রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, তাফসীর ইবনে কাছীরের অনুবাদক, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস-এর সাবেক সহ-সভাপতি, উপমহাদেশের খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন ও মুনাযির মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ)-এর জামাতা, বহু গ্রন্থপ্রণেতা শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান গত ২৮শে ফেব্রুয়ারী দুপুর ১২-টায় ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইনতিকাল করেন। ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৬ পুত্র, ২ কন্যা, অসংখ্য ছাত্র ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ঐদিন বাদ আছর সিএমএইচ জামে মসজিদে মাইয়েতের ১ম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তাঁর পুত্র মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান ইমামতি করেন। অতঃপর বাদ এশা বংশাল বড় (আহলেহাদীছ) জামে মসজিদে তাঁর ২য় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস-এর সেক্রেটারী ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী। উক্ত জানাযায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ঢাকা-দক্ষিণ সাংগঠনিক যেলার প্রধান উপদেষ্টা আলহাজ্জ মুহাম্মাদ আহসান ও বর্তমান সহ-সভাপতি মুহাম্মাদ আযীমুদ্দীনের নেতৃত্বে ঢাকা যেলা আন্দোলন ও যুবসংঘের দায়িত্বশীলগণ যোগদান করেন। অতঃপর তাকে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর কবরের পাশে বংশাল-মালিবাগ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রফেসর ড. মুজীবুর রহমান ১৯৩৬ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জ যেলার শিবগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত বাবলাবোনা (বর্তমান রাধাকান্তপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আব্দুল গণী। তিনি শিবগঞ্জ ইসলামপুর কওমী মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর দাদনচক হাই মাদ্রাসা থেকে জুনিয়র পরীক্ষা ও রাধাকান্তপুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে আলিম পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১ম বিভাগে ফাযিল এবং ১৯৫৫ সালে একই মাদ্রাসা থেকে ১ম বিভাগে ৮ম স্থান অধিকার করে কামিল পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামে‘আ সালাফিইয়াহ লায়ালপুর (ফয়ছালাবাদ) থেকে তাকমীল বা দাওরায়ে হাদীছ সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে তিনি এম.ও.এল (Masters of Oriental Languages) ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে এম.এ পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন।
১৯৬২ সালে দেশে ফিরে পিতার কর্মস্থল হাই মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি চাঁপাই নবাবগঞ্জ সরকারী ডিগ্রী কলেজে আরবী ও উর্দূ বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২৫.৮.১৯৮৪ থেকে ২৪.৮.১৯৮৭ পর্যন্ত তিনি রাবির আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। যেটি ১৯৮৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি মক্কার উম্মুল ক্বোরা ও মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, লাহোর ও ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৯৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রফেসর’ হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি একই সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকায় চলে যান এবং নিউইয়র্কের ইসলামিক এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রায় ২৬ বছর যাবৎ আমেরিকায় অবস্থান করেন। ২০২১ সাল থেকে তিনি দেশেই অবস্থান করছিলেন।
তাঁর অনূদিত তাফসীর ইবনে কাছীর ও বঙ্গানুবাদ কুর‘আনুল কারীম যথেষ্ট জনপ্রিয়। যা দারুস সালাম, রিয়াদ প্রকাশনী থেকে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচনায় সাবলীলতা ও সহজবোধ্যতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নিভৃতচারী এই শিক্ষাবিদের রচিত ও অনূদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল, মাযামীনে মুজীব (উর্দূ প্রবন্ধ সংকলন, নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত), কুরআনের চিরন্তন মু‘জিযা (ইফাবা), মিসরের ছোট গল্প (অনুবাদ), ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর সংস্কার পরিকল্পনা (অনুবাদ), মদীনার আনসার ও হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী, সাহাবী কবি কা‘ব ও তাঁর অমর কাব্য বানাত সু‘আদ, মুহাদ্দিস প্রসঙ্গ, ইসলামের আদি যুগের একটি পরিবার, ইমাম বুখারী (রহঃ), ইমাম মুসলিম (রহঃ), ভারতীয় আরবী তাফসীর ও তাফসীরকার (অনুবাদ), আরবী সাহিত্যের ইতিহাস (অনুবাদ), মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (জীবনী) প্রভৃতি।
[তাঁর মৃত্যুতে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব গভীর শোক প্রকাশ করেন ও তাঁর পরিবার ও সন্তান-সন্তুতিদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, তিনি ছিলেন একজন সহজ-সরল ও নিরহংকার আলেম। তিনিই বিভাগীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশক্রমে ১৯৭৯ সালের ৩১শে অক্টোবর সাতক্ষীরায় আমার গ্রামের বাড়ীতে ও ৭৯, উত্তর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ার ঠিকানায় স্বহস্তে পত্র লিখে আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য পত্র লিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এদেশের আহলেহাদীছ জামা‘আত একজন শিক্ষাবিদকে হারালো।মহান আল্লাহ তাঁর গুনাহখাতা মাফ করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দান করুন- আমীন!- সম্পাদক]