বিশ্বে
যত আন্দোলন রয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং নির্ভেজাল আন্দোলন
হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসা এই আন্দোলন
বাতিলের ভ্রুকুঞ্চন, অত্যাচার-নির্যাতনকে মাড়িয়ে, বাঁধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে
ইসলামের ভিতর অনুপ্রবিষ্ট যাবতীয় শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ উৎখাতে
নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিগত শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে
একাধারে বৃটিশ বিরোধী জিহাদ ও আহলেহাদীছ আন্দোলনের সমাজ সংস্কারমূলক
আন্দোলনের অসংখ্য কেন্দ্র চালু ছিল। বিহারের দিলালপুর কেন্দ্র ছিল অনুরূপই
একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যার প্রভাব সুদূর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেও
পড়েছিল। আহলেহাদীছ আন্দোলনের উপমহাদেশীয় ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো পাঠ করলে
স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, কিভাবে এসকল কেন্দ্রের নিরলস সংস্কার প্রচেষ্টার
বদৌলতে এবং সর্বোপরি আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলার বুকে অসংখ্য মানুষের নিকট
হক্বের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, বাংলাদেশে
সাম্প্রতিককালে যেসকল দ্বীনদার ভাই-বোন হক্বের দাওয়াত গ্রহণ করছেন, তাদের
অনেকেই এই সংস্কার আন্দোলনের বেদনাদায়ক ইতিহাস সম্পর্কে বেখবর। ফলশ্রুতিতে
অবলীলাক্রমে তারা বলে ফেলেন, ‘আহলেহাদীছ আবার কি? আমরা তো সবাই মুসলিম’।
এদেশের বুকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের এত গুরুত্বপূর্ণ অথচ অনধীত অধ্যায়গুলো
সম্পর্কে নিদারুণ অজ্ঞতার কারণেই পূর্বপুরুষদের মহান আত্মত্যাগের মূল্যায়ন
করতে তারা সক্ষম হন না। নিম্নে উপমহাদেশের আহলেহাদীছ আন্দোলনের অতীত
ইতিহাসের কিছু পাঠ নিতে ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত দিলালপুর কেন্দ্র
সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
দিলালপুরের অবস্থান :
বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত ছাহেব পঞ্জি (দুমকা) যেলায় কোটাল পুকুর থানাধীন দিলালপুর মুজাহিদ কেন্দ্র ছিল পূর্বের রাজমহল পরগানার ভাগলপুর কমিশনারীর অন্তর্ভুক্ত। স্থানটি মূলতঃ একটি পাহাড়ী এলাকা। গঙ্গা নদীর এপারে (পূর্বে) পশ্চিম বঙ্গের মালদহ যেলা এবং ওপারে (পশ্চিম) রাজমহল সাঁওতাল পরগনা পরস্পরে মিশে আছে। সাঁওতাল পরগনারই একটি গ্রামের নাম ইসলামপুর। এখানেই হিজরত করেছিলেন রফী মোল্লার হাতে জিহাদের বায়‘আত গ্রহণকারী নারায়ণপুর কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদের ঝাউডাঙ্গা গ্রামের ইবরাহীম মন্ডল। হিজরতের এ ঘটনা সম্ভবতঃ ১৮৪০ হ’তে ১৮৫৩ সালে রফী মোল্লা গ্রেফতার হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে হবে।
দিলালপুর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট :
জিহাদের বায়‘আত গ্রহণকারী ইবরাহীম মন্ডল ইসলামপুরে এসে চুপ থাকতে পারেননি। তিনি পাহাড়ী অঞ্চলের লোকদেরকে জিহাদের উদ্দেশ্যে সংগঠিত করতে থাকেন। তাঁর নিরলস দাওয়াত ও জিহাদের তৎপরতার ফলে স্থানটি কালক্রমে মুজাহিদ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাছাড়া একদিকে প্রশস্ত নদী ও অপরদিকে পাহাড়ী অঞ্চল হওয়ার কারণে স্থানটি মুজাহিদগণের ট্রেনিং ও আশ্রয় কেন্দ্র হওয়ার উপযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে পাটনা কেন্দ্র থেকে প্রেরিত মাওলানা আহমাদুল্লাহ এখানে আসেন এবং ইবরাহীম মন্ডলজীর পরামর্শক্রমে দুই মাইল দক্ষিণে ‘দিলালপুর’ নামক স্থানটিকে কেন্দ্র হিসাবে বাছাই করেন ও সেখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার নীচে ভূগর্ভ কেন্দ্র যাকে ‘তেহখানা’ বলা হ’ত। সেখানে গোপন অস্ত্রাগার ছিল বলে জনশ্রুতি আছে।
মাদ্রাসাটি একই সাথে দ্বীনী ইলম ও জিহাদের ট্রেনিং কেন্দ্র হিসাবে পরিগণিত হয়। মাদ্রাসা পরিচালনা, জিহাদের ফান্ড সংগ্রহ এবং আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় ‘সরদার’ নিয়োগ করেন। যাদের সাধারণত ‘সরদারজী’ বলা হ’ত। ‘সরদার’কে আমীর-এর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করতে হ’ত। এইভাবে চারিদিকে সরদার নিয়োগের ফলে জিহাদের জন্য সর্বত্র লোক ও রসদ সংগ্রহ ব্যবস্থা সুষ্ঠতর ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুদূর রাজশাহীর দুয়ারী ও বগুড়ার সোনাবাড়ীতে মাদ্রাসা ও মারকায কায়েম হয়। সেখান থেকে লোক ও রসদ পত্র দিলালপুর কেন্দ্র হয়ে পাটনা দিয়ে সীমান্তের মূল ঘাটিতে চলে যেত। রাজশাহীর সরদহ ও চারঘাট এলাকার কিছু গ্রাম দিলালপুর কেন্দ্রের মুবাল্লিগদের মাধ্যমে আহলেহাদীছ হয় বলে জানা যায়। পাবনার চর এলাকার ‘কাবুলীপাড়া’ বলে খ্যাত মুজাহিদ আহলেহাদীছ জামা‘আতগুলি এবং কুলনিয়া, শালগাড়িয়া, শিবরামপুর প্রভৃতি এলাকার আহলেহাদীছ দুয়ারী হয়ে দিলালপুর কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন।
নারায়ণপুর কেন্দ্রের পরিচালক মৌলবী আমীরুদ্দীনের বিরুদ্ধে ‘মালদহ ষড়যন্ত্র মামলা ১৮৭০’এর পর পরই দিলালপুর কেন্দ্রের পরিচালক ইবরাহীম মন্ডলের বিরুদ্ধে ‘রাজমহল ষড়যন্ত্র মামলা ১৮৭০’ দায়ের করা হয়। ইবরাহীম মন্ডলের গ্রেফতারের কারণ সম্পর্কে যে কথা এলাকায় জনশ্রুতি আছে তাহ’ল অন্যূন ২৫ কিলোমিটার দূরের ‘পাকুড়’ গ্রামের বিদ‘আতীরা তাদের প্রেরিত একজন ছাত্রের মাধ্যমে দিলালপুরের গোপন তথ্য জানতে পারে এবং ইংরেজ সরকারের কাছে তা ফাঁস করে দেয়। যার পরিণতিতে মন্ডলজীকে গ্রেফতার বরণ করতে হয়। তিনি কালাপানিতে থাকা কালে দানু মন্ডল ভারপ্রাপ্ত ‘সরদারজী’ মনোনীত হন। ফিরে আসার পর ইবরাহীম মন্ডল পুনরায় ‘সরদারজী’ হন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র রহীম বখ্শ মন্ডল সরদারজী নিযুক্ত হন। সরদারীর প্রস্তাব জানতে পেরে তিনি বাড়ী থেকে ভয়ে পালিয়ে যান। দু’দিন পরে দু’মাইল দূরে যখন তাঁকে এক গুহার মধ্যে পাওয়া গেল, তখন তিনি সেখান থেকে পুনরায় পালিয়ে যান। পরে সোনাকৈড় গ্রামে আশ্রয় নিলে ভক্তরা ধরে এনে তাঁর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করে। এই সময় তিনি দায়িত্বের ভয়ে কেঁদে দাড়ি ভিজিয়ে ফেলেন। দিলালপুরের আমীরগণের মধ্যে রহীম বখ্শ মন্ডল ছিলেন সবচেয়ে কীর্তিমান ও দক্ষ সংগঠন।
