ভূমিকা : ইসলাম কেবল কিছু ব্যক্তিগত জীবনাচরণের নাম নয়, কিছু ইবাদত আর আদবের সমষ্টি নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের দিক-নির্দেশনা বিদ্যমান। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনাই হিকমতপূর্ণ এবং সুশৃংখল। দুর্ভাগ্যজনক হ’ল, পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসনে ইসলামী খেলাফত পরবর্তী মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে নেতৃত্বের বিরাট সংকট তৈরী হয়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতে ইসলামের সামাজিক শাসন-অনুশাসন, সামাজিক শৃংখলা, নেতৃত্ব-আনুগত্য সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলের মাঝে সংশয়, হতাশা ও নৈরাশ্যের এক দীর্ঘ ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে। ফলে ইসলামের সামাজিক দর্শন সম্পর্কে তাদের মধ্যে তৈরী হয়েছে অস্পষ্ট ধারণা। দানা বেঁধেছে সীমাহীন তর্ক-বিতর্ক। ছড়িয়েছে অনৈক্যের ডালপালা। একেকজন একেক আঙ্গিক থেকে ফৎওয়া দিয়ে, কখনও দায়িত্বহীন মন্তব্য প্রকাশ করে জনমনে তৈরী করেছেন চরম বিভ্রান্তি। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা এবং এ ব্যাপারে জনসাধারণের কাছে সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছানোর নিমিত্তে আমরা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নির্দেশনা জামা‘আতবদ্ধ জীবন এবং এতদসম্পর্কীয় একটি বিধান বায়‘আত বা শপথ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন-১ : ইসলামে জামা‘আত বলতে কী বুঝায়?
উত্তর : الجماعة শব্দটির উৎপত্তি হ’ল الجمع মূলধাতু থেকে, যার অর্থ কোন জিনিসকে একত্রিত করা।[1] রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ بِجَوَامِعِ الْكَلِمِ ‘আমি ব্যাপকার্থবোধক বাক্যসমূহ সহকারে প্রেরিত হয়েছি’।[2] الجماعة অর্থ বহু সংখ্যক মানুষ অথবা এমন এক দল মানুষ যারা একক লক্ষ্যে সংগঠিত।[3] এর দ্বারা মূলতঃ একটি ঐক্যবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ দল উদ্দেশ্য। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, জামা‘আত হ’ল একতা, যা বিচ্ছিন্নতার বিপরীত। তবে একটি ঐক্যবদ্ধ দলের জন্যই জামা‘আত শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[4] এই অর্থেই আরবী الإجماع শব্দটি এসেছে, যার অর্থ ঐক্যমত পোষণ করা। কোন মাসআলায় আলেমদের ঐক্যমতকে الإجماع বলা হয়।
পারিভাষিক অর্থে জামা‘আত শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্বাবারী পূর্বসূরীদের বেশ কিছু অভিমত একত্রিত করেছেন। আর তা হ’ল- (১) মুসলমানের মধ্যে বড় দল। (২) ফিরক্বায়ে নাজিয়ার মানহাজ তথা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের গৃহীত নীতির অনুসারী ইমাম ও বিদ্বানগণ। (৩) ছাহাবীগণ। (৪) কোন শারঈ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণকারী বিদ্বানগণ। (৫) মুসলমানদের জামা‘আত, যখন তারা কোন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়(الجماعة جماعة المسلمين إذا اجتمعوا على أمير)।[5] ইমাম শাত্বেবীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।[6] হাদীছে এর প্রতিটি অর্থই পাওয়া যায়। তবে উপরোক্ত মতামতগুলি একত্রিত করলে জামা‘আত শব্দের মৌলিক দু’টি অর্থ দাঁড়ায়[7], তা হ’ল-
