নিজের জীবনের প্রতি মমতা মানুষের সর্বাধিক। তাই জীবনের যবনিকায় কেউ উপনীত হ’তে চায় না। কেউ চায় না ধ্বংসের মুখোমুখি হ’তে। কিন্তু মহাপ্রলয় সকল চাওয়া-পাওয়ার অবসান ঘটিয়ে, সবার ইচ্ছা-অনিচ্ছার অবসান ঘটিয়ে সকল প্রাণের মৃত্যু ঘটাবে। সমগ্র সৃষ্টির বিনাশ সাধন করবে, পাহাড়-নদী, গাছ-গাছালি সবকিছুকে একাকার করে জগৎটাকে সৃষ্টি শূন্য করে দিবে। একসময় জিন জাতি পৃথিবীতে একচেটিয়া রাজত্ব করত। আল্লাহ তাদের পরে মানুষকে সৃষ্টি করলেন। তার পূর্বে বহু জাতির বিলুপ্ত হয়েছে। কারণ প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর নিকটে রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সময়সীমা রয়েছে। যখন তাদের সেই মেয়াদ এসে যাবে, তখন সেখান থেকে এক মুহূর্ত পিছাবেও না আগাবেও না’ (আ‘রাফ ৭/৩৪)। এমনকি এই মহাবিশ্বেরও একটি সময়সীমা রয়েছে। যার পরে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক বস্ত্তই ধ্বংস হবে তাঁর চেহারা ব্যতীত। বিধান কেবল তাঁরই এবং তাঁর কাছেই তোমরা ফিরে যাবে’ (কাছাছ ২৮/৮৮)। কিন্তু কখন পৃথিবী ধ্বংস হবে? এর স্পষ্ট সমাধান কুরআন ও ছহীহ হাদীছে পাওয়া যায় না। তবে এটি যেকোন মুহূর্তে হ’তে পারে। চোখের পলকে বা আরো দ্রুত ঘটে যেতে পারে মহাবিশ্বের পরিসমাপ্তি (নাহল ১৬/৭৭)। মুমিনরা ক্বিয়ামতকে খুব নিকটে মনে করে, আর কাফিররা ক্বিয়ামতকে দূরে মনে করে (মা‘আরিজ ৭০/৬-৭)। ইবনে ছাইয়াদ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ তাকে দাজ্জাল মনে করতেন।[1] কারণ তারা ক্বিয়ামতকে খুব নিকটে মনে করতেন। ছাহাবীগণ আকাশে কালো মেঘ ও বাতাশে রক্তিম আভা দেখলে ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করতেন’।[2] সূর্যগ্রহণ হ’লে রাসূল (ছাঃ) ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করতেন।[3] রাসূল (ছাঃ) তাঁর আগমনকে ও ক্বিয়ামতকে তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলের পার্থক্যের সাথে তুলনা করেছেন।[4] আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এ সংক্রান্ত আল্লাহর বাণী ও রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশনাগুলো তুলে ধরব।-
পৃথিবীর পরিসমাপ্তি সম্পর্কে আল্লাহর বাণী :
ক্বিয়ামত কখন ঘটবে তা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। তবে তা আকস্মিকভাবে ঘটবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ رَبِّي لاَ يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلاَّ هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ لاَ تَأْتِيكُمْ إِلاَّ بَغْتَةً يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِندَ اللهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ ‘তারা তোমাকে প্রশ্ন করছে ক্বিয়ামত কখন হবে? বলে দাও, এর জ্ঞান কেবল আমার প্রতিপালকের কাছেই রয়েছে। তার নির্ধারিত সময় কেবল তিনিই প্রকাশ করে দিবেন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে সেটি হবে একটি ভয়ংকর বিষয়। যা তোমাদের নিকটে আসবে আকস্মিকভাবে। তারা তোমাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে যেন তুমি এ বিষয়ে পূর্ণ অবগত! বলে দাও, এর জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (আ‘রাফ ৭/১৮৭)।[5] অত্র আয়াতে ক্বিয়ামত জানিয়ে আসবে না বলে সতর্ক করা হয়েছে।
অপর
আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত খুব নিকটবর্তী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ
বলেন, اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ، وَإِنْ يَرَوْا آيَةً
يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُسْتَمِرٌّ ‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং
চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে। আর তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে,
চলমান যাদু’ (ক্বামার ৫৪/১-২)। তিনি আরো বলেন, اقْتَرَبَ
لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مَّعْرِضُونَ- ‘মানুষের
হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন। অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে’ (আম্বিয়া ২১/০১)।[6]
ক্বিয়ামতের আগমন অবশ্যই হবে এবং সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَأَنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ لا رَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللهَ يَبْعَثُ مَن فِي الْقُبُورِ ‘আর ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে। এতে কোনই সন্দেহ নেই। আর আল্লাহ অবশ্যই পুনরুত্থিত করবেন যারা কবরে আছে’ (হজ্জ ২২/৭)।
ক্বিয়ামতের সময়কাল উল্লেখ না করে গোপন রাখার কারণ হ’ল- মানুষ যাতে আল্লাহর ভয়ে আমল করে। তিনি বলেন, إِنَّ السَّاعَةَ ءاَتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে। আমি সেটা গোপন রাখতে চাই। যাতে প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’ (ত্বা-হা ২০/১৫)। অর্থাৎ যাতে মানুষ অন্যায় কর্মে ভীত হয় এবং দ্রুত সৎকর্মে এগিয়ে আসে। অতঃপর স্ব স্ব কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করতে পারে।
