৪. যোগ্য মানুষ তৈরি করে যাওয়া :
যোগ্য মানুষ তৈরী করে গেলে জীবদ্দশায় দুনিয়াতেই তার ফায়েদা মেলে। একইভাবে মৃত্যুর পরেও ছওয়াব মিলবে। সুতরাং হে পাঠক! আপনার চেয়েও ভালো ও যোগ্য মানুষ তৈরী করা যেন আপনার রাত-দিনের চিন্তা-ফিকির হয়। কুরআনের নির্দেশনা তাই, সুন্নাহর নির্দেশনাও তাই।
আল্লাহ বলেন,وَوَاعَدْنَا مُوْسَى ثَلَاثِيْنَ لَيْلَةً وَأَتْمَمْنَاهَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِيْقَاتُ رَبِّهِ أَرْبَعِيْنَ لَيْلَةً وَقَالَ مُوْسَى لِأَخِيْهِ هَارُوْنَ اخْلُفْنِي فِي قَوْمِي وَأَصْلِحْ وَلَا تَتَّبِعْ سَبِيلَ الْمُفْسِدِيْنَ، ‘আর আমরা মূসাকে ত্রিশ দিনের ওয়াদা দিয়েছিলাম। অতঃপর তা আরো দশ দিন দ্বারা পূর্ণ করি এবং এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত চল্লিশ দিন সময় পূর্ণ হয়। আর এ সময় মূসা তার ভাই হারূণকে বলে, আমার সম্প্রদায়ে তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে ও তাদের সংশোধন করবে। আর সাবধান! তুমি বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করবে না’ (আ‘রাফ ৭/১৪২)। আয়াতে উল্লেখিত নবী হারূণ (আঃ) ছিলেন মূসা (আঃ)-এর যামানায় তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি।
হাদীছে এসেছে,أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَكَلَّمَتْهُ فِى شَىْءٍ، فَأَمَرَهَا بِأَمْرٍ فَقَالَتْ أَرَأَيْتَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنْ لَمْ أَجِدْكَ قَالَ إِنْ لَمْ تَجِدِينِى فَأْتِى أَبَا بَكْرٍ- ‘জনৈক মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে একটি বিষয়ে কথা বলেন। তিনি তাকে একটি আদেশ দেন। মহিলা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি যদি আগামীতে আপনাকে না পাই? তিনি বললেন, আমাকে না পেলে আবুবকরের নিকট যেও’।[1] হুমায়দী ইবরাহীম বিন সা‘দের বর্ণনায় বর্ধিত বলেছেন, যেন তিনি তাঁর মৃত্যুকে বুঝিয়েছেন।
মুতা যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং বলেন,إِنْ قُتِلَ زَيْدٌ فَجَعْفَرٌ، وَإِنْ قُتِلَ جَعْفَرٌ فَعَبْدُ اللهِ بْنُ رَوَاحَةَ، ‘যায়েদ নিহত হ’লে জা‘ফর সেনাপতি হবে। সেও যদি নিহত হয় তবে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা সেনাপতি হবে। তিনি তাদের জন্য একটি সাদা পতাকা বেঁধে দেন এবং তা যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ)-এর হাতে দেন’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে গমনকালে এগারোর অধিক ছাহাবীকে মদীনা নগরীতে তাঁর প্রতিনিধি বা খলীফা নিয়োগ করে যান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সা‘দ বিন ওবাদাহ, যায়েদ বিন হারেছা, বাশীর বিন আব্দুল মুনযির, সিবা‘ গিফারী, ওছমান বিন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম, আবু যর গিফারী, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, নুমায়লা লায়ছী, কুলছূম বিন হুছাইন, মুহাম্মাদ বিন মাসলামা (রাঃ)।
