আলেমদের সম্পর্কে এ ধরনের ভিত্তিহীন ও নোংরা মন্তব্য করা হয়, তাহ’লে এদেশের দু’কোটি আহলেহাদীছের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হবে, যা এক সময় জাতীয় ক্ষোভে পরিণত হবে’।[5] ‘আবারো বোমা বিস্ফোরণঃ কথিত জাদীদ আল-কায়েদার দায়িত্ব স্বীকার’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে আরো সুস্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে, ‘ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। কোনরূপ চরমপন্থাকে ইসলাম সমর্থন করে না। বোমা মেরে সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া ইসলামী পদ্ধতি নয়। আমাদের নবীকে আল্লাহপাক সশস্ত্র ‘দারোগা’ রূপে প্রেরণ করেননি’।...‘প্রচলিত জঙ্গীবাদ কখনো জিহাদ নয়’। এতে আরো বলা হয়েছে, ‘সুতরাং আজকেও যারা জিহাদের নামে প্রচলিত জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্ত, যারা বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে, আত্মঘাতী বোমার মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস করে তারা দেশ, জাতি, ইসলাম ও মানবতার শত্রু’।[6] এভাবে বিভিন্ন সময়ে ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ’, ‘জঙ্গীবাদ সম্পর্কে বাবরের স্বীকারোক্তি: প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’, ‘ধর্মের নামে বোমা হামলার নেপথ্যে’, ‘সুইসাইড বোমা হামলা: অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রের বিস্তার আর কতদূর’, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ করুন!’, ‘আহলেহাদীছের বিরুদ্ধে বিষোদগার’, ‘সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হৌক’, ‘আদর্শ চির অম্লান’, ‘রাজনৈতিক আদর্শ’ প্রভৃতি শিরোনামে লিখিত সম্পাদকীয়তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জঙ্গীবাদ বা চরমপন্থার তীব্র বিরোধিতা করে তা দমনের পথ বাৎলে দেয়া হয়েছে।
২. দরসে কুরআন :
‘দরসে কুরআন’ আত-তাহরীক-এর একটি নিয়মিত বিভাগ। যেখানে মুসলিম জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হয়। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ‘দরসে কুরআন’ কলামেও দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য রয়েছে। যেমন- ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ নামক এক দরসে কুরআনে প্রকৃত জিহাদের স্বরূপ ও প্রকৃতি এবং জিহাদের নামে প্রতারণা করে সশস্ত্র যুদ্ধ ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দ্বীন ক্বায়েমের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘কবীরা গোনাহগার মুসলমনাদের খতম করে সমাজকে নির্ভেজাল করার জঙ্গীবাদী তৎপরতা কোন জিহাদ নয়, ক্বিতালও নয়’।[7]
অতঃপর ‘দ্বীন ক্বায়েমের সঠিক পদ্ধতি’ শীর্ষক দরসে আরো সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘জানা আবশ্যক যে, আমাদের নবীকে আল্লাহ পাক সশস্ত্র ‘দারোগা’ রূপে প্রেরণ করেননি। বরং তিনি এসেছিলেন জগদ্বাসীর জন্য ‘রহমত’ হিসাবে। তাই ‘জিহাদ’-এর অপব্যাখ্যা করে শান্ত একটি দেশে বুলেটের মাধ্যমে রক্তগঙ্গা বইয়ে রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন দেখানো জিহাদের নামে স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। অনুরূপভাবে দ্বীন ক্বায়েমের জন্য জিহাদের প্রস্ত্ততির ধোঁকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে কোন নিরাপদ পরিবেশে অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ সরলমনা তরুণদেরকে ইসলামের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে আটকিয়ে ধ্বংস করার চক্রান্ত মাত্র’।... ‘দেশের ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হৌক বা নিরস্ত্র হৌক যেকোন ধরনের অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ ইসলামে নিষিদ্ধ। বরং সরকারের জনকল্যাণমূলক যেকোন ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ মেনে চলতে যেকোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য’।[8] এতে আরো বলা হয়েছে যে, ‘...সাম্প্রতিককালে জিহাদের ধোঁকা দিয়ে বহু তরুণকে বোমাবাজিতে নামানো হচ্ছে। অতএব হে জাতি! সাবধান হও’![9]
সুতরাং জঙ্গীবাদ বা চরমপন্থা মোকাবিলায় ‘আত-তাহরীক’-এর অবস্থান কতটা স্বচ্ছ ও সুদৃঢ় সেটা উপরোক্ত বক্তব্যে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে।
৩. প্রবন্ধ-নিবন্ধ :
সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণালব্ধ বিশুদ্ধ তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর সুচিন্তিত অভিমতই ‘প্রবন্ধ’। যা বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামীতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘আত-তাহরীকে’ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জোরালো ও সাহসিকতার সাথে দৃপ্তকন্ঠে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ‘ইসলাম ও মুসলমানদের চিরন্তন শত্রু চরমপন্থীদের থেকে সাবধান!’ নামক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘জঙ্গী তৎপরতা হ’ল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। জিহাদের নামে বা ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন বিধান ইসলাম ও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর বিশ্ববিজয়ী মৌলিক আদর্শের উপর কালিমা লেপনের অতি সূক্ষ্ম চক্রান্ত। এ তো ইসলাম প্রতিষ্ঠার দাবীতে কথিত জিহাদের নামে আকস্মিক বোমাবাজি করে মানুষের প্রাণ হরণ করা, ত্রাসের রাজ্য কায়েম করা, বুলেটের আঘাতে পাখির মত মানুষ হত্যা করা। এটা স্রেফ গোপনে মানুষ হত্যার গোপন কৌশল। ইসলাম ও ইসলামের কোন নবী এই শিক্ষা দেননি। অতএব জঙ্গী তৎপরতার সাথে (ইসলাম ও) জিহাদের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই, বরং প্রশ্নই আসে না’।[10]
জনগণকে সন্ত্রস্ত করা ও ত্রাস করে পরিবেশকে অস্থিতিশীল করা ও ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত। যেমন ‘সন্ত্রাস ও ইসলাম : সংবাদপত্রের ভূমিকা’ নামক নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ‘..সভ্য, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে জিহাদ ও ক্বিতালের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই’।[11] এমনি করে ‘কে সন্ত্রাসী?’, ‘আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতার : সরকারের অদূরদর্শিতা ও জনগণের ধিক্কার’, ‘মিডিয়া সন্ত্রাস ও আমাদের করণীয়’, ‘মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও সরকারের দায়িত্বহীনতা : হয়রানী ও লাঞ্ছনার শিকার আলেম সমাজ’, ‘অতিক্রান্ত তিনটি বছর: আমীরে জামা‘আত আজও কেন কারাবন্দী?’, ‘মুসলিম ব্যক্তিকে কাফির বলার শর্তাবলী ও খারেজী মতবাদ’, ‘জঙ্গীবাদের কবলে আহলেহাদীছ জামা‘আত’ প্রভৃতি প্রবন্ধ-নিবন্ধে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যে আপোষহীন বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে তা জঙ্গীবাদ উৎখাতে যেমন পত্রিকার সুদৃঢ় অবস্থান সুস্পষ্ট করে, তেমনি শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ সহায়কের ভূমিকা পালন করে।
৪. সংগঠন বিষয়ক রিপোর্ট পরিবেশন :
মাসিক আত-তাহরীক ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুখপত্র। এ সংগঠনের সার্বিক কর্মতৎপরতার রিপোর্ট ‘সংগঠন সংবাদ’ শিরোনামে জাতির সামনে পেশ করা হয়। এতেও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য সমূহ তুলে ধরা হয়। যেমন- ২০০৫ সালের ১৭ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় প্রতিনিধি ও সুধী সমাবেশ’-এ বক্তাগণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জঙ্গীবাদের চরম বিরোধিতা করে বলেন, ‘সমাজ চরিত্র বিধ্বংসকারী সিনেমা হল আর ঐ সূদখোর এনজিও অফিসগুলোতে বোমা হামলা ও মানুষ হত্যার নাম জিহাদ নয়। এটা মুসলিম সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী ঘাতকদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা এবং তাদেরকে এদেশ দখলের সুযোগ করে দেওয়া মাত্র। এর সাথে আহলেহাদীছদের আক্বীদা ও আমলের কোন সম্পর্ক নেই’।[12] ২০০৫ সালের ১৩ ও ১৪ অক্টোবর রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ‘বার্ষিক কর্মী ও কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য সম্মেলন’-এ বলা হয় যে, ‘বোমা মেরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আদর্শে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা ইসলামের শান্তিপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক আদর্শে বিশ্বাসী। যারা দেশব্যাপী বোমা হামলা করে বিশৃঙ্খল ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার রঙ্গিন স্বপ্ন দেখে এরা নিঃসন্দেহে দেশ, জাতি, ইসলাম ও মানবতার শত্রু’।[13] অতঃপর ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭-২০ মিনিটে ‘বিটিভি’-তে প্রচারিত এক বিশেষ টকশোর উদ্ধৃতি দিয়ে ‘আত-তাহরীক’ আরো ঘোষণা করে যে, ‘ইসলাম শান্তিপূর্ণ আদর্শের নাম। এখানে জোর-জবরদস্থির কোন সুযোগ নেই। জঙ্গীবাদকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না’।[14] সেখানে আরো বলা হয়েছে যে, ‘জিহাদ ও জঙ্গীবাদ কখনো এক নয়। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তারা কোনভাবেই জিহাদ করে না। যারা নিরীহ মানুষ হত্যা করে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, বোমাবাজি করে তারা কখনো ইসলামের বন্ধু নয়...’।[15] এমনিভাবে ‘মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় চার নেতার মুক্তির দাবীতে এবং দেশব্যাপী বোমা হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ’ এবং বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক সম্মেলন, আঞ্চলিক সম্মেলন, মানববন্ধন প্রভৃতি সাংগঠনিক তৎপরার রিপোর্ট পরিবেশনের মাধ্যমে ‘আত-তাহরীক’ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সৃষ্টি করে।
৫. পাঠকের মতামত :
প্রত্যেক পত্রিকায় বিজ্ঞ পাঠকদের মত প্রকাশের সুযোগ থাকে। আত-তাহরীকেও ‘পাঠকের মতামত’ নামক বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগের মাধ্যমেও ‘আত-তাহরীক’ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তুলে ধরে। যেমন ‘অপরাধীরা ধরাছোয়ার বাইরে’ নামক এক লেখায় বলা হয়েছে যে, ‘ইসলাম সন্ত্রাসকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামে জঙ্গীবাদ সন্দেহাতীতভাবে নিষিদ্ধ’।[16] অনুরূপভাবে ‘প্রকৃত সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করুন’, ‘সাবধান!’, ‘ড. গালিবকে নিয়ে মঞ্চায়িত নাটকের অবসান করুন: দেশের মানুষ এত বোকা নয়’, ‘সকল চক্রান্ত নস্যাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ’, ‘প্রতিবারই নতুন বেশ: এভাবেই কি চলবে দেশ?’ প্রভৃতি শিরোনামে বিভিন্ন পাঠকের উম্মুক্ত মতামত প্রকাশের মাধ্যমে ‘আত-তাহরীক’ জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করেছে।[17]
৬. কবিতা :
কাব্যিক ছন্দে হৃদয়ের ভাব প্রকাশের নাম ‘কবিতা’। এটি মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর এক নিয়মিত বিভাগ। এর মাধ্যমেও ‘আত-তাহরীক’-এর নীতি-আদর্শ প্রস্ফুটিত হয়। কারণ সে পাঠকের হৃদয় কুটিরে ঝংকার তোলে। আন্দোলিত করে পাঠক সমাজের হৃদয়তন্ত্রী। তাই জঙ্গীবাদের বিরোধিতা করতেও সে কছূর করেনি। যেমন- ‘আত-তাহরীক’ নামক এক কবিতায় জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে,
ধর্মের ধ্বজাধারীরা আজ বড় ত্রস্ত
তোমারই দিকে তুলে ধরে খড়গহস্ত
নও তুমি জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক
মূল ইসলামের একমাত্র ধারক
সহসা যাবে না হারিয়ে কালের স্রোতে
যুগ যুগ ধরে ওদের জবাব দিবে।[18]
এভাবে ‘আমরা আহলেহাদীছ’ নামে একটি কবিতায় বলা হয়েছে,
আমরা পরাধীন রাষ্ট্র স্বাধীন করেছি
ইংরেজ করেছি দূর,
আমাদের তাই আজ দাও সন্ত্রাসী অপবাদ
তোল জঙ্গীবাদী নব সুর।
আমরা কোন সন্ত্রাসী নই
নই জঙ্গীবাদী চরমপন্থী
মোরা স্বাধীনতার অগ্রদূত
যুগে যুগে মোরা এনে দিয়েছি এই বাংলায়
স্বাধীনতার চির সুখ।[19]
এমনি করে ‘সন্ত্রাসী প্রেতাত্মার নগ্ন অবয়ব’, ‘জোট সরকার জবাব চাই’, ‘হক্বের উত্থান’, ‘অবৈধ কারা’, ‘বোমা হামলা’, ‘সন্ত্রাস’, ‘ভয় নেই ড. গালিব’ প্রভৃতি কবিতার মাধ্যমে মাসিক ‘আত-তাহরীক’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জঙ্গীবাদের প্রতিবাদ করেছে।
৭. ফৎওয়া বা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে :
যুগ-জিজ্ঞাসার দলীল ভিত্তিক জবাবদানে আপোষহীন সাহসী কণ্ঠস্বর হ’ল মাসিক ‘আত-তাহরীক’। এর প্রশ্নোত্তর পর্বটি এক অন্যন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এর মাধ্যমে হক্ব পিয়াসী মানুষেরা বিশুদ্ধ ও দলীল ভিত্তিক ফৎওয়া পেয়ে আক্বীদা-আমল সংশোধন করে নিজেদের জীবন গঠনে সচেষ্ট হ’তে পারে। সুযোগ পায় শান্তিপূর্ণভাবে ও নিবিষ্টমনে ইসলামী জীবন-যাপন করার। আর এ বিভাগটির মাধ্যমেও আত-তাহরীক জঙ্গীবাদ দমনে অবদান রাখছে। যেমন ২০০০ সালের আগষ্ট মাসের এক প্রশ্নোত্তরে (২৪/৩২৪) বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে মৌখিক ও আন্তরিক কালেমা পাঠকারী জনগণ ও নেতাদের বিরুদ্ধে কোন সশস্ত্র যুদ্ধ করা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয হবে না।’... কোনরূপ জঙ্গী দলের সাথে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কোন স্তরের নেতা বা কর্মীর যোগদান করা বৈধ হবে না’।[20]