কিয়ামত হঠাৎ করে আসবে এবং কাউকে সামান্য সুযোগ দেওয়া হবে না বলে আল্লাহ সতর্ক করে বলেন, هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ ‘তারা তো তাদের অজ্ঞাতসারে আকস্মাৎ ক্বিয়ামত আসার অপেক্ষা করছে’ (যুখরুফ ৪৩/৬৬)।
তিনি আরো বলেন,فَهَلْ يَنْظُرُوْنَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ ‘সুতরাং তারা কি কেবল এই অপেক্ষা করছে যে, ক্বিয়ামত তাদের উপর আকস্মিকভাবে এসে পড়ুক? অথচ ক্বিয়ামতের আলামতসমূহ তো এসেই পড়েছে। সুতরাং ক্বিয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৮)।
তিনি আরো বলেন, يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللهِ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُوْنُ قَرِيْبًا ‘লোকেরা আপনাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে বলে দিন এর জ্ঞান কেবল আলাহর কাছেই আছে। কিভাবে আপনি সেটা জানবেন? হ’তে পারে ক্বিয়ামত খুবই নিকটবর্তী’ (আহযাব ৩৩/৬৩)।
তিনি আরো বলেন,يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا، فِيمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا، إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا، إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَخْشَاهَا، كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا- ‘তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন হবে? এ বিষয়ে বলার জন্য তুমি কে? এর চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার প্রভুর নিকটে। তুমি তো কেবল সতর্ককারী ঐ ব্যক্তির জন্য যে ক্বিয়ামতকে ভয় করে। যেদিন তারা তা দেখবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে ছিল একটি সন্ধ্যা বা একটি সকাল’ (নাযে‘আত ৭৯/৪২-৪৬)।
ক্বিয়ামতের পূর্ব লক্ষণ
সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا
لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا
بِآياتِنَا لا يُوقِنُونَ- ‘অতঃপর যখন তাদের উপর ক্বিয়ামতের শাস্তি অবধারিত
হয়ে যাবে। তার প্রাক্কালে আমরা তাদের জন্য ভূগর্ভ থেকে একটা জীব বের করে
আনব। সে তাদের সাথে (পুনরুত্থান বিষয়ে) কথা বলবে। একারণে যে, মানুষ আমাদের
নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করত না’ (নামল ২৭/৮২)।[7]
তিনি আরও বলেন, حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ- وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَاوَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِيْنَ- ‘অবশেষে যখন ইয়াজূজ ও মাজূজ বন্ধনমুক্ত হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি হ’তে ছুটে আসবে এবং অমোঘ প্রতিশ্রুত সময় আসন্ন হবে, তখন অবিশ্বাসীদের চক্ষুসমূহ উচ্চে স্থির হয়ে যাবে এবং তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা এদিনের ব্যাপারে উদাসীন ছিলাম। বরং আমরা যালেম ছিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৯৭-৯৮)।
পৃথিবীর পরিসমাপ্তি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী :
মানুষের মৃত্যুকে তার জন্য ক্বিয়ামত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ رِجَالٌ مِنَ الأَعْرَابِ جُفَاةً يَأْتُونَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَيَسْأَلُونَهُ مَتَى السَّاعَةُ، فَكَانَ يَنْظُرُ إِلَى أَصْغَرِهِمْ فَيَقُولُ: إِنْ يَعِشْ هَذَا لاَ يُدْرِكْهُ الْهَرَمُ حَتَّى تَقُومَ عَلَيْكُمْ سَاعَتُكُمْ-
আয়েশা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত তিনি বলেন, ‘কিছু সংখ্যক রুক্ষ্ম মেজাযের গ্রাম্য লোক নবী করীম
(ছাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল ক্বিয়ামত কখন হবে? তখন তিনি তাদের
সর্বকনিষ্ঠ লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি এ লোক বেঁচে থাকে তবে তার বুড়ো
হবার আগেই তোমাদের উপর তোমাদের ক্বিয়ামত এসে যাবে। হিশাম বলেন, অর্থাৎ
তাদের মৃত্যু’।[9]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَتَى تَقُوْمُ السَّاعَةُ؟ وَعِنْدَهُ غُلاَمٌ مِنَ الأَنْصَارِ يُقَالُ لَهُ مُحَمَّدٌ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: إِنْ يَعِشْ هَذَا الْغُلاَمُ فَعَسَى أَنْ لاَ يُدْرِكَهُ الْهَرَمُ حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ-
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি
রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ক্বিয়ামত কখন হবে? তখন তাঁর নিকট মুহাম্মাদ
নামক এক আনছারী বালক উপস্থিত ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এ বালক যদি বেঁচে
থাকে তবে সে বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে’।[10]
অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَتَى تَقُومُ السَّاعَةُ قَالَ فَسَكَتَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هُنَيْهَةً، ثُمَّ نَظَرَ إِلَى غُلاَمٍ بَيْنَ يَدَيْهِ مِنْ أَزْدِ شَنُوْءَةَ فَقَالَ : إِنْ عُمِّرَ هَذَا لَمْ يُدْرِكْهُ الْهَرَمُ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ. قَالَ قَالَ أَنَسٌ ذَاكَ الْغُلاَمُ مِنْ أَتْرَابِى يَوْمَئِذٍ.
