ভারতবর্ষে
৩২৬ বছরব্যাপী মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যহীরুদ্দীন মুহাম্মাদ বাবর
(১৫২৬-১৫৩১)-এর সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ
নির্মাণ করেন। (ক) ৩৫৭ বছর পর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে উক্ত মসজিদকে মন্দির
বানানোর প্রথম দাবী তোলেন জনৈক মহন্ত রঘুবীর দাস। তিনি বাবরী মসজিদের বাইরে
চাঁদোয়া টাঙিয়ে রামলালার (শিশু রাম) মূর্তি স্থাপনের জন্য অযোধ্যার
ফয়যাবাদ যেলা আদালতে আবেদন জানান। যা নাকচ হয়ে যায়। (খ) এর ৬৪ বছর পর
স্বাধীন ভারতে ১৯৪৯ সালে মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন
করা হয়। মন্দিরপন্থীরা দাবী করে, রামলালা আবির্ভূত হয়েছেন। মুসলিমরা এর
প্রতিবাদ করলে সরকার জমিটি বিতর্কিত ঘোষণা করে ও তালাবদ্ধ করে দেয়। ১৯৫০
সালে রামলালার পূজার অধিকার দাবী করে ফয়যাবাদ যেলা আদালতে আবেদন করেন দু’জন
হিন্দু নেতা। ১৯৫৯ সালে বাবরী মসজিদের ওই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করে
‘নির্মোহী আখড়া’ নামক একটি হিন্দু সংগঠন। এর বিরোধিতা করে ১৯৮১ সালে জমির
মালিকানা দাবী করে আদালতে মামলা করে উত্তর প্রদেশ ‘সেন্ট্রাল সুন্নী ওয়াকফ
বোর্ড’। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ফয়যাবাদের আদালত মসজিদ চত্বরে হিন্দু
তীর্থযাত্রীদের প্রবেশাধিকার দিতে তালা খুলে দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ
দেন। তবে পাল্টা আবেদনের ফলে ১৯৮৯ সালের ১৪ই আগস্ট এলাহাবাদ হাইকোর্ট
বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। (গ) ১৯৯০ সালের ২৫শে
ডিসেম্বর ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (বিজেপি) নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী (পরে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন অযোধ্যার
বাবরী মসজিদের উদ্দেশ্যে। উক্ত রথযাত্রায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদিও শামিল ছিলেন। (ঘ) সবশেষে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর কথিত করসেবকরা ৪৬৪
বছর পর বাবরী মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘তার চাইতে বড় যালেম আর কে
আছে যে আল্লাহর মসজিদ সমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলিকে
বিরান করার চেষ্টা চালায়? অথচ তাদের জন্য সেখানে প্রবেশ করা বিধেয় ছিল না
ভীত অবস্থায় ব্যতীত। তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে রয়েছে
ভয়াবহ শাস্তি’ (বাক্বারাহ ১১৪)।
(ঙ) মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ১৯৯৩ সালে সংসদে আইন পাস করে অযোধ্যার বিতর্কিত জমির দখল নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেন, বিতর্কিত জমি সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং ‘রামলালা বিরাজমান’ তিন সংগঠনের মধ্যে সমবণ্টন করে দেওয়া হোক। এ রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উভয় পক্ষ আপিল করলে ২০১১ সালের ৯ই মে উক্ত রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেন সুপ্রীম কোর্ট। ২০১৬ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী বিতর্কিত স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেন রাজ্যসভার বিজেপি সংসদ সদস্য সুব্রামানিয়ান স্বামী। ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর পক্ষগুলোকে আদালতের বাইরে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। তাতে কাজ না হওয়ায় ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী সুপ্রীম কোর্টে সব দেওয়ানী মামলার আবেদনের শুনানি শুরু হয়।
উপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, ইংরেজ আমলে বাবরী মসজিদ অক্ষত থাকলেও স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে তার অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। সেদিন যে শিবসেনা কর্মী বলবীর শিং মসজিদের মাথায় উঠে প্রথম শাবল মেরেছিল, সে ও তার সাথী যোগেন্দ্রপাল পরে মুসলমান হয়ে যায়। বলবীরের পিতা দৌলতরাম তাকে বাড়ীতে ঢুকতে দেননি এবং ছেলের এই অপকর্মের দুঃখেই তিনি অল্প দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। অথচ বলবীরের শাবলে ভাঙ্গা দু’টি ইট, যা সে সাথে করে নিয়ে এসেছিল, পানিপথের শিবসেনা অফিসে সেদু’টিকে সাদরে সাজিয়ে রাখা হয়। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য বলবীর ওরফে ‘মুহাম্মাদ আমীর’ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের প্রায় শ’খানেক ভেঙ্গে পড়া মসজিদ মেরামত করেছেন। অন্যদিকে যোগেন্দ্র মস্তিষ্ক বিকৃতি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
রায় : ২০১৯ সালের ৮ই জানুয়ারী প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নেতৃত্বে সুপ্রীম কোর্ট পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ঘোষণা করেন। দু’দিন পর ১০ই জানুয়ারী বিচারপতি ইউ ইউ ললিত নিজেকে মামলা থেকে সরিয়ে নিলে ২৫শে জানুয়ারী এস আব্দুন নাযীর উক্ত বেঞ্চে যুক্ত হন। টানা ৪০ দিন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের পর রায় লেখার জন্য মাসখানেক সময় নেন বেঞ্চ। অবশেষে দীর্ঘ ২৭ বছর মামলা চলার পর গত ৯ই নভেম্বর’১৯ শনিবার ১০৪৫ পাতার বিশাল বিবরণী সহ সর্বসম্মত রায় ঘোষিত হ’ল। যাতে বাবরী মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেওয়া হ’ল। একেই বলে ‘পর্বতের মুষিক প্রসব’। মসজিদের ২.৭৭ একর বিবাদীয় জমিতে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর মসজিদ নির্মাণের জন্য সরকারকে অন্যত্র পাঁচ একর জমি বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট।
উপরোক্ত ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে এটাই ফুটে ওঠে যে, ৩৫৭ বছর যাবৎ যে মসজিদে মুসলমানদের মালিকানা নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিল না। বৃটিশ চলে যাওয়ার প্রাক্কালে ১৮৮৫ সালে ‘ভারতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বছরেই প্রথম জনৈক হিন্দুকে দিয়ে কাল্পনিক এক মিথ্যা মামলা আদালতে দায়ের করা হয়। বৃটিশের ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ পলিসির আলোকে বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে খুশী করার জন্য এবং সাবেক শাসক সম্প্রদায় মুসলিম শক্তিকে পর্যুদস্ত করার জন্যই উক্ত দুষ্ট পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৪৯ সালে ভারত সরকার প্রথমে স্থানটিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে মসজিদটি তালাবদ্ধ করে দেয়। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দু’হাযার এবং তার জের ধরে ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে গুজরাট দাঙ্গায় আরও প্রায় দু’হাযার মুসলমান নিহত হয়। আহত ও পঙ্গু হয় ২০ হাযারের বেশী। লুট হয় তাদের ঘর-বাড়ী, দোকান-পাট ও নারীদের সম্ভ্রম। অবশেষে বিতর্কহীন এক জীবন্ত মসজিদকে বিতর্কিত বানিয়ে জেনেশুনে আদালতের মাধ্যমে হিন্দু মন্দিরে পরিণত করা হয়। প্রশ্ন হ’ল, সর্বোচ্চ আদালতের রায় কি চূড়ান্ত? আল্লাহর আদালতেই এর বিচার রইল।