আলক্বামা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম। এমন সময় খাববাব (রাঃ) এলেন। তিনি তাকে বললেন, হে আবু আব্দুর রহমান! এ যুবকরা কি তোমার মতো কুরআন পড়তে পারে? তিনি বললেন, তুমি চাইলে তাদের কাউকে তোমার সামনে পড়তে আদেশ করতে পার। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তিনি বললেন, আলক্বামা, তুমি পড়। আলক্বামা বলেন, আমি সূরা মারয়াম থেকে পঞ্চাশ আয়াত পড়লাম। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বললেন, কেমন দেখলে? খাববাব বললেন, খুব সুন্দর। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বললেন, যা কিছু আমি পড়তে পারি সে তা পড়তে পারে’।[3]
জীবনী গ্রন্থগুলোতে বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন, আলক্বামা (রহঃ) সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। আবু হামযাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাবাহ আবুল মুছান্নাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আব্দুল্লাহকে দেখেননি? তিনি বললেন, আমি বরং ওমরের সাথে তিন বার হজ্জ করেছি; তখন আমি যুবক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ওমর (রাঃ) ২৩ হিজরীতে এবং ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ৩২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ ও আলক্বামা লোকদের দু’সারিতে ভাগ করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ একজনকে পড়াতেন, আলক্বামা অন্যজনকে পড়াতেন। পড়া শেষ হ’লে তারা দু’জনে হজ্জ-কুরবানী এবং হালাল-হারামের নানা বিধি-বিধান আলোচনা করতেন। সুতরাং তুমি যখন আলক্বামাকে দেখেছ তখন আর আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদকে না দেখলে ক্ষতি নেই। জ্ঞান-গরিমা স্বভাব-চরিত্রে আলক্বামা ইবনু মাসঊদের প্রতিচ্ছবি। অনুরূপভাবে যখন ইবরাহীম নাখঈকে দেখেছ তখন আর আলক্বামাকে না দেখলে ক্ষতি নেই। জ্ঞান-গরিমা স্বভাব-চরিত্রে ইবরাহীম নাখঈ আলক্বামার প্রতিচ্ছবি।[4]
আ‘মাশ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমি যখন যুবক তখনকার কথা। ইবরাহীম নাখঈ সেসময় আমাকে একটি ফরয সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা মুখস্থ রাখো। সম্ভবত এ বিষয়ে তোমার কাছে জানতে চাওয়া হবে’।[5]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও তার ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফের ঘটনা :
ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) ছিলেন ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর একেবারে নিকটতম ছাত্র। আবু ইউসুফ (রহঃ)-এর প্রকৃত নাম ছিল ইয়া‘কূব বিন ইবরাহীম। খলীফা হারূণুর রশীদের আমলে তিনি বাগদাদের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। খলীফার সাথে তার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বলেন, আমার পিতা ইব্রাহীম বিন হাবীব যখন মারা যান তখন আমি ছোট শিশু। মা-ই আমার লালন-পালন করতেন। অভাবের কারণে তিনি আমাকে এক ধোপার নিকটে কাজে দেন। কিন্তু ধোপাকে ছেড়ে আমি আবু হানীফার মজলিসে যোগ দিতাম এবং মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতাম। আমার মা আমার পিছনে পিছনে আবু হানীফার মজলিসে হাযির হ’তেন, তারপর আমার হাত ধরে ধোপার কাছে নিয়ে যেতেন। এদিকে আবু হানীফা (রহঃ) আমার উপস্থিতি এবং ইলম শেখার আগ্রহ দেখে আমাকে গুরুত্ব দিতেন। এভাবে যখন তার মজলিসে আমার উপস্থিতি আমার মায়ের কাছে বেশী পীড়াদায়ক হয়ে উঠল এবং আমার পলায়ণপরতা তার কাছে দীর্ঘায়িত হয়ে দাঁড়াল তখন তিনি আবু হানীফাকে বললেন, এই বাচ্চাকে নষ্ট করার মূলে আপনি। এ একটা ইয়াতীম অনাথ বাচ্চা। অর্থ-সম্পদ বলতে তার কিছু নেই। সুতো কেটে আমি তার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করি। আমি কামনা করি যে, সে নিজের খরচ চালানোর জন্য অন্তত এক ‘দানেক’ (তৎকালীন মুদ্রার নাম) আয় করুক।