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, ক্বিয়ামত কবে হবে? এ কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। অতঃপর তিনি সম্মুখস্থ আয্দ-শানুআ গোত্রের এক বালকের প্রতি তাকিয়ে বললেন, এ বালক যদি দীর্ঘ হায়াত পায় তবে তার বার্ধক্যে পদার্পণ করার পূর্বেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন এ বালক আমার সমবয়স্ক ছিল’।[11] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ أَبِى سَعِيْدٍ قَالَ لَمَا رَجَعَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مِنْ تَبُوْكَ سَأَلُوْهُ عَنِ السَّاعَةِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ تَأْتِى مِائَةُ سَنَةٍ وَعَلَى الأَرْضِ نَفْسٌ مَنْفُوسَةٌ الْيَوْمَ-
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম
(ছাঃ) তাবূক অভিযান থেকে ফিরে এলে লোকেরা তাঁকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘একশ’ বছর অতিক্রান্ত হ’লে এখনকার কোন ব্যক্তি
জীবিত থাকবে না’।[12] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ)
বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে তাঁর মৃত্যুর এক মাস পুর্বে বলতে শুনেছি,
‘তোমরা আমাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ, অথচ তার জ্ঞান তো আল্লাহরই
কাছে। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণবন্ত জীব নেই,
যার উপর একশ’ বছর পূর্ণ হবে’।[13]
আব্দুল্লাহ
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে একরাতে আমাদের
সঙ্গে ইশারায় ছালাত আদায় করলেন। তিনি সালাম শেষে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা এই
রাত সম্পর্কে লক্ষ্য করেছ? (শোন) এর একশ’ বছরের মাথায়, আজ যারা পৃথিবীর
পৃষ্ঠে বিদ্যমান আছে তাদের কেউ জীবিত থাকবে না। ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন, তখন
লোকেরা একশ’ বছর সংক্রান্ত এই সব হাদীছের বর্ণনায় ভ্রান্তিতে পড়ে গেল।
মুলতঃ রাসূল (ছাঃ) ‘আজ যারা পৃথিবী পৃষ্ঠে বর্তমান আছে তাদের কেউ বাকী
থাকবে না’ দ্বারা এই যুগের পরিসমাপ্তির কথা বুঝাতে চেয়েছেন।[14]
সূর্য গ্রহণ হ’লে ক্বিয়ামতের ভয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছালাতে দাঁড়াতেন :
عَنْ أَبِى مُوسَى قَالَ خَسَفَتِ الشَّمْسُ، فَقَامَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَزِعًا، يَخْشَى أَنْ تَكُونَ السَّاعَةُ، فَأَتَى الْمَسْجِدَ، فَصَلَّى بِأَطْوَلِ قِيَامٍ وَرُكُوعٍ وَسُجُودٍ رَأَيْتُهُ قَطُّ يَفْعَلُهُ وَقَالَ: هَذِهِ الآيَاتُ الَّتِى يُرْسِلُ اللهُ لاَ تَكُونُ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلاَ لِحَيَاتِهِ ، وَلَكِنْ يُخَوِّفُ اللهُ بِهِ عِبَادَهُ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَافْزَعُوْا إِلَى ذِكْرِهِ وَدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ-
আবু মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত
তিনি বলেন, একবার সূর্যগ্রহণ হ’ল, তখন নবী করীম (ছাঃ) ভীত-সন্ত্রস্ত
অবস্থায় উঠলেন এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা করলেন। এরপর তিনি মসজিদে
আসলেন এবং দীর্ঘ ক্বিয়াম, রুকূ ও সিজদা সহকারে ছালাত আদায় করলেন। আমি তাঁকে
ইতিপূর্বে এতো দীর্ঘ করে ছালাত আদায় করতে খুব কমই দেখেছি। আর তিনি বললেন,
এগুলো হ’ল নিদর্শন যা আল্লাহ পাঠিয়ে থাকেন, তা কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে
হয় না। বরং আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন। কাজেই যখন
তোমরা এর কিছু দেখতে পাবে, তখন ভীত-বিহবল অবস্থায় আল্লাহর যিকর, দো‘আ এবং
ইসতিগফারের দিকে অগ্রসর হবে’।[15]
ইউসায়র ইবনু জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, هَاجَتْ رِيحٌ حَمْرَاءُ بِالْكُوفَةِ فَجَاءَ رَجُلٌ لَيْسَ لَهُ هِجِّيرَى إِلاَّ يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ جَاءَتِ السَّاعَةُ. قَالَ فَقَعَدَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ إِنَّ السَّاعَةَ لاَ تَقُومُ حَتَّى لاَ يُقْسَمَ مِيرَاثٌ وَلاَ يُفْرَحَ بِغَنِيمَةٍ. ‘একবার কূফা নগরীতে লাল ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত হ’ল। এমন সময় জনৈক লোক কূফায় এসে বলল যে, হে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ! সতর্ক হও, ক্বিয়ামত চলে এসেছে। রাবী বলেন, তিনি হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, ক্বিয়ামতে সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না উত্তরাধিকার সম্পদ অবণ্টিত থাকবে এবং যতক্ষণ না লোকেরা
গনীমতের বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে’।[16]
উম্মতে মুহাম্মাদীর গড় বয়স : উম্মতে মুহাম্মাদীর গড় বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছর হবে। এরূপ বয়সে কেউ উপনীত হ’লে মৃত্যুর ব্যাপারে তাকে অধিক সতর্ক থাকতে হবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَعْمَارُ أُمَّتِى مَا بَيْنَ سِتِّينَ إِلَى سَبْعِيْنَ وَأَقَلُّهُمْ مَنْ يَجُوْزُ ذَلِكَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের বয়স হ’ল ষাট ও সত্তরের মাঝে।
তাদের খুব কম সংখ্যকই এই সীমা অতিক্রম করতে পারবে’।[17] কেউ সত্তর বছর বয়স
পাওয়ার পরেও নেক আমল করে জান্নাত লাভ করতে না পারলে সে কোন আফসোস করতে
পারবে না। এজন্য আল্লাহ বলেন, وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيْهَا رَبَّنَا
أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ أَوَلَمْ
نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ ‘আর সেখানে তারা
আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এখান থেকে আমাদের বের করুন। আমরা
সৎকর্ম করব। পূর্বে যা করতাম তা করব না। (তখন আল্লাহ্ বলবেন,) আমরা কি
তোমাদের দীর্ঘ জীবন দেইনি? তখন কেউ উপদেশ গ্রহণ করতে চাইলে করতে পারত’ (ফাতির ৩৫/৩৭)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَعْذَرَ اللهُ إِلَى امْرِئٍ أَخَّرَ أَجَلَهُ حَتَّى
بَلَّغَهُ سِتِّينَ سَنَةً ‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে দীর্ঘায়ু করেছেন, এমনকি
যাকে ষাট বছরে পৌঁছিয়েছেন তার ওযর পেশ করার সুযোগ রাখেননি’।[18] অন্যত্র
রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ عُمِّرَ مِنْ أُمَّتِيْ سَبْعِيْنَ سَنَةً، فَقَدْ
أَعْذَرَ اللهُ إِلَيْهِ فِي الْعُمُرِ ‘আমার উম্মতের যাকে সত্তর বছর বয়স
দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাকে বয়সের ব্যাপারে ওযর পেশ করার সুযোগ দেবেন না’।[19]
৩. ছাহাবীগণ ক্বিয়ামতকে খুবই নিকটবর্তী মনে করতেন
: যেমন হাদীছে এসেছে- ‘আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামী হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমরা মাদায়েন থেকে কয়েক মাইল দূরে অবতরণ করলাম। জুম‘আর দিন তিনি
উপস্থিত হ’লেন এবং আমিও তার সাথে উপস্থিত হ’লাম। হুযায়ফা (রাঃ) খুৎবা
দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘ক্বিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং
চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/১)। সাবধান! নিশ্চয়ই ক্বিয়ামত
নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্রও বিদীর্ণ হয়েছে। সাবধান! দুনিয়া পৃথক হ’তে
ঘোষণা দিয়েছে। সাবধান! আজকে আমল করার দিন এবং আগামীকাল (কিয়ামতের দিন) ফল
প্রাপ্তির দিন। আমি আমার পিতাকে বললাম, লোকেরা আগামীকাল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত
হবে? তিনি বললেন, হে বৎস! তুমি বড়ই মূর্খ। এর অর্থ হ’ল- আজকে কর্মের দিন
আর আগামীকাল প্রতিদানের দিন। পরের জুম‘আ আসলে আমরা উপস্থিত হ’লাম। হুযায়ফা
(রাঃ) আবারো খুৎবা দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত নিকটবর্তী
হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/১)। সাবধান! নিশ্চয়ই
ক্বিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্রও বিদীর্ণ হয়েছে। সাবধান! দুনিয়া পৃথক
হ’তে ঘোষণা দিয়েছে। সাবধান! আজকে আমল করার দিন এবং আগামীকাল ফল প্রাপ্তির
দিন। সাবধান! শেষ পরিণতি হ’ল জাহান্নাম এবং অগ্রাগামী সে যে জান্নাতের
প্রতি অগ্রগামী হয়েছে’।[20]
ক্বিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হ’লেই রাসূল (ছাঃ) তা এড়িয়ে যেতেন। কারণ তার সঠিক জ্ঞান তাঁর নিকটে ছিল না। তবে তিনি প্রতিটি মুহূর্তে ক্বিয়ামত হয়ে যায় কি-না এই আশঙ্কায় থাকতেন। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ وَاقِفاً بِعَرَفَاتٍ فَنَظَرَ إِلَى الشَّمْسِ حِين َتَدَلَّتْ مِثْلَ التُّرْسِ لِلْغُرُوبِ فَبَكَى وَاشْتَدَّ بُكَاؤُهُ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ عِنْدَهُ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَدْ وَقَفْتَ مَعِى مِرَاراً لَمْ تَصْنَعْ هَذَا فَقَالَ ذَكَرْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ وَاقِفٌ بِمَكَانِى هَذَا فَقَالَ : أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّهُ لَمْ يَبْقَ مِنْ دُنْيَاكُمْ فِيمَا مَضَى مِنْهَا إِلاَّ كَمَا بَقِىَ مِنْ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيمَا مَضَى مِنْهُ-
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা তিনি
আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সূর্যের দিকে তাকালেন। তখন সূর্য অস্তমিত
হওয়ার জন্য ঢালের মত রূপ ধারণ করেছিল। এরপর তিনি অঝর নয়নে কাঁদলেন। তার
পাশের একজন লোক বলল, হে আবু আব্দুর রহমান! আপনি বহুবার এখানে আমার সাথে
অবস্থান করেছেন। কিন্তু কখনো এরূপ করেননি। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূলের
কথা স্মরণ করলাম যখন তিনি এই স্থানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হে লোক সকল!
তোমাদের এই পৃথিবীর বয়স থেকে আর ততটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, যতটুকু আজ তোমাদের
এই দিনের মধ্যে অবশিষ্ট রয়েছে’।[21]
তিনি আরও বলেন, بُعِثْتُ فِي نَسَمِ السَّاعَةِ ‘আমি ক্বিয়ামতের সূচনায় প্রেরিত হয়েছি’।[22] অর্থাৎ প্রচন্ড ঝড় শুরু হওয়ার পূর্বে যে মৃদু বায়ু প্রবাহিত হয় তার মত ক্বিয়ামতের পূর্বে আমি প্রেরিত হয়েছি।
তিনি
আরও বলেন, بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَذِهِ مِنْ هَذِهِ إِنْ كَادَتْ
لَتَسْبِقُهَا ‘আমি এবং ক্বিয়ামত এই আঙ্গুল ও এই আঙ্গুলের মত প্রেরিত
হয়েছি। এটি (তর্জনী আঙ্গুল) এটির (মধ্যমা আঙ্গুলের) উপর অতিক্রম হওয়ার
সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।[23] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, أَنْ كَادَتْ لَتَسْبِقَنِيْ ‘মনে হচ্ছিল আমাকে অতিক্রম করবে’।[24]
অর্থাৎ আমার সময়েই ক্বিয়ামত হয়ে যাবে। ক্বিয়ামতকে রাসূল (ছাঃ) খুব নিকটে
মনে করতেন। জাবের (রাঃ) বলেন, আর যখন তিনি ক্বিয়ামতের উল্লেখ করতেন তাঁর
