উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য অনুসরণীয় হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)। অতঃপর তাঁর ছাহাবীগণ। এ কারণেই তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত দলের পরিচয় দিতে গিয়ে ما أنا عليه وأصحابي ‘আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যে পথে আছি’ উল্লেখ করেছেন (তিরমিযী, মিশকাহ হা/১৭১-১৭২)। ছাহাবায়ে কেরামের জীবনেতিহাস মুমিনদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রেরণা যুগায়। তাই তাঁদের ঘটনাবহুল জীবনী জানা প্রয়োজন। আলোচ্য নিবন্ধে অত্যন্ত মশহূর ছাহাবী আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বিধৃত হ’ল।-

নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম ‘আস‘আদ’। কুনিয়াত ‘আবূ উমামা’। পিতার নাম যুরারাহ বিন ‘উদাস। মাতার নাম সা‘আদ বিনতে রাফে‘। তার পূর্ণ নসবনাম হচ্ছে- আবূ উমামা আস‘আদ বিন যুরারাহ বিন ‘উদাস বিন ‘উবায়দ বিন ছা‘লাবাহ বিন গানাম বিন মালেক বিন নাজ্জার।[1] তিনি আস‘আদ আল-খায়র নামেও পরিচিত। কেউ কেউ তার নাম ‘আসাদ বিন যুরারাহ’ (أَسَدُ بْنِ زُرَارَةَ)ও বলেছেন। তিনি মদীনার খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। এজন্য তাঁকে খাযরাজী ও নাজ্জারীও বলা হয়।[2] তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

ইসলাম গ্রহণ : তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনুল আছীর ওয়াকেবদীর সূত্রে বলেন, আস‘আদ বিন যুরারাহ ও যাকওয়ান বিন আব্দিল ক্বায়স নিজেদের একটি বিষয় নিষ্পত্তির জন্য মক্কার কুরায়শ নেতা উতবা বিন রাবী‘আহর নিকট গমন করেন। এ সময়ে উতবাহর নিকট তারা রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে পান। অতঃপর সেখান থেকে গোপনে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাসূল (ছাঃ) তাঁদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং কুরআন মাজীদের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনান। ফলে সেখানেই তারা দু’জন ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর সেখান থেকে আর উতবাহর নিকট না গিয়ে সরাসরি তারা মদীনায় ফিরে আসেন।[3]

ইবনু ইসহাক বলেন, আস‘আদ বিন যুরারাহ একাদশ নববী বর্ষে অনুষ্ঠিত আক্বাবার ১ম বায়‘আতে অংশগ্রহণ করে ইসলাম কবুল করেন।[4] নববী ১১তম বর্ষের হজ্জের মওসুমে একরাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর ও আলীকে সাথে নিয়ে মক্কায় আগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদেরকে তাদের তাঁবুতে গিয়ে দাওয়াত দিতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা মিনার আক্বাবাহ গিরিসংকটের আলো-অাঁধারীর মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে যান। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলেন যে, তারা ইয়াছরিব থেকে হজ্জে এসেছেন এবং তারা ইহূদীদের মিত্র খাযরাজ গোত্রের লোক। তারা ছিলেন সংখ্যায় ছয়জন এবং সকলেই ছিলেন বয়সে তরুণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন। অতঃপর সেখানেই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনেন এবং পিতৃধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেন। সৌভাগ্যবান এই ৬ তরুণের নেতা ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ট বনু নাজ্জার গোত্রের আস‘আদ বিন যুরারাহ। অন্যান্যরা হ’লেন (২) একই গোত্রের ‘আওফ বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (৩) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের রাফে‘ বিন মালেক বিন আজলান (৪) বনু সালামাহ গোত্রের কুৎবা বিন ‘আমের বিন হাদীদাহ (৫) বনু হারাম গোত্রের ওক্ববা বিন ‘আমের বিন নাবী (৬) বনু ওবায়েদ বিন গানাম গোত্রের জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব (রাঃ)।[5]

মদীনায় দ্বীনের দাওয়াত ও আক্বাবার ২য় বায়‘আত : ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় ফিরে আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মত দ্বীনের দাওয়াত শুরু করেন। যে মহাসত্যের সন্ধান তিনি পেয়েছেন তা জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মদীনায় পৌঁছেই সর্বপ্রথম আবুল হায়ছামের সাথে দেখা করেন এবং তার কাছে তার নতুন বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন। আবুল হায়ছাম সাথে সাথে বলে ওঠেন, ‘তোমার সাথে আমিও তাঁর রিসালাতের উপর ঈমান আনলাম’।[6]

এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকটে তিনি দ্বীনের দাওয়াত তুলে ধরেন। তার এই নিরন্তর দাওয়াতের ফলেই পরের বছর দ্বাদশ নববী বর্ষে হজ্জের মৌসুমে নতুন আরো ৭জন সহ মোট ১২জন মক্কায় গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বায়‘আত করেন। এই বায়‘আতে গত বছরের পাঁচজন ছাড়াও এ বছর নতুন যে সাতজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হ’লেনঃ (১) বনু নাজ্জার গোত্রের মু‘আয বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (২) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের যাকওয়ান ইবনু ‘আব্দে ক্বায়েস (৩) বনু গানাম গোত্রের ‘উবাদাহ বিন ছামেত (৪) বনু গানামের মিত্র গোত্রের ইয়াযীদ বিন ছা‘লাবাহ (৫) বনু সালেম গোত্রের আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (৬) বনু ‘আব্দিল আশহাল গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রের ‘ওয়ায়েম বিন সা‘এদাহ। গত বছরের জাবের বিন আব্দুল্লাহ এ বছর আসেননি।[7] এসময়ে তারা মদীনায় দ্বীন শিক্ষাদান ও ব্যাপকভিত্তিক দাওয়াতের জন্য মক্কা থেকে একজন দাঈকে মদীনায় প্রেরণের আবেদন জানান। রাসূল (ছঃ) তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে উদ্যমী ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক মুছ‘আব বিন ‘উমায়রকে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনিই হচ্ছেন মদীনার প্রথম দাঈ।

আস‘আদ ও মুছ‘আবের ব্যাপকভিত্তিক দাওয়াত এবং আক্বাবার ৩য় বায়‘আত : মুছ‘আব বিন ‘উমায়র মদীনায় পৌঁছে আস‘আদ বিন যুরারাহর মেহমান হন। অতঃপর মুছ‘আব ও আস‘আদ দু’জনে নতুন উদ্যমে ব্যাপকভাবে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন। তারা মদীনার বিভিন্ন ব্যক্তি, পরিবার ও গোত্রের নিকট গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেন। তাদের দাওয়াত এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নববী ত্রয়োদশ বর্ষে ২জন মহিলাসহ মোট ৭৫জন ইয়াছরিববাসী মক্কার পূর্বোক্ত আক্বাবা নামক পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে ‘বায়‘আতে কুবরা’ বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনের ভিত্তি স্বরূপ। মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহর নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর প্রথম ইসলাম কবুলের বায়‘আত। ১২ নববী বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং ১৩ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত- যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের সূচনা হয়।[8] ইবনু ইসহাক বলেন, আস‘আদ বিন যুরারাহ উক্ত তিনটি বায়‘আতেই অংশগ্রহণ করেন।[9]

তাঁদের দাওয়াতের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নোক্ত ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ মুছ‘আব বিন উমায়েরকে সাথে নিয়ে বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফারের (بنو ظَفَر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসেন। তখনো পর্যন্ত বনু আব্দিল আশহাল গোত্রের দুই নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের ইসলাম কবুল করেননি। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেরে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল-সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’।

উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এখনি পালাও। তোমরা আমাদের বোকা লোকগুলিকে মুসলমান বানাচ্ছ’। মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমধ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন,مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلاَمَ وَأَجْمَلَهُ  ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর’। এরপর তিনি সেখানেই ইসলাম কবুল করলেন।

অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, فَواللهِ مَا رَأَيْتُ بِهِمَا بَأْسًا، ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি’। তবে আমি তাদের নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যান। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহর লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব নিশ্চিন্তে বসে আছে। বনু হারেছাহর হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধস্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায় এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’। আস‘আদ পূর্বেই সা‘দ ও উসায়েদ-এর বিষয়ে মুছ‘আবকে অবহিত করেছিলেন যে, এরা দু’জন মুসলমান হ’লে এদের গোত্রের সবাই মুসলমান হয়ে যাবে। আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হ’লে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’। অতঃপর তিনি বসলেন এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’লেন। অতঃপর সেখানেই দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে ফিরে আসলেন। পরবর্তীতে তার গোত্রের সকলেই ইসলাম কবুল করেন।[10]

তাঁর মর্যাদা ও বৈশষ্ট্য :  