জিহাদ আন্দোলন এবং বাংলাদেশে নামে-বেনামে চরমপন্থী জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে (৩৭/১৯৭) বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশে ইসলামের নামে কথিত চরমপন্থী আন্দোলন সমূহ পরিচালিত হচ্ছে দেশীয় মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে কবীরা গোনাহ। এরা বিগত যুগের খারেজী চরমপন্থীদের অনুসারী। এদের থেকে বিরত থাকার জন্য রাসূলের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে’।[21] অতঃপর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ৪০/২০০ নং প্রশ্নোত্তরে আরো পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যে, বস্ত্ততঃ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ব্যতীত অন্য কারু প্রতি অস্ত্র ধারণ ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনাদর্শই বাস্তব প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট। অতএব জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ না করেই যারা চটকদার কথা বলে জিহাদের নামে জঙ্গীবাদকে উসকে দিচ্ছে, তারা ইসলামের বন্ধু তো নয়ই, বরং ইসলামের শত্রু এবং খারেজী চরমপন্থীদের দলভুক্ত। যাদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বহুপূর্বেই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে গিয়েছেন’।[22]
রূঢ় বাস্তবতা :
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! যে পত্রিকা জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ সহ যাবতীয় নাশকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং যা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে সেই পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর মাননীয় সভাপতি, দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে জঙ্গীবাদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর পাঠক নন্দিত পত্রিকা ‘আত-তাহরীক’-কে চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার নীল-নকশা অাঁকা হয়। যেলা প্রশাসক বরাবরে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করে আত-তাহরীক বন্ধের চূড়ান্তষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু তা ধোপে টেকেনি। অতঃপর শুরু হয় ‘আত-তাহরীক’-কে আদর্শিকভাবে খতম করার অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র। কিন্তু ফায়ছালা হয় আসমান থেকে। সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ‘আত-তাহরীক’ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ অবধি স্বগৌরবে ও স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। বিচ্ছেদ ঘটেনি এর ধারাবাহিকতায়। সর্বদা তার আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে সমুন্নত থেকেছে এক দিপ্তীমান নক্ষত্রের ন্যায়। যার তেজোদীপ্ত আলোকময় জ্যোতির তীব্র ছটায় অন্যায় ও অসত্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে আলোকিত করেছে বিশ্ব ধরিত্রীকে। পদানত করেছে যাবতীয় চরমপন্থা ও জঙ্গীবাদের হিংস্রতাকে। আর এখানেই ‘আত-তাহরীকে’র স্বচ্ছতা এবং সম্মুখ পানে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
পরিশেষে বলব, হে মানুষ! বিশ্ব আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিভক্তির উৎকণ্ঠা, ধর্মীয় বাড়াবাড়ি, যান্ত্রিক সভ্যতা, আদর্শ ও চেতনাহীন কর্মতৎপরতার বাহুল্য এবং জঙ্গীবাদ ও চরমপন্থার রাহুগ্রাসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব মানবতা। কোথায়ও এতটুকু শান্তি নেই। নেই জীবন ও ধর্ম পালনের পূর্ণ নিশ্চয়তা। আছে শুধু উৎকণ্ঠা, ভয়-ভীতি আর নোংরা সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন আক্রমণ। তাই জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে একক তাওহীদী চেতনায় উদ্ভাসিত, আপোষহীন লেখনী সমৃদ্ধ, সত্য প্রকাশের অন্যতম পথিকৃত, বাতিলের বিরুদ্ধে আদর্শ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার উন্মেষ সাধন এবং শান্তি ও নিরাপত্তার আলোকবর্তিকা সদৃশ ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা মাসিক ‘আত-তাহরীক’ তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এসো হে বিশ্ব বিবেক! সত্যের পক্ষে জাগ্রত হও। মিথ্যাকে পদানত কর। হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকারকে অবদমিত কর। ন্যায় ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ন্যায়ানুগ পন্থায় জীবন বাজি রেখে সম্মুখ পানে অগ্রসর হও। তোমার সুচিন্তিত অভিমত জাতির সামনে পেশ কর। তোমার মাধ্যমেই আবির্ভাব ঘটবে মেঘমুক্ত আকাশে আলোকময় চন্দ্রের উজ্জ্বলতা। সংঘটিত হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রস্ফুটিত হবে ন্যায় ও সত্যে ভরপুর এক নতুন বিশ্বের। অতএব হে মানুষ! আদর্শ ও অস্থিত্ব রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হও। বিশ্ববাসীর নিকট এটিই ‘আত-তাহরীক’-এর চূড়ান্ত আহবান। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!
