গত ২৫শে আগস্ট’১৭ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা নিধন পুনরায় জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ১৭৯৯ সাল থেকে এ অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হ’লেও এবারের জাতিগত নিধন তৎপরতা এত মারাত্মক রূপে চলছে যে, সমগ্র আরাকান থেকে রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের পথে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমূদ আলীর মতে, উত্তর রাখাইনের ১৭ লাখের মত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৯ লাখই এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের বাইরে আরো কিছু দেশে চার লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ফলে তার মতে, বড়জোর চার থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা এখন মিয়ানমারের উত্তর রাইনে অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৫শে আগষ্ট থেকে তিন হাযারের মত রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। তবে অন্যদের মতে পাঁচ হাযারের অধিক।

গত দেড় মাসে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যার মধ্যে ১০ সহস্রাধিক কেবল ইয়াতীম শিশু। এখনো দৈনিক রোহিঙ্গা আসছে। সীমান্ত পেরোনোর অপেক্ষায় আছে লক্ষাধিক। শত শত গ্রাম, ফসলী জমি, গাছপালা সহ এমনভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন তারা ফেরত আসলেও তাদের অবস্থানস্থল চিনতে না পারে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রদত্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ২১৪টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

শরণার্থীদের যবানীতে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র :

(১) বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মংডু পর্যন্ত যে বাস চলাচল করে সেই পরিবহন কোম্পানীর মালিক আরিফুল সওদাগর। বাসের পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। বছরে ৫-৬ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। নিজেও গাড়িতে চলাফেরা করতেন। সেনাবাহিনী ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁদের সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়েছে। সব হারিয়ে তিনি এখন পথের ভিখারী। বললেন, ভাই আগে মানুষকে সাহায্য করতাম, আর এখন সাহায্যের জন্যে বসে আছি।

(২) শুদ্ধ বাংলা ও ইংরেজী বলতে সক্ষম শিক্ষিত আরেক রোহিঙ্গা। ১০০ একরের চিংড়িঘেরের মালিক ছিলেন। আরও ছিল ২০ একরের আবাদি জমি। বাড়িতে ফ্রিজ-টিভি সবই চলে। ছেলেমেয়েরা চলাচল করত দামি গাড়িতে। বললেন, এখন পলিথিনের ছাউনির বাসিন্দা, বেঁচে আছি রিলিফ খেয়ে। এটাও একটা জীবন। প্রথম প্রথম কাঁদতাম, এখন আর কান্না আসে না। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।

(৩) নযীর হোসাইন (৯৭)। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে কখনোই বাংলাদেশে আসতে চাননি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তিন ছেলে আগেই বাংলাদেশে এসেছে। শুধু একাই বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বললেন, ‘ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হ’তে দেখছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হ’তে দেখছি। আমার ৯৭ বছর বয়সে এত বর্বরতা দেখিনি।

(৪) পিতৃ-মাতৃহারা দিলারা (১১) ও আযীযা বেগম (৯)। আযীযার ভাষ্য, সেদিন দুপুরের খাবারের আগে আমরা উঠানে খেলছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে গ্রামের পাশের একটি ঝোপে দৌড়ে পালিয়ে যাই। তারপর আড়াল থেকে দেখলাম পিতা-মাতাকে গুলি করছে সেনাবাহিনী। পরে তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পিতাকে জবাই করে, বড় একটি ছুরি দিয়ে মায়ের পেটে আঘাত করে। ৯ ভাই-বোনকে হারিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে পালিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার পর হারানো বোন দিলারাকে খুঁজে পেয়েছে।

(৫) পরিবার হারা দশ বছরের রোহিঙ্গা শিশু আশরাফ। বিভীষিকাময় সেইদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলল, মিয়ানমারের সেনারা চোখের সামনে আমার মা ও বোনকে ধর্ষণ করে গলা কেটে হত্যা করে। পিতার হাত পা বেঁধে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ছোট ভাইটাকে দুই টুকরো করে ফেলে এক কোপে। কোন রকমে পালিয়ে বাইরে এসে দেখি অনেক মানুষ দৌড়াচ্ছে। তাদের সাথে আজ আমি এখানে।

(৬) উখিয়া ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন শরীফা (৩০)। কোলে ছয়মাসের শিশু। সাত বছরের কম বয়সী চারটি শিশুকে ধরে সামনের দিকে চেয়ে অশ্রুসজল চোখে চেয়ে আছেন। বললেন, একনাগাড়ে অনেক দিন গোসল ছাড়া আছি। কারণ অতিরিক্ত কোন কাপড় নেই। অন্যরা ত্রাণের জন্য বাইরে যেতে পারলেও ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। স্বামীকে মগেরা গুলি করে মেরে ফেলেছে।

