পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।
চিন্তার ইবাদতের নমুনা
চিন্তা-ভাবনা মানব মস্তিষ্কের এক অপরিহার্য ক্রিয়া। মানুষ যখন এই চিন্তাকে স্বীয় স্রষ্টা, পালনকর্তা ও প্রতিপালকের অভিমুখী করে, তখন সেই চিন্তা-ভাবনা ইবাদতে রূপান্তরিত হয়। নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীবৃন্দ এই ইবাদতে অভ্যস্ত ছিলেন। কারণ চিন্তার ইবাদত সম্পাদন করার ব্যাপারে মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। তাই তারা নিজেরা যেমন এই ইবাদত করতেন, তেমনি অন্যদের এই ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করতেন। নিমেণ এর কয়েকটি নমুনা পেশ করা হ’ল।-
(১) বারা ইবনে ‘আযেব (রাঃ) বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। হঠাৎ তিনি একদল লোকের সমাবেশ দেখতে পেয়ে বললেন, কী ব্যাপারে ওরা জমায়েত হয়েছে? তাকে বলা হ’ল- একজনের কবর খোঁড়ার জন্য তারা একত্রিত হয়েছে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেন ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ছাহাবীদের ত্যাগ করে তড়িঘড়ি করে কবরের নিকট পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন। রাবী বলেন, তিনি কি করছেন তা দেখার জন্য আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। পরিশেষে তিনি এত কাঁদলেন যে, তার চোখের পানিতে মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। এরপর তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে বললেন, তোমরা বেশী বেশী কবর ও মৃত্যুর কথা স্মরণ কর’।[1]
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরআনের আয়াত নিয়ে খুব বেশী চিন্তা-গবেষণা করতেন। বিশেষ করে যেসব সূরাতে ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় বর্ণনা এসেছে। একবার আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি তো বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। রাসূল (ছাঃ) জবাবে বলেন, সূরা হূদ, ওয়াকি’আহ, সূরা মুরছালাত, সূরা নাবা ও সূরা তাক্ববীর আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে’।[2] বিশেষ করে সূরা হূদের সেই আয়াতটি আল্লাহর রাসূলকে চিন্তার ইবাদতে সবচেয়ে বেশী নিবিষ্ট রাখতেন, যেখানে আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘অতএব তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ সেভাবে দৃঢ় থাক এবং তোমার সাথে যারা (শিরক ও কুফরী থেকে) তওবা করেছে তারাও। আর তোমরা সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের সকল কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেন’ (হূদ ১১/১১২)। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নবুঅতের যে নির্দেশনা ও দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার উপর তিনি কতটুকু অটল থাকতে পেরেছেন, সেটাই ছিল তাঁর চিন্তা-ভাবনার মূল কারণ। ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন,الاستقامة على الصراط في الدنيا صعب كالمرور على صراط جهنم، ‘দুনিয়াতে ছিরাতে মুস্তাক্বীমে অটল থাকা জাহান্নামের পুলছিরাতের ওপর দিয়ে পার হওয়ার মতই কঠিন’।[3] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাঝে মাঝে চিন্তার এত গভীরে ডুব দিতেন যে, একটি আয়াতের মাধ্যমে তিনি তাহাজ্জুদ পড়ে ফেলতেন। আবূ যার (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে একটি মাত্র আয়াত পড়তে থাকলেন, আয়াতটি হ’ল-إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ، وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ، ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহ’লে তারা আপনার বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করেন, তাহ’লে আপনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৫/১১৮)।
