সুলতান মাহমূদ বর্তমান আফগানিস্তানের অন্তর্গত গযনী প্রদেশের সুলতান ছিলেন। তিনি যেমন একজন দক্ষ শাসক ছিলেন, তেমনি ছিলেন সত্যানুসন্ধানী ধর্মপরায়ণ মানুষ। তাঁর পুরো নাম ছিল আবুল কাসেম মাহমূদ বিন নাছিরুদ্দৌলা আবুল মানছূর সবুক্তগীন। তিনি সাইফুদ্দৌলা নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ৩৬১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪২১ হিজরীতে গযনীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি গযনীর সুলতান নির্বাচিত হন। সুলতান হওয়ার পর তিনি দেশ জয়ে মনোযোগী হন। একের এক দেশ জয় করতে থাকেন। তিনি ১৭ বার ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনা করেন। জয় করেন ভারত উপমহাদেশের বহু অঞ্চল। প্রাথমিক জীবনে তিনি একজন উঁচুদরের হানাফী আলেম ছিলেন। তাঁর রচিত ‘আত-তাফরীদ’ হানাফী ফিকহের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।[1]

পরবর্তীতে ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ঐতিহাসিক মোল্লা মুহাম্মাদ কাসিম হিন্দুশাহ ঈরানী ওরফে ফিরিশ্তা (৯৭৮-১০২১ হিঃ) তাকে ‘আহলেহাদীছ’ বিদ্বানদের মধ্যে গণ্য করেছেন (سلطان محمود از ائمه اہل حديث بود)[2]

ইলমে হাদীছের প্রতি তিনি খুবই আকৃষ্ট ছিলেন। মন্ত্রী পরিষদসহ বড় বড় শায়খদের নিকট থেকে তিনি হাদীছ শ্রবণ করতেন এবং হাদীছের ব্যাখ্যা জানতে চাইতেন। এতে তিনি অধিকাংশ হাদীছ শাফেঈ মাযহাবের অনুকূলে পেতেন। ফলে তার হৃদয়ে শাফেঈ মাযহাবের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। একদিন তিনি মার্ভে হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের ফক্বীহদের একত্রিত করে যেকোন একটি মাযহাবকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহবান জানালেন। তারা সকলে এ মর্মে একমত হলেন যে, সুলতানের সামনে দুই মাযহাবের পদ্ধতিতে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা হবে। তিনি তা পর্যবেক্ষণ করে যেটি সঠিক, সুন্দর ও বিশুদ্ধ মনে করবেন সেটি গ্রহণ করবেন। শায়খ আবুবকর আল-ক্বাফ্ফাল মারওয়াযী প্রথমে শাফেঈ মাযহাবের পদ্ধতিতে ছালাত আদায় শুরু করলেন। তিনি সুন্দরভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে পানি দ্বারা ওযূ করলেন। অতঃপর পরিষ্কার ও পবিত্র কাপড় পরিধান করে কিবলামুখী হয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলে ছালাত শুরু করলেন। যথাযথভাবে ছালাতের আহকাম ও আরকানসহ খুশূ-খুযূ সহকারে ছালাতের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করে সালাম ফিরানোর মাধ্যমে ছালাত শেষ করলেন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এরূপ পদ্ধতি ব্যতীত ছালাত বৈধ মনে করতেন না।

এরপর তিনি হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত বৈধ পদ্ধতিতে ছালাত আদায়ের প্রস্ত্ততি শুরু করলেন। প্রথমে তিনি কুকুরের পাকানো (দাবাগাত করা) চামড়া পরিধান করে তার এক চতুর্থাংশে নাপাকি লাগিয়ে নিলেন। অতঃপর খেজুরের পচা রস (নাবীয) দিয়ে ওযূ করলেন। সেটি নির্জন ভূমি  হওয়ায় খেজুরের পচা রসের দুর্গন্ধে মাছি ও মশা তাকে ঘিরে ফেলল। ক্বিবলা সামনে করে তিনি ফারসী ভাষায় তাকবীর দিয়ে ছালাত শুরু করলেন। অতঃপর ফারসীতে ক্বিরাআত دَوْبَرْكَك سَبْز (এটি সূরা রহমানের ৬৪ আয়াত مُدْهَامَّتَانِ -এর ফারসী অনুবাদ) পাঠ করলেন। এরপর রুকূতে গেলেন। রুকূ থেকে মাথা ভালোভাবে না উঠিয়েই সিজদায় চলে গেলেন। অতঃপর মোরগের ঠোকর দেওয়ার ন্যায় দু’সিজদার মাঝের দো‘আ না পড়েই দ্রুত দু’টি সিজদা শেষ করলেন এবং তাশাহ্হুদের পর দরূদের পূর্বে বায়ু নিঃসরণ করলেন। অতঃপর সালাম না ফিরিয়ে ছালাত সম্পাদন করে সুলতান মাহমূদকে বললেন, এটি হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত ছালাতের পদ্ধতি।