গন্ডদ্বয়ের উপরিভাগ লাল হয়ে যেত এবং আওয়াজ উচ্চ হয়ে যেত, তার রাগ বেড়ে যেত
যেন তিনি কোন সৈন্য বাহিনীকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলতেন, শক্রবাহিনী তোমাদের
উপর সকালে অথবা সন্ধ্যায় আক্রমণ করতে পারে’।[25]
অনেক ছাহাবী ক্বিয়ামত নিকটে মনে করে ইবনু ছাইয়াদকে দাজ্জাল মনে করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
عنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ قَالَ رَأَيْتُ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللهِ يَحْلِفُ بِاللهِ أَنَّ ابْنَ الصَّائِدِ الدَّجَّالُ قُلْتُ تَحْلِفُ بِاللهِ. قَالَ إِنِّى سَمِعْتُ عُمَرَ يَحْلِفُ عَلَى ذَلِكَ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ يُنْكِرْهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم-
মুহাম্মদ ইবনু মুনকাদির (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আমি জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ)-কে আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে শুনেছি যে,
ইবনুছ ছায়িদ অবশ্যই (একটা) দাজ্জাল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কসম
খেয়ে বলছেন? তিনি উত্তরে বললেন, আমি ওমর (রাঃ)-কে নবী করীম (ছাঃ)-এর
উপস্থিতিতে কসম খেয়ে এ কথা বলতে শুনেছি। তখন নবী করীম (ছাঃ) এ কথা অস্বীকার
করেননি’।[26]
নাফে‘ (রহঃ) বলেন,كَانَ ابْنُ
عُمَرَ يَقُولُ وَاللهِ مَا أَشُكُّ أَنَّ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ ابْنُ
صَيَّادٍ ‘ইবনু ওমর (রাঃ) বলতেন, ইবনু ছাইয়াদই যে মাসীহ দাজ্জাল এতে আমার
কোন সন্দেহ নেই’।[27]
ক্বিয়ামতকে সর্বদা আসন্ন ভেবে আমল করতে হবে :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ قَالَ: غَدَوْتُ عَلَى ابْنِ عَبَّاسٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ: مَا نِمْتُ اللَّيْلَةَ حَتَّى أَصْبَحْتُ. قُلْتُ: لِمَ؟ قَالَ: قَالُوا طَلَعَ الْكَوْكَبُ ذُو الذَّنَبِ، فَخَشِيتُ أَنْ يَكُونَ الدُّخَانُ قَدْ طَرَقَ، فَمَا نِمْتُ حَتَّى أَصْبَحْتُ-
আব্দুল্লাহ বিন আবু মুলায়কা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন সকালে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকটে গেলাম। তখন তিনি বললেন, আমি গত রাতে সকাল পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তিনি বললেন, লোকেরা বলল যে, লেজ বিশিষ্ট তারকা উদিত হয়েছিল। এতে আমি আশঙ্কা করছিলাম যে ধোঁয়া অবশ্যই আগমন করবে। এজন্য সকাল অবধি ঘুমাতে পারিনি।[28] ছাহাবীগণ যদি ক্বিয়ামতের পূর্বে আগত আলামতের ভয়ে ঘুমাতে না পারেন, তবে আমাদের জন্য ক্বিয়ামতকে বহু দূরের বিষয় ভাবা সমীচীন নয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করে বলেন,
يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلِ انْتَظِرُوا إِنَّا مُنْتَظِرُونَ-
‘তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে। (মনে রেখ) যেদিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন (যেমন ক্বিয়ামত প্রাক্কালে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠা) এসে যাবে, সেদিন তাদের ঈমান কোন কাজে আসবে না, যারা ইতিপূর্বে ঈমান আনেনি অথবা তাদের ঈমান দ্বারা কোন সৎকর্ম করেনি। বলে দাও যে, তোমরা অপেক্ষায় থাক, আমরাও অপেক্ষায় রইলাম’ (আন‘আম ৬/১৫৮)। অতএব আমাদের সকলেরই উচিত ক্বিয়ামত নিকটবর্তী মনে করে বেশী বেশী নেক আমল করা।
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ :
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সতর্ক করে বলেন,
فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ، يَغْشَى النَّاسَ هَذَا عَذَابٌ أَلِيمٌ، رَبَّنَا اكْشِفْ عَنَّا الْعَذَابَ إِنَّا مُؤْمِنُونَ-
‘অতএব অপেক্ষা কর সেদিনের যেদিন স্পষ্ট ধোঁয়া আচ্ছন্ন হবে আকাশ। যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, এটি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তখন তারা বলবে ‘হে আমাদের রব! আমাদের হ’তে আযাব দূর করুন; নিশ্চয়ই আমরা মুমিন হব’ (দুখান ৪৪/১০-১২)।
রাসূল
(ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَوَّلَ الآيَاتِ خُرُوْجًا طُلُوْعُ الشَّمْسِ مِنْ
مَغْرِبِهَا وَخُرُوْجُ الدَّابَّةِ عَلَى النَّاسِ ضُحًى وَأَيُّهُمَا مَا
كَانَتْ قَبْلَ صَاحِبَتِهَا فَالأُخْرَى عَلَى إِثْرِهَا قَرِيْبًا،
‘ক্বিয়ামতের প্রথম আলামত হ’ল পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্যোদয় এবং দিন দুপুরে
মানুষের মাঝে ‘দাববাতুল আরয’ নামক প্রাণীর আত্মপ্রকাশ। এই দু’টি আলামতের
মধ্যে যেটিই সর্বপ্রথম প্রকাশ পাবে, অপরটিও তার পরপরই প্রকাশ পাবে’।[29] আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমার মনে হয় সর্বপ্রথম পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্য উদিত হবে।[30]
অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثٌ إِذَا خَرَجْنَ لاَ
يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ
كَسَبَتْ فِى إِيمَانِهَا خَيْرًا طُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا
وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ ‘তিনটি আলামত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে
যারা ঈমান আনেনি বা ঈমান অনুযায়ী নেক কাজ করেনি, এগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর
তাদের ঈমান কোন উপকারে আসবে না। (১) পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্যোদয়, (২) দাজ্জাল
(এর আবির্ভাব) ও (৩) দাববাতুল আরয (ভূ-পৃষ্ঠ হ’তে এক প্রকার প্রাণী বের
হওয়া)’।[31]
অন্য হাদীছে এসেছে,لاَ تَقُوْمُ
السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا، فَإِذَا طَلَعَتْ
وَرَآهَا النَّاسُ آمَنُوْا أَجْمَعُوْنَ، وَذَلِكَ حِيْنَ لاَ يَنْفَعُ
نَفْسًا إِيْمَانُهَا- ‘ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম
দিক থেকে উদিত হবে। যখন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে, আর লোকজন তা
দেখবে, তখন সকলেই ঈমান আনবে। কিন্তু তখন কোন ব্যক্তির ঈমান কাজে আসবে না’।[32] দাববাতুল আরয নামে মাটি হ’তে এক প্রকার প্রাণী বের হবে। মানুষের সাথে কথা বলবে এবং মু'মিন ও কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য করে দিবে।[33]
অতএব সূর্য পশ্চিমে উদিত হ’লে বা দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করলে বা দাববাতুল
আরযের আবির্ভাব ঘটলেই সকলের আমলে মোহর মেরে দেওয়া হবে। যাদের ঈমান ছিল তারা
তাদের ঈমান অনুযায়ী আমল করবে। যারা ফাসিক ছিল তারা পাপাচারের উপর আমল
করবে। যারা কাফির ছিল তারা কুফরির উপরেই থাকবে। তখন নতুনভাবে ঈমান আনার বা
সৎকর্মশীল হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, এই তিনটি আলামত বের
হ’লে আমলের দরজা বন্ধ হবে। আর তিনটি খুব কাছাকাছি সময়েই বের হবে।[34]
তবে হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) এসে বললেন, তোমরা দশটি আলামত না দেখলে ক্বিয়ামত হবে না। তার মধ্যে প্রথমেই তিনি ধোঁয়ার কথা উল্লেখ করেন।[35] অন্য হাদীছে ধোঁয়ার আলোচনা পরে করা হয়েছে। অবশ্য আকাশে ধোঁয়া দেখার বিষয়টি দু’বার পরিলক্ষিত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। যার একবার ছাহাবীগণের আমলে ঘটেছে। আরেকবার ক্বিয়ামতের পূর্বে ঘটবে।
عَنْ مَسْرُوقٍ قَالَ كُنَّا عِنْدَ عَبْدِ اللهِ فَقَالَ إِنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم لَمَّا رَأَى مِنَ النَّاسِ إِدْبَارًا قَالَ : اللَّهُمَّ سَبْعٌ كَسَبْعِ يُوسُفَ. فَأَخَذَتْهُمْ سَنَةٌ حَصَّتْ كُلَّ شَىْءٍ حَتَّى أَكَلُوا الْجُلُودَ وَالْمَيْتَةَ وَالْجِيَفَ، وَيَنْظُرَ أَحَدُهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فَيَرَى الدُّخَانَ مِنَ الْجُوعِ، فَأَتَاهُ أَبُو سُفْيَانَ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ إِنَّكَ تَأْمُرُ بِطَاعَةِ اللَّهِ وَبِصِلَةِ الرَّحِمِ وَإِنَّ قَوْمَكَ قَدْ هَلَكُوا، فَادْعُ اللهَ لَهُمْ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى ( فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِى السَّمَاءُ بِدُخَانٍ مُبِينٍ) إِلَى قَوْلِهِ ( عَائِدُونَ * يَوْمَ نَبْطِشُ الْبَطْشَةَ الْكُبْرَى) فَالْبَطْشَةُ يَوْمَ بَدْرٍ، وَقَدْ مَضَتِ الدُّخَانُ وَالْبَطْشَةُ وَاللِّزَامُ وَآيَةُ الرُّومِ-
মাসরূক
হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর নিকটে বসাছিলাম। এক সময়
তিনি বললেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন লোকদেরকে ইসলাম বিমুখ দেখলেন, তখন দো‘আ
করলেন, হে আল্লাহ! ইউসুফ (আঃ)-এর যামানার সাত বছরের (দুর্ভিক্ষের) ন্যায়
তাঁদের উপর সাতটি বছর দুর্ভিক্ষ দিন। ফলে তাঁদের উপর এমন দুর্ভিক্ষ আপতিত
হ’ল যে, তা সব কিছুই ধ্বংস করে দিল। এমনকি মানুষ তখন চামড়া, মৃতদেহ এবং পচা
ও গলিত জানোয়ারও খেতে লাগল। ক্ষুধার তাড়নায় অবস্থা এত চরম আকার ধারণ করল
যে, কেউ যখন আকাশের দিকে তাকাত তখন সে ধোঁয়া দেখতে পেত। এমতাবস্থায় আবু
সুফিয়ান (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে
মুহাম্মাদ! তুমি তো আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণন
রাখার আদেশ দান কর। কিন্তু তোমার কওমের লোকেরা তো মরে যাচ্ছে। তুমি তাঁদের
জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তুমি সে
দিনটির অপেক্ষায় থাক যখন আকাশ সুস্পষ্ট ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে সেদিন আমি
প্রবলভাবে তোমাদের পাকড়াও করব’ (দুখান ৪৪/১০-১৬)। আব্দুল্লাহ
(রাঃ) বলেন, সে কঠিন আঘাতের দিন ছিল বদরের যুদ্ধের দিন। ধোঁয়াও দেখা গেছে,
আঘাতও এসেছে। আর মক্কার মুশরিকদের নিহত ও গ্রেফতারের যে ভবিষ্যদ্বাণী করা
হয়েছে, তাও সত্য হয়েছে। সত্য হয়েছে সূরা রুম-এর এ আয়াতও (রূমবাসী দশ বছরের
মধ্যে পারসিকদের উপর আবার বিজয় লাভ করবে)।[36] ক্বিয়ামতের পূর্বের ধোঁয়া
সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ছয়টি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই তোমরা নেক আমলে
দ্রুততা কর, তা হ’ল- (১) পশ্চিমদিক হ’তে সূর্যোদয় হওয়া, (২) ধোঁয়া উত্থিত
হওয়া, (৩) দাজ্জালের আবির্ভাব হওয়া, (৪) দাববাহ (অদ্ভুত জন্তুর)
আত্মপ্রকাশ), (৫) খাছ বিষয় [কোন ব্যক্তির মৃত্যু] ও (৬) আম বিষয় সার্বজনীন
বিপদ বা ক্বিয়ামত’।[37]
তাবেঈ মুজাহিদ বলেন,
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলতেন,هُمَا دُخَانَانِ قَدْ أُمْضِيَ أَحَدُهُمَا
وَالَّذِي بَقِيَ يَمْلَأُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ‘দু’টি
ধোঁয়ার একটি অতিবাহিত হয়ে গেছে। আর যেটি অবশিষ্ট আছে তা আকাশ ও যমীনকে
আচ্ছন্ন করে ফেলবে’।[38]
অতএব হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা ক্বিয়ামতের আগমনকে আসন্ন মনে করতে পারি, যেমনটি ছাহাবীগণ মনে করতেন। কিন্তু এজন্য সময়কাল নির্দিষ্ট করে বলার অবকাশ নেই।
