গত ১৩ই জানুয়ারী’১৮ ঢাকায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাম দল সমূহের প্রতিনিধিদের দু’দিন ব্যাপী সম্মেলন ‘ঢাকা ঘোষণা’র মাধ্যমে শেষ হ’ল। সম্মেলনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও বাংলাদেশের বামনেতারা অংশ নেন। সম্মেলন শেষে গৃহীত ‘ঢাকা ঘোষণা’য় বলা হয় যে, অর্থনৈতিক অসমতাই সকল সংকটের জন্য দায়ী। বলা হয়েছে, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করছে। যা অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক সংকট বাড়াচ্ছে। ঘোষণায় বলা হয়, স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে, তবে বৈশ্বিকভাবে জনগণকে সংগঠিত করতে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন প্রয়োজন’।
উক্ত ঘোষণায় সমস্যা বলা হয়েছে। কোন সমাধান বলা হয়নি বা এতে ভবিষ্যৎ আশার আলো নেই। বাংলাদেশের সুপরিচিত বাম অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর আবুল বারাকাত প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে ইঙ্গিত করে গত ১১ই জানুয়ারী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে স্বীয় গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, অর্থনীতি শাস্ত্র ৫০০ বছর ধরে যেভাবে এগিয়েছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এ শাস্ত্র জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা এ শাস্ত্র জনকল্যাণের কথা ভাবেনি। তার মতে, অর্থনীতি শাস্ত্রে এখন তিনটি বড় ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে : বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক। বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেই নিজেকে সংশোধন করে নেয়, এই চিন্তাধারাই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা। নৈতিক ব্যর্থতার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যই প্রবৃদ্ধি পূজা করেছি, ভালো জীবনের জন্য নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ফলপ্রদ বাজার তত্ত্বে বিশ্বাসী। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠান মনে করে, অর্থবাজারকে তেমন নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজন নেই’। বর্তমান সময়ের অর্থনীতি শিক্ষাকে নীতিহীন ও জনকল্যাণবিমুখ বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে অর্থনীতি পড়ানো হচ্ছে, তা শুধু স্যুট-বুট পরা কেরানী তৈরী করছে। তাই দর্শন ও নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন বর্তমান অর্থনীতি শাস্ত্রের পাঠ্যক্রমে বড় ধরনের সংস্কার আনা প্রয়োজন’।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর মোহাম্মাদ ফরাসউদ্দীন বলেন, সাধারণ মানুষের জীবনে সমস্যা দু’টো। একটা হ’ল সে কীভাবে বাঁচবে। আরেকটা হ’ল বাঁচার জন্য কী করতে হবে। পুঁজিবাদের বিকল্প ‘সাম্যবাদ’ সাধারণ মানুষকে তেমন কিছুই দিতে পারেনি। সাম্যবাদের দর্শন যদি এতই আকর্ষণীয় হ’ত, তাহ’লে রাশিয়া ও চীন শুধু রাজনীতির জন্য সাম্যবাদ, আর অর্থনীতির জন্য বাজার ব্যবস্থার কাছে যেত না। এই প্রশ্নের উত্তর অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিকদের খুঁজতে হবে। অর্থনীতির সঙ্গে নৈতিকতার একটি সার্বজনীন যোগসূত্র বের করতে হবে’। কথাগুলি নিঃসন্দেহে গ্রহণীয়।
মানুষের জীবন এক ও অবিভাজ্য। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য দৈনন্দিন আয়-রোজগার যেমন যরূরী, তেমনি তার আয়-ব্যয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নীতি একান্তভাবেই অপরিহার্য। নইলে অসম প্রতিযোগিতা মানুষের সমাজকে হিংস্র পশুর সমাজে পরিণত করবে। যেমন বাণিজ্যিক যুদ্ধ এখন আণবিক যুদ্ধ ডেকে আনছে। বস্ত্ততঃ রাজনীতি ও অর্থনীতিকে জীবন থেকে পৃথক ভাবাটাই আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি। মানুষের নিকট মনুষ্যত্বই প্রধান। অর্থ-সম্পদ কখনোই মুখ্য নয়। যদিও তা গুরুত্বপূর্ণ। আর নৈতিক উন্নতি ব্যতীত বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক উন্নতি স্রেফ মরীচিকা মাত্র। কোন ব্যক্তিই রাজনীতি বা সমাজনীতি কোন ব্যাপারেই বস্ত্তবাদী বা সেক্যুলার হ’তে পারে না। মানুষের জন্য দৈহিক খাদ্য যেমন প্রয়োজন, তার রূহানী খাদ্য তেমনি প্রয়োজন। সে কেবল ভোগে সন্তুষ্ট নয় বরং ত্যাগেই বেশী তৃপ্ত হয়। আর এখানেই মানুষের উচ্চ মর্যাদা নিহিত। এক্ষণে সর্বোত্তম অর্থনীতি কেবল সেটাই হতে পারে, যা ভোগ ও ত্যাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে (ইসরা ১৭/২৯)। এপথে বড় বাধা হ’ল পুঁজিবাদ। যা ভোগবাদ থেকে উৎসারিত। ব্যক্তি মালিকানা লাভ ও সেজন্য অবাধ প্রতিযোগিতা মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ভদ্রবেশী পুঁজিবাদ। যা আসলে কোন মতবাদই নয়। কেননা দু’হাতে লুটপাট করার জন্য কোন পড়াশুনা করা লাগে না। কিন্তু এটাকে ভদ্রতার মুখোশ পরানোর জন্য নিযুক্ত হয়েছেন অর্থনীতিবিদ নামধারী একদল ব্যক্তি। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। ফলে পুঁজিবাদী শোষণে জর্জরিত জনতা ‘হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান করা’র প্রতারণামূলক সমাজবাদী অর্থনীতির শ্লোগান শুনে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা ছিল এক আগুন থেকে বাঁচার জন্য আরেক আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার শামিল। এর মাধ্যমে ব্যক্তি পুঁজিবাদের বদলে সৃষ্টি হ’ল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। সমাজ দেহের বিভিন্ন স্থানে জমাট বাঁধা সমস্ত রক্ত মাথায় জমা করে তা এখন পুরা দেহকে রক্তশূন্য করে দিল। যার ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্র অল্প দিনেই মারা পড়ল। যারা এখন এর পক্ষে কথা বলছেন, তাদের জীবনের সর্বত্র পুঁজিবাদ কিলবিল করছে। কথিত সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির চাইতে বড় পুঁজিবাদী। গরীব রাষ্ট্রগুলি তাদের নগ্ন শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট। নিজ দেশের নাগরিকদের বাক, ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা কার্যতঃ বিলুপ্ত। জগদ্দল পাথরের মত তাদের মাথার ওপর চেপে আছে সমাজতন্ত্র নামের এই হিংস্র দৈত্য। এক্ষণে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ দুই চরমপন্থী মতবাদের জোয়াল ফেলে মানুষের মুক্তির পথ কি?
এজন্য মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট থেকে জবাব নিতে হবে। তিনি বলে দিয়েছেন, ‘তবে কি তারা তোমার প্রতিপালকের রহমত বন্টন করবে? আমিই তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং তাদেরকে একে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি। যাতে তারা একে অপর থেকে কাজ নিতে পারে। বস্ত্ততঃ তারা যা কিছু জমা করে তা থেকে তোমার প্রতিপালকের রহমত অনেক উত্তম’ (যুখরুফ ৪৩/৩২)। এতে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে যে, রিযিকের বণ্টন তিনিই করেন এবং সেখানে কমবেশী থাকবেই। যাতে একে অপর থেকে কাজ নিতে পারে। আর মানুষ পরস্পরের মুখাপেক্ষী। অতএব সম্পদ জমা করার চাইতে ব্যয় করার মধ্যেই আল্লাহর অনুগ্রহ নিহিত রয়েছে। মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের মানসিকতা সীমাহীন। তাই বলে দেওয়া হয়েছে, ‘যমীন থেকে হালাল ও পবিত্র রূযী খাও। কিন্তু শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না (বাক্বারাহ ২/১৬৮)। বলা হয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত কোন আদম সন্তান পা বাড়াতে পারবে না। তার মধ্যে দু’টি হ’ল, কোন পথে সম্পদ অর্জন করেছ ও কোন পথে তা ব্যয় করেছ’ (তিরমিযী হা/২৪১৬)। ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। কেননা সূদ সম্পদকে সংকুচিত করে ও ছাদাক্বা সম্পদকে বৃদ্ধি করে (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। ‘প্রত্যেকের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। আর তা হ’ল সঞ্চিত ধনের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ ফরয যাকাত আদায় কর এবং সর্বাবস্থায় নফল ছাদাক্বা দাও। আল্লাহকে অগ্রিম ঋণ দাও। তার বহুগুণ বেশী তুমি পাবে (বাক্বারাহ ২/২৪৫)। একটি ধানের বীজ থেকে যেমন অসংখ্য ধান সৃষ্টি হয়, ছাদাক্বা থেকে তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয় (বাক্বারাহ ২/২৬১)। এর বদলা আখেরাতে জান্নাত এবং দুনিয়াতে সমৃদ্ধ একটি মানবিক সমাজ। যেখানে আর্থিকভাবে সকলে সচ্ছল ও পরস্পরে সহানুভতিশীল সুখী জীবনের অধিকারী হবে। এটিই হ’ল ন্যায় বিচার ভিত্তিক অর্থনীতি। যার বিপরীতে পুঁজিবাদ হ’ল দু’হাতে সম্পদ জমা করার রাক্ষসী অর্থনীতি। আর সমাজবাদ হ’ল ব্যক্তিমালিকানাহীন কারাগারী অর্থনীতি। দু’টিই মানুষের স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই অর্থনৈতিক অসমতা নয়, অর্থনৈতিক অন্যায্যতাই সকল সংকটের জন্য দায়ী। আর সামাজিক ন্যায় বিচার ভিত্তিক ইসলামী অর্থনীতির লালন ও বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজের চাবিকাঠি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন-আমীন! (স.স.)]