আবু হানীফা (রহঃ) আমার মাকে বললেন, ওহে রা‘না, তোমার ছেলে লেখাপড়া করে এমন বিদ্বান হবে যে, সে পেস্তা বাদামের তেলে রান্না করা ফালুদা খাবে। এ রকম ফালুদা তখনকার দিনের রাজা-বাদশাহ ও ধনীদের খাবার ছিল। তার কথায় আমার মা বললেন, আপনি বুড়ো মানুষ। আপনার মাথা বিগড়ে গেছে। তাই আবোলতাবোল বকছেন। এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। তারপর থেকে আমি আবু হানীফার কাছেই থাকতে লাগলাম। আমার লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত তিনিই আমার খরচ চালাতেন। এভাবে একদিন আল্লাহ আমাকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী করেন এবং আমি আববাসীয় খলীফা হারূণুর রশীদের আমলে বিচারপতির পদে আসীন হই। খলীফার সাথে সখ্যতার ফলে আমি তার দরবারে বসতাম এবং তার দস্তরখানে একসাথে খানা খেতাম। একদিন পরিচারকরা খলীফা হারূণের সামনে এক নতুন ধরনের খানা হাযির করল। খলীফা আমাকে বললেন, ওহে ইয়াকূব! এ খানা থেকে কিছুটা খাও, এ ধরনের খাবার আমাদের জন্যে প্রতিদিন তৈরি করা হয় না। আমি বললাম, আমীরুল মুমিনীন, এ খাবারের নাম কি? তিনি বললেন, এর নাম ফালুদা, যা পেস্তা বাদামের তেলে রান্না করা হয়েছে। এ কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। তিনি বললেন, হাসছ কেন? আমি বললাম, ভালো জিনিস আল্লাহ বিদ্যমান রাখুন, হে আমীরুল মুমিনীন! কিন্তু তিনি কারণ জানার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি তখন তাকে ঘটনা আনুপূর্বিক শুনালাম। শুনে তিনি আশ্চর্যান্বিত হ’লেন এবং বললেন, আমার জীবনের কসম! নিশ্চয়ই বিদ্যা মানুষের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং তার দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণ বয়ে আনে। তিনি আবু হানীফা (রহঃ)-এর জন্য রহমত কামনা করলেন এবং বললেন, তিনি তার মানস চোখে এমন কিছু দেখতে পেতেন বাহ্যিক চোখে যার দেখা মেলে না।[6]
ছাত্ররা যাতে ভবিষ্যতের যোগ্য আলেম হয় সেভাবে তাদের গড়ে তোলা :
নিজ ছাত্রদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, কোন বিষয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, বই-পুস্তক রচনা ও সম্পাদনা ইত্যাদি কাজে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা আলেমের কর্তব্য। ছাত্রদের গবেষণাপত্র শিক্ষকের উপস্থিতিতে অন্য ছাত্রদের সামনে পড়ে শুনাতে হবে এবং গবেষণার কাজগুলোকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে সবাই সেই গবেষণাকর্ম থেকে উপকৃত হ’তে পারে।
শিক্ষকের উচিত ছাত্রদের সামনে সময় সময় বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরা, সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে উদ্বুদ্ধ করা, তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা না করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাঝে মাঝে এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতেন।
