ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (৬১-১০১ হি.) ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের স্বনামধন্য খলীফা। তার জীবন ছিল পরহেযগারিতা, দুনিয়াবিমূখতা ও অল্পেতুষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁর জীবনের ভাঁজে ভাঁজে উপদেশের খোরাক রয়েছে জান্নাত পিয়াসী মুমিনের জন্য। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সময়কালীন একটি ঘটনা খুবই শিক্ষণীয়। মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় একবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন প্রখ্যাত উমাইয়া সেনাপতি ও রাজপুত্র মাসলামা ইবনে আব্দুল মালেক। কথার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি সর্বদা আপনার সন্তানদের সম্পদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তারা একেবারেই নিঃস্ব। যদি আমাকে অথবা আপনার পরিবারের যাকে উত্তম মনে করেন তাকে সন্তানদের জন্য অভিভাবক মনোনীত করে যান, তাহ’লে খুবই ভালো হ’ত’।

তার কথা শেষ হ’লে ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) বললেন, ‘আমাকে ধরে বসাও’। তাকে ধরে বসানো হ’লে তিনি বললেন, ‘মাসলামা! আমি তোমার কথা শুনলাম। প্রথম যে কথাটি বলেছ যে, আমি আমার সন্তানদের সম্পত্তি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আল্লাহর কসম! তাদের যে অধিকার রয়েছে, তা থেকে আমি কখনোই তাদের বঞ্চিত করিনি। তবে হ্যাঁ, যেখানে তাদের কোন হক নেই তাদের এর কাছেও ঘেঁষতে দেইনি। আর তোমার দ্বিতীয় কথা- ‘তাদের জন্য আমাকে অথবা...’। তাদের জন্য আমি যাকে অভিভাবক মনোনীত করে রেখেছি, তিনি হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি সত্য কিতাব নাযিল করেছেন এবং সৎকর্মশীল বান্দাদের হেফাযতও করেন। আর তাদের বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকেন।

মনে রেখ হে মাসলামা! আমার ছেলেরা হয়ত নেককার পরহেযগার হবে, যাদের আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে ধনী করে দিতে পারেন, যে কোন সমস্যা থেকে বের হওয়ার পথ দেখাতে পারেন। অথবা তারা হ’তে পারে পাপাচারে নিমজ্জিত অসৎ বদকার। এদের অঢেল অর্থের জোগান দিয়ে আল্লাহর নাফরমানী ও অবাধ্যতায় আমি সহযোগী হ’তে চাইনি’।

এরপর বললেন, ‘আমার ছেলেদের আমার কাছে ডেকে পাঠাও!’ সবাইকে ডেকে আনা হ’ল। তারা ছিল ১৩ জন। যখন তিনি তাদের ছেলেদের দেখতে পেলেন, অঝোর ধারায় তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। ছেলেদের বললেন, ‘বাবারা! আমি তোমাদের একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছি..’। আবার তিনি কান্নায় নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাদের দিকে তাঁকালেন। সবটুকু ভালোবাসা কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাবারা! ধন-দৌলতের বিচারে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে গেলেও মান-মর্যাদার বিচারে আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি প্রচুর মূল্যবান সম্পদ। এই বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের যে জনপদেই তোমরা যাবে, মুসলিম-অমুসলিম, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সম্মান করবে তোমাদের।

আমার প্রাণাধিক পুত্ররা! তোমাদের সামনে দু’টো পথ খোলা থাকবে; অন্যায় পথে লব্ধ সম্পদে হয়ত তোমরা ধনী হবে, ফলশ্রুতিতে তোমাদের পিতাকে যেতে হবে জাহান্নামে। অথবা আল্লাহর হুকুমে অবিচল থেকে দরিদ্রতা স্বীকার করে জীবনের পথে চলতে থাকবে। পুরস্কার হিসাবে তোমরা পাবে জান্নাত। আমি নিশ্চিত যে, এটাই হবে যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানদের প্রকৃত পুরস্কার। এটাই হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদপত্র’।

এরপর তাদের দিকে সেণহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার তোমরা যাও, আল্লাহ তোমাদের হেফাযত করুন। আল্লাহ তোমাদের সকল অভাব মোচন করুন’। পিতার বুকভরা দো‘আ নিয়ে সন্তানরা সেখান থেকে চলে গেল।

এবার মাসলামা কাছে এসে বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আমার কাছে ওদের জন্য আরো উত্তম প্রস্তাব আছে’।

-‘কী সেটা?’

