অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেরও পররাষ্ট্র নীতি হ’ল ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা  নয়’। অনেকে বলেন, ‘বন্ধু, প্রভু নয়’। এগুলি স্বাভাবিক সময়ের নীতি। যা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এরপরেও প্রত্যেক দেশ ও জাতির নিজস্ব নীতি-আদর্শ থাকে। যার উপর দেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে। যেমন আমেরিকা তার ডলারে লিখে রেখেছে, In God we trust. ‘আল্লাহতে আমরা বিশ্বাস করি’। বস্ত্ততঃ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হ’লে সেই দেশ ভঙ্গুর হবে অথবা বিভক্ত হয়ে যাবে। যেভাবে পাকিস্তানী শাসকদের আদর্শচ্যুতির কারণে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে পূর্বাংশে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতীয় হিন্দু নেতাদের গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, সে আদর্শের অগ্রসৈনিক ছিল ঢাকা। ১৯০৬ সালে নওয়াব সলীমুল্লাহ প্রথম মুসলিম লীগ গঠন করেন। অতঃপর শুরু হয় পাকিস্তান আন্দোলন। যা পূর্ণতা পায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তান লাভের মাধ্যমে। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরে পাকিস্তানী নেতারা আমেরিকার কব্জায় চলে যান। ফলে স্বাধীনতা কেবল শ্লোগানে থাকে, বাস্তবে বন্দী হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক ইহূদী-খৃষ্টান ও কুফরী চক্রের হাতে। যার শেষ নামে ভারতের সরাসরি হামলার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। আস্ত রুটি এক সাথে খাওয়া যায় না। তাই দু’টুকরা করা হ’ল। এখন দু’টিই রয়েছে সংকটের মুখে।

ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে কব্জায় নেওয়ার জন্য ভারত, রাশিয়া, চীন, আমেরিকা সবাই তৎপর। একদিকে ১৭ কোটি মানুষের বিরাট বাজার, অন্যদিকে এখানে ঘাঁটি গাড়তে পারলে বঙ্গীয় বদ্বীপ এলাকায় ছড়ি ঘুরানো যাবে। বিপুল বন সম্পদ সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নীচে লুকিয়ে থাকা তৈল ও গ্যাসের বিশাল ভান্ডার হাত করা যাবে। আরও হাত করা যাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা অক্সিজেন উৎপাদনকারী বনভূমি সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল মৎস্য ভান্ডার। সবার সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বিপদে কেউ এগিয়ে আসছে না। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লক্ষাধিক মুসলিম ভাই-বোন আজ বাংলাদেশের গলগ্রহ হয়ে আছে। অথচ তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোর ব্যাপারে কোনরূপ সহযোগিতা ঐসব দেশ করেনি। যদি রোহিঙ্গারা মুসলিম না হ’ত, তাহ’লে আন্তর্জাতিক কূটনীতি হয়ত ভিন্নরূপ হ’ত। এ বিষয়ে মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদের প্রতি আল্লাহর আহবান স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

যেমন অমুসলিম নেতাদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা কর। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর (প্রতিশোধ গ্রহণ) সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে’ (আলে ইমরান ২৮)। অমুসলিম রাষ্ট্র নেতারা নানা পুরস্কার ও লকব দিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদের খুশী করার চেষ্টা করবে। সেজন্য সাবধান করে আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে? অথচ যাবতীয় সম্মান কেবল আল্লাহর জন্য’ (নিসা ১৩৯)

অতঃপর নির্দিষ্টভাবে ইহূদী-খৃষ্টানদের ব্যাপারে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহূদী-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে’ (মায়েদাহ ৫১)। যুগে যুগে আবিষ্কৃত নানা তন্ত্রে-মন্ত্রে যাতে মুসলিম নেতারা ভুলে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক করে আল্লাহ বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী থাকবে না’ (বাক্বারাহ ১২০)। এখানে ইল্ম অর্থ কুরআন ও সুন্নাহ। আর ইহূদী-খৃষ্টান ও অমুসলিম বিশ্ব সবাই এক দলভুক্ত। তাদের কারু সামনে কুরআন ও সুন্নাহর হেদায়াত নেই। তাদের অর্জন সবই দুনিয়ার জন্য। তার বিপরীতে মুসলিমদের অর্জন কেবল আখেরাতের জন্য। তাই মুসলিম শাসকদের নিকট একটি নগণ্য পশুও নিরাপদ। কারণ সেও আল্লাহর সৃষ্টি। তার জন্যও মুসলিম নেতাদের আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে।

মুসলিম নেতাদের মনে রাখতে হবে যে, তারা সর্বাগ্রে মুসলিম। অতঃপর তার দেশের পরিচয়। আখেরাতে জান্নাত লাভ আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আখেরাত বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করা লক্ষ্য নয়। একটি পাকা কলা ছাগলেও খায়, মুসলমানেও খায়। ছাগল সরাসরি খেয়ে নেয়, কিন্তু মুসলমান হালাল-হারাম বেছে খায়। স্রেফ আদর্শের কারণে মুসলমান ও কাফের পরস্পরের সম্পত্তির ওয়ারিছ হয় না (বুঃ মুঃ)। তাই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যার তার সাথে মুসলমান গাঁটছড়া বাঁধতে পারে না। তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া গাইড লাইন মেনে চলতে হয়।