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদের বললেন,أَخْبِرُونِي عَنْ شَجَرَةٍ، مَثَلُهَا مَثَلُ الْمُؤْمِنِ ‘তোমরা আমাকে এমন একটা গাছের কথা বলো, যার দৃষ্টান্ত একজন মুমিনের ন্যায়’। তারপর তিনি উত্তর বলে দিলেন, هِيَ النَّخْلَةُ ‘সেটি খেজুর গাছ’।[7]
কি করে মাসআলা বা বিধি-বিধান উদ্ভাবন (ইস্তিম্বাত) করতে হয়, দলীল-প্রমাণ প্রদানের নিয়ম-পদ্ধতিই বা কি, নানা মতের আলোচনা-সমালোচনার নীতি কেমন করে করতে হবে এবং মূলনীতির ভিত্তিতে উদ্ভাবিত শাখা মাসআলা-মাসায়েলের মধ্যে সমন্বয়ের পদ্ধতি কি হবে, সেসব বিষয়ে শিক্ষক ছাত্রদের ভালোভাবে যোগ্য করে গড়ে তুলবেন।
ছাত্রের শিক্ষা অর্জন একটি নির্দিষ্ট স্তরে উপনীত হওয়ার পর তার শিক্ষক তাকে শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ ও প্রস্ত্ততি হিসাবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সুযোগ করে দিবেন। এতে তার যোগ্যতা শাণিত হবে এবং তার শিক্ষা একান্তই তার নিজের হয়ে যাবে। এভাবে এক পর্যায়ে সেই ছাত্রের নিজস্ব দরসী হালাকা গড়ে উঠবে। আমাদের পূর্বসূরিরা এভাবে তাদের ছাত্রদের গড়ে তুলতেন এবং ফৎওয়াদানের অনুমতি দিতেন। ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেঈ (রহঃ) প্রমুখের শিক্ষাদান পদ্ধতি এমনই ছিল।
শিক্ষক তার ছাত্রদের অন্ধ অনুকরণের শিক্ষা দিবেন না। বরং তিনি তাদের নেতৃত্বের যোগ্য করে গড়ে তুলবেন। মুসলিম উম্মাহর আজ এমন নেতাদের খুব প্রয়োজন যারা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর বিষয়ের দিকে পরিচালনা করবে। এ কারণেই পূর্বকালের খলীফাগণ কোন কোন যুদ্ধে সেনাদলের সেনাপতিত্ব ও নেতৃত্ব এমন লোকদের হাতে প্রদান করতেন যারা তাদের থেকে বয়সে ও যোগ্যতায় নীচু স্তরের। যাতে তারা প্রশিক্ষিত হয় এবং তারা উত্তম যোগ্যতার অধিকারী হয়, যেন পরবর্তীতে তারা সেনাদলের নিশানবরদার হ’তে পারে।
৫. ইসলামী ওয়াক্ফ :
দুনিয়া ও আখেরাতে নেক আমলের আধিক্য এবং ছওয়াবের বৃদ্ধি ঘটাতে ওয়াক্ফ অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আসলকে আবদ্ধ রেখে তা থেকে লভ্য সুযোগ-সুবিধা দান করাকে ওয়াক্ফ বলা হয়।[8]
এখানে ‘আসল’ অর্থ, সেই মূল যাকে অবিকল আবদ্ধ রেখে তা থেকে সুযোগ-সুবিধা লাভ সম্ভব। যেমন ঘর-বাড়ি, দোকানপাট, বাগান, ক্ষেত-খামার ইত্যাদি।
আর ‘সুযোগ-সুবিধা’ অর্থ মূল থেকে উৎপাদিত ফসল, আয় ইত্যাদি। যেমন ফল, শস্য, ভাড়া, বাড়িতে বসবাস প্রভৃতি।
নবী করীম (ছাঃ) ওমর (রাঃ)-কে যে কথা বলেছিলেন তার সাথে এ সংজ্ঞা মিলে যায়। তিনি বলেছিলেন, فَاحْبِسْ أَصْلَهَا، وَسَبِّلِ الثَّمَرَةَ، ‘তুমি তোমার বাগানের মূল আবদ্ধ রাখো এবং তার উৎপন্ন ফল দান করো’।[9]