প্রতিক্রিয়া : (১) উত্তর প্রদেশের ‘সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডে’র কৌঁসুলি জাফরিয়াব জীলানী বলেন, রায়কে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু এই রায়ে আমরা খুশী নই। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা হবে কি না, তা আলোচনা করে স্থির করা হবে। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ যে, ভারতের মুসলিম সংগঠনগুলি এ রায়ের ব্যাপারে দ্বিধা-বিভক্তিতে ভুগছে।
(২) ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখায় বলেন, এই রায়টা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হ’ল, ঠিক বুঝতে পারছি না। প্রায় ৫০০ বছর ধরে একটা মসজিদ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মসজিদকে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভেঙে দেওয়া হ’ল বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে। আর আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, ওখানে এবার মন্দির হবে। সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে তো একটা বিষয় রয়েছে! এমন কোনও কাজ করা উচিত নয়, যাতে দেশের সংবিধানের ওপর থেকে কারও আস্থা উঠে যায়। আজ অযোধ্যার ক্ষেত্রে যে রায় হ’ল, সেই রায়কে হাতিয়ার করে ভবিষ্যতে এই রকম কান্ড আরও যে ঘটানো হবে না, সে নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? শুধু অযোধ্যায় নয়, মথুরা এবং কাশীতেও একই ঘটনা ঘটবে এ কথা আগেই বলা হ’ত। যারা গুন্ডামী করে বাবরী মসজিদ ভেঙেছিল, তারাই এ কথা বলত। এখন আবার সেই কথা বলা শুরু হচ্ছে। যদি সত্যিই মথুরা বা কাশীতে কোনও অঘটন ঘটানো হয় এবং তার পরে মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়, তাহ’লে কি হবে? সেখানেও তো এই রায়কেই তুলে ধরে দাবী করা হবে যে, মন্দিরের পক্ষেই রায় দিতে হবে বা বিশ্বাসের পক্ষেই রায় দিতে হবে। অযোধ্যা মামলা এর আগেও সুপ্রীম কোর্টে উঠেছে। তখনই আদালত স্বীকার করে নিয়েছিল যে, বিতর্কিত জমিতে মসজিদ ছিল। যেখানে বছরের পর বছর ধরে ছালাত পড়া হচ্ছে, সেই স্থানকে মসজিদ হিসাবে মান্যতা দেওয়া উচিত, এ কথা আদালত মেনে নিয়েছিল। তাহ’লে আজ এই নির্দেশ এলো কিভাবে? যেখানে একটা মসজিদ ছিল বলে সুপ্রীম কোর্ট নিজেই মেনেছে, সেখানে আজ মন্দির বানানোর নির্দেশ সেই সুপ্রীম কোর্টই দিচ্ছে কোন যুক্তিতে? ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ (এএসআই) জানিয়েছিল, ওই মসজিদের নীচে একটি প্রাচীন কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই কাঠামো যে মন্দির ছিল, এমন কোনও প্রমাণ তো মেলেনি। সুপ্রীম কোর্ট নিজেও মেনে নিয়েছে যে, পুরাতাত্ত্বিক রিপোর্টে কোনভাবেই প্রমাণ হচ্ছে না যে, একটা মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ করা হয়েছিল। তাহ’লে কিসের ভিত্তিতে আজ একই স্থানে মন্দির তৈরীর নির্দেশ? বিশ্বাসের ভিত্তিতে?... এটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত হ’ল? রামচন্দ্র আদৌ ছিলেন কি না, কোথায় জন্মেছিলেন, সে সবের কোনও প্রামাণ্য নথি কি রয়েছে? নেই। রাম শুধু মহাকাব্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে অনেক মানুষের মনে একটা বিশ্বাসও রয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের বলে একটা মসজিদের জমি মন্দিরের নামে হয়ে যেতে পারে না। কালকে যদি আমি বলি, আপনার বাড়ীর নীচে আমার একটা বাড়ী রয়েছে, এটা আমার বিশ্বাস, তাহ’লে কি আপনার বাড়ীটা ভেঙে জমিটা আমাকে দিয়ে দেওয়া হবে?