(১) এমন হক্বপন্থী জামা‘আত (جماعة السنة أو جماعة الحق), যেটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা হকের অনুসারী এবং বিদ‘আত পরিত্যাগকারী। এটা হ’ল সত্য পথ, যার উপর পরিচালিত হওয়া এবং যার অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। এটাই হ’ল ছাহাবীগণ এবং তাদের পথের অনুসারীদের গৃহীত নীতি ও মানহাজ, যা ‘মা আনা আলাইহে ওয়া আছহাবিহী’ [আমি (মুহাম্মাদ) ও আমার ছাহাবীগণ যে নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত]-এর সঠিক রূপ। এই দলের অনুসারীর সংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক, এদেরই অনুসরণ অপরিহার্য। জামা‘আতের এই সংজ্ঞা হকের অনুসরণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,إِنَّمَا الْجَمَاعَةُ مَا وَافَقَ طَاعَةَ اللهِ وَإِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ، ‘জামা‘আত হ’ল যা আল্লাহর আনুগত্যশীল হয়, যদিও তুমি একাকী হও না কেন’।[8]
(২) এমন ক্ষমতাশীল জামা‘আত (جماعة التمكين), যেটি কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালিত একজন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। যাতে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকা অপরিহার্য এবং তা থেকে বেরিয়ে আসা নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য যে, সুন্নাতবিরোধী কোন ঐক্য এখানে ধর্তব্য নয়। যেমন খারেজী, মু‘তাযিলা ও অন্যান্য দলসমূহ। এই সংজ্ঞাটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহর বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত।[9] যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জামা‘আতবদ্ধ জীবনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে বলেন,عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ، ‘তোমাদের উপর জামা‘আতবদ্ধ জীবন অপরিহার্য এবং বিচ্ছিন্ন জীবন থেকে দূরে থাক’।[10] তিনি বলেন, الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন
হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’।[11]
মোদ্দাকথা উপরোক্ত সংজ্ঞাদ্বয় থেকে বোঝা যায় যে, জামা‘আত শব্দের মধ্যে মৌলিক কিছু উপাদান থাকা আবশ্যক। যেমন তাতে একতাবদ্ধ বহু সংখ্যক মানুষ থাকবে। তা দুনিয়াবী ফিৎনা, ভ্রষ্টতা ও ধ্বংস হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করবে এবং তা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবে। একজন মুসলিমের জন্য ফিৎনা থেকে আত্মরক্ষার্থে উপরোক্ত দুই ধরনের জামা‘আত অবলম্বন করাই যরূরী।
উল্লেখ্য যে, সামাজিক অর্থে ‘জামা‘আত’ বলতে বুঝায় বিচ্ছিন্ন জনতা একটি বিশেষ লক্ষ্যে একজন নেতার অধীনে সংঘবদ্ধ হওয়া। জামা‘আত গঠনের প্রধান শর্ত হ’ল নেতৃত্ব ও আনুগত্য। মসজিদ ভর্তি মুছল্লী থাকলেও যদি ইমাম না থাকে, তাকে যেমন জামা‘আত বলা হয় না। তেমনি মুক্তাদীবিহীন ইমামকেও ‘ইমাম’ বলা হয় না। মুসলিম উম্মাহকে সর্বদা জামা‘আতবদ্ধ হয়ে সুশৃংখল জীবন যাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি তিনজনে একটি সফরে বের হ’লেও সেখানে একজনকে ‘আমীর’ বা নেতা হিসাবে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামা‘আতে ছালাত হ’ল জামা‘আতবদ্ধ জীবনের দৈনন্দিন প্রশিক্ষণের অংশ। জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা মানুষের স্বভাবধর্ম। একে অস্বীকার করা চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার ন্যায়।