ওয়াক্ফ শরী‘আত সম্মত হওয়ার দলীল :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيْمٌ، ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত থেকে দান করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তা সবই জানেন’ (আলে ইমরান ৩/৯২)। এ আয়াতে ‘ইনফাক’ অর্থ দান-ছাদাক্বা।[10] আর ওয়াক্ফ তো দান-ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা করা সুন্নাত হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ‘ কর, সিজদা কর ও তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর। আর তোমরা সৎকর্ম সম্পাদন কর যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (হজ্জ ২২/৭৭)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ- ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার থেকে তার সকল আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনটি আমল ব্যতীত। ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ বা চলমান দান, উপকারী বিদ্যা এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[11] ইমাম নববী বলেন, ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ হ’ল ওয়াক্ফ।[12]
ওয়াকফের কিছু উপকারিতা :
(১) ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক কল্যাণ সাধনের এক অনন্ত উৎস ওয়াক্ফ। এতদপ্রেক্ষিতে ওয়াক্ফ সম্পর্কে বলা যায় যে, ওয়াক্ফ এমন এক পাত্র, যার মধ্যে মানুষের জন্য শুধুই কল্যাণ আর কল্যাণ ঢালা হয় এবং তা এমন এক ঝরণা, যার থেকে শুধুই কল্যাণ উৎসারিত হয়। সন্দেহ নেই যে, কল্যাণের এ ধারা মুসলিমদের সম্পদ ও সম্পত্তি থেকে হবে এবং তা হবে তাদের হালাল আয় ও উৎকৃষ্ট সম্পদ থেকে।
(২) ওয়াক্ফকে সমাজের উপর অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী আমল বলে বিবেচনা করা হয়। এটি অর্থ যোগানদানের একটি বড় বুনিয়াদী প্রতিষ্ঠান। ইসলামের অতীত যুগের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইত্যাদির অগ্রগতিতে ওয়াক্ফ প্রতিষ্ঠানের বিরাট অবদান রয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, গ্রন্থাগার ও হাসপাতাল স্থাপন ও তাদের ব্যয় নির্বাহে ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয় কাজে লাগানো হয়। অধিকন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার, কৃষি ও শিল্পের উৎকর্ষ সাধন, সড়ক, সেতু, গৃহ নির্মাণের মতো মৌলিক অবকাঠামো বিনির্মাণে ওয়াক্ফের ভূমিকা অতুলনীয়।
ওয়াক্ফ সামাজিক ঐক্য ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করে। অসহায় দুর্বলদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ, অভাবগ্রস্তদের সহায়তা দান, যুবকদের বিবাহে সহযোগিতা দানে ওয়াকফের অর্থ কাজে লাগানো হয়। প্রতিবন্ধী, বয়োবৃদ্ধ, উপার্জনে অক্ষমদের খাওয়া-পরার ব্যয় নির্বাহে ওয়াক্ফ সম্পদের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া মৃতদের গোসল, কাফন-দাফন ও কবর খননের ব্যয়ও ওয়াক্ফ থেকে করা যায়।
(৩) শারঈ বিদ্যা শিক্ষার ধারা চলমান ও শক্তিশালী রাখতে ওয়াক্ফ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এই শারঈ বিদ্যাই তো ইসলামী দাওয়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যার চর্চা জ্ঞান-গবেষণার আন্দোলনকে বেগবান করতে অতুলনীয় ভূমিকা রাখে। এ আন্দোলনের ফলে মুসলিমদের মধ্যে প্রচুর ইলমী গবেষণা সাধিত হচ্ছে, অর্জিত হচ্ছে চিরস্থায়ী ইলমী উত্তরাধিকার এবং তৈরী হচ্ছে এমন সব বিজ্ঞ আলেম যাদের নাম সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকছে।