১৯৪৮ সালের ১৪ই মে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ‘ইস্রাঈল’ নামে একটি অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তৈলভান্ডারের উপর ছড়ি ঘুরানোর জন্য কথিত পরাশক্তিগুলির অপচেষ্টার অংশ। সেখানকার হাযার বছরের স্থায়ী মুসলিম নাগরিকদের রাতারাতি উৎখাত করে সেখানে বাহির থেকে ইহূদীদের এনে বসানো হ’ল। আজও সেই অবৈধ বসতি স্থাপন চলছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্যের সব আরব রাষ্ট্র ইস্রাঈলকে বয়কট করে। বাংলাদেশ সহ মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দেশ তাদের নাগরিকদের পাসপোর্টে লিখে দেয় This passport is valid for all countries of the world except Israel. ‘এই পাসপোর্ট সব দেশেই চলবে কেবল ইস্রাঈল ব্যতীত’। কিন্তু পরবর্তীতে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংকীর্ণ দুনিয়াবী স্বার্থে সর্বপ্রথম ইস্রাঈলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মিসর ১৯৭৯ সালে। এরপর জর্ডন ১৯৯৪ সালে। এবার তৃতীয় ও চতুর্থ হিসাবে চুক্তি করল আরব-আমিরাত গত ১৩ই আগস্টে এবং বাহরাইন গত ১১ই সেপ্টেম্বরে। এরপরে হয়ত অন্যান্যরাও যোগ দিবে। হোয়াইট হাউজে ১১ই সেপ্টেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুশী হয়ে বলেন, ‘আজ নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর হ’ল’। ফিলিস্তীন কর্তৃপক্ষ বলেছে, এই চুক্তি ফিলিস্তীনীদের বিরুদ্ধে আরেকবার বিশ্বাসঘাতকার ছুরিকাঘাত’। নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান উক্ত চুক্তি সম্পর্কে বলেন, একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে মধ্যপ্রাচ্যে’।

ইতিমধ্যে যতদূর জানা গেছে তা হ’ল ইয়ামনের দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন চারটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত সুকুত্রা দ্বীপপুঞ্জকে নিজেদের প্রভাবাধীন রাখাই হ’ল আরব-আমিরাত ও ইস্রাঈলের লক্ষ্য। যেখানে থেকে খুব সহজেই ইরান, চীন ও পাকিস্তানের উপর নযরদারী করা যাবে। এখন তারা সেখানে একটি ছোট পরিসরের সেনাঘাঁটি স্থাপনের অবস্থায় রয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে আমেরিকা। তাদের উদ্দেশ্য, এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করা এবং ইরানকে কোণঠাসা করা। অন্যদিকে ইস্রাঈলের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য প্রায় ৪০ বছর পর আকাবা উপসাগরের ইলাত বন্দর থেকে উত্তর ইস্রাঈলের আসকালান বন্দর পর্যন্ত প্রায় ২৩০ কি.মি. দীর্ঘ আরব পাইপলাইন তারা পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আমিরাত ও সঊদী আরবের জ্বালানী তেল খুব সহজে ইউরোপে রফতানীর পথ সুগম হবে। এছাড়া অন্যান্য আফ্রো-এশীয় দেশগুলোতেও ঐ তেল পেঁŠছানো যাবে। বর্তমানে মিসরের সুয়েজ খাল দিয়ে সুপার ট্যাংকার চলাচল করতে না পারায় জ্বালানীর পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। সেকারণ উক্ত পাইপ লাইনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

উক্ত প্রেক্ষিতে ইস্রাঈলের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির গুরুত্ব যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, তারা আল্লাহর ‘অভিশপ্ত’ জাতি এটা মনে রেখেই কাজ করতে হবে। তাহ’লে আল্লাহ অন্যভাবে পুষিয়ে দিবেন। কেননা তিনি বান্দার রূযী প্রশস্ত করেন ও সংকুচিত করেন (বাক্বারাহ ২৪৫)

ইতিমধ্যে ফিলিস্তীনের প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি ইস্রাঈলের দখলে চলে গেছে। যেখানে প্রায় ৪ লাখ ইহূদীর বসবাস রয়েছে। এক্ষণে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ১৮১ নং প্রস্তাবের আলোকে পূর্ব যেরুযালেমকে ফিলিস্তীনের রাজধানী করে দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান ও আরব রাষ্ট্র সমূহ থেকে ফিলিস্তীনী মুসলিম শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসন করাটাই মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত পররাষ্ট্রনীতি হওয়া আবশ্যক। মনে রাখতে হবে যে, ইস্রাঈলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হ’ল হারামায়েন শরীফায়েন দখল করা। ১৯৬৭ সালের ৬ই জুন যেরুযালেম দখলের পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান ঘোষণা করেছিলেন, The way to Medina and Mecca is now open to us. ‘মদীনা ও মক্কা দখলের পথ এখন আমাদের জন্য উন্মুক্ত’ (দ্র. ‘আরব বিশ্বে ইস্রাঈলের আগ্রাসী নীল নকশা’ বই ৩১ পৃ.)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)






নববর্ষের সংস্কৃতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সংবিধান পর্যালোচনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আমি চাই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জাতীয় সংসদ নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সালাফীবাদ নয় সালাফী পথ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুছল্লী না সন্ত্রাসী? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পুঁজিবাদের চূড়ায় ধ্বস - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহদ্রোহীদের আস্ফালন ও মুসলমানদের সরকার - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সত্যের সন্ধানী - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চলে গেলেন আফ্রিকার সিংহ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী শিক্ষার বিকাশ চাই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সমঝোতা ও শান্তি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.