রহীম বখ্শ মন্ডলের মৃত্যুর পর পুত্র মহিববুল হক, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র আলহাজ্জ মুঈনুল হক, তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র মাওলানা যামীরুল হক সালাফী এডভোকেট (ফারেগ, দারুল হাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়াহ দারভাঙ্গা) সরদারজীর দায়িত্ব পালন করেন। মন্ডল বা সরদার নিযুক্ত হ’লে এলাকার সমস্ত লোক তাঁর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত করে থাকেন। দিলালপুর জামা‘আত সাধারণত ‘পাহাড়িয়া’ জামা‘আত বলে পরিচিত।
দিলালপুর কেন্দ্র থেকে যারা রসদপত্র ও টাকা-পয়সা নিয়ে পাটনা (ছোট গুদাম) বা সীমান্ত ওরফে খোরাসান (বড় গুদাম) যাতায়াত করতেন তারা হ’লেন তাহেরুদ্দীন (উত্তর প্রদেশ), সিরাজুদ্দীন (উত্তর প্রদেশ) ও বরকতুল্লাহ। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ইবরাহীম মন্ডলজী (কালাপানির বন্দী) এবং মাওলানা গাযী আব্দুল মান্নান বিন মাওলানা আব্দুর রহমান মালীহাবাদী লাক্ষ্ণৌভীর নাম এতদঞ্চলে সমধিক প্রসিদ্ধ। শেষোক্ত জন খ্যাতনামা আলেম মাওলানা আব্দুল হান্নান দিলালপুরীর জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা।
দিলালপুর কেন্দ্রের সংস্কার কার্যাবলী :
দিলালপুর মাদ্রাসা শামসুল হুদার মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষা দান ছাড়াও মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র ও অন্যান্য মুজাহিদ সাথীগণ আমীরের তথা মন্ডলজীর নির্দেশক্রমে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন প্রান্তে তাবলীগী কাফেলা নিয়ে যেতেন। বিশেষ করে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আহমাদুল্লাহ ও তাঁর জামাতা মাওলানা আব্দুর রহমান মালীহাবাদী লাক্ষ্ণৌভী মুসলিম সমাজ হ’তে শিরক ও বিদ‘আত উৎখাতে জোরালো ও আপোষহীন ভূমিকা পালন করেন। খৃষ্টীয় ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ও শেষার্ধের এই সময় বাংলাদেশের বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির গাঢ় অন্ধকারে কি পরিমাণ নিমজ্জিত ছিল নিম্নোক্ত সমাজচিত্র সামনে রাখলে কিছুটা অাঁচ করা সম্ভব হবে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ: (১) মুসলমানেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে খাৎনা করত। অনেকের খাৎনাই হ’ত না (২) হিন্দুদের মত তারাও মাথায় টিকি রাখত (৩) হাতে ও গলায় গোদানা করত (৪) মুসলমান মেয়েরা নদীর পাড়ে কাপড় খুলে রেখে নিঃসংকোচে উলঙ্গ হয়ে পানিতে নেমে গোসল করত (৫) কেউ শূকরের পূজা করত (৬) খাৎনা উপলক্ষে বিরাট আয়োজন ও ঢাক-ঢোল পিটানো হ’ত (৭) ব্রাহ্মণ যজমানদের দেখাদেখি মুসলিম সমাজেও পীর-মুরীদীর প্রথা ছড়িয়ে পড়েছিল (৮) আল্লাহর বদলে পীরের নামে পীরের দরগাহে খাসি, গরু, মোরগ ইত্যাদি মানত করা, হাজত দেওয়া, পীরের ধ্যানে মগ্ন থাকা, পীরের যিকর করা ইত্যাদি চালু হয়েছিল (৯) মোরগ-মুরগী যবহ করার জন্য মোল্লা-মৌলবীগণ ছুরিতে ফুঁক দিয়ে দিতেন। ফিস-এর পরিমাণ মোতাবেক দুই বা ছয় মাসের মেয়াদে ফুঁক দেওয়া ছুরি দিয়ে যবহ করাই যথেষ্ট ছিল, পৃথকভাবে কোন দো‘আ পড়তে হ’ত না। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে পুনরায় ফিস দিয়ে ফুঁক দিয়ে আনতে হ’ত। নইলে ঐ ছুরিতে যবহ করা পশুর গোশত খাওয়া হারাম হ’ত। শী‘আদের ‘তাযিয়া প্রথা সুন্নীদের মধ্যেও প্রবেশ করেছিল। প্রত্যেক গ্রামে ‘তাযিয়া’ বানিয়ে রাখা হ’ত। বিয়ের পর সেখানে গিয়ে জামাই-মেয়ে ‘তাযিয়া’ সিজদা করত। কারো সন্তান না হ’লে কিংবা কেউ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হ’লে তাকে তাযিয়ার মধ্য দিয়ে পার হ’তে হ’ত।
(১০) মুসলমান মেয়েরা হিন্দু মেয়েদের মত বিয়ের সময় মাথায় সিঁদুর দিত। কপালে লাল টিপ লাগাত (১১) কারো পরপর দু’টি সন্তান মারা গেলে তৃতীয় সন্তানের নাম কুবাক্যে রাখা হ’ত, যাতে ‘মালাকুল মউত’ ঘৃণায় তার কাছে না আসে (১২) পরপর দু’টি বা তিনটি সন্তান মারা গেলে পরবর্তী সন্তানের মাথায় টিকি রেখে দিত। মৃত্যু সন্দেহ দূর হ’লে পরে টিকি কেটে ফেলত (১৩) হিন্দুদের ‘মনসা’ পূজার সময় মুসলমানদের ঘরে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার নাম রাখা হ’ত ‘মনসা’, অমনিভাবে তাদের হোলির সময় মুসলমানদের ঘরে কোন সন্তান এলে তার নাম রাখা হ’ত ‘কগওয়া’ (১৪) হিন্দুদের সাথে মিল রেখে মুসলমানেরাও তাদের ছেলে মেয়েদের নাম রাখত। দুখে, পচা, কালাচান, সোনাভান, রূপভান ইত্যাদি (১৫) অধিকাংশ মুসলমানদের ঘর থেকে ‘ছালাত’ বিদায় নিয়েছিল। তরুণ ও যুবকেরা বাজে খেলাধূলা ও বয়স্করা পীর ছাহেবদের শিখানো বিভিন্ন তরীকায় যিকর ও সাধনায় মশগূল থাকত। ছালাত বুড়া বয়সে আদায় করতে হয়, এমন একটা কথা সর্বত্র চালু হয়েছিল (১৬) মসজিদগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এমনও দেখা যেত যে একজন মুওয়ায্যিন স্বল্প বেতনের বিনিময়ে একই ওয়াক্তে কয়েকটি মসজিদে গিয়ে আযান দিত। অথচ মসজিদগুলির অধিকাংশ মুছল্লীশূন্য থাকত। এমনিতরো আরও বহু রেওয়াজ চালু ছিল। মজার ব্যাপার এই যে, এই সব বিদ‘আত সৃষ্টি ও টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী ছিলেন এই সময়কার বিদ‘আতী মোল্লা ও মৌলবীরা। এরাই ছিলেন শিরক ও বিদ‘আতের হোতা এবং পাহারাদার।
দিলালপুরের মুবাল্লিগণ বিশেষ করে মাওলানা আহমাদুল্লাহ ও মাওলানা আব্দুর রহমান এসবের বিরুদ্ধে সর্বদা জোরালো ভূমিকা রাখতেন। ফলে তাদেরকে প্রায়ই বিদ‘আতী আলেমদের মুকাবিলায় বাহাছ-মুনাযারায় যোগদান করতে হ’ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ‘আতীরা হয় অনুপস্থিত থাকত, নয় পালাত, নয় পরাজিত হ’ত। ফলে দলে দলে লোক আহলেহাদীছ হয়ে যেত। দিলালপুরের আশেপাশে বহুদূর পর্যন্ত কোন মসজিদ ছিল না। ফলে দূর-দরায থেকে মুসলমানরা এখানে জুম‘আ পড়তে আসত। এখানকার ওয়ায শুনে ও আমল-আখলাক দেখে অনেকে ‘আহলেহাদীছ’ হয়ে যেতেন ও শিরক বিদ‘আত থেকে তওবা করে নবজীবন লাভে ধন্য হ’তেন।