(৩) ১০ই নভেম্বর সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের প্রধান হায়দরাবাদ থেকে লোকসভার তিন তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিষ্টার আসাদউদ্দীন ওয়াইসি বাবরী মসজিদের রায়ের সমালোচনা করে বলেন, বিজেপির আদর্শিক গুরু ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ (আরএসএস)-এর হাতে বেশ কিছু মসজিদের তালিকা রয়েছে। এই মসজিদগুলো রূপান্তর করে মন্দির বানানো হবে। বিজেপি ও সংঘ পরিবার যখন মসজিদের একটি তালিকা বানিয়েছে, তখন বাবরী মসজিদের জন্য লড়াই করে যাওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বাবরী মসজিদ আমাদের বৈধ অধিকার। আমরা তো জমি দখলের লড়াই করছি না, কারো অনুগ্রহ চাই না। দেশের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার চাই।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো মুসলমানদের ধোঁকা দিয়েছে বলে তিনি দাবী করেন। সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়ারও তিনি নিন্দা জানান। সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টি ও ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির মতো কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর নীরবতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি মুসলমানদের হতাশ না হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, এটি তাদের দেশ। তারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। সবাইকে নিয়মিত ছালাত আদায়ের অনুরোধ করে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে বলেন।
(৪) ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের আলেম ও আইনজীবীগণ উক্ত রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আদালত এ জমিটির মালিকানা স্পষ্ট না করেই রায় দিয়েছেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া : (১) বাবরী মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের দাবীতে প্রচার চালানো বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী রায়ের পর বলেছেন, আজ স্বপ্নপূরণ হয়েছে। রাম মন্দির নির্মাণের গণ-আন্দোলনে আমাকেও অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। (২) পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘ ৭২ বছর বন্ধ থাকা পাঞ্জাবের করতারপুর করিডোর উদ্বোধনে ব্যস্ত থাকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর টুইটে বলেন, ‘ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই দিনটি একটি স্বর্ণালী অধ্যায়’। (৩) শাসক দলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘মিল কা পাত্থর’ অর্থাৎ এ রায় একটি ‘মাইলফলক’। (৪) কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী রায়কে স্বাগত জানিয়ে এ রায়কে সম্মান জানানোর ও নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার আহবান জানান। (৫) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। (৬) বামেরা সব দিক বাঁচিয়ে বয়ান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। (৭) বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) সহ কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তাদের পরবর্তী টার্গেট সম্পর্কে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তারা ৩২ হাজার মন্দির উদ্ধারের নামে ভারতের মসজিদগুলোকে ধ্বংস করার ঘোষণা দিয়েছে। রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসাবে গান্ধীজীর স্বপ্ন সফলের লক্ষ্যে মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি, বারানসীর কাশী ‘বিশ্বনাথ মন্দির’ এবং পশ্চিমবঙ্গে ‘আদিনাথ মন্দির’ নির্মাণ করা হবে। মূলতঃ এসব স্থানে এখন মসজিদ রয়েছে। যা তাদের পরবর্তী টার্গেট। (৮) বাংলাদেশের প্রায় সকল ইসলামী দল এ রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে সরকারী দল আওয়ামী লীগ বলেছে, এটি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়। বিরোধী দল বিএনপি এবং সকল বাম দল এ ব্যাপারে চুপ রয়েছে।
আমরা বলি, অনতিবিলম্বে এ রায় পুনর্বিবেচনা করা হৌক এবং সরকারী খরচে বাবরী মসজিদ তার নিজস্ব স্থানে পুনর্নির্মাণের আদেশ দেওয়া হৌক! নইলে এর মন্দ প্রতিক্রিয়া নিরপেক্ষ ভারতবাসীদের নিকট এবং বিশ্বব্যাপী সর্বত্র হবে। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ১৯৯২-৯৫ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে দেশছাড়া এক বসনীয় মুসলিম মহিলা ১৯৯৯ সালে নিজ বাড়ীতে ফিরে তার বাড়ীর বাগানে একটি ‘গীর্জা’ দেখে তার বিরুদ্ধে সেদেশের আদালতের শরণাপন্ন হন। গত ১লা অক্টোবর’১৯ আদালতের রায়ে বসনিয়া সরকারকে উক্ত গীর্জা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ৯০ কর্মদিবস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বস্ত্ততঃ ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের রায়ে সেদেশের কথিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মুখোশ খুলে পড়েছে। এর ফলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের পরাজয় হয়নি, পরাজয় হয়েছে ন্যায়বিচারের। মসজিদ নির্মাণের নেকী সম্রাট বাবর ও তার সেনাপতি ঠিকই পেয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখ হ’ল হিন্দু নেতাদের জন্য। যাদের একটি শিশু সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে দিল্লীর রাজপথে বাবর নিজের জীবন বাজি রেখে একাই হামলা চালিয়ে এক মত্ত হস্তীকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ তারাই তাঁর স্মৃতিচিহ্ন পবিত্র বাবরী মসজিদকে মুছে দিল! ধর্মে ধর্মে সহাবস্থানের হাযার বছরের ভারতীয় ঐতিহ্য ধ্বংস করল রাজনীতিক নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। এখন প্রয়োজন কেবল ধৈর্যধারণের এবং ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার। ইনশাআল্লাহ সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন বলবীর শিংয়ের ন্যায় অগণিত অমুসলিম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।
সংশোধনী : নভেম্বর’১৯ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে মাহবুবুল আলম হানিফকে ভুলবশতঃ ‘সাবেক মন্ত্রী’ বলা হয়েছে। এই অনাকাংখিত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। -সম্পাদক।