(৪) ওয়াক্ফ মুসলিম উম্মাহর মাঝে সংহতি গড়ে তোলার মৌল কাঠামো বাস্তবায়ন এবং সমাজের সদস্যদের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন নিশ্চিত করে। ওয়াক্ফ থেকে অর্থ সহযোগিতা লাভের মাধ্যমে সমাজে দরিদ্ররা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, দুর্বলরা শক্তিশালী হয় এবং অসহায়রা সহায়তা লাভ করে।
(৫) ওয়াক্ফের আয় থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্কিম হাতে নেওয়া হয়। যার ফলে জনসাধারণের নানাবিধ প্রয়োজন পূরণ হয়, তাদের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সহযোগিতা মেলে। এভাবে ওয়াক্ফ জনকল্যাণে অবদান রেখে চলে।
(৬) সম্পদ অক্ষত রেখে যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় তা থেকে উপকার লাভের যামানত হিসাবে ওয়াক্ফ কাজ করে। তাই ওয়াক্ফ সম্পত্তিকে নয়-ছয়কারীদের হাত থেকে রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। তবেই নিশ্চিত হবে ওয়াক্ফকারীর জন্য বিরামহীন ছওয়াব।
শেষ কথা :
প্রিয় পাঠক! মৃত্যুর পর আপনি যাতে আখেরাতের জীবনে সুখে থাকতে পারেন সেজন্য একজন ভালো আমলদার মুসলিম হ’তে সচেষ্ট থাকুন। আপনার আমলের ছওয়াব মৃত্যুর পরেও যাতে আপনি পেতে পারেন সেজন্য আলোচ্য নিবন্ধে বর্ণিত হাদীছের আমলগুলো কিছুমাত্র হ’লেও করে যান। মানবকল্যাণে আপনার ভূমিকা হোক বৃষ্টির মতো।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَثَلُ أُمَّتِيْ مَثَلُ المَطَرِ لَا يُدْرَى أَوَّلُهُ خَيْرٌ أَمْ آخِرُهُ ‘আমার উম্মতের উপমা বৃষ্টির ন্যায়। এটা জানা যায় না যে, প্রথম দিকের বৃষ্টি উত্তম, না শেষের দিকের’।[13]
কোন কোন হাদীছে مطر এর স্থলে غيث শব্দ এসেছে। উভয়ের অর্থ বৃষ্টি। এখানে বৃষ্টির উপমা দ্বারা এই উম্মতের মাঝে যে বহুবিধ কল্যাণ লুকিয়ে আছে সে কথা বলা হয়েছে। বৃষ্টি তো সাক্ষাৎ রহমত, যা আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তার সৃষ্টিকুলের জন্য হাদিয়া। তার মাধ্যমে মৃত ভূমিকে আল্লাহ সঞ্জীবিত করে তোলেন।
এমনিভাবেই প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের মাঝে কল্যাণকামী লোকেদের হিম্মত ছাহাবী রিবঈ বিন আমের (রাঃ)-এর মতো দেখা দেয়। তিনি পারসিক সেনাপতি রুস্তমের সামনে বলেছিলেন,اللهُ ابْتَعَثْنَا لِنُخْرِجَ مَنْ شَاءَ مِنْ عِبَادَةِ الْعِبَادِ إِلَى عِبَادَةِ اللهِ، وَمِنْ ضِيقِ الدُّنْيَا إِلَى سِعَتِهَا، وَمِنْ جَوْرِ الْأَدْيَانِ إِلَى عَدْلِ الْإِسْلَامِ ‘যারা মানুষের দাসত্ব ছেড়ে মানুষের রবের দাসত্ব করতে চায়, দুনিয়ার সংকীর্ণতা ছেড়ে আখেরাতের প্রশস্ততার মাঝে জায়গা নিতে চায় এবং নানান ধর্মের যুলুম-অত্যাচার থেকে ইসলামের ইনছাফ ও সুবিচারের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে চায় এবং তাদেরকে এহেন অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য আল্লাহ মুসলিমদের পাঠিয়েছেন।[14]
