সঊদী আরব থেকে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে উদ্ধার হওয়া ইরানীরা। বিমানে যার যার আসনে বসে আছেন সবাই। তখনই সেখানে হাযির সঊদী আরবের এক শীর্ষ কমান্ডার। বিমানে থাকা ইরানীদের উষ্ণ বিদায় জানালেন তিনি। শোনালেন ভ্রাতৃত্বের কথা। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৯শে এপ্রিল জেদ্দায়। সঊদী পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক কমান্ডার মেজর জেনারেল আহমাদ আদ-দাবাইসের সঙ্গে ছিলেন সঊদীতে ইরানী উপরাষ্ট্রদূত হাসান জারাঙ্গার। এসময় আহমাদ আদ-দাবাইস বলেন, ‘এটা এখন আপনাদের দেশ। যদি সঊদীতে কিছু প্রয়োজন পড়ে, আপনাদের স্বাগতম। কোন শঙ্কা নেই।
এর আগে সুদান থেকে ৬৫ জন ইরানীকে উদ্ধার করা হয়েছিল। লোহিত সাগরের তীরবর্তী শহর জেদ্দায় ফুলের তোড়া দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছে সঊদী সামরিক বাহিনী।
বিমানে দাবাইস বলেন, ইরানী উদ্বাস্ত্তদের সসম্মানে আশ্রয় দিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং বাদশাহ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সেদিন ইরানীদের প্রতি সঊদীরা যে উষ্ণ আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, মাস কয়েক আগেও তা ছিল অকল্পনীয়। তারা ছিল তখন পরস্পরের শত্রু দেশ। আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে দু’দেশের মধ্যকার তিক্ততা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকটি ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যাতে ব্যাপক প্রাণহানি, রক্তক্ষয় ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটেছে। কিন্তু সাত বছরের বৈরী সম্পর্ক চীনের মধ্যস্থতায় মিটিয়ে ফেলেছে তারা। এমনকি অল্প সময়ের মধ্যেই পরস্পরের রাজধানীতে দূতাবাস খুলবে দেশ দু’টি।
এতদিন যে দেশটি চলেছে আমেরিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সেই দেশটিই যেন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আপন স্বকীয়তায়। যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বের হয়ে উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের নিয়ে নতুন বলয় গড়ার চেষ্টা করছে দেশটি। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে রয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তি। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের তালিকায় যোগ হয়েছে কাতার ও বাহরাইন। গত ১২ই এপ্রিল কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে দেশ দু’টি।
সবকিছু মিলিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগের যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে এসেছে সঊদী আরব। দেশটি তার বৈশ্বিক ভাবমর্যাদা নতুন করে গড়তে চায়। সাবেক শত্রুদের সঙ্গে একে একে ঝগড়া মিটিয়ে নিচ্ছে রিয়াদ। ফলে একাট্টা মুসলিম বিশ্বের স্বপ্ন যেখানে ছিল অধরা, সেখানে ইরানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি, সিরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা ও ইয়ামনে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে বাদশাহ সালমানের পদক্ষেপগুলো হচ্ছে প্রশংসিত।
কেবল দ্বন্দ্বের অবসানই না, শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে চায় সঊদী আরব। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সেই সংকল্পের কথা জানিয়েছে দেশটি। গেল এক দশকেরও অধিক সময় ধরে সঊদী পররাষ্ট্রনীতি ছিল দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময়। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সঊদীর পরিচয় ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ হিসাবে। এ সময়ে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেও দেখা গেছে রিয়াদকে।
সঊদীর সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে নতুন এক পররাষ্ট্রনীতির দেখা মিলছে। এজন্য মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করতে কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটি। যেমন উত্তরপূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে দুই জেনারেলের অনুগত বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। উভয় জেনারেলই দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত কয়েক হাযার মানুষ হতাহত হয়েছেন। বহু মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। সংঘাত কবলিত এই দেশটিতে সঊদী আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।
যুক্তরাষ্ট্রে সঊদী দূতাবাসের মুখপাত্র ফাহাদ নাযর বলেন, সংকট কাটিয়ে উঠতে যা যা করা দরকার, আমরা তার সবই করছি। আমরা সেই চেষ্টায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছি।
সঊদী বিশ্লেষক আলী শিহাবী বলেন, সুদানে তৎপরতার মধ্য দিয়ে লোহিত সাগর ঘিরে সঊদী আরবের যে সুযোগ রয়েছে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তা কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য পথ করে দিচ্ছে রিয়াদ। এতে বিশ্বে সঊদী আরবের ভাবমর্যাদা বেড়ে যাবে। এখন থেকে সঊদীকে ভিন্নভাবে চিনতে পারবে বিশ্ববাসী।
পাশাপাশি তুরস্ক ও সিরীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পথে হাঁটছে রিয়াদ। বৈশ্বিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সুযোগ করে দিচ্ছে আরব বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার। এক দশক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হ’লে আসাদ সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল সঊদীসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইতিমধ্যে সিরিয়া আরব লীগের সদস্যপদ লাভ করেছে এবং রিয়াদে তাদের দূতাবাস খুলেছে।
সঊদী আরবের মধ্যস্থতার চেষ্টা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গত বছর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দী বিনিময়ে ভূমিকা রেখেছে তারা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই সেনা ও পাঁচ ব্রিটিশ নাগরিকসহ অন্তত ১০ জন মুক্তি পেয়েছে। এছাড়া রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে বন্দী বিনিময়েও মধ্যস্থতা করেছে তারা। এভাবে আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তির বাহক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে যাচ্ছে সঊদী আরব।
[মক্কা পৃথিবীর নাভীস্থল এবং মানব জাতির ঐক্য কেন্দ্র। বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীযের মাধ্যমে ১৩৪৩ হিজরীতে কাবাগৃহের চারপাশে চার মাযহাবের চার মুছাল্লা ভেঙ্গে বিশ্ব মুসলিমকে একক ইব্রাহীমী মুছাল্লায় ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে। অতএব হারামায়েন শরীফায়েন-এর হেফাযতকারী হিসাবে সঊদী আরবকেই নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে হবে। আমরা সঊদী আরবের বর্তমান অভিভাবক সূলভ নেতৃত্ব সফলতার সাথে অব্যাহত থাকুক, সেই প্রার্থনা করি। (স.স)]