মদীনায় জামা‘আতে ছালাত ও জুম‘আ চালু করা : আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) বয়সে তরুণ হ’লেও তার ঈমানী জাযবা ও দৃঢ়তা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তিনি মদীনার নতুন মুসলমানদের নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতে শুরু করেন এবং মদীনায় তিনিই সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত চালু করেন। মদীনার বনু বায়াযাহ গোত্রের নাক্বী‘উল খাযেমাত (نَقِيعُ الْخَضِمَاتِ) নামক স্থানের ‘নাবীত’ (هَزْمُ النَّبِيْتِ) সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর ছালাত শুরু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুছল্লী উপস্থিত ছিলেন।[11] তার এই যুগান্তকারী উদ্যোগকে স্মরণ করে সমকালীন ছাহাবীগণের অনেকেই সারা জীবন তার জন্য খাছ দো‘আ করেছেন। যেমন- আবদুর রহমান ইবনে কা‘ব বিন মালেক (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা অন্ধ হয়ে গেলে আমি ছিলাম তার পরিচালক। আমি তাকে নিয়ে যখন জুম‘আর ছালাত আদায় করতে বের হ’তাম, তখন তিনি আযান শুনলেই আবূ উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং দো‘আ করতেন। আমি তাকে ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করতে শুনে কিছুক্ষণ থামলাম, অতঃপর মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ! কি বোকামী! জুম‘আর আযান শুনামাত্রই আমি তাকে আবূ উমামাহ-এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করতে শুনি, অথচ আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করিনি? অতঃপর আমি তাকে নিয়ে একদিন জুম‘আর উদ্দেশ্যে বের হ’লাম। তিনি যখন আযান শুনলেন তখন অভ্যাস মাফিক আস‘আদ বিন যুরারাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে পিতা! জুম‘আর আযান শুনলেই আপনি আস‘আদ বিন যুরারাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, এটি কেন করেন? তিনি বললেন, বৎস! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় আসার পূর্বে তিনিই সর্বপ্রথম বনূ বায়যাহ গোত্রের প্রস্তরময় সমতল ভূমিতে অবস্থিত ‘নাক্বী‘উল খাযামাত’-এ আমাদের নিয়ে জুম‘আর ছালাত পড়েন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা তখন কতজন ছিলেন? তিনি বলেন, চল্লিশজন পুরুষ’[12] 

বনু নাজ্জার-এর নক্বীব : আক্বাবায়ে কুবরায় অংশগ্রহণকারী ৭৫ জনের মধ্য হ’তে ১২ জনকে রাসূল (ছাঃ) তাদের জন্য ‘নক্বীব’ (প্রতিনিধি) বা নেতা নির্বাচন করে দেন। তন্মধ্যে ৯ জন খাযরাজ ও ৩ জন আউস গোত্র হ’তে। আস‘আদ বিন যুরারাহ ছিলেন খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখার নক্বীব। তিনি শুধু নক্বীবই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন তাদের প্রধান।[13] তার মৃত্যুর পরে বনু নাজ্জারের লোকেরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে আবেদন করেন যে, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আস‘আদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি ছিলেন আমাদের নক্বীব। এক্ষণে আপনি আমাদের জন্য অন্য একজন নক্বীব নিযুক্ত করে দিন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা আমার মাতুল গোত্র। আমিই তোমাদের নক্বীব। আর এটি ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাকর।[14]

সাহল ও সোহাইল এর তত্ত্বাবধায়ক : রাসূল (ছাঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসার পর যে স্থানে তাঁর উটনি বসে পড়ে এবং যে স্থানটিকে তিনি মসজিদ ও বাসস্থানের জন্য নির্ধারণ করেন, সে জায়গাটির মালিক ছিল সাহল ও সোহাইল নামক দুই ইয়াতীম বালক। আর আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) ছিলেন তাদের তত্ত্বাবধায়ক। রাসূল (ছাঃ) বালক দু’টির তত্ত্বাবধায়ক আস‘আদের নিকট জমির মূল্য জানতে চাইলে বালকদ্বয় বলে ওঠে, আমরা আল্লাহর কাছে এর মূল্য চাই। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বিনা মূল্যে নিতে রাযী না হওয়ায় আবু বকর (রাঃ) জমির মূল্য পরিশোধ করেন। অবশ্য অন্য বর্ণনা মতে, আস‘আদ তার বনী বায়যায় অবস্থিত একটি বাগান মসজিদের এই জমির বিনিময়ে ইয়াতীমদ্বয়কে প্রদান করেন।[15]

রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাদ্য প্রেরণ : রাসূল (ছাঃ) হিজরতের পর আবু আইয়ূব আনছারীর বাড়ীতে অবস্থানকালে এক রাত পর পর পালাক্রমে তাঁর জন্য খাবার পাঠাতেন। আস‘আদের বাড়ী থেকে খাবার আসার পালার রাতে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আস‘আদের পাত্রটি কি এসেছ? বলা হ’ত, হ্যাঁ। তিনি বলতেন, সে পাত্রটি নিয়ে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, এর দ্বারা বুঝা যেত যে, আস‘আদের বাড়ীর খাবারটি তার নিকট পসন্দনীয় ছিল।[16]

