পায়ুপথের একটি জটিল রোগ পাইলস। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, কোষ্ঠকাঠিন্য, আঁশজাতীয় খাবার কম খাওয়া থেকে এ সমস্যা দেখা দেয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করালে রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আবার সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে পাইলস থেকে বেঁচে থাকা যায়।

অনেকে মনে করেন অপারেশনের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হ’লে তা পুরোপুরি ভালো হয় না। এ ব্যাপারে বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুল হক বলেন, রিং লাইগেশন এবং লংগো অপারেশনের মাধ্যমে প্রায় ১০০% রোগীর মলদ্বারে কোন রূপ কাটা ছেঁড়া ছাড়াই পূর্ণ চিকিৎসা করা সম্ভব।

উপসর্গ :

মলত্যাগের পর ব্যথাহীন রক্তপাত পাইলসের অন্যতম উপসর্গ। পাইলস যদি প্রথম ধাপে থাকে, তবে মলদ্বারে বাড়তি গোশতের মতো কোন কিছু থাকে না। শুধু মলত্যাগের পর রক্ত যায়।

দ্বিতীয় ধাপের পাইলসে মলত্যাগের পর তাজা রক্ত যাওয়ার পাশাপাশি মলত্যাগের পর মনে হয়, ভেতর থেকে কি যেন একটা বাইরে বেরিয়ে আসে। তবে সেটি এমনিতেই ভেতরে ঢুকে যায়।

তৃতীয় ধাপের পাইলসে মলত্যাগের পর বাড়তি গোশতের মতো বের হওয়া অংশ এমনিতেই আর ভেতরে ঢুকে যায় না; চাপ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

চতুর্থ ধাপের পাইলস হ’লে মলত্যাগের পর বাড়তি যে গোশত বের হ’ত, সেটি আর ঢুকছে না বলে মনে হয়।

অনেক সময় পাইলসের ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একে বলা হয় থ্রম্বোসড পাইলস।

হাতুড়ে চিকিৎসা :

যুগ যুগ ধরে এ জাতীয় রোগীরা প্রতারণার শিকার হয়ে আসছে। এর মূল কারণ শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক ও সচেতনতার অভাব। অনেক হাতুড়ে চিকিৎসক আছেন যারা বিনা অপারেশনে চিকিৎসার নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। দেশের অজস্র মানুষ এসব চিকিৎসকদের খপ্পরে পড়ে আজীবনের জন্য মলদ্বার ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।

এদের অনেকে মলদ্বারে বিষাক্ত কেমিক্যাল ইনজেকশন দিচ্ছেন, যাতে মলদ্বারে মারাত্মক ব্যথা হয় এবং মলদ্বারের আশপাশে পচন ধরে এবং এজন্য রোগী অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা ভোগ করেন। পরিণামে কারও কারও মলদ্বার সরু হয় এবং বন্ধ হয়ে যায়। তখন পেটে মলত্যাগের বিকল্প পথ করে দিয়ে ব্যাগ লাগিয়ে দিতে হয়। আবার কোন কোন হাতুড়ে চিকিৎসক বিষাক্ত কেমিক্যাল পাউডার দেন, যা মলদ্বারে লাগালেও মলদ্বার পচে ঘা হয়ে যায় এবং রোগীর একই পরিণতি হয়।

রোগীরা যখন বিনা অপারেশনের কথা শোনেন তখন এ জাতীয় চিকিৎসার জন্য খুবই প্রলুব্ধ হন। তিনি যখন প্রতারণার

শিকার হন তখন আর তার কিছুই করার থাকে না।

চিকিৎসা :

পাইলসের ধরন বা উপসর্গের ওপর এর চিকিৎসা নির্ভর করে। অস্ত্রোপচার করতে হবে কি-না, তা পরীক্ষা করে চিকিৎসক নির্ধারণ করে থাকেন।

প্রথম ধাপের পাইলসের শুরুতেই রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের রোগীকে পায়খানা স্বাভাবিক করার জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি ও পানি পান করতে হবে।

কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে মল নরম করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে। যদি ওষুধে কাজ না হয়, তখন বেন্ডিং বা সেক্লরো থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। যেমন রিং লাইগেশন, ইনজেকশন ইত্যাদি।

দ্বিতীয় ধাপের পাইলসেও অস্ত্রোপচারের দরকার নেই। তবে এক্ষেত্রে কিছু আধুনিক চিকিৎসার সহায়তা নেওয়া হয়।

তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের পাইলসে অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। আধুনিক স্টেপলড হেমোরয়ডেকটমিতে বাইরে কোন কাটাছেঁড়া হয় না, মলত্যাগের পর ড্রেসিং করারও প্রয়োজন হয় না। সাত দিন পর থেকেই রোগী স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারেন।