তখন সুলতান মাহমূদ বললেন, এটি যদি হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত ছালাতের পদ্ধতি না হয়, তাহ’লে আমি তোমাকে হত্যা করব। কারণ কোন দ্বীনদার ব্যক্তি এরূপ পদ্ধতিতে ছালাত আদায় বৈধ বলতে পারেনা। হানাফী মাযহাবের ওলামায়ে কেরাম তাদের ফিক্বহে এরূপ ছালাত আদায়ের পদ্ধতি বিদ্যমান থাকাকে অস্বীকার করল। তখন ক্বাফ্ফাল হানাফী মাযহাবের ফিক্বহের কিতাবগুলো নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। কিতাবগুলো নিয়ে আসা হ’লে সুলতান মাহমূদ ক্বাফ্ফালকে পড়তে না দিয়ে একজন খৃষ্টান লেখককে তা পাঠ করতে বললেন। যখন উক্ত ব্যক্তি হানাফী ফিক্বহ পাঠ করলেন তখন সুলতান মাহমূদ বুঝতে পারলেন যে, ক্বাফ্ফাল হানাফী ফিক্বহে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ীই ছালাত আদায় করেছেন। তিনি সত্য বুঝতে পারলেন। অতঃপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে হানাফী মাযহাব ত্যাগ করলেন এবং শাফেঈ মাযহাবের ছালাত রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ অনুযায়ী হওয়ায় শাফেঈ মাযহাব গ্রহণ করলেন।[3] এভাবে তিনি মূলতঃ হাদীছকে প্রাধান্য দিলেন, মাযহাবকে নয়। অতএব তিনি নিঃসন্দেহে একজন ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন।

প্রিয় পাঠক! এটি কোন গল্প নয়। শায়খ ক্বাফ্ফাল হানাফী মাযহাবের যে পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করেছেন তা হানাফী ফিক্বহে সত্যিই বর্ণিত হয়েছে। হানাফীদের মতে, কুকুরের পাকা চামড়া (দাবাগাত করা) পরিধান করে ছালাত আদায় করা যাবে এবং কুকুরের চামড়া দিয়ে তৈরী পাত্রে ওযূ করা যাবে।[4] তাদের মতে, পানি না পেলে খেজুরের পচা রস (নাবীয) দ্বারা ওযূ করা যাবে।[5] হানাফী ফিক্বহে ফারসী ভাষায় তাকবীরে তাহরীমা ও ক্বিরাআত পাঠের বৈধতা রয়েছে।[6] তাদের মতে, পোশাকের এক চতুর্থাংশে গরু-ছাগলের পেশাব লেগে থাকলেও ছালাত হয়ে যাবে।[7] তাদের মতে, দু’সিজদার মাঝে কোন দো‘আ পাঠ না করে সোজা হয়ে বসার পূর্বেই আবার তাকবীর দিয়ে সিজদায় গেলেও যথেষ্ট হবে।[8] তাদের মতে, তাশাহ্হুদের পর কারু যদি ওযূ টুটে যায়, কথা বলে বা ছালাত বিনষ্টকারী কোন কাজ করে, তাতে মুছল্লীর ছালাত নষ্ট হবে না। বরং তা পূর্ণ হয়ে যাবে।[9] অতএব প্রত্যেক ছহীহ হাদীছের অনুসারী আলেম-ওলামা এবং সাধারণ জনগণের করণীয় হচ্ছে শায়খ আবুবকর আল-ক্বাফ্ফাল মারওয়াযীর মত ছহীহ হাদীছকে সকলের সামনে উপস্থাপন করা। হয়ত এর মাধ্যমে আল্লাহ অনেক মানুষকে হেদায়াত দান করতে পারেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার মাধ্যমে আল্লাহ যদি একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন তাহলে তোমার জন্য সেটি সর্বোত্তম লাল উট (কুরবানী করা) অপেক্ষা উত্তম হবে।[10] উপরোক্ত বিষয়সমূহ কারো জন্য আঘাত মনে না করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করুন এবং সত্যকে গ্রহণ করুন। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়াত দান করুন- আমীন!