-‘আমার কাছে তিন লক্ষ দীনার আছে। সেগুলো আপনাকে দিচ্ছি, আপনি ওদের মাঝে ভাগ করে দিন অথবা আপনার ইচ্ছামতো অন্য কোথাও দান করুন’।

ওমর ইবনু আব্দুল আযীয বললেন, ‘আমি কী এর চেয়েও উত্তম প্রস্তাব দেব তোমাকে?’

-কী সেটা আমীরুল মু’মিনীন!

-এগুলো সেখানে ফিরিয়ে দেবে যেখান থেকে নেওয়া হয়েছে। ওগুলোর ওপর তোমার কোন হক নেই।

অনুশোচনায় ভিজে গেল মাসলামার দু’চোখ। বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আমার পাথরসম হৃদয়কে আপনি কোমল করে দিয়েছেন। বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়া কথা এনে দিয়েছেন স্মরণের সদর দুয়ারে। নেক মানুষের অন্তরে আমাদের স্মরণকে স্থায়ী করে দিয়েছেন’।

ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মৃত্যুর পরে মাসলামা তার সন্তানদের খবরাখবর ও অবস্থার প্রতি বিশেষ নযর রেখেছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকেই অভাবী, অস্বচ্ছল কিংবা নিঃস্ব পাওয়া যায়নি। (ড. আব্দুর রহমান রাফাত পাশা, ছুয়ারুম মিন হায়াতিত তাবেঈন (কায়রো : দারুল আদাবিল ইসলামী, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৯৯৭ খৃ.) পৃ. ২৬১-২৬৪)সুবহানাল্লহি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লহিল ‘আযীম

শিক্ষা :

  1. নেককার সন্তান গড়ে তোলার জন্য পিতামাতাকে আগে নেককার হওয়া যরূরী। কেননা পিতামাতার কাছেই সন্তান আদর্শ শেখে।
  2. পিতামাতার গাফলতিতে সন্তান বিপথগামী হ’লে তার দায়ভার পিতামাতাকেও নিতে হবে।
  3. যে পিতা সন্তানকে নেককার করে গড়ে তোলেন, মৃত্যুর সময় কোন সম্পদ রেখে যেতে না পারলেও তিনি সফল পিতা হিসাবে গণ্য হবেন। পক্ষান্তরে সন্তানদের যদি দ্বীনের পথে গড়ে তোলা না হয়, তাহ’লে তাদের জন্য কাড়ি কাড়ি সম্পদ রেখে গেলেও সেই পিতা ব্যর্থ পিতা হিসাবে বিবেচ্য হন।
  4. সন্তানের জন্য পিতামাতার দো‘আ অব্যর্থভাবে কার্যকর হয়। ঠিক তেমনি তাদের বদদো‘আও বাস্তবায়িত হয়।
  5. সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়া সফলতা নয়; বরং তাদেরকে দ্বীনের শিক্ষা দেওয়াই সবচেয়ে বড় সফলতা।





সততা ও ক্ষমাশীলতার বিরল দৃষ্টান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
খলীফা হারূনুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি - ইহসান ইলাহী যহীর
তাতারদের আদ্যোপান্ত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মৃত্যুকালীন নছীহত - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
হারামাইন প্রাঙ্গনের শীতলতার রহস্য - আত-তাহরীক ডেস্ক
অভাবী গভর্ণরের অনুপম দানশীলতা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ছাহাবায়ে কেরাম নেতৃত্বকে যেভাবে ভয় পেতেন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
দিলালপুর : আহলেহাদীছ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র - এডভোকেট জারজিস আহমাদ
স্ত্রী নির্বাচনে নিয়তের গুরুত্ব - আব্দুত তাওয়াব
তাতারদের আদ্যোপান্ত (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
খলীফা হারূণুর রশীদের নিকটে প্রেরিত ইমাম মালেক (রহঃ)-এর ঐতিহাসিক চিঠি (শেষ কিস্তি) - ইহসান ইলাহী যহীর
খলীফা ওমর (রাঃ)-এর অনুশোচনা
আরও
আরও
.