১৯২৪ সালে ইসলামী খেলাফত বিলুপ্ত হওয়ার পর মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের পথ যখন রুদ্ধপ্রায়, সেই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে মুসলমানদের টিকে থাকতে হ’লে মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসরণের ভিত্তিতে যে কোন মূল্যে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা অপরিহার্য। নতুবা একবিংশ শতাব্দীর নব্য জাহেলী যুগে বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অসম্ভব। এই জামা‘আত যদি রাষ্ট্রীয় জামা‘আত হয়, তবে সেটাই সর্বোত্তম, যা হবে জামা‘আতে আম্মাহর স্থলাভিষিক্ত (الدولة الاسلامية)।
আর যদি জামা‘আতে আম্মাহ না থাকে, তবে জামা‘আতে খাছ্ছাহ বা বিশেষ জামা‘আত বা সংগঠন কায়েমের মাধ্যমে সর্বাবস্থায় আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার তথা ‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ’-এর দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَّدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে-ইমরান ৩/১০৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَحِلُّ لِثَلاَثَةٍ يَكُونُونَ بِفَلاَةِ مِّنْ الْأَرْضِ إلاَّ أَمَّرُوا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ- وَقَالَ : إذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِي سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوْا أَحَدَهُمْ- ‘কোন তিনজন ব্যক্তির জন্যেও কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা হালাল নয় তাদের মধ্যে একজনকে ‘নেতা’ নিযুক্ত না করা পর্যন্ত’।[12] তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের তিনজন যখন সফরে বের হবে, তখন তাদের মধ্যে একজনকে যেন নেতা নির্বাচন করে’।[13]
এজন্য ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, يَجِبُ أَنْ يُعْرَفَ أَنَّ وِلاَيَةَ أَمْرِ النَّاسِ مِنْ أَعْظَمِ وَاجِبَاتِ الدِّينِ، بَلْ لاَ قِيَامَ لِلدِّيْنِ وَلاَ لِلدُّنْيَا إِلاَّ بِهَا، فَإِنَّ بَنِي آدَمَ لاَ تَتِمُّ مَصْلَحَتُهُمْ إلاَّ بِالْاِجْتِمَاعِ لِحَاجَةِ بَعْضِهِمْ إلَى بَعْضٍ وَلَا بُدَّ لَهُمْ عِنْدَ الِاجْتِمَاعِ مِنْ رَأْسٍ، ‘এটি জেনে রাখা ওয়াজিব যে, নেতা নির্ধারণ করা দ্বীনের বড় ওয়াজিব সমূহের অন্যতম। বরং নেতৃত্ব ছাড়া দ্বীন ও দুনিয়ার কোন অস্তিত্বই থাকে না। কেননা মানব সম্প্রদায় তাদের পরস্পরের প্রয়োজন সমূহ পূর্ণ করতে পারে না, সমাজ ব্যতীত। আর অবশ্যই সমাজের জন্য একজন নেতা প্রয়োজন। অতঃপর তিনি বলেন,فَأَوْجَبَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَأْمِيرَ الْوَاحِدِ فِي الِاجْتِمَاعِ الْقَلِيلِ الْعَارِضِ فِي السَّفَرِ تَنْبِيهًا بِذَلِكَ عَلَى سَائِرِ أَنْوَاعِ الِاجْتِمَاعِ، ‘সফরের সাময়িক ও অল্প সংখ্যক সাথীদের মধ্যেও একজনকে নেতা নির্বাচনের আদেশ দানের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ) সমাজের অন্য সকল ক্ষেত্রে নেতা নির্বাচন ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে উম্মতকে তাকীদ করেছেন’।