সংকলনে : মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।


[1]আব্দুর রহমান ফিরিওয়াঈ, জুহূদ মুখলিছাহ, পৃঃ ৩১-৩২; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ২৪০-২৪১

[2]তারীখে ফিরিশ্তা, কানপুর, ভারত: নওলকিশোর ছাপা ১৩০১/১৮৮৩ খৃঃ, ১ম মাক্বালাহ, ১ম খন্ড পৃঃ ২৩; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ২৪১

[3]ইবনু খাল্লিকান, অফিয়াতুল আ‘ইয়ান ৫/১৮০-১৮১; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৩২/২৩৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৭/৪৮৭; আবুল ফালাহ, শাযারাতুয যাহাব ৫/১০৯; আলী ইবনু সুলায়মান ইয়াফেঈ, মির’আতুল জিনান ওয়া ইবরাতুল ইয়াকযান ৩/১৯

[4]وَكُلُّ إهَابٍ دُبِغَ فَقَدْ طَهُرَ وَجَازَتْ الصَّلَاةُ فِيهِ وَالْوُضُوءُ مِنْه.. وَلَيْسَ الْكَلْبُ بِنَجِسِ الْعَيْنِ ُ হেদায়া (দেওবন্দ,সাহারানপুর ইউপি, মাকতাবা থানবী, ১৪১৬ হিঃ), ১/৪০, ‘যে পানি দ্বারা ওযূ বৈধ এবং যে পানি দ্বারা ওযূ বৈধ নয়’ অধ্যায়;  বদরুদ্দীন আয়নী, আল-বেনায়া শারহুল হেদায়া (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১৪২০/২০০০ইং), ১/৪০৭

[5]فَإِنْ لَمْ يَجِدْ إلَّا نَبِيذَ التَّمْرِ قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى : يَتَوَضَّأُ بِهِ وَلَا يَتَيَمَّمُ বেদায়াতুল মুবতাদী  (কায়রো : মাকতাবা ওয়া মাতবা‘আহ মুহাম্মাদ আলী ছাবাহ) ১/০৬; হেদায়া ১/৪৭, ‘উচ্ছিষ্ট ও অন্যান্য বিষয়’ অধ্যায়; আল-বেনায়া ১/৪৯৭

[6]فَإِنْ افْتَتَحَ الصَّلَاةَ بِالْفَارِسِيَّةِ أَوْ قَرَأَ فِيهَا بِالْفَارِسِيَّةِ أَوْ ذَبَحَ وَسَمَّى بِالْفَارِسِيَّةِ وَهُوَ يُحْسِنُ الْعَرَبِيَّةَ أَجْزَأَهُ عِنْدَ أَبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ বেদায়াতুল মুবতাদী ১/১৪; হেদায়া ১/১০১, ‘ছিফাতুছ-ছালাত‘ অধ্যায়; নূরুল আনওয়ার (দেওবন্দ : মাকতাবায়ে থানবী), পৃঃ ১২

[7]وَإِنْ كَانَتْ مُخَفَّفَةً كَبَوْلِ مَا يُؤْكَلُ لَحْمُهُ جَازَتْ الصَّلَاةُ مَعَهُ حَتَّى يَبْلُغَ رُبُعَ الثَّوْبِ বেদায়াতুল মুবতাদী ১/১০; হেদায়া ১/৭৫, ‘অপবিত্রতা এবং তা হ’তে পবিত্রতা অর্জন‘ অধ্যায়; আল-বেনায়া ১/৪০৭

[8].وَلَوْ لَمْ يَسْتَوِ جَالِسًا وَكَبَّرَ وَسَجَدَ أُخْرَى أَجْزَأَهُ عِنْدَ أَبِي حَنِيفَةَ وَمُحَمَّدٍ رَحِمَهُمَا اللَّهُ বেদায়াতুল মুবতাদী ১/; হেদায়া ১/১১০, ‘ছিফাতুছ ছালাত’ অধ্যায়।

[9]وَإِنْ تَعَمَّدَ الْحَدَثَ فِي هَذِهِ الْحَالَةِ أَوْ تَكَلَّمَ أَوْ عَمِلَ عَمَلًا يُنَافِي الصَّلَاةَ تَمَّتْ صَلَاتُهُ বেদায়াতুল মুবতাদী ১/১৭; হেদায়া ১/১৩০, ‘ছালাতে ওযূ নষ্ট হওয়া’ অধ্যায়

[10]বুখারী হা/৩৭০১; মুসলিম হা/২৪০৬;মিশকাত হা/৬০৮০







খলীফা হারূনুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি (২য় কিস্তি) - ইহসান ইলাহী যহীর
পরিবর্তনের জন্য চাই দৃঢ় সংকল্প - নাজমুন নাঈম
পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্রের খলীফা হারূণুর রশীদের প্রতি ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক পত্র - আত-তাহরীক ডেস্ক
খলীফা হারূণুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি (শেষ কিস্তি) - ইহসান ইলাহী যহীর
আবু দাহদাহ (রাঃ)-এর দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ছাহাবায়ে কেরাম নেতৃত্বকে যেভাবে ভয় পেতেন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
দিলালপুর : আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র - এডভোকেট জারজিস আহমাদ
ধৈর্যের অনন্য দৃষ্টান্ত - আবু রাযিয়া, নিয়ামতপুর, নওগাঁ
একজন কৃষ্ণকায় দাসের পরহেযগারিতা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর জীবনী থেকে কতিপয় শিক্ষণীয় ঘটনা - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক-এর গোপন আমল - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
সততা ও ক্ষমাশীলতার বিরল দৃষ্টান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.