কয়েকটি বিশেষ মুনাযারার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : (১) ঝানাগাড়িয়ার বাহাছ (পোঃ হিরণপুর, যেলা ছাহেবগঞ্জ, বিহার) : জনৈক মারেফতী পীরের সাথে ১৯৫৪ খৃষ্টাব্দে এই গ্রামে একটি বড় ধরনের বাহাছ হয়। আহলেহাদীছ পক্ষে ছিলেন দিলালপুরের খ্যাতনামা শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হান্নান দিলালপুরী (১৮৯৫-১৯৮২ খৃঃ), মাওলানা মুছলেহুদ্দীন আব্দুল্লাহপুরী (১৯২১-৮১ খৃঃ), মাওলানা আফফান, মাওলানা শামসুল হক দারভাঙ্গাবী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম। উক্ত মুনাযারায় ব্যর্থ হয়ে পীর ছাহেব পালিয়ে যান। ফলে উক্ত গ্রাম সহ আশে পাশের এলাকা সব আহলেহাদীছ হয়ে যায়।
(২) বাঁশখুদরী বাহাছ (পোঃ সিটিপাড়া, যেলা ছাহেবগঞ্জ, বিহার) : প্রথমে এই গ্রামের এক পীরের সাথে বাহাছের দিন ধার্য হয়। কিন্তু তিনি নির্ধারিত তারিখের পূর্বেই পালিয়ে গেলে জনৈক দেউবন্দী হানাফী আলেম এসে লোকদেরকে তার মতে দীক্ষা দিতে চেষ্টা করেন। এতে গ্রামবাসীরা আহলেহাদীছ আলেমদেরকে আহবান জানায় দেউবন্দীদের সাথে মুনাযারা করার জন্য। মুনাযারার বিষয় বস্ত্ত ছিল (১) তাক্বলীদ (২) তা‘যিয়া (৩) মীলাদ (৪) ক্বিয়াম। আহলেহাদীছ পক্ষে ছিলেন মাওলানা নিযামুদ্দীন, মাওলানা আব্দুল আযীয হাক্কানী, মাওলানা আলী হোসায়েন প্রমুখ। দেউবন্দীদের পক্ষে ছিলেন মাওলানা শামসুদ্দীন ও মাওলানা সিরাজুদ্দীন প্রমুখ। বিস্তারিত আলোচনা শ্রবণ করে অর্ধেক গ্রামবাসী সঙ্গে সঙ্গে আহলেহাদীছ হয়ে যায়।
(৩) ইটাপুকুর বাহাছ (পোঃ বিষণপুর, যেলা ছাহেবগঞ্জ, বিহার) : ১৯৫২ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই মুনাযারার বিষয়বস্ত্ত ছিল (১) ওরস (২) কবর পূজা (৩) কাওয়ালী ও বয়াতী গান (৪) ধ্যানের মাধ্যমে ছালাত আদায়। বিষয়গুলির পক্ষে জনৈক ভোয়ালুদ্দীন পীর ও তার সহযোগীরা ছিলেন। বিপক্ষে ছিলেন মাওলানা আব্দুল হান্নান দিলালপুরী, মাওলানা শামসুযযোহা, মাওলানা আহমাদুল্লাহ রহমানী (সাং ভবানীপুর, পোঃ ও যেলা ছাহেবগঞ্জ, বিহার) স্বয়ং আমীর জনাব মঈনুল হক মন্ডলজীও উপস্থিত ছিলেন। বাহাছের পরে দু’একজন বাদে গ্রামের সবাই আহলেহাদীছ হয়ে যায়।
(৪) কাশিলা বাহাছ (পোঃ রাজগাঁও যেলা বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ) : এই মুনাযেরায় ব্রেলভী হানাফীদের পক্ষে (১) কবর পূজা (২) অসীলা পূজা (৩) কবরে গেলাফ চড়ানো (৪) পীরের নামে খাসি মানত করা (৫) মীলাদ-ক্বিয়াম ইত্যাদি বিষয়ে বাহাছ করার জন্য যথাসময়ে কোন ব্রেলভী আলেম হাযির হননি। আহলেহাদীছ পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আব্দুল হক (সাং মংগ্রামপুর যেলা ছাহেবগঞ্জ, বিহার) মাওলানা ইসমাঈল, মাওলানা আব্দুল আযীয হক্কানী, মাওলানা নিযামুদ্দীন প্রমুখ। গ্রামবাসী প্রায় সকলেই আহলেহাদীছ হয়ে যায় ও সেখানে একটি মাদ্রাসা কায়েম হয়।