মৃত্যু ও দাফন : এই মহান ছাহাবী অল্প বয়সে রাসূল (ছাঃ)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ১ম বছর শাওয়াল মাসে, যখন মসজিদ নববীর নির্মাণ কাজ চলছিল তখন ‘জাবহা’ নামক কণ্ঠনালীর এক প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ফারী‘আ, কাবশা ও হাবীবা নামে তিন কন্যা রাসূল (ছাঃ)-এর যিম্মায় রেখে যান।[17] রাসূল (ছাঃ) আজীবন তাদের দেখাশুনা করেন। এক মেয়েক সাহল বিন হুনাইফের সাথে বিবাহ দেন, যাদের ঔরসে আবূ উমামা বিন সাহল জন্মগ্রহণ করেন।[18] রাসূল (ছাঃ) তার জানাযার ছালাত পড়ান এবং ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ তাকে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য যে, আনছারদের মতে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে ‘বাক্বীউল গারক্বাদে’ দাফন করা হয়। তবে মুহাজিরদের মতে ‘বাক্বী’তে প্রথম দাফন করা হয় ওছমান বিন মায‘উনকে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।[19]

উপসংহার : আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) ছিলেন তরুণ, উদ্যমী ও সাহসী ছাহাবী। তিনি ছিলেন আল্লাহর পথের নিঃস্বার্থ দাঈ। ইসলাম কবুলের পর মাত্র কয়েক বছর বেঁচে থাকলেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল উম্মাতের জন্য তিনি রেখে গেছেন দাওয়াতী কাজের গভীর প্রেরণা। মদীনায় ইসলামের বীজ বপিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমেই। তাঁর নিরন্তর দাওয়াতের ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে মদীনা রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। সেকারণ প্রত্যেক দাঈর জন্য তার সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে ব্যাপক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের নিঃস্বার্থ দাঈ হিসাবে কবুল করুন-আমীন!!


[1]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ ৩য় প্রকাশ ১৯৮৫), ১ম খন্ড, পৃ: ২৯৯; আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীযিছ ছাহাবাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৩৪।

[2]. উসদুল গাবাহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৭১।

[3]. ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তাবি), ৩য় খন্ড, পৃ: ৮২; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১ম খন্ড, পৃ: ৩০২। উলেলখ্য, অধিকাংশ তারীখের কিতাবে এই বিবরণটি উদ্ধৃত হ’লেও এর বিশুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা এটি ওয়াক্বেদীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর ওয়াক্বেদী সম্পর্কে অনেকের মন্তব্য হচ্ছে ‘ওয়াক্বেদী মাতরূক’। -দ্রঃ সিয়ার, পৃ: ৩০২, টীকা ১-২।

[4]. ইছাবাহ ১/৩২ পৃ: জীবনী নং ১১১।

[5]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৫), পৃ: ২০০-২০১।

[6]. মুহাম্মদ আবদুল মা‘বুদ, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা (ঢাকা: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, পঞ্চম প্রকাশ ২০০৭), ৩য় খন্ড, পৃ: ১৪; গৃহীত: তাবাকাত ১/১৪৬ পৃ:।

[7]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ২০১-২০২।

[8]. ঐ, পৃ: ২১২।

[9]. আল-ইছাবাহ, ১/৩২ পৃ:, জীবনী নং ১১১।

[10]. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ২০৫-২০৬।

[11]. ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), পৃ: ১৮৯; গৃহীত: ইবনু মাজাহ হা/১০৮২; আবুদাঊদ হা/১০৬৯ সনদ ‘হাসান’; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৪৩৫; যা-দুল মা‘আ-দ ১/৩৬১; নায়ল ৪/১৫৭-৫৮; মির‘আত ৪/৪২০।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/১০৮২, সনদ হাসান।

[13].  সিয়ার ১/৩০২ পৃ:

[14]. ঐ, ১/৩০৩ পৃ:; মুনতাযাম ৩/৮৩ পৃ:।

[15]. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৬।

[16]. ঐ।

[17]. সিয়ার ১/৩০৩ পৃ:।

[18]. আসহাবে রাসূলের জীবন কথা ৩/১৭ পৃ:।

[19]. সিয়ার ১/৩০৩ পৃ:; মুনতাযাম ৩/৮২ পৃ:।





হোসাইন বিন আলী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারিছ (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৪র্থ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ) (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইসলামের প্রথম দাঈ, ওহোদের ঝান্ডাবাহী শহীদ ছাহাবী মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
রায়হানা বিনতু শামঊন (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়া (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
হাসান বিন আলী (রাঃ) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ (রাঃ) (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.