[14]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,اَلْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ، ‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট উত্তম ও অধিকতর প্রিয়, দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[15] নিঃসন্দেহে একক ব্যক্তির চাইতে সংগঠিত একদল মানুষ অবশ্যই শক্তিশালী এবং আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের জন্য যা অবশ্যই যরূরী। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জামা‘আত যত বড় হবে, আল্লাহর নিকট সেটি তত প্রিয় হবে’।[16] যেমন মুহাজির ও আনছারগণের ঐক্যবদ্ধ জামা‘আতের মাধ্যমে মদীনায় বৃহত্তর ইসলামী খেলাফত কায়েম হয়। আধুনিক যুগে জামা‘আতে খাছছাহর আমীর ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (১১১৫-১২০৬ হি./১৭০৩-১৭৯১ খৃ.)-এর নিকটে ১৭৪৪ সালে দির‘ইইয়ার শাসক মুহাম্মাদ বিন সঊদ (১৬৯৭-১৭৬৫ খৃ.)-এর বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে বৃহত্তর সঊদী ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি রচিত হয়। যা দির‘ইইয়ার বায়‘আত (مُبَايَعَةُ الدِّرْعِيَّةِ) নামে খ্যাত।[17]
ইমাম শাওকানী তাঁর نيل الأوطار গ্রন্থে باب وجوب نصب ولاية القضاء والإمارة وغيرهما، (বিচারক, আমীর প্রভৃতি নিয়োগ অপরিহার্য) শিরোনামে অধ্যায় রচনা করে লিখেছেন, وفيها دليل على أنه يشرع لكل عدد بلغ ثلاثة فصاعدا أن يؤمروا عليهم أحدهم؛ لأن في ذلك السلامة من الخلاف الذي يؤدي إلى التلاف، فمع عدم التأمير يستبد كل واحد برأيه ويفعل ما يطابق هواه فيهلكون، ومع التأمير يقل الاختلاف وتجتمع الكلمة، وإذا شرع هذا لثلاثة يكونون في فلاة من الأرض أو يسافرون فشرعيته لعدد أكثر يسكنون القرى والأمصار ويحتاجون لدفع التظالم وفصل التخاصم أولى وأحرى ‘(মুসাফির অবস্থায় তিন জনের জামা‘আত গঠন) এটা ইঙ্গিত করে যে, তিন বা ততোধিক যত সংখ্যায় হোক না কেন, তাদের উপর একজনের নেতৃত্ব থাকবে। কেননা এতে মতভেদ থেকে নিরাপদ থাকা যায়, যা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। আর যদি নেতা না থাকে, তবে প্রত্যেকে নিজ মতে অটল থাকবে এবং নিজের খেয়াল-খুশী মত কাজ করবে। ফলে তারা ধ্বংস হবে। একজন নেতা নিয়োগের মাধ্যমে এই মতভেদ কমে যায় এবং একতা সৃষ্টি হয়। তিনজনের ক্ষেত্রে শরী‘আত যদি নেতৃত্ব নির্বাচনকে অপরিহার্য করে, তবে কোন গ্রামে বা শহরে তা নির্বাচন করা অধিকতর শরী‘আতসম্মত এবং পারস্পরিক যুলুম -নির্যাতন ও বিবাদ-বিসম্বাদ মেটাতে অধিকতর আবশ্যক’।[18]
সুতরাং ইসলামে জামা‘আত একটি সার্বজনীন পরিভাষা, যা ইসলামী খেলাফত, ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী সংগঠন সর্বক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোতাবেক প্রযোজ্য হ’তে পারে, যদি তা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালিত হয়। ইসলামী সমাজকে সুশৃংখল রাখতে যা ইসলামের একটি সুস্পষ্ট হেদায়াত।
প্রশ্ন-২ : বর্তমানে প্রচলিত ইসলামী সংগঠনসমূহ কি ইসলামী জামা‘আত? ইসলামী খেলাফত ও ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে সংগঠন কি হাদীছে বর্ণিত ইসলামী জামা‘আতের দায়িত্ব পালন করতে পারে?