(৫) কনকপুর বাহাছ (পোঃ রাজগাঁও, যেলা বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ) : ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত এই বাহাছে আহলেহাদীছ ও দেউবন্দী উভয় পক্ষের আলেমগণ সমবেত হন এবং মুক্তাদীদের সূরায়ে ফাতিহা পাঠ, নিয়ত পাঠ, কাতার সোজা করণ, মীলাদ প্রথা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এতে অর্ধেক গ্রামবাসী আহলেহাদীছ হয়ে যায়।
দিলালপুর কেন্দ্রের বিশেষ করে মাওলানা আহমাদুল্লাহ ও মাওলানা আব্দুর রহমানের নিরলস দাওয়াত-তাবলীগে তাঁদের প্রভাবিত লোকদের মধ্যে হ’তে শিরক ও বিদ‘আত সমূহ বিদূরিত হয়। পরবর্তীতে মাওলানা আব্দুল হান্নান দিলালপুরী ও তাঁর সহযোগী আলেমদের মাধ্যমে এই সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। (মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় প্রকাশ ২০১১), পৃঃ ৪৪০-৪৪৬)।
উপসংহার :
সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় না। ইবরাহীম মন্ডল মূলত একজন সৎ ও যোগ্য সরদারজী ছিলেন। তিনি তাঁর যোগ্যতা বলে তাঁর সহযোগীদের নিয়ে বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে যেভাবে মুনাযারা পরিচালনা করেন, তাতে ঐ সময় ঐসব এলাকার অনেক লোকই আহলেহাদীছ হয়ে যান।
বর্তমানেও অনুরূপভাবে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে অসংখ্য কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি চালু রয়েছে। তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত যেমন- (১) হিন্দুদের মত নতুন ধানে নবান্ন (২) সন্ধ্যার পর প্রয়োজনীয় দ্রব্য চাইতে গেলে না দেওয়া (৩) ডিম খেয়ে বাড়ী থেকে বের হ’লে যাত্রা অশুভ মনে করা (৪) বাড়ী হ’তে বের হওয়ার সময় কোন স্থানে আঘাত লাগলে বাধা মনে করা (৫) অনেকের বাড়ীতে শোকেসে ‘অজর’ মূর্তিকে অন্যান্য জিনিসের মত যত্ন করে রাখা (৬) হাতে ব্যথা হ’লে কাল সূতা পরা (৭) হাতের আঙ্গুলে আংটিতে পাথর ব্যবহার করলে ভাগ্য ভাল হওয়া (৮) বিবাহের পর সন্তান না হ’লে সন্তান লাভের আশায় বিভিন্ন স্থানে গমন করা (৯) ব্যবসার ক্যাশ বাক্সে আগরবাতি জ্বালানো (১০) খালি কলস দেখলে অশুভ মনে করা ইত্যাদি অনেক রেওয়াজ এখনও চালু আছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিষয়গুলি দেখতে পাওয়া যায়। এ সকল কুসংস্কার ও শিরকী-বিদ‘আতী আমল-আক্বীদার বিরুদ্ধে আজও যে আন্দোলন লড়াই করে যাচ্ছে, তা কিন্তু আহলেহাদীছ আন্দোলনই। আল্লাহ রাববুল আলামীন এই আন্দোলনকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখুন এবং হক্বের অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে মুসলিম সমাজকে শিরক ও বিদ‘আত থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সুদৃঢ় ভূমিকা রাখার তাওফীক দান করুন- আমীন!
এডভোকেট জারজিস আহমাদ
উপদেষ্টা, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, রাজশাহী সদর।