নদীর বুকে সারি সারি নৌকা। চারিদিকে চকচকে মুক্তার দানার মতো রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ইত্যাদি কার্প জাতীয় অর্থকরী মাছের ডিমের ছড়াছড়ি। চৌকস জেলেরা মা-মাছদের ছেড়ে দেয়া ভাসমান ডিম সংগ্রহের মহা ব্যস্ত। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সারাদেশের পুকুর, দীঘি, জলাশয়সহ মৎস্য খামারে চাষের জন্য রেণূ সংগ্রহে লিপ্ত। উৎপাদিত পোনা ও বড় মাছের মূল্য কয়েক হাযার কোটি টাকা। যার জোগানদার বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চট্টগ্রামের হালদা নদী, যা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী এবং এশিয়ার প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র।

দেশী-বিদেশী বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণ হালদাকে ‘জীন ব্যাংক’, ‘জাদুকরী মাছের ব্যাংক’, ‘মুক্তার খনি’, ‘অর্থনৈতিক নদী’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে এ নদীতে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদকে আল্লাহ তা‘আলার অপার নে‘মত মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এবছর এপ্রিলে মা-মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিগত দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে ২২ হাযার ৬৮০ কেজি ডিম এ মৌসুমে সংগৃহীত হয়েছে। যার বিক্রয়মূল্য কেজিপ্রতি ৭০ হাযার থেকে এক লাখ টাকা।

প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ সময় ও পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস মা-মাছ দলে দলে ডিম ছাড়ে। মা-মাছ সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। এ সময় প্রচন্ড বজ্রসহ বৃষ্টিপাত থাকতে হয়। বজ্রবর্ষণ স্থানীয়ভাবে ও নদীর উজানেও হ’তে হয়। এর ফলে নদীতে পাহাড়ী ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনার আকারে প্রবাহিত হয়। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই মা-মাছ ডিম ছাড়ে।

অনেকগুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানিতে প্রচুর পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়। এছাড়া এর বাঁকগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল পানির প্রচন্ড ঘূর্ণন ঘটে। ফলে পানিতে গভীর খাদ সৃষ্টি হয়। মা-মাছেরা এর ভেতরে এসে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে স্বাচ্ছন্দ্যে।

হালদার পাঁচটি সমস্যা :

হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ড. মনযূর বলেন, মিঠাপানির বড় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী শুধু বাংলাদেশের নয়; পৃথিবীর অনন্য ঐতিহ্য ও সম্পদ। হালদার সমস্যা সম্পর্কে তিনি জানান, এর প্রধান সমস্যা হ’ল নদীদূষণ, যা যেকোন মূল্যে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ হালদায় অবৈধ বালু উত্তোলন বিশেষ করে ড্রেজার দিয়ে নদীর তলদেশের মাটি খনন করে তোলা, যার কারণে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তৃতীয়তঃ হালদা নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যাহার করা হচ্ছে। উজানে স্থাপন করা হয়েছে ফটিকছড়ির ভূজপুরে রাবার ড্যাম। এছাড়া গতিপথের বিভিন্ন স্থানে ১৮টি স্লুইস গেইট ও ধুরং-এ স্থাপিত কংক্রিট ড্যাম। এভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে কোন পরিবর্তন ও প্রতিবন্ধক থাকতে দেয়া যাবে না।

চতুর্থতঃ হালদায় মা-মাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। পঞ্চমতঃ হালদার উৎসস্থল মানিকছড়িতে শত শত একর জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। কেননা তামাকের বর্জ্য হালদায় গিয়ে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ ও প্রজনন পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে।

তিনি বলেন, মিঠাপানির বড় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী সংরক্ষণ ও নিরাপদ করতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

[আমরা হালদা নদী সংরক্ষণের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানাচ্ছি (স.স.)]






আরও
আরও
.