ক্বিয়ামতের নির্ধারিত সময় গোপন রাখার রহস্য :
আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের সঠিক সময় কাউকে অবগত করেননি। উদ্দেশ্য হ’ল মানুষ যাতে সদা সতর্ক থাকে, পরকালের জন্য পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে এবং সর্বদা সৎকাজে লিপ্ত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيْرٌ ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকটেই রয়েছে ক্বিয়ামতের জ্ঞান। আর তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনিই জানেন মায়ের গর্ভাশয়ে কি আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন মাটিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত’ (লোক্বমান ৩১/৩৪)। আল্লাহ আরো বলেন, وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ ‘আল্লাহর নিকটেই রয়েছে অদৃশ্যের চাবিকাঠি। তিনি ব্যতীত তা কেউ জানে না’ (আন‘আম ৬/৫৯)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি। আল্লাহ ব্যতীত যা কেউ জানে না। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।[39]
রাসূল (ছাঃ)-কে ক্বিয়ামত সম্প©র্ক জিজ্ঞেস করা হ’লে সময়সীমার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আমলের কথা জিজ্ঞেস করতেন। যেমন আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ! مَتَى السَّاعَةُ قَالَ : وَمَا أَعْدَدْتَ لِلسَّاعَةِ؟ قَالَ حُبَّ اللهِ وَرَسُولِهِ قَالَ: فَإِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ. قَالَ أَنَسٌ فَمَا فَرِحْنَا بَعْدَ الإِسْلاَمِ فَرَحًا أَشَدَّ مِنْ قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم، فَإِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ. قَالَ أَنَسٌ فَأَنَا أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَأَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ مَعَهُمْ وَإِنْ لَمْ أَعْمَلْ بِأَعْمَالِهِمْ-
‘জনৈক
ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে জিজ্ঞেস করল, ক্বিয়ামত কখন হবে?
উত্তরে তিনি বললেন, ক্বিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছ? সে
বলল, কোন কিছুই প্রস্ত্তত করিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি।
তখন নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি যাকে ভালবাস ক্বিয়ামতের দিন তুমি তাঁর
সাথেই থাকবে। আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা একথা শুনে যতটা খুশী হ’লাম ইসলাম
গ্রহণের পর তত খুশী আর কখনও হইনি। আনাস (রাঃ) আরো বলেন, আমি আল্লাহকে
ভালবাসি, নবীকে ভালবাসি, আবু বকরকে ভালবাসি এবং ওমরকে ভালবাসি। আশা করি
তাঁদেরকে ভালবাসার কারণে আমি তাঁদের সাথেই থাকব। যদিও আমি তাঁদের ন্যায় আমল
করতে পারি না’।[40]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
একজন লোক এসে জিজ্ঞেস করল, مَتَّى السَّاعَةُ يَا رَسُولَ اللهِ! قَالَ:
مَا أَعْدَدْتَ لَهَا؟ فَكَأَنَّ الرَّجُلَ اسْتَكَانَ ثُمَّ قَالَ يَا
رَسُولَ اللهِ! مَا أَعْدَدْتُ لَهَا مِنْ كَثِيرِ صَلاَةٍ وَلاَ صَوْمٍ
وَلاَ صَدَقَةٍ، وَلَكِنِّى أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ. قَالَ : أَنْتَ
مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ- ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামত কখন হবে? তিন
বলেন, তুমি তার জন্য কী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছ? এতে লোকটি যেন কিছুটা
লজ্জিত হ’ল। তারপর বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ছাওম, ছালাত, ছাদাক্বাহ
খুব একটা তার জন্য করতে পারিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসি।
তিনি বললেন, তুমি যাকে ভালবাস (ক্বিয়ামতে) তার সঙ্গেই থাকবে’।[41] আবার
কখনো ক্বিয়ামত সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি সময়সীমা এড়িয়ে
ক্বিয়ামতের আলামত বর্ণনা করেন। এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে
আল্লাহর রাসূল! ক্বিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন,فَإِذَا ضُيِّعَتِ
الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ، قَالَ: كَيْفَ إِضَاعَتُهَا قَالَ:
إِذَا وُسِّدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ ‘যখন
আমানত নষ্ট করা হবে তখন ক্বিয়ামতের প্রতীক্ষা করবে। সে বলল, কিভাবে আমানত
নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্য ব্যক্তিকে কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া
হয়, তখন তুমি ক্বিয়ামতের প্রতীক্ষা করবে’।[42]
হাদীছে
জিবরীলে বর্ণিত হয়েছে, জিবরীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, مَتَى
السَّاعَةُ؟ قَالَ : مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ،
‘ক্বিয়ামত কবে হবে? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তিনি
জিজ্ঞেসকারী অপেক্ষা বেশী জানেন না’।[43]
মোটকথা হাদীছ থেকে আমরা যা অবগত হ’লাম তা এই যে, ক্বিয়ামত কখন হবে তা নিয়ে গবেষণা করা অনর্থক। ক্বিয়ামতের জন্যে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা এবং সর্বদা আনুগত্যের কাজে লিপ্ত থাকাই প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির একান্ত করণীয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমলে ছালেহ করার মাধ্যমে দুনিয়াবী সফলতা ও পরকালীন মুক্তি অর্জন করার তাওফীক দান করুন!-আমীন!!