(৩) ইবরাহীম (আঃ) তাঁর কওমের কাফের-মুশরিকদের দাওয়াত দেওয়ার এক অভিনব পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তাদের চিন্তার যমীন কর্ষণ করে সেখানে তাওহীদের চারা রোপনের প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি মূলতঃ চিন্তার ইবাদতের মাধ্যমে তাদেরকে তাওহীদমুখী করার চেষ্টা করেছেন। মহান আল্লাহ সূরা আন‘আমে চমৎকারভাবে এর বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘(স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, তুমি কি (আল্লাহকে ছেড়ে) মূর্তিগুলিকে উপাস্য গণ্য করো? আমি তো দেখছি তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ। আর এভাবে আমরা ইবরাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব (অর্থাৎ তার নিদর্শন সমূহ) প্রদর্শন করি। আর যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অনন্তর যখন তার উপর রাত্রির অন্ধকার সমাচ্ছন্ন হ’ল, তখন সে নক্ষত্র দেখে বলল, এটিই আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন সে বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না। অতঃপর যখন সে উজ্জ্বল চন্দ্রকে দেখল, তখন বলল, এটিই আমার প্রতিপালক। কিন্তু যখন সেটি অস্তমিত হ’ল, তখন সে বলল, যদি আমার প্রভু আমাকে পথপ্রদর্শন না করেন, তাহ’লে আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর যখন সে ডগমগে সূর্যকে দেখল, তখন বলল এটাই আমার রব ও এটাই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসবকে (আল্লাহর সাথে) শরীক কর, আমি সেসব থেকে মুক্ত। আমি আমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছি ঐ সত্তার দিকে, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (আন‘আম ৬/৭৪-৭৯)।
(৪) ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবনী থেকে আরেকটি নমুনা পেশ করা যেতে পারে। তিনি কওমের লোকদের উপাসিত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলে বড় মূর্তিটা রেখে দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি জনগণকে চিন্তার ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, যেন তারা নিজেদের হাতে গড়া মূর্তিদের অসারতা-অক্ষমতা বুঝতে পারে এবং এদের উপাসনা না করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে। আল্লাহ বলেন, ‘(ইবরাহীম বলল,) আল্লাহর কসম! তোমরা পিঠ ফিরে (মেলায়) চলে গেলে তোমাদের মূর্তিগুলির একটা সুরাহা আমি করবই। অতঃপর সে মূর্তিগুলি গুঁড়িয়ে দিল বড়টিকে ছাড়া। যাতে তারা তার কাছে ফিরে যায়। (মেলা থেকে ফিরে এসে) তারা বলল, আমাদের উপাস্যগুলির সাথে এরূপ আচরণ কে করল? নিশ্চয়ই সে অত্যাচারী। লোকেরা বলল, আমরা এক যুবককে ওদের সমালোচনা করতে শুনেছি, তার নাম বলা হয় ইবরাহীম। তারা বলল, তাহ’লে তোমরা তাকে জনসমক্ষে হাযির কর, যাতে সকলে সাক্ষ্য দিতে পারে। তারা বলল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমাদের উপাস্যগুলির সাথে এরূপ আচরণ করেছ? সে বলল, তাদের এই বড়টাই তো এ কাজ করেছে। অতএব তোমরা ভাঙ্গা মূর্তিগুলিকে জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে। এতে লজ্জিত হয়ে তারা নিজেরা বলতে লাগল, আসলে তোমরাই তো অত্যাচারী। অতঃপর অবনত মস্তকে তারা বলল, (হে ইবরাহীম!) তুমি তো জান যে ওরা কোন কথা বলতে পারে না। সে বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর পূজা করবে, যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর তাদের জন্য! তোমরা কি কিছুই বুঝ না?’ (আম্বিয়া ২১/৫৭-৬৭)
(৫) ওছমান (রাঃ)-এর মুক্তদাস হানী বলেন, ওছমান (রাঃ) যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন, তখন এত কাঁদতেন যে, তার দাঁড়ি ভিজে যেত। তাকে প্রশ্ন করা হ’ল, জান্নাত জাহান্নামের আলোচনা করা হ’লে তো আপনি এত কাঁদেন না অথচ কবর দেখলে আপনি এত বেশী কাঁদেন কেন? তখন তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আখেরাতের মনযিলসমূহের মধ্যে কবর হ’ল প্রথম মনযিল। এখান থেকে যদি কেউ মুক্তি পায়, তবে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলোতে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ হয়ে যাবে। আর সে যদি এখানে মুক্তি না পায়, তবে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলো আরো বেশী কঠিন হবে। তিনি (ওছমান) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেছেন, আমি কবরের চাইতে অধিক ভয়ংকর দৃশ্য আর কখনো দেখিনি’।[4]