উত্তর : ফিৎনার যুগেও নিজের ঈমান ও আমলকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য রাসূল (ছা.) জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার জন্য বলেছেন। যেমন : ছহীহুল বুখারী ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থের ‘ফিতান’ অধ্যায়ে বহু ফিৎনার সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং সেসব ফিৎনা থেকে বাঁচার এই উপায় বলা হয়েছে যে, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘তুমি মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে’। এটিই হ’ল ফিৎনার সময় রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ অছিয়ত।
ইসলামী খেলাফত পরবর্তী বিশ্বে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিদ্বানগণ ৩ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (১) دار الكفر (অমুসলিম বা কাফির রাষ্ট্র) (২) دار المسلمين (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র), (৩) دار الإسلام (ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র)। কোন স্থানে প্রকৃত দারুল ইসলাম থাকলে সেখানে উক্ত ইসলামী রাষ্ট্রই মুসলিম জামা‘আত। যেমন সঊদী আরব। আর দারুল ইসলাম না থাকলে কাফির বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বিকল্প হিসাবে সাধ্যমত বিশেষ জামা‘আত গঠনের মাধ্যমে জামা‘আতবদ্ধভাবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যেতে হবে। এই সাংগঠনিক জামা‘আত কাঠামোগতভাবে জামা‘আতে খাছ্ছাহ বা বিশেষ পরিসরে গঠিত জামা‘আত। এজন্য এসকল জামা‘আত প্রয়োজনে একাধিক থাকতে পারে। এই জামা‘আতগুলোকে বিদ্বানগণ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ বা جَمَاعَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ বলেন।
অতএব জামা‘আতে আম্মাহর অনুপস্থিতিতে ক্ষুদ্রতর জামা‘আত গুলোই جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ-এর স্থলাভিষিক্ত হবে এবং সাধ্যমত শারঈ বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করবে। তবে এই জামা‘আতের আমীরগণ যেহেতু বৃহত্তর রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনস্থ থাকেন, তাই তারা হদ্দ বাস্তবায়ন করবেন না। কেননা এতে বিশৃংখলা তৈরী হবে।[19]
সঊদী আরবের স্থায়ী ফৎওয়া বোর্ডসহ বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা বিদ্বানগণ প্রচলিত আহলেহাদীছ সংগঠনগুলোকে جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এবং জনসাধারণকে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও মানহাজের উপর টিকে থাকার জন্য সালাফী সংগঠনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।[20] যেমন সুদানের সালাফী সংগঠন আনছারুস সুন্নাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই সংগঠনটি মতবাদবিক্ষুব্ধ এই সমাজে সত্যিই ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে।[21]
শায়খ বিন বায (রহ.) বলেন, أن الواجب على المسلم لزوم جماعة المسلمين، والتعاون معهم في أي مكان سواء كانت جماعة وجدت في الجزيرة العربية، أو فيمصر، أو في الشام، أو في العراق، أو في أمريكا، أو في أوربا، أو في أي مكان ,فمتى وجد المسلم جماعة تدعو إلى الحق ساعدهم وصار معهم، وأعانهم وشجعهم وثبتهم على الحق والبصيرة، فإذا لم يجد جماعة بالكلية فإِنه يلزم الحق: وهو الجماعة، ولو كان واحدًا، ‘কোন মুসলিমের উপর ওয়াজিব হ’ল, جماعة المسلمين বা মুসলমানদের জামা‘আতের সাথে সম্পৃক্ত থাকা এবং যেখানে থাকুক তাদেরকে সহযোগিতা করা। হোক তা সঊদী আরবে বা মিসরে, শামে কিংবা ইরাকে, আমেরিকা কিংবা ইউরোপে অথবা যেখানেই হোক। যখনই একজন মুসলিম এমন কোন জামা‘আতের সন্ধান পাবে যারা হক্বের দিকে আহবান জানায়, তার উচিত হবে সেই জামা‘আতকে সহযোগিতা করা, তাদের সাথে থাকা, তাদেরকে সাহায্য করা, অনুপ্রাণিত করা, তাদেরকে সত্য ও প্রজ্ঞার উপর কায়েম থাকার জন্য সহায়তা করা। আর যদি কোন প্রকারের জামা‘আতই খুঁজে না পায়, তবে সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। যদিও সে একাই হোক না কেন’।[22]