[1]. মুত্তাফাকুন আলাইহ্, মিশকাত হা/৫৪৯৪।
[2]. মুসলিম হা/২৮৯৯; হাকেম হা/৮৪৭১; আহমাদ হা/৩৬৪৩; মিশকাত হা/৫৪২২।
[3]. বুখারী হা/১০৫৯; মুসলিম হা/৯১২; মিশকাত হা/১৪৮৪।
[4]. বুখারী হা/৫৩০১; মুসলিম হা/২৯৫১; মিশকাত হা/৫৫০৯।
[5]. বিজ্ঞানীদের ধারণা এখন থেকে ৫০০ কোটি বছর পরে সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। আর তখনই ক্বিয়ামত (Dooms Day) হবে। এটি ঠিক নয়। বরং আল্লাহর হুকুম হ’লে যেকোন সময় ক্বিয়ামত হ’তে পারে।- লেখক।
[6]. সূরার শুরুতেই আল্লাহ ক্বিয়ামত অত্যন্ত নিকটবর্তী বলে মানুষকে সাবধান করেছেন। যেন তারা সে বিষয়ে উদাসীন না হয় এবং সেজন্য দ্রুত প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। আর নবীগণ যেহেতু মানুষকে সতর্ককারী হিসাবে আগমন করেছিলেন, সেহেতু তাঁদের নামের সূরার শুরুতে এরূপ সতর্ক বার্তা খুবই যথার্থ হয়েছে।- লেখক।
[7]. এটি ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে আবির্ভূত দশটি নিদর্শনের অন্যতম। হুযায়ফা বিন আসীদ আল-গিফারী বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর কক্ষ হ’তে বের হ’লেন। এমতাবস্থায় আমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। অতঃপর তিনি বললেন, ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ দশটি নিদর্শন তোমরা দেখতে না পাবে। (১) পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া (২) ধোঁয়া বের হওয়া (৩) ভূগর্ভ থেকে জন্তু বের হওয়া (৪) ইয়াজূজ-মা‘জূজ-এর আবির্ভাব (৫) মারিয়াম তনয় ঈসার আগমন (৬) দাজ্জালের আবির্ভাব (৭) পশ্চিমে (৮) পূর্বে ও (৯) আরব উপদ্বীপে তিনটি ভূমিধ্বস এবং (১০) এডেন-এর গর্তসমূহ থেকে আগুণ নির্গত হওয়া। যা মানুষকে হাঁকিয়ে হাশরের ময়দানে জমা করবে’ (মুসলিম হা/২৮৯৯; হাকেম হা/৮৪৭১; আহমাদ হা/৩৬৪৩; মিশকাত হা/৫৪২২)।
[8]. হাকেম হা/৭৯১৭; ছহীহাহ হা/১৫১০; ছহীহুল জামে‘ হা/১১৪৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৩৪৮।
[9]. বুখারী হা/৬৫১১; মুসলিম হা/২৯৫২; মিশকাত হা/৫৫১২।
[10]. মুসলিম হা/২৯৫৩; আহমাদ হা/১৩৪১০; ছহীহাহ হা/৩৪৯৭।
[11]. মুসলিম হা/২৯৫৩।
[12]. মুসলিম হা/২৫৩৯; মিশকাত হা/৫৫১১।
[13]. মুসলিম হা/২৫৩৮; মিশকাত হা/৫৫১০।
[14]. মুসলিম হা/২৫৩৭; আবুদাউদ হা/৪৩৪৮; তিরমিযী হা/২২৫১।
[15]. বুখারী হা/১০৫৯; মুসলিম হা/৯১২; মিশকাত হা/১৪৮৪।
[16]. মুসলিম হা/২৮৯৯; আহমাদ হা/৩৬৪৩।
[17]. তিরমিযী হা/৩৫৫০; মিশকাত হা/৫২৮০; ছহীহাহ হা/৭৫৭।
[18]. বুখারী হা/৬৪১৯; মিশকাত হা/৫২৭২।
[19]. হাকেম হা/৩৬০১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৯৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩৬০।
[20]. হাকেম হা/৮৮০০; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৩৫২।
[21]. হাকেম হা/৩৬৫৬; আহমাদ হা/৬১৭৩, সনদ ছহীহ।
[22]. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৮২৩১; ছহীহাহ হা/৮০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩২।
[23]. আহমাদ হা/১৮৭৯২।
[24]. আহমাদ হা/২২৯৯৭; মু‘জামুল কাবীর হা/৩২৬; মাজামা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৮২২৭, সনদ ছহীহ।
[25]. নাসাঈ হা/১৫৭৮; আহমাদ হা/১৪৪৭১, ১৪৬৭০; ছহীহাহ হা/২০৭৯।
[26]. বুখারী হা/৭৩৫৫; মিশকাত হা/৫৫০০।
[27]. আবুদাউদ হা/৪৩৩০; মিশকাত হা/৫৫০১, সনদ ছহীহ।
[28]. ইবনু কাছীর, ৭/২৪৯; সনদ ছহীহ, তাফসীরে ত্বাবারী ২২/১৭, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[29]. মুসলিম হা/২৯৪১; মিশকাত হা/৫৪৬৬।
[30]. আবুদাউদ হা/৪৩১০; ইবনু মাজাহ হা/৪০৬৯, সনদ ছহীহ।
[31]. মুসলিম হা/১৫৮; মিশকাত হা/৫৪৬৭।
[32]. বুখারী হা/৪৬৩৬; মিশকাত হা/৫৪১০।
[33]. নববী, অত্র হাদীছের শরাহ দ্রষ্টব্য।
[34]. ফাৎহুলবারী ১১/৩৫৩; নববী, শারহু মুসলিম ২/১৯৫; ফায়যুল কাদীর ৩/২৯৮; ইবনু রজব, জামে‘উল ঊলূম ওয়াল হিকাম ২/৩৮৮।
[35]. মুসলিম হা/২৯০১; মিশকাত হা/৫৪৬৪।
[36]. বুখারী হা/১০০৭; মুসলিম হা/২৭৯৮।
[37]. মুসলিম হা/২৯৪৭; ইবনু মাজাহ হা/৪০৫৬; মিশকাত হা/৫৪৬৫।
[38]. কুরতুবী, কিতাবুত-তাযকিরাহ ১/৭৩৮; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/৩৪৫।
[39]. বুখারী হা/৪৬২৭।
[40]. বুখারী হা/৬১৬৭; মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।
[41]. বুখারী হা/৭১৫৩; মুসলিম হা/২৬৩৯।
[42]. বুখারী হা/৫৯; মিশকাত হা/৫৪৩৯।
[43]. বুখারী হা/৫০; মুসলিম হা/১০; মিশকাত হা/০২।