তবে কারও যদি মলদ্বার একদম বাইরে বের হয়ে আসে এবং ইনফেকশন থাকে। তবে ওপেন হেমোরয়ডেকটমি বা ক্লোজ হেমোরয়ডেকটমি করতে হবে।

সবমিলিয়ে পাইলসের প্রচলিত চিকিৎসাগুলো হ’ল : (১) ব্যান্ড লাইগেশন : এর মাধ্যমে পাইলসের উপরে একটি ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হয়, এর ফলে পাইলসের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাইলস ও ব্যান্ড ঝরে পড়ে যায়। (২) ইনজেকশন এবং ইনফ্রারেড : যদি পাইলস মলদ্বারের বাইরে বের হয়ে না আসে সেসব ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা করা হয়, যে চিকিৎসা সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত। (৩) অপারেশন পদ্ধতি : অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে আরামদায়কভাবে পাইলস সম্পূর্ণ কেটে নিয়ে আসা হয়। (৪) লংগো অপারেশন : এই পদ্ধতিতে একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পাইলস কেটে নিয়ে আসা হয়। এই অপারেশনের পর রক্তপাত বা পাইলস বের হয়ে আসে না। অপারেশনের ৩-৪ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক কাজ করা যায়।

যেসব খাবারে পাইলসের সমস্যা বৃদ্ধি পায় :

এমন কিছু খাবার রয়েছে, যেগুলো পাইলস রোগের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন :

মরিচ : শুকনো মরিচ তো বটেই, পাইলস হ’লে কাঁচা মরিচও এড়িয়ে চলা উচিত। অন্যথা বাড়তে পারে এই সমস্যা। বিশেষ করে যাদের পাইলসের কারণে প্রদাহ হয়, বেশি ঝাল খেলে তাদের ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।

আইসক্রিম : এটি পাইলসের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে মল শক্ত হয়ে যায়।

ময়দা দিয়ে বানানো খাবার : এই জাতীয় খাবারে ফাইবারের পরিমাণ খুব কম থাকে। তাই ময়দা দিয়ে বানানো খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এক্ষেত্রে আটার খাবার তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।

মাছ ও ডিম : সবার ক্ষেত্রে না হ’লেও কোন কোন পাইলস রোগীর ক্ষেত্রে মাছ এবং ডিম সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

ভাজা খাবার : অতিরিক্ত ভাজা খাবার, জাংক ফুড এবং বেশী তেল আছে, এমন খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না। এতে শরীরে পানির অভাব হয়। আর মলও শক্ত হয়ে যেতে পারে। তাতে পাইলসের সমস্যা মারাত্মক আকার নিতে পারে।

গরুর গোশত : পাইলস হ’লে গরুর গোশত একেবারে খাওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে হোয়াইট মিট বা মুরগির গোশত খাওয়া যেতে পারে। সেটাও পরিমিত মাত্রায়।

গরম মশলা : যে সমস্ত খাবারে গরম মশলা বেশী থাকে, পাইলস রোগীদের সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এগুলো পাইলসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। ফলে চিকিৎসায় ফল পেতেও দেরি হয়। কাজেই সুস্থ থাকতে চাইলে খাবারে একটু লাগাম টানতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

পাইলস থেকে রেহাই পেতে যেসব খাবার উপকারী :

পুষ্টিবিদদের মতে, ফাইবার সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি পাইলস এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের দারুণ কাজে আসে। আর মৌসুমী রঙিন ফল ডায়েট লিস্টে রাখতে হবে।

পাইলস রোগে যেহেতু মলত্যাগে সমস্যা হ’তে দেখা যায় এবং সঙ্গে কখনও রক্তপাত হয়, তাই এসব রোগীদের খালি পেটে সকালে ইসবগুল খাওয়া যরূরী।

খাবারে প্রাধান্য দিতে হবে ঢেঁকি ছাটা চাল, লাল আটা, শস্যজাতীয় খাবার আর বিভিন্ন প্রজাতির ডাল। এ ধরনের রোগীদের প্রতিদিন কমপক্ষে তিন লিটার পানি খাওয়া উচিত।

শরীরে তরলের ভারসাম্য ঠিক রাখতে তেল চর্বিযুক্ত খাবার, ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলতে হবে। বরং এর পরিবর্তে বেছে নিতে হবে বিভিন্ন ফলের জুস, ওটস ও টকদইকে।

রাতে ভাতের বদলে খেতে হবে লাল আটার রুটি। তাছাড়া পাইলস রোগীদের ক্ষেত্রে কলা, খেজুর, কিশমিশ, আলুবোখারা, নাশপাতি, আপেল, বার্লি, মিষ্টি আলুও কার্যকরী হ’তে পারে।

\ সংকলিত \






আরও
আরও
.