(৭) ১১ সন্তানের স্বামীহারা মা সফুরা খাতুন। থাকেন নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম শরণার্থী শিবিরে। বড় সন্তানের বয়স ১৪ আর কোলের শিশুর বয়স এক বছর। খুপড়ির ভিতরে শিশুরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। অসহায় মা ধমকাচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন সন্ধ্যা হোক খাবার দেব। কিন্তু তারা কেঁদেই চলেছে। জানতে চাইলে সফুরা বেগম বললেন, ‘ওদের পেটে যেন রাক্ষুসে ক্ষুধা। খাইতে না পারলেই খালি কাঁদে। ঘরে কেবল তিন কেজি চাল। নুন দিয়ে এক বেলা সিদ্ধ ভাত খেয়ে দু’ঘন্টা যেতেই বাচ্চারা ভাতের জন্য কাঁদতে থাকে। কিন্তু উপায় তো নেই।

(৮) চল্লিশ বছরের আব্দুল মজীদ তার ৮০ বছরের মাকে কাঁধে করে ৬৩ মাইল পথ হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন। বললেন,  যেখানে আমার দাদার জন্ম, পিতার জন্ম, আমার জন্ম, আমার সন্তানের জন্ম। আজ সেই মাটি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেদিন রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পাশের গ্রামে চিৎকার আগুন আগুন। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ। বুঝতে আর বাকি রইল না। এর কিছুক্ষণ পরই পার্শ্ববর্তী মগরা এসে আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। এমন ভয়ংকর দৃশ্য বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। ওদের একটাই কথা- তোরা মিয়ানমারের কেউ না। তোদের প্রাণে শেষ করে দেব।

(৯) বর্বরদের হাত থেকে হিন্দুরাও রেহাই পায়নি। হিন্দু রোহিঙ্গা রুশনা শীল। নিজের চোখের সামনে সে দেখেছে পরিবারের ৬ সদস্যের হত্যাকান্ড। তার ভাষ্য, ঘটনার দিন রাতে হঠাৎ গুলির শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। সেনারা তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। অন্য ঘরের জানালা দিয়ে দেখে ঘরের ভিতর কালো পোশাক পরা ১০-১২ জন সেনা। পিতা-মাতা, তিন বোন ও দুই মাসের ভাই কৃষ্ণ-এর চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে প্রথমে গুলি করে। অতঃপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একে একে তাদের গলা কেটে ফেলে। রক্তে ঘরের মেঝে ভেসে যায়। এ দৃশ্য দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে এবং তাদের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। রুশনা আরও জানায়, তার পরিবারের সদস্যদের মতো অনেক হিন্দু পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করেছে সেনারা।

(১০) ৫৫ বছরের বৃদ্ধা কানিছা খাতুন বললেন, আমরা বাংলাদেশের অবদানের কথা ভুলতে পারব না। আমরা এদেশের মানুষের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। এদেশের মানুষ আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাই দিয়েছে। এখন আমাদের কাজ হবে এই অবদানের কথা যুগ যুগ ধরে স্মরণে রাখা।

আবুল হামাদ নামে আরেকজন বললেন, এদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষ যদি আমাদেরকে খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে সহযোগিতা না করত, তাহ’লে এতদিনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ইতিহাস হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হ’ত।







হৃদরোগীদের ভরসার জায়গা সরকারী হাসপাতাল হাইপার অ্যাকিউট স্ট্রোক কেয়ার সেন্টার
চুরি রুখতে চোর নিয়োগের বিজ্ঞাপন
প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফীকুল হক-এর মৃত্যু
১১৬ জন আলেম ও ধর্মীয় বক্তা এবং ১০০০ মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের নিকট ঘাদানিক-এর আবেদন পেশ
পা দিয়ে বিমান চালান পাইলট
নিজেকে ঈশ্বরের দূত ও পরমাত্মার অংশ দাবি করলেন নরেন্দ্র মোদি
স্বদেশ-বিদেশ
অত্যধিক তাপমাত্রায় মারা যাচ্ছে মানুষ, পুড়ছে বনাঞ্চল; সেতু মুড়িয়ে রাখা হয়েছে ফয়েলে
ভারতে পবিত্র কুরআনের আয়াত বাতিলের আবেদন খারিজ : রিটকারীর জরিমানা
স্বদেশ-বিদেশ
সন্তানহারা এক মায়ের আকুতি (আজকে আমি নিঃসন্তান, শুধু জিপিএ ফাইভের জন্য)
সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশে সম্মানিত, ভারতে অধিকার বঞ্চিত - -ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
আরও
আরও
.