বযলুর রহমান
কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি ও এম.এ (শেষ বর্ষ), ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. বুখারী হা/৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩০; মুসলিম হা/২৫১১; আবূদাঊদ হা/৪৭৬৭; নাসাঈ হা/৪১০২; মিশকাত হা/৩৫৩৫।
[2]. বুখারী হা/৫০৫৮; মুসলিম হা/২৪৫৩ ও ২৪৪৮; মিশকাত হা/৫৮৯৪।
[3]. বুখারী হা/৭৪৩২; আবুদাঊদ হা/৪৭৬৪; নাসাঈ হা/৪১০১; মুসানাদে আহমাদ হা/১১৬৬৬; মিশকাত হা/৫৮৯৪।
[4]. বিস্তারিত দ্র. মাসিক আত-তাহরীক সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃঃ ১০।
[5]. মাসিক আত-তাহরীক, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১২তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০০৩-এর সম্পাদকীয় দ্রষ্টব্য।
[6]. মাসিক আত-তাহরীক, ১০ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, মে ২০০৭-এর সম্পাদকীয় দ্রষ্টব্য।
[7]. মাসিক আত-তাহরীক, ৫ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০১, পৃঃ ১৩।
[8]. মাসিক আত-তাহরীক, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০৩, পৃঃ ৮ ও ১১।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩।
[10]. মাসিক আত-তাহরীক, ৮ম বর্ষ, ১২তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃঃ ১০।
[11]. মাসিক আত-তাহরীক, ৮ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, এপ্রিল ২০০৫, পৃঃ২৫-২৬।
[12]. মাসিক আত-তাহরীক, ৮ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা, জুলাই ২০০৫, পৃঃ ৪৩-৪৪।
[13]. মাসিক আত-তাহরীক, ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর ২০০৫, পৃঃ ৪২, ৪৫, ঐ, ৪র্থ-৫ম সংখ্যা, জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ২০০৬, পৃঃ ৪২।
[14]. মাসিক আত-তাহরীক, ৯ম বর্ষ, ৪র্থ-৫ম সংখ্যা, জানুয়ারী- ফেব্রুয়ারী ২০০৬, পৃঃ ৪২।
[15]. ঐ, পৃঃ ৪৩-৪৭।
[16]. মাসিক আত-তাহরীক, ৯ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৫ পৃঃ ৪৬।
[17]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মাসিক আত-তাহরীক-এর ৮ম বর্ষের ২০০৫ সালের মে থেকে ১০ বর্ষের ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘পাঠকের মতামত’ বিভাগ।
[18]. মাসিক আত-তাহরীক, ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর ২০০৫, পৃঃ ৩৩।
[19]. মাসিক আত-তাহরীক, ৮ম র্বষ, ৯ম সংখ্যা, জুন ২০০৫, পৃঃ ৩৪।
[20]. মাসিক আত-তাহরীক, ৩য় বর্ষ, ১১তম সংখ্যা, আগষ্ট ২০০০, পৃঃ ৫৪-৫৫।
[21]. মাসিক আত-তাহরীক, ১২তম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৯, পৃঃ ৫৫; ঐ, ২য় বর্ষ, ১১তম সংখ্যা, আগষ্ট ১৯৯৯, পৃঃ ৫৫-৫৬।
[22]. মাসিক আত-তাহরীক, ১৬তম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০১৩, পৃঃ ৫৫-৫৬।
هتمل كس وجافا سكريبت هما العنصران العميلان لكل موقع ويب. تعلمهم ليصبحوا مطور ويب.