তিনি অন্যত্র বলেন, جماعة المسلمين هم الملتزمون بأمر الله، العاملون بكتاب الله وسنة رسوله عليه الصلاة والسلام، هؤلاء هم جماعة المسلمين في أي مكانٍ ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন হ’ল ঐ জামা‘আত, যা আল্লাহর নির্দেশ পালন করে, আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর উপর আমল করে। প্রতিটি স্থানে তারাই হ’ল ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’। তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বলেন,فجماعة المسلمين هم الملتزمون بالإسلام، السَّائرون على نهج النبي عليه الصلاة والسلام، ولو كانوا قليلين، في أي طرفٍ من الأرض، في أي بقعةٍ، فالجماعة الملتزمة في أمريكا هم جماعة المسلمين، والملتزمة في لندن هم جماعة المسلمين، والملتزمة في فرنسا مثلًا أو هولندا أو كذا هم الجماعة، وهكذا الجماعة الملتزمة في أي مكانٍ: في الجزيرة العربية، في مصر، في الشام، في إندونيسيا. المقصود مَن التزم بأمر الله، واستقام عليه، ودعا إليه؛ هؤلاء هم الجماعة الملتزمة، تلزمهم وتُكثِّر سوادهم أينما كنتَ، في الجهة التي أنت فيها،. ‘অতএব জামা‘আতুল মুসলিমীন হ’ল, যেই জামা‘আত ইসলামকে ধারণ করে। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে চলে। যদিও তারা সংখ্যায় কম হোক না কেন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, যে কোন ভূখন্ডেই হোক না কেন। অতএব অনুরূপ যে জামা‘আত আমেরিকায় রয়েছে, তারা সেখানকার জামা‘আতুল মুসলিমীন, যে জামা‘আত লন্ডনে রয়েছে, তারা সেখানকার জামা‘আতুল মুসলিমীন, অনুরূপই ফ্রান্স, হল্যান্ডেও। তদ্রূপই সঊদী আরব, মিসর, সিরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার জন্য প্রযোজ্য। মূলকথা, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ জামা‘আত, যা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে, তার উপর টিকে থাকে এবং তার দিকেই মানুষকে আহবান করে। অতএব উচিৎ হবে যে, তাদের সাথে সম্পৃক্ত হৌন; যেখানেই থাকেন, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন’।[23]
অন্যত্র তিনি বলেন, هذا أمره ﷺ عند تغير الأحوال: أن يلزم جماعة المسلمين، فالجماعة التي ترى أنها أقرب إلى الحقِّ وأقرب إلى الهدى تلزمها وتُعينها، ولو كان فيها نقصٌ، ولو كان فيها أخطاء، تُعينها على الصواب، وتُرشدها إلى الخطأ؛ لأنها جماعة مسلمين، جماعة من المسلمين ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ হ’ল, জামা‘আতুল মুসলিমীনকে আঁকড়ে ধরা। যে জামা‘আতকে দেখা যাবে যে, হক্বের দিকে বেশী নিকটবর্তী, সঠিকপথের অধিক অনুগামী সে জামা‘আতকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং সহযোগিতা করতে হবে। যদিও তার মধ্যে কিছু ঘাটতি, কিছু ভুল থাকুক না কেন। যদি তারা সঠিক কাজ করে, তবে সহযোগিতা করতে হবে। যদি কোথাও ভুল করে, সঠিক পরামর্শ দেবে। কেননা তা হ’ল জামা‘আতুল মুসলিমীন কিংবা মুসলমানদের একটি জামা‘আত।[24]
হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন,"فاعتزل تلك الفرق" وهل هذا الأمر على إطلاقه وأن الإنسان إذا لم يجد إماما عاما للمسلمين يجب عليه أن يعتزل؟ الظاهرلا، ‘এই হাদীছে ‘সমস্ত দলসমূহকে ত্যাগ করা’র অর্থ কি এই যে, মুসলিম সমাজে একজন সার্বজনীন ইমাম না থাকলে বাকি দলগুলিকে ত্যাগ করতে হবে? এটা স্পষ্ট যে, এ কথা সঠিক নয়’। অতঃপর তিনি বলেন, لكن على كل حال إذا كانت هذه الفرق آمنة ليس فيها تناحر فاختر ما ترى أنه أقرب إلى تحكيم شريعة الله عز وجل إذا تمكنت من ذلك ‘বরং পরিস্থিতি যাই হোক, যদি বিদ্যমান দলগুলো শান্তিপূর্ণ হয় এবং পারস্পরিক হানাহানি মুক্ত থাকে, তবে যে দলটি আল্লাহর শরী‘আত বাস্তবায়নে অধিক অগ্রসর, সেটিকে ধারণ কর; যদি তা সম্ভবপর হয়’।[25]
সর্বোপরি, মুসলমানদের প্রতি সাধারণ নির্দেশ হ’ল এই যে, তারা সর্বাবস্থায় জামা‘আতবদ্ধ থাকবে, সেটার রূপ খেলাফত হোক, কিংবা রাষ্ট্র কিংবা ইসলামী সংগঠন। আর এটাই হ’ল সেই বাস্তবতা যার ঘোষণা দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট শব্দে দিয়েছিলেন যে,لاَ إِسْلاَمَ إِلاَّ بِجَمَاعَةٍ، وَلاَ جَمَاعَةَ إِلاَّ بِإِمَارَةٍ، وَلاَ إِمَارَةَ إِلاَّ بِطَاعَةٍ، ‘ইসলাম হয় না জামা‘আত ছাড়া, জামা‘আত হয় না আমীর ছাড়া এবং ইমারত হয় না আনুগত্য ছাড়া’।[26] অর্থাৎ নেতৃত্ববিহীন মুসলিম সমাজ কল্পনা করা যায় না।
(ক্রমশঃ)
গবেষণা বিভাগ, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
[1]. ইবনু ফারেস, মু‘জামু মাক্বায়ীসীল লুগাহ, ১/৪৭৯।
[2]. মুসলিম হা/৫২৩।
[3]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ১/১৩৫।
[4]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমু‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৭।।
[5]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৭।
[6]. الجماعة راجعة إلى الاجتماع على الإمام الموافق للكتاب والسنة (আশ-শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম, ২/২৬৩)।
[7]. ড. ছলাহ আছ-ছাভী, জামা‘আতুল মুসলিমীন, মাফহূমুহা ওয়া কায়ফিইয়াতু লুযূমিহা ফী ওয়াক্বিইনাল মুআছির (কায়রো : দারুছ ছাফওয়াহ, তাবি), পৃ. ২১।
[8]. হিবাতুল্লাহ আল-লালকাঈ, শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১/১২১।
[9]. ড. মুহাম্মাদ ইউসরী, ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ২১-২২।
[10]. তিরমিযী হা/২১৬৫।
[11]. আহমাদ হা/১৮৪৭২; ছহীহাহ হা/৬৬৭।
[12]. আহমাদ হা/৬৬৪৭।
[13]. আবুদাঊদ হা/২৬০৮।
[14]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৮/৩৯০।
[15]. মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮।
[16]. আবুদাঊদ হা/৫৫৪; নাসাঈ হা/৮৪৩; মিশকাত হা/১০৬৬।
[17]. ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন বই, পৃ. ৯৬।
[18]. শাওকানী, নায়লুল আওতার, পৃ. ৮/২৯৪।
[19]. ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন, পৃ. ৯৭।
[20]. على الشاب المسلم أن يطلب العلم النافع على العلماء المحققين، ويتمسك بالسنة، ويكون مع جماعة المسلمين السائرين على منهج السلف الصالح(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ২৫/২৪১ (ফৎওয়া নং : ১৬২৫০)।
[21]. فهي تمثل جماعة المسلمين الحقة في وسط هذه المجتمعات التي تعج بأنواع الفرق والنحل(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা, ২/৩২১ (ফৎওয়া নং : ১৬৮৭২)।
[22]. শায়খ বিন বায, মাজমু‘ ফাতাওয়া, ৮/১৭৯।
[23]. ما معنى "جماعة المسلمين" في الحديث؟ প্রশ্নের জবাবে শায়খ বিন বায (দ্র. https://binbaz.org.sa/)।
[24]. ما موقف المسلم تجاه الجماعات الإسلامية؟ প্রশ্নের জবাবে শায়খ বিন বায (দ্র. https://binbaz.org.sa/)।
[25]. ছহীহুল বুখারী, কিতাবুল ফিতান ওয়াল মালাহিম-এর ব্যাখ্যা- শায়খ ছালিহ ইবনুল উছায়মীন (দ্র. https://alathar.net/)।
[26]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, পৃ. ১/২৬৩।