(৬) ইবরাহীম ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, একদিন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ)-এর কাছে খাবার আনা হ’ল, তখন তিনি ছিয়াম পালন করছিলেন। তিনি বললেন, মুছ‘আব ইবনে উমাইর শহীদ হ’লেন। তিনি ছিলেন আমার চেয়েও শ্রেষ্ঠ মানুষ। অথচ তাঁকে কাফন দেওয়ার মতো এমন একটি চাদর ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না, যা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে পা দু’টি বের হয়ে যাচ্ছিল এবং পা দু’টি ঢাকলে মাথা বের হয়ে যাচ্ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে পড়ে, তিনি হামযাহ (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, তিনিও (হামযাহ) ছিলেন আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তারপর আমাদেরকে পৃথিবীর যে প্রাচুর্য দেওয়া হ’ল, আমাদের আশঙ্কা হয় যে, হয়তো আমাদের সৎকর্মের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর তিনি কাঁদতে লাগলেন, এমনকি খাবারও পরিহার করলেন’।[5]
(৭) হানযালা আল-উসাইদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা তিনি কাঁদতে কাঁদতে আবুবকর (রাঃ)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে হানযালা! তোমার কি হয়েছে? তিনি বললেন, হে আবুবকর! হানাযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। আমরা যখন রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে অবস্থান করি এবং তিনি আমাদের জান্নাত-জাহান্নাম স্মরণে নছীহত করেন, তখন মনে হয় যেন আমরা সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে দেখছি। কিন্তু বাড়ী ফিরে আসার পর স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অনেক কিছুই ভুলে যাই। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমাদেরও তো একই অবস্থা! চল আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে যাই। অতঃপর আমরা সেদিকে রওয়ানা হ’লাম। রাসূল (ছাঃ) তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হানযালা! কি খবর? তখন উত্তরে তিনি অনুরূপ বক্তব্যই পেশ করলেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমার নিকট থেকে তোমরা যে অবস্থায় প্রস্থান কর, সর্বদা যদি সেই অবস্থায় থাকতে তাহ’লে ফেরেশতারা অবশ্যই তোমাদের মজলিসে, বিছানায় এবং পথে-ঘাটে তোমাদের সাথে মুছাফাহা করত। হে হানযালা! সেই অবস্থা তো সময় সময় হয়েই থাকে’।[6]
(৮) কাসেম বিন মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন, ‘আমার সকালে হাঁটা-হাটির অভ্যাস ছিল। আর হাঁটতে বের হ’লেই আমি প্রথমে (আমার ফুফু) আয়েশা (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। একদিন আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তিনি ছালাতুয যুহা বা চাশতের ছালাত আদায় করছেন এবং তাতে নিমেণর আয়াত বারবার পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে দো‘আ করছেন। فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ ‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন’ (তূর ৫২/২৭)। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে এল, কিন্তু তিনি তা পুনরাবৃত্তি করেই চলছিলেন। এমন অবস্থা দেখে আমি ভাবলাম, বাজারে আমার একটু প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন সেরে না হয় আবার আসব। বাজার থেকে আমার কাজ সেরে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখি, তিনি আগের মতই একই আয়াত পুনরাবৃত্তি করছেন, আর কেঁদে কেঁদে দো‘আ করছেন’।[7] সুবহানাল্লাহ, তেলাওয়াতের কত গভীরে ঢুকে গেলে এমন অবস্থা হ’তে পারে, ভাবতেই অবাক লাগে।
(৯) সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘একদিন ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) ভরা মজলিসে চুপ করে বসে থেকে কি যেন ভাবছিলেন। আর তার সঙ্গী-সাথীরা পরস্পর কথা-বার্তা বলছিল। সবাই যখন বুঝতে পারল যে- তিনি কোন কথা না বলে চুপ হয়ে আছেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার কি হয়েছে, কোন কথা বলছেন না যে? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম- জান্নাতের মধ্যে জান্নাতের অধিবাসীরা পরস্পর কিভাবে সাক্ষাৎ করবে এবং মতবিনিময় করবে। আবার চিন্তা করছিলাম, আযাবের সম্মুখীন হয়ে জাহান্নামীরা কিভাবে চিৎকার করবে। কথাগুলো বলতেই তার চোখ দু’টো অশ্রুসজল হয়ে গেল’।[8]
অপর বর্ণনায় এসেছে- ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) একদিন এক মজলিসে কেঁদে উঠলেন। তার সঙ্গী-সাথীরা তখন তার পাশেই বসা ছিল। তাকে কাঁদার করণ জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ‘আমি দুনিয়া, পার্থিব ভোগ্য-সমগ্রী ও কামনা-বাসনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলাম। তারপর এ থেকে শিক্ষা নিলাম। দুনিয়ার কামনা-বাসনা ততদিন শেষ হবে না, যতদিন না তিক্ততা (মৃত্যু) একে পঙ্কিল করে দেয়। এতে যদি শিক্ষাগ্রহণকারী শিক্ষা না পায়, তাহ’লে এটা চিন্তা করলেও সে অনেক উপদেশ পেয়ে যাবে’।[9] সুবহানাল্লাহ। দুনিয়ার শত ব্যস্ততার মাঝেও সালাফগণ কিভাবে চিন্তার ইবাদত করতেন, যা তাদের হৃদয়কে আখেরাতমুখী করে রাখত।
(১০) সালাফদের যুগে বছরায় একজন পুণ্যবতী মহিলা বাস করতেন। তিনি চিন্তার ইবাদতের শক্তি দিয়ে সকল হতাশা-দুশ্চিন্তা দূর করে দিতে পারতেন। তার উপরে যতই বিপদ আসুক না কেন, তার চেহারায় কোন দুশ্চিন্তার ছাপ পড়তো না। এলাকার মহিলারা তাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! সমস্যা-সংকটে আপনি কিভাবে এত স্বাভাবিক থাকতে পারেন, ধৈর্যধারণের এই অপরিমেয় শক্তি আপনি কোথা থেকে লাভ করেন? তখন তিনি বললেন, আমার জীবনে যখনই কোন বিপদ আসে, তখন আমি জাহান্নামের কথা স্মরণ করি এবং সেই বিপদের সাথে জাহান্নামের আগুনের তুলনা করার চেষ্টা করি। যখনই আমি এই চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করি, তখন সেই বিপদটি আমার দৃষ্টিতে মাছির চেয়ে নগণ্য হিসাবে ধরা দেয়। ফলে আমি খুব সহজেই ধৈর্যধারণ করতে পারি।[10]
(১১) একবার সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) এক মজলিসে বসেছিলেন। হঠাৎ করে ঘরের বাতি নিভে গেল। কক্ষের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল গাঢ় অন্ধকার। যখন বাতি জ্বালানো হ’ল সবাই দেখলেন যে, সুফিয়ান (রহঃ)-এর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হ’ল আপনার?। তিনি উত্তরে বললেন, এ অন্ধকারে কবরের কথা স্মরণ হয়ে গেল’।[11]
(১২) আবূ উসামা আল-মিছরী বলেন, একদিন আবূ শুরাইহ (রহঃ) বসেছিলেন। হঠাৎ তিনি কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়ে কান্না শুরু করলেন। আমরা বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম। আমার বয়স কত দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার আমল খুবই নগণ্য। এদিকে মৃত্যুও আমার দোরগোড়ায় চলে এসেছে’।[12]
(১৩) দাঊদ আত-ত্বায়ী (রহঃ) চাঁদনী রাতে বাড়ির ছাদে উঠলেন। অপলক দৃষ্টিতে তিনি জ্যোৎসণার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ছাদ থেকে প্রতিবেশীর বাড়িতে পড়ে যান। বাড়ির মালিক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে তরবারী হাতে নিলেন। তিনি মনে করেছেন, হয়ত বাড়িতে কোন চোর ঢুকেছে। কিন্তু দেখলেন- এ তো দাউদ! বাড়ির মালিক তরবারী রেখে দিয়ে দাঊদ (রহঃ)-এর হাত ধরলেন এবং তাকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিলেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ‘বলতে পারব না, কিভাবে সেখানে পৌঁছলাম’।[13]
(১৪) আবূ সুলাইমান আদ্দারানী (রহঃ) এক রাতে তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে উঠলেন। সেই রাতে তার ঘরে একজন মেহমান ছিলেন। আদ্দারানী (রহঃ) ওযূ করার জন্য পাত্র হাতে নিলেন। পানি দিয়ে আঙ্গুল ভিজালেন। এভাবে চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে রইলেন। এদিকে ফজর হয়ে গেল। যখন ফজরের আযান হচ্ছিল তখন তিনি ঐভাবেই বসে ছিলেন। মেহমান তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ওযূর পাত্র হাতে নিতেই আমার একটি আয়াতের কথা মনে পড়ে গেল যে,
إِذِ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلَاسِلُ يُسْحَبُونَ، فِي الْحَمِيمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُونَ-
‘স্মরণ করো! যখন তাদের গলদেশে বেড়ী ও শৃংখল সমূহ পরানো হবে এবং তাদেরকে উপুড়মুখী করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে- উত্তপ্ত জাহান্নামে। অতঃপর সেখানে তাদেরকে আগুনে দগ্ধ করা হবে (মুমিন ৪০/৭১)। আমি ভাবতে থাকলাম- কিভাবে আমি এগুলো পরব? তখন আমার কেমন অবস্থা হবে? এরপর বাকী সময়টা এভাবেই কেটে গেল।[14]
উপসংহার :
মহান আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন চিন্তাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশক্তি থাকার কারণেই ক্বিয়ামতের দিন মানুষ ও জিন জাতির কর্মফলের হিসাব-নিকাশ ও বিচার হবে। অন্যান্য জীব-জন্তুর নাক, কান, চোখ, হাত, পা, মুখ, হৃদপিন্ড প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকার পরেও তাদের কোন হিসাব নিকাশ হবে না কেবল চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকার কারণে। তাই কোন মানুষ যখন চিন্তার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার রবের সৃষ্টিরাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না, আল্লাহর একত্বের প্রমাণবাহী তাঁর নিপুণ নিদর্শনাবলী নিয়ে ভাবে না, তার নাযিলকৃত কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না, পরকালের হিসাব ও শাস্তি নিয়ে চিন্তা করে না; বরং তার চিন্তা-ভাবনা শুধু পার্থিব সুখ-শান্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়, তখন সে আর মানুষের পর্যায়ে থাকে না। বরং সে পশুদের কাতারভুক্ত হয়ে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে জীব-জন্তুর চেয়েও নিমণ পর্যায়ে নেমে যায়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হ’ল শরী‘আত নির্দেশিত পন্থায় সাধ্যানুযায়ী নিজেকে চিন্তার ইবাদতে নিমগ্ন রাখা। প্রকৃত চিন্তার ইবাদত বান্দার নিস্পন্দ অনুভবে বয়ে আনে জান্নাতী অনুভূতির স্পন্দন। পাপ বিদগ্ধ হৃদয়ে সিক্ত করে তওবার শীতল শিশির। সে অনুভব ও চেতনা এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, শয়তানের ছুঁড়ে দেওয়া ওয়াসওয়াসার তূণ তার বক্ষদেশ ভেদ করতে পারে না। জান্নাতের চির শান্তির অভিলাষে জীবনটা সদা ছুটে চলে তার রবের পানে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে চিন্তার ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর রেযামন্দি হাছিলের তাওফীক্ব দিন। আমৃত্যু ছিরাত্বে মুস্তাক্বীমে অটল রেখে জান্নাতের গুল-বাগিচায় ঠাঁই দান করুন- আমীন!
[1]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৭৫১; আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন।
[2]. তিরমিযী হা/৩২৯৭; মিশকাত হা/৫৩৫৪; ছহীহ হাদীছ।
[3]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ ১/৮৪।
[4]. তিরমিযী হা/২৩০৮; ইবনু মাজাহ ৪২৬৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৫৫০; মিশকাত হা/১৩২; সনদ ছহীহ।
[5]. ছহীহুল বুখারী হা/১২৭৫, ৪০৪৫।
[6]. মুসলিম হা/২৭৫০, মিশকাত হা/২২৬৮।
[7]. ইবনুল জাওযী, ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ২/৩১।
[8]. ইবনু আবীদ্দুনয়া, আর-রিক্কু ওয়াল বুকা, পৃ. ৭১।
[9]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ২/১৮৫।
[10]. তাছলিয়াতু আহলিল মাছায়েব, পৃ. ৩০।
[11]. মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দী উওয়াইযাহ, ফাছ্লুল খিত্বাব ফিয যুহদি ওয়ার রাক্বায়েক্ব ৫/১২৪।
[12]. ইবনু আবীদ্দুন্য়া, আল উমরু ওয়াশ শাইব, পৃ. ৫৬।
[13]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/২৮০।
[14]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/৩১৪।