যখন মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে আসে, খরা, হতাশা ও নিরাশা যখন তাদের ঘিরে ধরে তখন আসে বৃষ্টি। এই ইসলামী উম্মাহ হচ্ছে কল্যাণকারী দানশীল উম্মাহ। ইতিহাসের তিক্ত সময় যতই ঘনিয়ে আসুক না কেন তারা হতাশ হয় না, ভেঙ্গে পড়ে না, হীনবল হয় না। ইসলামী দেশগুলোর উপর তার লম্বা ইতিহাসে কত সমস্যা চেপে বসেছে, কত বালা-মুছীবত, কত বিপর্যয় ঘিরে ধরেছে; ভূমিকম্পের মতো ইসলামী দুনিয়া প্রবল কম্পনে কেঁপে উঠেছে কিন্তু প্রতিবারেই ইসলামী উম্মাহ সে বিরাট সংকট কাটিয়ে উঠেছে। তার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে আরো শক্তভাবে, আরো ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে। অথচ প্রতিবারেই চক্রান্তকারীরা ভেবেছে, এবারেই মুসলিম জাতিকে তারা তাদের পদানত করে ছাড়বে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার কৌশল তো তাদের অজানা। তিনি তাদের জন্য ঘাঁটি করে আছেন। এরশাদ হয়েছে,يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ، ‘তারা চায় মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতিকে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ স্বীয় জ্যোতিকে পূর্ণতায় পৌঁছানো ব্যতীত ক্ষান্ত হবেন না। যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপসন্দ করে’ (তওবা ৯/৩২)।
ছাহাবীগণ যখন আল্লাহর বাণীفَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ‘কাজেই তোমরা সৎকর্ম সমূহে প্রতিযোগিতা কর’ (বাক্বারাহ ২/১৪৮) এবং আল্লাহর অপর বাণীوَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ، ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩) শুনলেন তখন প্রত্যেকে একথা থেকে বুঝে নিলেন যে, তাকে উঠেপড়ে লাগতে হবে, যাতে তিনি অন্যদের আগে এই সম্মান ও মর্যাদা লাভের অধিকারী হন; উঁচু মর্যাদার দ্বারপ্রান্তে সবার আগে তিনি উপনীত হন। তাই তারা যখন কাউকে তার থেকে বেশী আখেরাতের আমল করতে দেখতেন তখন তারা তার সাথ ধরার জন্য, এমনকি তাকে অতিক্রম করার জন্য চেষ্টা ও প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন। তাদের প্রতিযোগিতা ছিল আখেরাতের মর্যাদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। এজন্যই তারা প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। আল্লাহ বলেন, خِتَامُهُ مِسْكٌ وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ، ‘তার মোহর হবে মিশকের। আর এরূপ বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’ (মুত্বফফিফীন ৮৩/২৬)।
আমি সবার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট উপকারী বিদ্যা হাছিল ও নেক আমলের সুযোগ দানের জন্য দো‘আ করি। মহান আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সকল ছাহাবীর উপর রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করুন-আমীন!!
[1]. বুখারী হা/৭৩৬০; মুসলিম হা/২৩৮৬।
[2]. বুখারী হা/৪২৬১।
[3]. বুখারী হা/৪১৩০।
[4]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৪/৫৪।
[5]. জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, পৃ. ৪৮৫।
[6]. তারীখু বাগদাদ ১৪/২৫০।
[7]. বুখারী হা/৬১২২; মুসলিম হা/২৮১১।
[8]. আল-কাফী ২/২৫০।
[9]. নাসাঈ হা/৩৬০৪; সনদ ছহীহ।
[10]. তাফসীরে তাবারী ৬/৫৮৭।
[11]. মুসলিম হা/১৬৩১; আবুদাঊদ হা/২৮৮০; তিরমিযী হা/১৩৭৬; মিশকাত হা/২০৩।
[12]. শরহু মুসলিম ১১/৮৫।
[13]. আহমাদ হা/১৮৯০১; তিরমিযী হা/২৮৬৯; মিশকাত হা/৬২৭৭।
[14]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/৬২২।
মূল (আরবী) : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক